কলঙ্ক পর্ব-১৪

0
1574

#কলঙ্ক
#১৪তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


ফাগুনের দিনগুলো বড়ই মধুর হয়। সেই মধুর এক বিকেলে আমার মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে লাগলেন এই জন্য যে আমার হবু বর মেহরাব মাকে বলেছে,’তূর্ণা আবার ঢাকায় যাবে।ওর অনার্স মাস্টার্স শেষ করবে। তারপর ওকে আমি বিয়ে করবো।আর হ্যা আরেকটা কথা আছে।ও কিন্তু আগের হোস্টেলেই থাকবে।’
মা চমকে উঠে বললেন,’এটা কীভাবে সম্ভব বাবা!আমরা তো মেয়েকে আর পড়াবো না!’
মেহরাব বললো,’কিন্তু আমি পড়াবো।’
‘তূর্ণার তো ইচ্ছে নাই পড়ার।সে আর পড়াশোনা করবে না।’
মেহরাব বললো,’শুনুন মা, তূর্ণা কিংবা আপনারা যদি আমার এই কথা না রাখেন তবে কিন্তু আমি পাড়ার সব মানুষের কাছে তূর্ণার বিষয়টা বলে দিবো।’
মা চমকে উঠে বললেন,’কী বলে দিবে বাবা?’
মেহরাব মুখ শক্ত করে বললো,’তূর্ণা একটা গোপন বিয়ে করেছিলো।আরো অনেক কিছু।’
মা এই কথা শুনে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না মেহরাব এই কথা কীভাবে জানলো।
মা কিছু বলতে যাবেন এর আগেই মেহরাব বললো,’মা,আশা করি আপনি আমার এই কথা রাখবেন।কথা না রাখলে আপনাদের সম্মান নষ্ট হবে, আমার না।আজ আমি যাচ্ছি।কাল সকাল বেলা আপনারা আমায় জানাবেন আপনাদের সিদ্ধান্ত।যদি রাজি হন তবে আমি নিজে গিয়ে তূর্ণাকে স্টেশন অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবো।’
মেহরাব এই কথা বলে চলে গেল।
মা বোকার মতো ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন ‌।

রাতের বেলায় আমার ঘরে হঠাৎ করে মা এলেন। তারপর আমার ঘরের দরোজা ভেজিয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে মা বসলেন। বসে আমার দিকে তাকিয়ে মা বললেন,’মেহরাব কী করে এসব জানে?’
আমি বললাম,’কী সব জানে?’
‘তোর গোপন বিয়ে।এবরোশন?’
আমি শান্ত গলায় বললাম,’আমিই বলেছি ওকে।’
মা রেগে গিয়ে বললেন,’কেন বলেছিস?’
আমি বললাম,’আমার মনে হয়েছে বলা প্রয়োজন তাই বলেছি।’
মা তখন আমার গালে শক্ত করে এক চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বললেন,’সারাটা জীবন অবোঝের মতো কাজ করলি।তোর মন যা চেয়েছে তাই করেছিস।সব নিজের ইচ্ছেতে।এতে ফল কী হয়েছে?কার ক্ষতি হয়েছে?বিপদ কার হয়েছে? তোর।এবারও নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছিস।’
‘বিপদের কথা বলছো কেন মা? বিপদের কী হলো?’
মা মুখ শুকনো করে বললেন,’মেহরাব কী বলে গিয়েছে তুই জানিস?’
‘কী বলে গেছে?’
‘তোকে আবার ঢাকায় যেতে হবে। হোস্টেলে উঠতে হবে। পড়াশোনা করতে হবে আবার।আর পড়াশোনা যদি না করিস তবে নাকি সে তোকে বিয়ে করবে না। মানুষের কাছে সবকিছু জানিয়েও দিবে।’
মার কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম।
মা এবার আমার প্রতি ক্ষীপ্ত হয়ে বললেন,’তুই হাসছিস?’
‘হুম হাসছি। তুমি কী ভেবেছিলে?আমি কাঁদবো?’
মার প্রচন্ড রাগ পেলো।মা বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে তরতর করে হেঁটে বাইরে চলে গেলো। তারপর আবার ফিরে এলো আমার কাছে। এসে রাগ মাখা গলায় বললো,’তুই কী ঢাকায় যাবি?’
আমি হেসে বললাম,’যাবো। আগামী পড়শুদিনই যাবো।’
‘ওই হোস্টেলেই উঠবি?’
‘হ্যা ওই হোস্টেলেই উঠবো।’
মা এবার সবচেয়ে বেশি চমকালেন।আর বললেন,’তো আগে চলে এসেছিলে কেন?’
‘আগে চলে এসেছিলাম কিন্তু এখন আর আসবো না!’
‘যদি আসিস?’
‘আসবো না।’
‘ফিরে আসলে কিন্তু কিছুতেই আমার কাছে আসা যাবে না!এই বাড়িতে তোর আর জায়গা হবে না!’
আমি জানি মা এসব কিছু আমার উপর অভিমান এবং রাগ থেকেই বলছে।মন থেকে একটা কথাও বলছে না।
আমি তাই শান্ত গলায়ই বললাম,’ফিরে আসলে তোমার কাছে আসবো না। সোজা বারহাট্টা চলে যাবো। একেবারে শশুর বাড়ি!’
মা এতো মন খারাপের মাঝেও হেসে ফেললেন। কিন্তু হেসে আবার মুখ আঁধার করে ফেললেন। তারপর মেঘ থমথমে গলায় বললেন,’তুই কী ভাবছিস তোর জন্য মেহরাব এতো দিন অপেক্ষা করবে?এই চার পাঁচ বছর?’
আমি বললাম,’হ্যা ঠিক তাই ভাবছি।সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।’
মা বললেন,’এটাও তোর ভুল ভাবনা।আমান তো তোকে মিথ্যে বলে দেশ ছাড়লো। আর মেহরাব করবে কী জানিস? তোকে ঢাকায় পাঠিয়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিবে!’
‘এমন করে বলছো কীভাবে?অত কনফিডেন্স?’
‘হ্যা এতো কনফিডেন্সই।আসলে মেহরাব তোর কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর সে এটা মেনে নিতে পারেনি। জগতের কোন ছেলেই পারবে না তার হবু স্ত্রীর এমন একটা অতীত মেনে নিতে। কিন্তু মেহরাব সবকিছু শোনার পর তোকে সরাসরি নাও করতে পারছিলো না। উপায়হীন হয়ে সে একটা গেইম খেলেছে তোর সাথে।আমান যেভাবে খেলেছিলো।আমান বলেছিলো, বিসিএস দিবো, যোগাযোগ রেখো না।এই কথা বলে উধাও।আর এই ছেলে বলেছে,ঢাকায় গিয়ে তোর পড়াশোনা শেষ করে আসলে পরে বিয়ে। কিন্তু মোদ্দাকথা সে খুব ভালো করেই জানে যে ঢাকায় থেকে তুই পড়াশোনাটা কিছুতেই কম্প্লিট করতে পারবি না!’
‘মা আমি পড়াশোনা কম্প্লিট করেই আসবো এবার।’
‘পড়াশোনা কম্প্লিট করবি ভালো কথা। কিন্তু মেহরাবকে পাবি না। মেহরাব অন্য একটা মেয়ে দেখে ঠিক বিয়ে করে নিবে!’
আমি মার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,’মা,এটা কী তোমার অনুমান নাকি মেহরাবের পক্ষ থেকে বলা কোন কথা?’
মা বললো,’অনুমান।আর আমার অনুমান শতভাগ সত্য।’
‘বাহ্। কিন্তু আমার কষ্ট লাগছে এই ভেবে যে তোমার এবারের এই অনুমান মিথ্যে হয়ে যাবে।’
মা তখন বললেন,’সত্য মিথ্যা নিয়ে আমি ভাবছি না তূর্ণা ভাবছি তোর জীবন নিয়ে। তূর্ণা তুই এতো বেকুব কেন রে মা?কেন এতো সহজ সরল তুই?কেন সবকিছু মানুষের কাছে অবলীলায় বলে দিস?কেন তুই মানুষকে অত সহজে বিশ্বাস করে ফেলিস? তূর্ণা,তুই জানিস না।জানিস না বলেই বিশ্বাস করে ফেলিস। জগতের সবচেয়ে বড় কষ্ট তার হয় যে কাউকে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে ফেলে!’
আমি মার দিকে তাকালাম।মার চোখ বেয়ে জল নামছে। মাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর ব্যথা হচ্ছে কেমন।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,’মা,বিশ্বাস এমন এক বস্তু যা মানুষকে জান্নাতেও পৌঁছে দিতে পারে। সুতরাং আমাদের বিশ্বাস করা উচিৎ।যার কোন কিছুতে বিশ্বাস নাই সে অসুখি মানুষ।আমি অসুখি থাকতে চাই না মা।আমি সুখি মানুষ হতে চাই!’
ঠিক তখন বাবা এসে ঢুকলেন ঘরে। তিনি খানিক সময় দাঁড়িয়ে থেকে থমথমে গলায় বললেন,’তূর্ণা, তোদের দু ভাই বোনের সব ইচ্ছে আমি পূরণ করেছি।মনে আছে একবার তোরা দু ভাই বোন আমার কাছে বায়না ধরলি তোদের জন্য সাইকেল কিনে দিতে হবে। তখন আমার সংসারই চলে না।স্কুলের বেতন নাই। তবুও তোদের জন্য সাইকেল কিনে দিলাম। কীভাবে কিনেছিলাম জানিস? আমার মা মৃত্যুর সময় আমায় রুপার একটা পিকদানি দিয়ে গিয়েছিলেন।এই পিকদানিটা আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল।বড় যত্নে রাখতাম এটাকে আমি। সেদিন সেই পিকদানিটা বিক্রি করে দিয়ে তোদের আবদার পূরণ করেছিলাম আমি। কিন্তু এবারের আবদারটা কিছুতেই পূরণ করতে পারবো না আমি।ঢাকায় তোকে যেতে দিবো না।আমি তোকে অন্য কোন ছেলে দেখে বিয়ে দিবো। বিয়ে তোকে দিবো এটাই আমার শেষ কথা।’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে