কাঁচ কাটা হীরে পর্ব-০১

0
1361

#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

আমি ব্যারিষ্টার সায়মা রহমান। উত্তরা আট নম্বর সেক্টরে এক ছেলে আর বউমা নিয়ে আমার সুখের সাজানো সংসার। আমার ছেলে ইউনাইটেড হাসপাতালে আইসিইউ তে মেডিকেল অফিসার হিসাবে কর্মরত। পাশাপাশি এমডি কোর্সে আছে। বৌমা স্কলাস্টিকা স্কুলে টিচিং প্রফেশনে আছে। আল্লাহপাকের অপার মহিমায় একসময় ভেঙ্গেচুড়ে যাওয়া আমার সংসারটি এখন জান্নাতের বাগানে রুপান্তরিত হয়েছে। এই শোকরিয়া আদায় করে আমি শেষ করতে পারবো না।
আমার ছেলের আজকে নাইটডিউটি। আমি বেশ বুঝতে পারছি পাশের রুমে আমার বৌমা নীলা কাঁদছে। কাঁদারই কথা। বড় মুখ করে আমার কাছে একটা আবদার করেছিলো। কিন্তু সে আব্দার আমি মঞ্জুর করিনি। কারণ চুন খেয়ে যখন কারো একবার মুখ পোড়ে তখন দই দেখেও যে ঐ মানুষটা চমকায়?ওদের বিয়ে হয়েছে তিনবছর। আমার ছেলে ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস কমপ্লিট করেছে। বৌমা ঢাকা ভার্সিটি থেকে ইংরেজীতে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। সেই থেকে ওদের পরিচয় তারপর প্রেমের চুড়ান্ত পরিনতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।
আমার বৌমাটি খুব লক্ষী। ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে। মানুষকে খুব বিশ্বাস করে। অনেকটা আমারই মতোন। আমি একসময় মানুষকে খুব বিশ্বাস করতাম। তারপর প্রচন্ড বিশ্বাসের মানুষটা যখন আমাকে অবিশ্বাসের চোরাবালিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো তখন থেকেই অন্তত মানুষকে বিশ্বাস করতে আমার বড্ড ভয়। একটা পশুকে যখন আমরা আদর যত্ন করি সেও বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু একজন মানুষের বিশ্বাস ভাঙ্গতে একমুহুর্ত সময় লাগে না।
আজ তাড়াতাড়ি ডিনার শেষ করেছি। মামুনের যেদিন নাইট থাকে ও বেড়িয়ে যাবার পরপরই আমরা শাশুড়ী বৌমা ডিনার সেরে ফেলি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ন,টা বাজে। কাল যেহেতু ছুটির দিন আমি জানি নীলা এখনও ঘুমায়নি। সারাসপ্তাহ ক্লাস থাকার কারনে মেয়েটা দৌড়ের উপর থাকে। ও ছুটির দিনের আগের রাতে বসে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখে। আসলে পেশাগত ব্যস্ততার কারনে মামুনটা ওকে একদম সময় দিতে পারে না। মাঝে মাঝে আমার সাথে একটু শপিং বের হয়। তখন আমরা দু,জনে একটা রেস্টুরেন্টে বসে কিছুটা টাইম পাস করে আসি। এ নিয়ে অবশ্য নীলার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ ডাক্তারদের ব্যস্ততা সম্পর্কে ওর ভালো জানা আছে। ওর বাবাও সরকারী ডাক্তার ছিলেন।
এখনও মনে হয় অভিমান করে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে। আমি কিচেনে গিয়ে দু,কাপ চা বানিয়ে বসার ঘরে রেখে এসে ওর রুমের দরজায় দুটো ঠোকা দিয়ে বললাম,
——নীলা তুমি জেগে আছো?
কোনো সাড়াশব্দ নেই। আবারও ঠোকা দিয়ে বললাম,
—–কাল তো ছুটি আছে। দু,কাপ চা বানিয়েছি। ড্রইং রুমে আসো। একসাথে চা খাবো।
আমি এ,কথা বলে বসার ঘরে গিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই খট করে শব্দ হলো। মনে হয় নীলা বের হলো। মুখ গোমড়া করে ড্রইংরুমে এসে আমাকে বললো,
——মামনি আমায় ডেকেছো?
——আসো, আমার একা চা খেতে ভালো লাগছে না। দু,জনে বসে একসাথে চা খাই।
ও চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে আমার মুখোমুখি সোফায় বসলো। আমি ওর মুখ দেখে ঠিক বুঝতে পারছি এতোক্ষণ ধরে ও কেঁদেছে। আসার আগে মুখটা ধুয়ে এসেছে। চোখদুটো এখনও বেশ লাল দেখাচ্ছে। আমিই নিরবতা ভঙ্গ করে ওকে বললাম,
—–খুব রাগ হয়েছে না তোমার আমার উপর?হওয়ারই কথা। আমেরিকা থেকে ছোটোবেলার বান্ধবী এসে তোমার কাছে দু,দিন থাকতে চেয়েছে। এ আর এমন কি? অথচ মামনি তোমার এই সামান্য আব্দারটুকু রাখতে পারলো না। তার মানে এই সংসারে তোমার চাওয়া পাওয়ার কোনো গুরুত্ব নেই। বান্ধবীর কাছে তোমার সম্মানটুকু রইলো না। ভাবছো মামনি কিভাবে তোমার সাথে এমন করলো? জানো বহুবছর আগে এক অবিশ্বাসের জলোচ্ছাস আমাকে এমন করে ভাসিয়ে নিলো যার ফলশ্রুতিতে মানুষকে বিশ্বাস করতে আমার ভয় হয়। সেই গল্পটাই আমি আজ তোমাকে শোনাবো। আমার এই গল্পটা আমি আজ অবদি আমার পেটের সন্তানকেও বলিনি। কেন বলতো? কারণ ও পুরুষ। ও হয়তো মায়ের এই বেদনার কথা জানলে কষ্ট পাবে কিন্তু তুমি যেভাবে বুঝবে ও সেভাবে বুঝবে না। আমরা দু,জনে যে নারী। তুমি তো জানো আমি ইউকে থেকে ব্যারিষ্টারী পাশ করেছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ল,তে অনার্স কমপ্লিট করে ইউকে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়েছি। আমার এই জার্ণিটা এতো সহজ ছিলো না। কারণ ওখানে গিয়ে আমাকে আবার বৃটিশ ল,কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে তারপর ব্যারিস্টারী পড়তে হয়েছে। ইংল্যান্ডে যাওয়ার বছর তিনেক পর দেশে এসে সবার অমতে মামুনের বাবাকে আমি বিয়ে করি। তখনও আমার ব্যারিস্টারী পড়া কমপ্লিট হয় নাই। তবে খন্ডকালীন চাকরি করে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছি।
সময়টা নব্বই এর স্বৈরাচারী আন্দোলন। ও তখন ছাত্র রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বাবা স্বরাষ্টমন্ত্রনালয়ে থাকার সুবাদে ওর কাজকর্ম সম্পর্কে ভালোই অবগত ছিলেন। একটা ঘটনার সুত্র ধরে ওকে ঢাকা ভার্সিটিতে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। দু,বছরের জন্য ওকে ঢাকাভার্সিটি থেকে বহিস্কারের আদেশ দেওয়া হয়। ও বাদে আমাদের ক্লাসের সবাই সেসময় ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেয়। আমিও ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। বছর তিনেক পর ইংল্যান্ড থেকে এসে ওকে বিয়ে করে আবার চলে যাই। তুমি তো জানো, আমার বাবা সিএসপি অফিসার ছিলেন। তখন বাবা অ্যাডিশনাল সেক্রেটারী হিসাবে স্বরাষ্ট মন্ত্রনালয়ে কর্মরত। বাবা আমার এই সিদ্ধান্তে প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে বলেছিলেন,”সায়মা তুমি জীবনে সবচেয়ে ভুল ডিসিশনটা আজকে নিলে। মানুষ চড়িয়ে খাই। তাই মানুষ চিনতে আমার ভুল হওয়ার কথা নয়”। তবে বাবা ওর পুলিশ ভ্যারিফিকেশনে ভুমিকা রেখেছিলেন। তাই ওর নামে রাজনৈতিক মামলাগুলো খুব তাড়াতাড়ি ডিসমিস করা হয়। পরবর্তীতে খুব তাড়াতাড়ি ভিসা করে আমরা ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। তবে ইউকে যাবার পর বাবা আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখেননি। না রাখারই কথা। কারণ ছাত্রী হিসাবে আমিও বাবার মতো প্রচন্ড মেধাবী ছিলাম। তখন তো এখনকার মতো জিপিএ ফাইভ ছিলো না। কিন্তু আমি ফাইভে, এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি। এসএসসি, এইচএসসি তে বোর্ডস্টান্ড করেছি। আমার পিছনে আমার বাবার কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। সেই মেয়ে যখন এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিলো তখন তো তার অভিমান হওয়ারই কথা। তবে যেদিন মামুনকে বুকে করে ইউকে থেকে শুন্য রিক্ত অবস্থায় দেশে ফিরে এসেছিলাম সেদিন বাবা আমায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলেন,”দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল অনেক ভালো। এ নিয়ে তুই মন খারাপ করবি না”। মা অবশ্য অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। কারন আমার মা বুঝেছিলেন ডিভোর্সী নারী হয়ে এসমাজে টিকে থাকা অনেক কঠিন। এতো মেধাবী একটা মেয়ের জীবনের এই দুর্ঘটনা উনি মেনে নিতে পারেননি। তাই আমি ইউকে থেকে চলে আসার দু,মাসের মধ্যে মা হার্টঅ্যাটাক করে না ফেরার দেশে চলে যায়। আসলে মা নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলেন না। কারন মাসতিনেক আগে মায়ের একবার হার্টঅ্যাটাক হয়েছিলো। সেই কারনে আমাকে তড়িঘড়ি করে ইউকে থেকে এসে মায়ের কাছে মাসখানিক থাকতে হয়। আর তখনি ঘটনাটা ঘটে।
আমি বিয়ে করে মামুনের বাবাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবার পর ওকে ও একটা ল,কলেজে ভর্তি করে দেই। তারপর আমাদের শুরু হয় কঠিন সংগ্রাম। একদিকে চাকরি অন্যদিকে পড়াশোনা। আমি ওর আগে ব্যারিস্টারী পাশ করে ফেলি। সাথে সাথে ভালো চাকরি পেয়ে যাই। আমি চাকরি পাবার পর আহসানকে আর তেমন কষ্ট করতে হতো না। খুব সুন্দর সাবলীলগতিতে আমাদের জীবনতরীটা বয়ে চলতে লাগলো। এর মাঝে মামুনের জন্ম হয়। আহসানেরও ব্যারিস্টারী কমপ্লিট হয়। ও ছিলো ওর মায়ের একমাত্র সন্তান। স্বাধীনতার যুদ্ধে ওর বাবা শহীদ হন। তাই ও ওর মাকে বছরে ছ,মাস নিজের কাছে এনে রাখতো। আমারও খুব ভালো লাগতো। এর মাঝে একদিন ঢাকা থেকে আমার আর ওর ফ্রেন্ড জেনিফার চিঠি পাঠায়। ও ইউকে আসছে ক,দিনের জন্য আমাদের সাথে থাকবে। তারপর নিজের একটা ব্যবস্থা করে চলে যাবে। আহসান নিজ মুখে কিছু বলেনি কিন্তু ওর বডিল্যাঙ্গুয়েজটা এমন ছিলো আমি যদি জেনিফারকে বাসায় থাকতে দেই তাহলে ও খুব খুশী হবে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে