কাঁচ কাটা হীরে পর্ব-০৪

0
495

#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

বাসায় ফিরতে সন্ধে পার হয়ে গেল। এক আকাশ উচ্ছাস নিয়ে বিকেলের নরম রোদের আলোয় বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এক সাগর বিষাদ নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। বাড়িতে ঢুকা মাত্রই মা আমার চেহারা দেখে আঁতকে উঠে বললেন,
—–সায়মা তোকে এমন লাগছে কেন?তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?
মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম,
—–আমি ঠিক আছি। মামুন কোথায়?
——সাজিদের সাথে খেলছে।
আমি আম্মার সাথে কোনো কথা না বলে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আমার মনে হতে লাগলো আমার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে আসছে। রুমের দরজাটা কিছুক্ষণের জন্য লক করে দিলাম। ফ্যানটা ফুল স্পীডে ছেড়ে দিলাম। তারপর বুকের ভিতর জমাট বাঁধা কান্নাগুলো দুচোখের কোল বেয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমি একটু থেমে গেলাম। কেননা আজও সেই বিষাদ মাখা নোনা জলের কাব্যের পৃষ্টা উল্টাতে গিয়ে চোখের কোনটা সিক্ত হয়ে গেল। নীলা মনে হয় বুঝতে পেরেছে। তাই আমাকে সামলে উঠার সুযোগ দিয়ে বললো,
—–মামনি, আমি আরো দু,কাপ চা বানিয়ে আনছি।
আমি জানি আমার বৌমাটি খুব বুদ্ধিমতী। ও চলে যাবার পর আমি আসলেই নিজেকে একটু সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছি আর ভাবছি, কি বিচিত্র মানুষের মন এতো বড় আঘাত পাওয়ার পরও কি এক অদৃশ্য বেদনায় বুকের ভিতরটা আজও হুহু করে কেঁদে উঠে। নীলা দুকাপ চায়ের সাথে একটু মুড়িমাখা নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়ে বললো,
—–ঘন দুধের চা,সাথে তোমার পছন্দের মুড়িমাখা। খেয়ে দেখতো কেমন হয়েছে?
আমি জানি নীলাও আমার মতো খুব সুন্দর চা বানাতে পারে। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম,
—–অপূর্ব! ভীষণ ভালো হয়েছে। কি করে বুঝলে আমার চায়ের তেষ্টা পেয়েছিলো?
—–এতোদিন ধরে আছি তোমার সাথে এই টুকু যদি বুঝতে না পারি তাহলে আমি তোমার কেমন বৌমা?
নীলার কথাটা শুনে আমার বুকটা ভরে গেল। এরপর নীলা আমায় বললে,
—–মামনি, আমার একটা বিষয় খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুমি বললে, আহসান আঙ্কেলকে তুমি কখনও ভালোবাসার কথা বলতে পারোনি। আর একবার বললে বিশেষ একটি ঘটনার পরিপেক্ষিতে তোমরা কাছাকাছি এসেছিলে? সেঘটনাটা কি? আর বিয়ের আগে তোমাদের ক,বছরের রিলেশন ছিলো?
—–সে সময় ছিলো স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের শাসনামল। একটানা দশবছর সংগ্রামের ফলে ঐ সরকার বিদায় হয়। সেদিন ছিলো ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর। আমার বাবা তখন রংপুরের ডিসি। ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর রোকেয়া হলে সিট পাই। আমি তখন অনার্স থার্ড ইয়ারে।স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সেদিন সব দল মিলে সচিবালয় অবরোধের ডাক দেওয়া হয়। শহরে তখন প্রচন্ড উত্তেজনা। সরকার থেকে ছাত্র ছাত্রীদের হল খালি করতে বলা হয়। স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতো নিষেধাজ্ঞা সত্বেও সকাল থেকে দলে দলে মানুষ পুরানা পল্টনে জড়ো হয়।ঢাকা ভার্সিটি থেকে ছাত্র ছাত্রী এসে সেখানে যোগ দেয়। সরকার থেকে প্রচুর দাঙ্গা পুলিশ নামানো হয়। দফায় দফায় পুলিশ ছাত্র জনতা সংঘর্ষ হয়। সেখানে শ্যামলা বর্ণের এক টগবগে তরুন এসে অংশ নেয়। তার বুকে আর পিঠে লেখাছিলো স্বৈরাচারী নিপাত যাক গনতন্ত্র মুক্তিপাক। ওর কন্ঠে ছিলো তেজদীপ্ত শ্লোগান।শ্লোগানে শ্লােগানে পল্টন প্রেসক্লাব জিরো স্কয়ার মুখরিত। একসময় পুলিশ গোলাগুলি শুরু করে। সেখানে আমিও ছিলাম। আমার পাশেই ছিলো আহসান। প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়। আমি উভয়পক্ষের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে যাই।একসময় মনে হলো আজকে যেন আমার জীবনের শেষদিন। আর হয়ত কোনোদিন বাবা মা ভাইকে দেখতে পাবো না। সে সময় আহসান কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে একরকম পাঁজাকোলা করে সেখান থেকে নিয়ে আসে। ও আমাকে সচিবালয়ের পাশ দিয়ে চানখারপুল হয়ে লালবাগে একটা বস্তিঘরে নিয়ে যায়। সারা রাত আমি আর আহসান সেঘরে লুকিয়ে থাকি। যদিও আহসানকে আমি শুদ্ধ চরিত্রের মানুষ হিসাবে জানি তারপর ও আমার ভয় হতে লাগলো। আহসান আমার ভয়টা বুঝতে পেরে বলেছিলো,”তুমি ঘরে নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমাও। আমি দরজার বাইরে বসে থেকে সারারাত পাহারা দিচ্ছি”। তখন তো ফোনের ব্যবস্থা ছিলো না। বুঝতে পারছি ওদিকে আমার বাবা মা খুব চিন্তা করছে। সেই রাতটা পার হওয়ার পর ভোরের আলো ফুটতেই আমি আর আহছান কার্ডফোনের সন্ধান করি। সদরঘাটের ওখানে কার্ডফোনের সন্ধান পাই। সেখানে দুটো কয়েন ঢুকিয়ে বাসায় মেসেজ দিয়ে বলি,”আমি ভালো আছি। ওরা যেন চিন্তা না করেন”। তবে মনে মনে আমি আহসানের উপর দুর্বল হয়ে পড়ি। ওর আচরণ, ওর চারিত্রিক শুদ্ধতা আমাকে মুগ্ধ করে। এখন বলো,ঐ মানুষটাকে আমি অবিশ্বাস কিভাবে করবো?। আমি ওর যে চারিত্রিক শুদ্ধতার পরিচয় পেয়েছি তাই ওকে কোনোদিন সন্দেহ করতে পারিনি। সারারাত আমি আর ও একসাথে ছিলাম। কতকিছুই তো ঘটে যেতে পারতো? সময় পরিবেশ পরিস্থিতীর উপর কারো তো হাত ছিলো না। যাই হোক এরপর আহসান আমাকে নিয়ে কমলাপুরের রেলস্টেশনে গিয়ে রংপুরগামী ট্রেনের টিকিট কেটে আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেয়। আমি রংপুরে যথাসময়ে পৌঁছে যাই। বাবা মা আমাকে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। পরদিন পেপারে নিউজ দেখে আমি ভীষণভাবে আহত হলাম। কারণ সরকারের নিষেধ সত্বেও ঢাকা ভার্সিটি ও অন্যান্য ভার্সিটি থেকে যেসব ছাত্র ছাত্রী এই সমাবেশে অংশ নেয় তাদের নামের তালিকা করা হয়। আহসানের কারনে আমার নামটা বাদ পড়ে। কিন্তু আহসানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এবং ওকে অ্যারেস্ট করা হয়। বুকে লেখা শ্লোগান সহ সেই টগবগে তরুনটা মারা যায়। ওর নাম ছিলো নুর হোসেন। গনতন্ত্রের জন্য সেদিন অনেক মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করে। অথচ রক্ত দিয়ে কেনা এই গনতন্ত্রটা বার বার হুমকির স্বীকার হয়। আমাদের প্রজন্মে গনতন্ত্র উদ্ধার আর দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠলো নুর হোসেন। অথচ আমরা অবলীলায় সে সব আত্মত্যাগের কথা বেমালুম ভুলে যাই। তখন তো মোবাইল ফোনের যুগ ছিলো না। পত্রিকার মাধ্যমে এসব খবর পাই। অনেক ছাত্র নেতাদের সাথে আহসানকেও শাহবাগ থানার পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সেলে কিছুদিন রাখা হয়। সেসময় স্বৈরাচারী সরকারের চাপে আহছানসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ কালো তালিকাভুক্ত করে। ওকে দুবছরের জন্য ভার্সিটি থেকে বহিস্কার করা হয়। এতে আহছান অনেক ভেঙ্গে পড়ে। কারন ওর পারিপার্শ্বিক অবস্থা খুব সঙ্গিন ছিলো। ওর মা অনেক কষ্ট করে ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতো। আমারও আহছানের জন্য খুব মায়া হয়। কেন যেন ওর প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা অনুভব করি। যখনি ভাবতাম সেদিন যদি ও পাশে না থাকতো তাহলে আমার কি হতো? আল্লাহপাক বলেছেন উপকারীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে। আর ওর সাথে আমার এভাবে জড়িয়ে পড়াটা হয়তো আল্লাহপাক আমাদের দু,জনের ললাটে লিখে দিয়েছেন। এরপর থেকে আহসানের সাথে আমার চিঠির আদান প্রদান হতে থাকে। প্রথম প্রথম সহমর্মিতা থেকে ওর সাথে আমি যোগাযোগ করতাম। কিন্তু এই সহমর্মিতা কখন যে ভালোবাসায় পরিনত হয়েছিলো আমি নিজেই জানি না।
যে আহছান আমাদের ক্লাসের হিরো ছিলো এই ঘটনার পরিপেক্ষিতে ও জিরোতে পরিনত হয়ে গেল। আহছান ছাত্রহিসাবে ক্লাসে টপার বয় ছিলো। দেখতেও সুদর্শন। তাই ক্লাসের অনেক মেয়েদের ও আকাঙ্খিত পুরুষ ছিলো। জেনিফারও ওদের একজন। কিন্তু এই ঘটনার পর সবাই আহছানকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। সময়ের আবর্তে আমিই আহসানের একমাত্র বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে