#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব- তিন
মাহবুবা বিথী
আমি সেদিন অফিস থেকে এসে মামুনকে কোলে নিয়ে লনে হাঁটছিলাম। আহসান তখনও ফেরেনি। জেনিফার ওর রুমে ঘুমাচ্ছিলো। সময়টা সেপ্টেম্বর। শীতের আগমনি বার্তা বাতাসে ভাসছে। সেই পড়ন্ত বিকেলে আহসান খুব খুশী মুখ করে বাড়ি ফিরে আমার কোল থেকে মামুনকে নিয়ে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলো। আমি অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
——এটা কি?
——খুলেই দেখোনা?
আমি খাম খুলে সত্যি খুব সারপ্রাইজড হলাম। ওখানে আমার আর মামুনের জন্য প্লেনের টিকিট। আমি কি বোকা ছিলাম? আহসানের ছলচাতুরী সেদিন বুঝতে পারিনি। আবেগে আপ্লুত হয়ে ভেবেছিলাম, আহসান আমার দিকে কতো খেয়াল রাখে। বরং ও যে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছে এটা ভেবে আমার চোখে জল এসে গেল। সেসময় জেনিফার ঘুম থেকে উঠে আমাদের কাছে এসে বললো,
——তোমরা কি নিয়ে এতো আনন্দে আছো?
আহসান খুশীতে গদগদ হয়ে বললো,
——সায়মা পাঁচবছর পর ওর বাবার বাড়ি যাচ্ছে।
জেনিফারের খুশীর মাত্রা যেন আহসানের খুশীকে ছাপিয়ে গেল। অতি আনন্দের আতিশয্যে বলেই ফেললো,
—–আমরা সেই খুশীতে বাসায় একটা ছোটো খাটো পার্টি দিতে পারি।
সত্যি সেদিন জেনিফার নিজ উদ্যেগে পার্টির ব্যবস্থা করেছিলো। তবে আমার শাশুড়ী মা রেগে গিয়ে বলেছিলেন,
—–ঘরের বউ আমার কতদিনের লাইগা বাংলাদেশে যাইতাছে এইডা তো খুশীর বিষয় নয়। বরং বৌমার লাইগা আমার মনডা তো পুড়বো। যতদিন আইবো না আমার তো নাতি, বউমার জন্য মন খারাপ থাকবো। আহসান তোর এতে আনন্দ লাগার কি আছে বুঝলাম না। আমার মনডা পুড়বো তোর মন পুড়বো না?
আহসান অবশ্য পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছিলো। কিন্তু আমার শাশুড়ী মা রেগে গিয়ে জেনিফার কে বলেছিলো,
—–এই সব ফালতু কাজ না কইরা বাসা দেইখা তুমি চইলা যাও। বৌমা না থাকলে তোমার এই বাড়িত থাকন যাইবো না।
এতে অবশ্য আহসান এর খুব মন খারাপ হয়। আমারও হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো শাশুড়ী মা এভাবে জেনিফারকে না বললেও পারতেন। কারণ বিদেশে প্রথমে সবাইকে খুব স্ট্রাগল করতে হয়। আমার দেশের মানুষ এবং ভার্সিটির বন্ধু হওয়াতে আমি আর আহসান জেনিফারকে এইটুকু সহযোগিতা করতেই পারি। তাই আমি শাশুড়ী মাকে সে কথা বলতে গেলে কারন হিসাবে উনি বলেছিলেন,
——হেই মাইয়ারে কেডা রান্না কইরা খাওয়াইবো। ওতো পারে শুধু সাজগোজ করে ব্যাডা মানুষের লগে নটাঙ্গীনি করতে। তোমার চোখে কি কিছুই পড়ে না? এই যে সারাক্ষণ আহসানের সাথে দাঁত কেলায়, বাইরে ঘুরতে যায় এগুলো আমার ভালো লাগে না।
আমি তখন ভেবেছিলাম আমার শাশুড়ী মা গাঁয়ের একজন আটপৌরে মহিলা। শহুরে এসব কালচারে উনি হয়তো অভ্যস্ত নন। এই কারনে হয়তো জেনিফারের বিষয়গুলো উনি মেনে নিতে পারছেন না। তাই শাশুড়ী মাকে বলেছিলাম,
——মা ওতো বিবাহিত।
——রাখো তোমার বিবাহিত! আদৌ ওর জামাইয়ের ঠিক আছে কিনা কে জানে?
পরে বুঝেছিলাম আমার শাশুড়ী মা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে জীবনের অনেক কঠিন সমস্যা মোকাবেলা করেছেন। তাই মানুষ চিনতে উনি ভুল করেননি। কারণ জীবন উনাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সত্যিকার অর্থে কোনটা সাদা আর কোনটা কালো।তাই উনার অভিজ্ঞ চোখে জেনিফারের চারিত্রিক ত্রুটিগুলো ঠিক ধরা পড়তো বলে এভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন। আর আমি সরল বিশ্বাসের মানুষ ছিলাম বলে এ ধরণের চিন্তা মাথায় আসতো না।
যাইহোক আমিও দু,দিন পর অ্যামিরাটসে করে হির্থোবিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের পথে উড়াল দেই। আহসান আমার সাথে এয়ারপোর্টে এসেছিলো। আমি আহসানকে আমার নিজের থেকে বেশী বিশ্বাস করতাম। তাই শাশুড়ী মা এতো কিছু বলার পরেও ওর প্রতি তখন আমার কোনো অবিশ্বাস জন্মায়নি।
নিজের আপনজনের কাছে ফিরে যাবার আনন্দে আমি এতোটাই বিভোর ছিলাম আহসান কিংবা জেনিফার ওদের নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিলো না। দীর্ঘ প্লেন জার্ণির পর ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে আমি বেশ পুলকিত। আমাকে রিসিভ করতে সাজিদ এসেছিলো। সাজিদ মামুনকে কোলে তুলে নিলো। ড্রাইভার আমার লাগেজগুলো নিয়ে গাড়িতে তুলে দিলো। তখন রাস্তায় এতো জ্যাম ছিলো না। খুব দ্রুত আমি ইস্কাটনে আমার বাবার কোয়ার্টারে পৌঁছে যাই। ব্যারিস্টারী পাশ করাতে বাবা মনে মনে খুশী হয়েছিলেন কিন্তু আহসানের ব্যাপারে তখন ও বাবার নেগেটিভ এটিটিউট ছিলো। আমার অবশ্য ঐ বিষয়টা মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। মাকে দেখতে পেয়েছি এই আনন্দে আমি আত্মহারা। তবে মামুনের সাথে বাবার সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। এরমাঝে সাতদিন পেরিয়ে গেল। আমাদের বাসায় সরকারী টেলিফোন ছিলো। কিন্তু এই কয়দিনে আহসান আমাকে ফোন করেনি দেখে মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
——জামাই তো ফোন দিয়ে তোর আর মামুনের খোঁজ নিলো না। তোরা ঠিকমতো পৌঁছালি কিনা সেটাও তো ওর জানা উচিত ছিলো?
আমি মাকে বললাম, “ওখান থেকে বাংলাদেশে সহজে লাইন পাওয়া যায় না”। আসলে এ কথাটা বলে মাকে এড়াতে চাইলাম। কিন্তু মনে মনে আহসানের এই আচরণ আমাকে পীড়া দিতে লাগলো। লন্ডনে থাকতে আমার এমন অনুভূতী কখনও হয় নাই অথচ বাংলাদেশে আসার পর আহসান ফোন না দেওয়াতে আমার ইনসিকিউরিটি অনুভব হতে লাগলো। মনের ভিতর কু ডাকতে শুরু করলো। অগত্যা ঐ টেনশনটা নিতে না পেরে নিজেই আহসানকে ফোন দিলাম। কিন্তু ফোন করার পর আমার কেন যেন মনে হলো আমি যেন আহসানের কথার মাঝে আগের সেই উচ্ছাসটা খুঁজে পেলাম না। আহসানও কাজের দোহাই দিয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা রেখে দিলো। এমনকি আমাকে জিজ্ঞাসা করলো না আমি কবে ফিরবো?
জেনিফারের কথা ওকে আর জিজ্ঞাসা করা হলো না। এর মাঝে আমার আসার খবর বন্ধুদের কানে পৌঁছে গেল। ওরা আমার সাথে দেখা করতে চাইলো। আমিও মনটাকে হালকা করার জন্য ওদের সাথে নিয়ে বেলীরোডে একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। মেঘদীপা, জারাহ্, রাসেল আর জামান ওরা সবাই যথাসময়ে চলে আসলো। এক দু,কথা বলার পর জেনিফারের প্রসঙ্গ চলে আসলো। মেঘদীপা আমাকে বললো,
——জেনিফার তো লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছে। তোর সাথে দেখা হয়েছে?
——ওতো আমার বাসাতেই আছে।
একথা শুনে জারাহ্ চিৎকার দিয়ে বললো,
—–কাজটা তুই ঠিক করিসনি?
—–কেন এতে কি সমস্যা?
——তুই তাহলে ওর সম্পর্কে কিছুই জানিস না?বাড়িতে কি আহসান ভাই একা আছেন?
—–না,আমার শাশুড়ী মা সাথে আছেন।
——কিন্তু ওকে তোর বাড়িতে জায়গা দেওয়া ঠিক হয়নি। তুই কি ভুলে গেছিস আহসান ভাইকে জেনিফার কিন্তু প্রচন্ড পছন্দ করতো।
—-পছন্দ আর ভালোবাসা তো এক কথা নয়। আহছান বহিস্কার হওয়ার পর জেনিফার নিজ থেকেই সরে আসে। আহসানকে আমার প্রথম থেকেই ভালো লাগতো। কিন্তু সে সময় ওকে আমার ভালোবাসার কথাটা বলার সময় পাইনি। কারণ সে সময় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আহছান সরাসরি অংশ নেয়। পরে একটা ঘটনাসুত্রে আমি আর আহছান কাছাকাছি চলে আসি।
এরপর রাসেলও আমাকে বললো,
—–আমি অবশ্য তোর আর আহছানের বিষয়টা জানি। কিন্তু তোর মনে আছে জেনিফার সে সময় সরকার পক্ষের এক রাজনৈতিক নেতাকে পনেরো লক্ষ টাকা কাবিনে ঘটা করে বিয়ে করে। এরপর এরশাদের পতনের সাথে সাথে ঐ রাজনৈতিক নেতার ঠাট বাট কমে যেতে থাকে। জেনিফারের সাথে তখন উনার সম্পর্কের অবনতি হয়। পরিশেষে ঐ লোকের কাছ থেকে নিজের সব পাওনা বুঝে নেয়। তারপর ডিভোর্স নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমায়।
জামানও জেনিফারের সম্পর্কে আমাকে বলে,
—-জেনিফার এমন একটা মেয়ে ও উপরে উঠার জন্য নিজের প্রয়োজন মাফিক কাউকে না কাউকে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করে। আর দেখতে সুন্দরী, খুব মিষ্টি করে কথা বলাতে অনেকেই ওর কথায় পটে যায়।
এসব শুনে আমার পায়ের তলার মাটিটা মনে হয় সরে যেতে লাগলো।
চলবে