কাগজের নৌকা পর্ব-৮

0
1027

# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
# পর্ব: ০৮
.
.
মাকে আর এখন আমার তেমন ঘৃণা লাগে না। ঘৃণা করেই বা লাভ কী, মা তো এখন আর অবৈধ সম্পর্ক করে না। অবৈধ সম্পর্কটা এখন বৈধ করে নিছে। মায়ের প্রতি আমার আর কোনো রাগও নেই। মা চলে যাওয়ার পর আমি প্রতিদিন নিজেকে জানছি, শিখছি। যে কাজগুলো কখনও করতাম না সেগুলোও করছি। নিজের প্রতি আস্থা কতটুকু সেটা বুঝতে পারছি। এখন আমি মাকে দুনিয়ার সেরা মা মনে করি। ফাঁকা জায়গা পেলেই চিৎকার করে বলে উঠি,
‘আমি তোকে ভালোবাসি মা।’
কিন্তু আমার ভালোবাসার কথাটুকু মা জানতে পারে না। কখনও তো তাকে বলা হয়নি যে তাকে আমি কতটা ভালোবাসি, আর তার শরীরকে ঘৃণা লাগে না।
.
মাকে দেখতে এসেছি। মালার শরীরটা ভালো নেই তাই সে আজ আসেনি। সপ্তাহে দুতিনদিন চলে আসি। ওদের যেন কোনো সমস্যা নাহয় সেজন্য দুপুরেই আসি, কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যাই। মা আমাকে দেখলে খুশি হয়, মনে মনে শান্তি পায়। হাজার হোক, আমি তার পেটের সন্তান। আজকেও মা আমাকে দেখে খুশি হলো। আমাকে তার কাছে বসিয়ে বললো,
‘কী রে বাপ, মালা আসল না যে?’
‘না মা, জ্বর আসছে মনে হয়। ওষধু দিয়া আসছি। ঘুমায়।’
‘ওহ। তুই বস আমি তোর জন্যে সেমাই রাঁধি।’
‘আচ্ছা মা।’
আকাশে অনেক মেঘ। কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সকাল থেকে রোদ ছিল। ভাবলাম হয়তো আজ ঝরবে না, কিন্তু আকাশে যেমন মেঘ তাতে মনে হলো খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টি নামবে। আমি মাকে ডাকি,
‘মা তাড়াতাড়ি দে, বৃষ্টি নামবে মনে হয়।’
রান্নাঘর থেকে শব্দ শোনা যায়,
‘আরেকটু সবুর কর বাপ। হয়ে গেছে প্রায়।’
আমি বসেই আছি। বাবুল চাচা ঘরে নেই। দুপুরে অবশ্য আমি তাকে পাই না। বেশিরভাগ সময়ই বিকেলে বাড়ি ফেরে। কী জানি, কোন রাজ্যের কাজ করে সে।
মা বাটিতে করে সেমাই নিয়ে এসে বলে,
‘নে বাপ, খা।’
আমি হাসিমুখে মুখে তুলি আর বলি,
‘দারুণ হইছে মা। একটু দিবি, মালার জন্যে?’
মা হেসে বলে,
‘মালাকে তুই খুব ভালোবাসিস না বাপ?’
আমি লজ্জা পাই। পাওয়ারই তো কথা, এত ছোট বয়সে ভালোবাসার কথা শুনলে এমনই লাগে। মা আবার বলল,
‘ওর কেউ নাই বাপ, ওকে ছাড়িস না কখনও।’
‘আচ্ছা মা।’
‘তুই খা, আমি বাটিতে ওর জন্যে দিয়া দেব।’
বলতে বলতে বৃষ্টি মহাশয় নেমে আসলো, খুব জোরে। আমি হেসে বললাম,
‘দেখেছিস মা, খাওয়া শেষ না হতেই বৃষ্টি শুরু হলো।’
‘তুই খা বাপ। থেমে যাবে।’
খাওয়া শেষে অনেকক্ষণ চলে গেল, কিন্তু বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। মা আমাকে বললো,
‘তুই না হয় একটু ঘুমিয়ে নে বাপ। বৃষ্টি থামলে তোকে জাগিয়ে দেব।’
‘আচ্ছা।’
মা আমাকে নিয়ে একটা ঘরে গেল। ঘরটাতে একটা খাট ছাড়াও চেয়ার-টেবিল, শোকেস আর আলনা আছে। বিছানাটা বেশ নরম। মা বললো,
‘একটু ঘুমিয়ে নে বাপ।’
‘আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিবি মা?’
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘এখন বুঝি ঘেন্না লাগে না?’
মায়ের কথায় আমি লজ্জা পেলাম। মাথা নিচু করে থাকলাম। মা আমাকে নিয়ে বিছানায় উঠলো। আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো,
‘মানুষের জীবনটা বড়ই অদ্ভুত বাপ, কাউকে সহজে চেনা যায় না। আমরা যাকে ভালো ভাবি আসলে সে খারাপ, আর যাকে খারাপ ভাবি সে হয়তো ভালো।’
আমি মায়ের কথায় সায় দেই আর চোখ বন্ধ করে থাকি। মা গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। মাকে বেশ আনমনা মনে হয়। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি, ঘুম আসে না। বাইরে এখনও বৃষ্টি। থামছেই না। অনেকটা সময় চলে যাওয়ার পর বাইরে থেকে ডাক আসে,
‘জমিলা, জমিলা?’
মা ধরাৎ করে বিছানা থেকে ওঠে। আমি ঘুমানোর ভান করে থাকি। মা বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে বলে,
‘আইছেন?’
‘ওই ঘরে কী করিস?’
মা দ্রুত তার দিকে এগিয়ে যায়। আমি বিছানা থেকে উঠে দরকার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকি।
‘আপন আইছে। তারপর বৃষ্টি, আর থামছেই না।’
আমি আছি এ কথা শুনে বাবুল চাচা যেন রেগে গেল। রেগে গিয়ে বললো,
‘ভালো হইছে, এখন যদি লোকজন চইলা আসে তাইলে কী হইব? দুইজন আসার কথা।’
মায়ের মুখটা কালো হয়ে গেল। বাবুল চাচার এ কথা শুনে আমার মাথাটা চক্কর দিলো। প্রতিদিন এ বাড়িতে লোকজন কেন আসে? আর আমি থাকলেই বা কী সমস্যা। হঠাৎ মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
‘আপন ঘুমাই গেছে। আর শব্দ যাইব না ওই ঘরে। ঘরটাও তো দূরে।’
‘তুই যা পারিস কর। আমার মানহানি করিস না। এখন তোয়ালা দে। ঘা মুছব।’
মা ঘরে গিয়ে তোয়ালা এনে দিলো। গা মুছে চেয়ারে বসে আরাম করে সিগারেট ধরালো। মা পাশে বসে।
‘দেখ তো আপন জেগে আছে না ঘুমাই গেছে।’
‘দেখতেছি।’
মা এদিকে আসছে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সব দেখছিলাম আর শুনছিলাম। মায়ের আসা দেখে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম, যেভাবে আগে ছিলাম। মা আমার পাশে এসে বসলো। তারপর কপালে একটা চুমু খেয়ে আবার চলে গেল। আমি বুঝলাম এ চুমুতে মায়ের ভালোবাসা নিহিত। যেটা শুধু আমার জন্যই বরাদ্দ। এর ভাগিদার আর কেউ নয়।
.
মা চলে যাওয়ার পর আমি আবার দরজার আড়ালে চলে গেলাম। মা আর বাবুল চাচা কথা বলছে,
‘পোলাটা রাতে কিছু খাইলো না যে?’
‘আগে লোকজন চইলা যাক তারপর এক লগে খামু।’
‘ওর বেশি খিদা লাগবো তো।’
‘জমিলা বেশি কথা কইস না। চুপ থাক। আগে কাজ তারপর খাওয়া-দাওয়ার কথা। এখন যা, একটু সেজে নে। পার্টি আইসা পড়ব। আইজ দুইজন আসব মনে হয়। বিদেশী পার্টি। ভালো করে খুশি করিস। আমার মনটা রাখ। অনেক সম্মানী দিছে কিন্তু।’
মায়ের মুখটা আবার নিমিষেই কালো হয়ে গেল। বারান্দা থেকে উঠে ঘরের ভেতর গেল। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টিতে মধ্যেই গাড়িতে করে দুজন লোক নামলো। আমার বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। কী হচ্ছে এসব! এরা কারা?
লোক দুটো বাবুল চাচার সাথে হ্যান্ডশেক করে তোয়ালা দিয়ে গা মুছে নিয়ে বললো,
‘কোন ঘরে?’
বাবুল চাচা বিদঘুটে হাসি দিয়ে বললো,
‘এই ঘরেই আছে। কে যাবেন আগে?’
তাদের একজন ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। বাকিজন বাবুল চাচার সাথে বসে সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো,
‘মজাটা সব শেষ করিস না।’
এ কথা বলেই হাসতে লাগলো। এ দৃশ্য দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। আমি বুঝতে পারছি এ বাড়িতে আসলে কী হচ্ছে। আমি ধপাস করে বসে পড়লাম। আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। কতক্ষণ বসে ছিলাম আমার মনে নেই। যখন উঠলাম তখন লোক দুটো চলে গেছে। আমার ভেতরে প্রচণ্ড রাগ হলো। রাগে ফোঁপাতে লাগলাম। বৃষ্টিতে ভিজে ওদের ঘরের দিকে গেলাম। মা আর বাবুল চাচা বলাবলি করছে,
‘ছেলেটাকে ডেকে আনেন। খিদা পাইছে খুব।’
বাবুল চাচা মাকে কাছে টেনে বললো,
‘ওদের শরীরের খিদা মিটালি, আমার মিটাবি না?’
এ কথা বলেই জোরাজুরি শুরু করলো। আমি ঘরে ঢুকলাম। আমাকে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে বাবুল চাচার গলাটা টিপে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। দুজনে ধস্তাধস্তি শুরু হলো। আমি শুধু একটা কথাই বলছিলাম,
‘কুত্তা তুই আমার মাকে ব্যবসায় নামাইছিস। হারামীর বাচ্চা তোকে শেষ করে ফেলমু।’
এদিকে আমাদেরকে ছাড়ানোর জন্য মা খুব চেষ্টা করছে। যখন দেখল আমি খুব আক্রমণাত্মক হয়ে যাচ্ছি তখন মা কান্না করতে লাগলো।
বাবুল চাচা আমাকে মাটিতে ফেলে গলাটা টিপে ধরে বললো,
‘পথের কাঁটা তুই। তুই গেলে শান্তিতে ব্যবসা করতে পারমু। এ বাড়িতেই আজ তুই শেষ।’
আমি ছটফট ছটফট করতে লাগলাম। মনে হয় আজকেই আমার শেষ দিন। চোখ বন্ধু হয়ে আসছিল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি বাবুল চাচা উঁহ বলে উঠলো। ধরধর করে রক্তের ফোঁটা আমার গায়ে পড়তে লাগলো। আমার গলা থেকে তার শক্ত হাত নরম হতে লাগলো। আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেল।
(শেষ পর্বের অপেক্ষা)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে