কাঁচ কাটা হীরে পর্ব-০২

0
566

#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
আমার দু,চোখে তখন রঙ্গিন স্বপ্ন। এতোদিন আমরা দু,জনে পড়াশোনা, নিজেদের ক্যারিয়ার এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারনে প্রেম করার সুযোগ হয়ে উঠেনি। এর মাঝে আবার মামুনেরও জন্ম হয়। আহছান ব্যারিস্টারী পাশ করার পর যেন আমার সংসারে পরিপূর্ণতা আসতে শুরু করলো। এতোদিনের কষ্ট সংগ্রামের ফসল তখন আমাদের দু,জনের ঘরে তোলার পালা। যদিও আমি ওর আগে ব্যারিস্টারী পাশ করেছি কিন্তু একা হাতে সংসারের সব খরচ, আহসানের পড়ার খরচ সব সামলিয়ে হিমসিম খেতাম। ও পাশ করার পর আমার ও দায়িত্বের বোঝা যেন একটু হালকা হলো। আমি তখন বেশ ফুরফুরে। আমরা তিনজন মিলে টেমস নদীর পার, লন্ডনের হাইড পার্ক থেকে শুরু করে একেকদিন একেক পার্কে ঘুরতে লাগলাম। কখনও রানীর প্রাসাদের সামনে ঘুরতে যেতাম। আমার কাছে নিজেকে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারী মনে হলো। এবং এ জগতের সবচেয়ে সুখী কাপলদের একজন আমি আর আহসান। আর আমাদের চোখের মনি মামুনকে নিয়ে সুখের তরীটা যেন তরতর করে বয়ে যেতে লাগলো। তখন সামারের সময় ছিলো। চারদিকে চেরী ফুল ফুটে আছে। এতো সুন্দরের মাঝে কোনো অসুন্দর আমার চোখে পড়েনি। যার ফলে আহসানের কোনো পরিবর্তন আমার চোখে ধরা পড়লো না। বরং ও যেন আমার প্রতি একটু বেশী গ্রেটফুল। দেশে থাকলে রাজনীতির গ্যাড়াকলে ওর ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে থাকতো। কিন্তু আমার সাথে লন্ডনে পাড়ি জমানোর ফলে ও ওর ক্যারিয়ারটাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে পেরেছিলো।
আমাদের বাসাটা ছিলো লন্ডনের ক্রিকেলউুডে। ওখানে এক বেডরুমের একটা বাসা আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম। বেডরুমটা বেশ বড় থাকাতে শাশুড়ী মা যখন আসতেন মাঝখানে মোটা পর্দা দিয়ে পার্টিশন দিয়ে দিতাম। তারপর ও সঙ্কোচ লাগতো। যতদিন শাশুড়ী মা থাকতেন আমাদের নিজেদের একটু সামলে রাখতাম। তখন দাম্পত্য প্রাইভেসীর হ্যাম্পার হতো। তাও আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম। এরমাঝে আমি জেনিফারের আসার কথা একদম ভুলে গেছি। কিন্তু আহসান ভুলেনি। ও একদিন আমাকে নিয়ে একটা বাসা দেখতে গেল। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। সামনে একচিলতে লন আছে। আমার শাশুড়ী মা তখন বাংলাদেশে। তাই আমি আর একটু দেরী করে বাসা ঠিক করতে চাইছিলাম। ওখানে অনেকটাকা বাসাভাড়া গুনতে হয়। কিন্তু আহসানের তাড়াটা বেশী ছিলো। আমি ভেবেছিলাম হয়ত আমার শাশুড়ী মায়ের জন্য ওর এই তাগাদা ছিলো। যাইহোক বাসাটা খুব সুন্দর ছিলো। আমার আসলে জেনিফারকে নিয়ে সন্দেহ করার কিছু ছিলো না। কারণ ও বিবাহিত ছিলো। ও ঢাকা ভার্সিটি থেকে ল,তে গ্রাজুয়েশন করেছিলো। এর মাঝে বিশাল উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে আহসান পুরো বাড়িটা সাজিয়ে ফেললো। বিশেষ করে একতলায় দুটো বেডরুম ছিলো। একটা রুম সে নিজের হাতে মনোরম করে সাজালো। আমি ভেবেছিলাম ঐ রুমটাতে মনে হয় আমার শাশুড়ী মা থাকবে। কিন্তু আহসান যখন অনেক দাম দিয়ে একটা পেইন্টিং কিনে ঐ রুমের ওয়ালে টাঙ্গালো তখন আমার একটু খটকা লাগলো। পেইন্টিংটা ছিলো দুটি আলিঙ্গনরত নরনারীর।আমি জানি আমার শাশুড়ী মা রুমে কোনো ছবি রাখা পছন্দ করেন না। খুব নামাজী মানুষ ছিলেন। তখন আমি আহসানকে জিজ্ঞাসা করলাম,
——মা তো ছবি পছন্দ করেন না। তুমি এখানে এই পেইটিং টা রাখলে কেন?
ও বলেছিলো,
——সব কৌতূহল একসাথে জানতে নেই।
আমি ওর হেঁয়ালী কথাকে হেঁয়ালী হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। তারপর এক পড়ন্ত বিকেলে আমার শাশুড়ী মাকে সাথে নিয়ে জেনিফার আমার বাসায় পদার্পন করলো। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। জেনিফারের আসার কথা আহছান ঠিকই জানতো। তাইতো আমার শাশুড়ীমাকে ওর সাথে ট্যাগ করে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে জানায়নি। শাশুড়ী আসার কথা জানতাম বলে ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
—-মা কার সাথে আসবে?
ও বলেছিলাে,”ওর একজন পরিচিতের সাথে মা আসবেন”। কিন্তু সেই পরিচিত মানুষটা যে জেনিফার সেটা আহছান আমার কাছে হাইড করেছিলো। আর জেনিফারও আমাকে চিঠি দিয়ে ওর আসার ডেট জানায়নি। একটু কষ্ট অনুভব করেছিলাম। পরমুহুর্তে ভেবেছিলাম ও হয়তো আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য জেনিফারের কথাটা গোপন করেছে। কিন্তু জেনিফার আসার পর আহসান যখন জেনিফারকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে ঐ রুমে নিয়ে গেল তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছিলো। কারন আমাদের বেডরুমটা ও এতো মমতা দিয়ে সাজায়নি। তাহলে ও জেনিফারের জন্যই স্পেশাল করে রুমটা সাজিয়েছে। সেদিন আমার কেন যেন মনে হয়েছিলো আহসানকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করার সুবাদে আমার দাম্পত্যের পালঙ্কে ঘুণ পোকা ধরেনিতো? পরে নিজেকে নিজেই প্রবোধ দিয়ে বলেছিলাম এতো সন্দেহ বাতিক হওয়া ঠিক নয়। কারণ ভালোবাসার ঘর টিকে থাকে বিশ্বাসের ভিতের উপর। কিন্তু আহসানের এটিটিউড দেখে আমার শাশুড়ী মা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে আমায় বললেন,
—–হেই মাতারী কি এখানে থাকবো বৌমা?
—–হুম। কদিনের জন্য এসেছে। তারপর নিজের একটা ব্যবস্থা করে চলে যাবে।
—–আহছান কি তোমার অনুমতি নিয়ে ঐ মাইয়ারে এখানে আনছে?
আসলে সত্যি বলতে আজ যে জেনিফার আসবে এবিষয়টাতো আহসান আমাকে জানায়নি। তাই আমতা আমতা করে শাশুড়ী মাকে বললাম,
——ও আসবে জানতাম। কিন্তু আজকেই যে আসবে তা জানতাম না।
—–তুমি শিক্ষিত মাইয়া। তারপরও তোমারে কই।কাজটা তুমি ঠিক করো নাই বৌমা। আহছান চাইলেও তোমার মত দেওয়া উচিত হয় নাই। আহসানের বুদ্ধির উপর আমার কোনো ভরসা নাই। ওর বুদ্ধির ধার যদি এতো বেশী থাকতো তাহলে এতো ছাত্র থাকতে ও কেন শাস্তি পাইলো। ও আসলে গ্যাড়াকলে পইড়া গেলে সেখান থেকে আর বাইর হইতে পারে না।
দেওয়াল ঘড়ির ঢং ঢং ঘন্টা বাজার শব্দে আমি আর নীলা বুঝতে পারলাম ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুয়েছে। অগত্যা আমি নীলার দিকে তাকিয়ে বললাম,
——তোমার বিরক্ত লাগছে নাতো?
—–না, মামনি। তুমি বলো। আমার কোনো সমস্যা নেই।
আমি আবারও বলা শুরু করলাম।
—–তবে একটা বিষয় আমার নজর এড়ালো না। জেনিফার আমার সাথে সময় কাটাতে যত না আগ্রহী তার থেকে বেশী আগ্রহ ওর আহসানকে নিয়ে। সামান্য একটা কোকের বোতল কিনতে গেলেও ওর আহসানকে চাই। আমি তো খুব সাদামাটা চেহারার মানুষ। কিন্তু জেনিফার ছিলো বেশ সুন্দর। সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিলো ওর ফিগার। মেদহীন ঝরঝরে শরীর। আমি আসলে তখন আহসানকে এতো নষ্ট চরিত্রের মানুষ ভাবতে পারিনি। ইউনিভার্সিটি পড়া অবস্থায় আহসানকে সবাই শুদ্ধ চরিত্রের মানুষ হিসেবে জানতো।
এর মাঝে বাংলাদেশ থেকে একটা চিঠি আসলো। সাজিদ পাঠিয়েছে। ও তখন বুয়েটে সিভিলে পড়াশোনা করছে। আমার একমাত্র আদরের ছোটো ভাই। আমি খুব আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম। কারণ পাঁচ বছর থেকে আমার বাবার বাড়ির কারো সাথে আমার কোনোরকম যোগাযোগ নেই। আমার ভিতরটা আমার মা, বাবা ভাইকে দেখার তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছিলো। তুমি জানো, আমি কতবার ঐ চিঠিতে হাত বুলিয়েছি। মনে হচ্ছিলো ওখানে আমার আপনজনের স্পর্শ লেগে আছে। কিন্তু চিঠি পড়ে আমি আর ইউকে থাকতে পারছিলাম না। কারণ চিঠিতে লেখা ছিলো আমার মায়ের হার্ট অ্যাটাক করেছে। মা আমাকে দেখতে চেয়েছে। আমার তখন খুব ইচ্ছে করছিলো এক ছুটে বাংলাদেশে চলে এসে মাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। মায়ের অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর প্রতি মুহুর্তে মায়ের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফিরে। আমার বাবা প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির সুবাদে আমাকে আর সাজিদকে তেমন সময় দিতে পারতেন না। কিন্তু মা আমাদের ভাইবোনের সাথে ছায়ার মতো ছিলেন। আমার মা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিলেন। সাইন্সের স্টুডেন্ট হওয়াতে আমি আর সাজিদ মায়ের কাছেই পড়াশোনা করতাম। সেদিনের সেসব স্মৃতি আমার সারাক্ষণ হতে লাগলো। আজকের এই আমি যেন সেদিনকার মায়ের পরিশ্রমের ফসল। আল্লাহপাক মানুষের রিজিক বরাদ্দ করে দেন। কিন্তু আল্লাহপাক রিজিকের সন্ধানও করতে বলেছেন। আমার মা সেই রিজিকের সন্ধানে আমাদের সহায়তা করেছেন।
আমার ভিতরে একধরনের ডিপ্রেশন শুরু হলো। কেন যেন মনে হলো আমি মনে হয় মাকে আর দেখতে পাবো না। তাই আহসান তখন কি করতো বা জেনিফারকে নিয়ে কোথায় যেতো এগুলো তখন আর আমি খেয়াল করতাম না। আর এই ডিপ্রেশন আহসান আর জেনিফারের জন্য শাপে বর হলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে