কাগজের নৌকা পর্ব-৬

0
1031

# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
# পর্ব: ০৬
.
.
সকাল থেকেই মাকে দেখার জন্য মনটা খুঁতখুঁত করছিল। রাতে মাকে স্বপ্নেও দেখেছিলাম। মা ছাড়া আমি কতটা অসহায় সেটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। শুধু আমি না, যাদের মা নেই তাদের ক্ষেত্রেও হয়তো কথাটা প্রযোজ্য। মানুষের মুখে মুখে একটা কথা অনেকবার শুনেছি, বাবা না থাকলে নাকি বাবার অভাব মা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে কিন্তু মা না থাকলে বাবা সে অভাবটা নাকি পূরণ করতে পারে না। বাবা-মা না থাকলে তার বটগাছটাই থাকে না। বটগাছ না থাকলে ছায়া পাব কোথা থেকে?
আমি যে ঝুপড়িতে থাকি সেখান থেকে অল্পকিছু দূরে মা থাকে। দুদিন হয়ে যাওয়ার পরও যখন মা আমাকে দেখতে আসল না তখন তার প্রতি আমার অভিমান হলো, প্রচণ্ড অভিমান। মনে মনে রাগ হলো। দুদিনেই মা আমাকে ভুলে গেল কীভাবে? বারো বছরের ছেলেটাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল একটা উটকো লোকের জন্য? উটকো বলছি কেন? উনি তো আমার মায়ের স্বামী এখন। আইনত স্বামী। তার প্রতি মায়া-ভালোবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক। হয়তো তার কাছে বেশি ভালোবাসা পেয়ে আমাকে ভুলে গেছে। তবুও মা ভালো থাকুক। আমি নাহয় একটু কষ্টই পেলাম, তাতে কী!
তবে আমি আশাবাদী একটা সময় আমি সুখের মুখ দেখব। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাকে নিরাশ করবেন না। একটা মানুষ হয়তো সারাটা জীবন কষ্টে থাকে না। একটা সময় অন্তত সুখ পায়। সে আশায় আমাকে পথ চলতে হবে, অনেকটা পথ।
.
নিজেকে অনেক বুঝিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। সাথে মালা। আমি কোথাও গেলে মালাকে সাথে নেই। ওর যেমন এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া কেউ নেই ঠিক তেমনি আমার মা থাকতেও নেই।
‘তোর কী মনে হয় মালা, মা ওইখানে অনেক সুখে থাকব?’
‘জানি না রে। তয় ওই মানুষটারে আমার ঠিক সুবিধার মনে হয় না।’
‘আমারও রে।’
‘আল্লাহ কী করে দেখি।’
‘আমার মাকে যদি হারামজাদাটা কষ্ট দেয় তাইলে খুন করমু।’
‘ছি, এমন কথা কইস না।’
বাবুল চাচার বাড়িটা আমি ঠিক চিনি না। মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করে শেষে খুঁজে পেলাম। আমাকে দেখে বেশ কয়েকজন টিটকারিও করলো। তাতে আমার কী, আমি সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ করিনি। আমি শুধু আমার মাকে দেখতে এসেছি।
বাড়িতে ঢুকেই দেখলাম বেশ বড় বাড়ি। অনেক কয়টা ঘর। অন্তত আমার ঝুপড়ির থেকে অনেকটাই বড়বড়। বেশ গোছানো বাড়িটা। আমি বাড়িতে ঢুকে চারদিকটা ভালো করে দেখছি। এমন সময় দেখি বাবুল চাচা মোটরবাইক নিয়ে বের হচ্ছে। আমাকে দেখে বললো,
‘কী রে আপন, হঠাৎ এ সময়?’
ওনার এ কথা শুনে আমার ভালো লাগলো না। কী বলে লোকটা! প্রথমবার বাড়িতে আসলাম তাতেই এ প্রশ্ন! আমি বললাম,
‘মাকে দেখতে আসছি।’
‘ওহ।’
আমার কথা শুনে বাবুল চাচা জোরে জোরে ডাকলো,
‘জমিলা, ও জমিলা?’
ছোট একটা ঘর থেকে উত্তর আসলো,
‘কী?’
‘তোমার পোলা আইছে।’
ঘরটা থেকে ধোঁয়া উঠছিল। দেখেই মনে হচ্ছে রান্নাঘর ওটা। বাবুল চাচা বাইকে করে কোথায় যেন চলে গেল। মা আমাকে দেখে দৌড়ে আসল। আমাকে জড়িয়ে ধরে সারা মুখটা চুমুতে ভড়িয়ে দিলো। আমার চোখে পানি আসলো কিন্তু পানি ফেলতে পারছিলাম না। যদি মাও কেঁদে দেয়, সেজন্য। মা আমাকে বললো,
‘ক্যামন আছিস বাপ?’
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘ভালা আছি মা। তুই ক্যামন আছোস?’
মাও আনমনে উত্তর দিলো,
‘তোকে ছাড়া ক্যামনে ভাল থাকি বাপ?’
‘তাইলে দুই দিন পার হয়া গেল তুই ঝুপড়িতে গেলি না ক্যান?’
আমার কথা শুনে মায়ের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমি মায়ের মুখটা ফ্যাকাসে হওয়ার অর্থটা বুঝিনি। মা মালাকে বললো,
‘তুই ক্যামন আছিস মালা?’
মালা হাসিমুখে বললো,
‘ভালো আছি চাচী।’
মা আমাদেরকে নিয়ে ঘরের ভেতর গেল। ঘরটা বেশ পরিপাটি। বেশ সাজানো গোছানো। বিছানায় এখনও ফুলের সজ্জা। চারদিকটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ঠিক যেমন বাসরঘর সাজানো হয়। মায়ের বেশভূষা দেখেও বেশ ভালো লাগলো। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। হাতে চুড়ি, গলায় মালা, কানে দুল। দেখেই বাহ্যিক দিক দিয়ে বুঝা যাচ্ছে মা বেশ ভালোই আছে এখানে। মাকে এমন দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। কিন্তু মায়ের মুখটা ভার। মা আমাকে না বললেও আমি ঠিক বুঝতে পারছি। কিন্তু মাকে কোনোভাবেই এটা জিজ্ঞেস করতে পারছি না।
মা আমাকে বললো,
‘সকালে কী খাইছিস বাপ?’
‘পরোটা খাইছি মা। তুই কী খাইছিস?’
আমার কথায় মা মেকি হাসলো। এ হাসির আড়ালে যে বিষণ্ণতা লুকিয়ে আছে আমি সেটা ঠিক ধরতে পেরেছি। মা বললো,
‘তোর নতুন আব্বু পায়েস খাইতে চাইছিল, সেটাই আমিও খাইছি।’
নতুন আব্বু কথাটা শুনে আমার মেজাজটা একটু খারাপ হয়ে গেল। রাগও হলো। আমার আব্বু একজনই। আমার জন্মদাতা।
‘না মা, নতুন আব্বু কইস না। আমার ভালো লাগে না। আমি তারে চাচা বলেই ডাকমু।’
আমার কথা শুনে মা কিছু বললো না। ঘরে বসিয়ে রেখে কোথায় যেন চলে গেল। একটু পর বাটিতে পায়েস নিয়ে এসে বললো,
‘আয় তোদের খাইয়ে দেই।’
পায়েস! একসময় কত নাম শুনেছি আর দেখেছি। কিন্তু কখনও খাওয়া হয়নি। খাওয়া হবেই বা কী করে, যার ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার ঘরে পায়েস রান্না করা বিলাসিতা। তবে মা পায়েস রান্না করা কোথা থেকে শিখেছে আমার সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই। মায়ের অতীত আমার অজানা। কখনও তাকে তার আব্বা-মা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়নি।
মা আমাদের পায়েস খাইয়ে দিচ্ছে আর বলছে,
‘দুপুরে ভাত খাইয়া যাইস বাপ।’
‘আচ্ছা মা, এতবড় বাড়িতে আর কেউ থাকে না?’
মা হাসে, বলে,
‘না বাপ। আমি একলাই থাকি। তুইও চইলা আয়। এক লগে থাকমু।’
‘না মা। আমার বাপের ঝুপড়ি ছাইড়া কোথাও যামু না।’
‘তোরে ছাড়া যে আমি থাকবার পারি না।’
‘প্রতিদিন তোরে দেইখা যামু মা।’
মা পানি দিলো। পানি খেয়ে বললাম,
‘আমার কাছে গেলি না ক্যান?’
‘নতুন বাড়িতে অনেক কাজ বাপ। তুই আজ না আসলে কালই যাইতাম।’
‘ওহ।’
‘তোরা থাক আমি তরকারি দেখি।’
‘আচ্ছা মা।’
মা চলে গেল। আমি আর মালা বসে আছি। মালা সারা ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। মায়ের সাজগোজের অনেক জিনিস।
‘আপন দেখ দেখ, কত সুন্দর মালা।’
‘বেশি টাকা কামাইলে তোরেও কিনা দিমু।’
‘সত্যি কইতাছোস?’
‘সত্যি।’
.
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মালাসহ স্টেশনে আসলাম। আসার সময় মায়ের চোখে স্পষ্ট পানি দেখেছি। আমি জানি মা আমাকে ছাড়া ভালো নেই। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,
‘কাল পরশু আসিস বাপ।’
‘আচ্ছা মা।’
‘মালাকে সাথে নিয়া আসিস।’
‘আচ্ছা মা।’
স্টেশনে এসে মালাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মা কি সত্যি ভালো আছে রে?’
‘আমার তো ভালাই মনে হইলো।’
‘আমার জন্যে মনে হয় ভালো নাই। আমার কথা মা ভাবে খুব।’
‘হ্যাঁ রে। ঠিক হইয়া যাইব। ট্রেন আইতাছে। চল যাই।’
আমরা দুজন দৌড়ে গেলাম। মালা একদিকে দৌড় দিলো আমি আরেকদিকে। দুজনেই একদিকে গেলে সুটকেস নেয়ার চাহিদা কমবে। দুজন দুদিকে গেলে অন্তত একটা করে হলেও কাজ পাব। এক সাহেব আমাকে দেখে ডাক দিলেন। আমি দৌড়ে গেলাম।
‘স্যার কিছু ধরতে হইব?’
‘হ্যাঁ।’
লোকটার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সবে বড়লোক হয়েছে। সেজন্য আলাদা একটা ভাব নিচ্ছে। কথাবার্তাও সুবিধার না। আমি ওদিকে ওত খেয়াল না করে সুটকেস দুটো মাথা তুলে ওনার পেছনে পছনে হাঁটতে লাগলাম। লোকটার সাথে কেউ ছিল না। ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল। কথার ধরণ দেখে আমার বেশ হাসিও পাচ্ছিল। ওপরে ফিটফাট আর ভেতরে সদরঘাট। আমি সুটকেস নামিয়ে বললাম,
‘স্যার ত্রিশ টাকা দেন।’
লোকটা ত্রিশ টাকার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। দশ টাকার নোট একটা হাতে দিয়ে বললো,
‘যা ভাগ।’
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। বললাম,
‘ভাগ মানেটা কী? আপনার ব্যাগের অনেক ওজন, তার উপর দুটো ব্যাগ। দশ টাকায় হইব না। ত্রিশ টাকা দেন।’
‘এটাই বেশি দিছি। চল, যা এখান থেকে।’
‘না স্যার দশ টাকা নিমু না। ত্রিশ টাকাই লাগবে। নাহলে এটাও ফেরত নেন।’
‘জানোয়ারের বাচ্চা যা ভাগ।’
‘সাহেব বাপ-মা তুলে গালাগাল দেবেন না কিন্তু।’
‘কী করবি রে?’
কথাটা বলে লোকটা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। আমার রাগ চরম সীমায় পৌঁছালো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হাতের কাছের ইটের টুকরো দিয়ে সোজা মাথা বরাবর ছুঁড়ে মারলাম। টুকরোটা সোজা ওনার কপালে লাগল। সাথে সাথে ওমা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। আমি স্পষ্ট দেখলাম রক্ত ঝড়ছে। মনে মনে রাগের মাত্রাটা মনে হয় একটু কমেছে। মাটি থেকে উঠে দৌড়ে পালালাম। মালা আমাকে দেখে বললো,
‘দৌড়াইতাছোস ক্যান?’
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
‘এক ব্যাটার মাথা ফাটাই দিছি। চল পালা আমার লগে।’
মালা আমার কথা শুনে আমার সাথে দৌড় দিলো।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে