কলঙ্ক পর্ব-১৩

0
5260

#কলঙ্ক
#১৩তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


মেহরাব এলো বাবা ওদের বাড়ি থেকে আসার তিনদিন পর।ওর পরনে একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির উপর একটা ঘিয়ে রঙা চাদর।দেখতে ভীষণ সুদর্শন! অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার মতো ছেলে!
এই ছেলেকে দেখে কিছুতেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মনে হয় না। ওকে দেখে মনে হয় কল্পনার কোন রাজ পুত্তুর!সে যায়হোক এখন মূল গল্প বলি!
মেহরাব আসার পর ওর জন্য শরবত নিয়ে এলাম আমি।মা বললেন,’যা শরবত দিয়ে আয়।’
আমি এমন বোকা মেয়ে যে ওর হাতে শরবতের গ্লাস তুলে দিতে গিয়ে ঝট করে খানিক শরবত ফেলে দিলাম ওর পাঞ্জাবির উপর।
সে আমার দিকে তাকিয়ে খানিক হাসলো।
আমি বললাম,:সরি!’
মেহরাব বললো,’সরি কেন?’
আমি লজ্জা মাখা গলায় বললাম,’আপনার পাঞ্জাবি ভিজিয়ে ফেলেছি বলে!’
মেহরাব তখন সরাসরি আমার মুখের উপর বলে দিলো,’আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।’
তখন বাবা মা কেউ এখানে নেই।আমি এই সুযোগে বললাম,’আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।যা শোনার পর আমায় পছন্দ তো দূরের কথা এ বাড়ি ছেড়ে কখন পালাতে পারবেন সেই সুযোগ খুঁজবেন।আমি ভাবছি আপনাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে যাবো। ওখানে পুকুর পাড়ের সুপুরি বাগানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলবো। অবশ্য আপনাকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার আমার যথেষ্ট ভয় আছে। আপনি কী সাঁতার জানেন?’
মেহরাব অবাক হয়ে বললো,’পুকুর পাড়ের সাথে সাঁতারের কী সম্পর্ক?’
আমি বললাম,’সম্পর্ক আছে। আপনি যখন আমার মুখ থেকে কথাগুলো শুনবেন তখন শিউ্যর পুকুরে ঝাঁপ দিবেন।আর আসলে আমাদের পুকুরটা খুব গভীর। ওখানে ঝাঁপ দিলে সাঁতার ছাড়া গতি নাই।’
মেহরাব হাসলো।ওর দাঁত সরু এবং সাদা সাদা। সুন্দর মানুষের দাঁত হয় বাঁকা রোকা।ওর দাঁত সোজা। কোন ত্রুটি নেই।
সে হেসে বললো,’আপনি তো সাঁতার জানেন। আপনিই রক্ষা করবেন!’
আমি বললাম,’না। আমি সাঁতার জানলেও আপনাকে রক্ষা করবো না। আপনি সাঁতার জানেন কী না বলুন?’
মেহরাব আবার হাসলো। হেসে বললো,’গ্রামের সব ছেলে মেয়েরাই সাঁতার জানে। আমিও জানি।এমনকি আমার স্কুলের অনেক ছেলে মেয়েকেই আমি সাঁতার শিখিয়েছি!’
আমি আমতা আমতা করে বললাম,’তবে চলুন।’
মেহরাব বললো,’শিউ্যর।’

পুকুর পাড়ে ফাগুনের বাতাসে আম গাছের পাতা কাঁপছে। মুকুল থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ চড়াচ্ছে। মেহরাব বললো,’জায়গাটা দারুন!’
আমি বললাম,’আমার কথাগুলো শোনার পর স্বর্গকেও আপনার নরক মনে হতে পারে এই জায়গা তো তার তূলনায় নস্যি!’
মেহরাব খানিক চমকে উঠে বললো,’তাই!’
আমি বললাম,’হু।’
তারপর বলতে শুরু করলাম।
বললাম আমানের সাথে আমার সম্পর্কের কথা।গোপনে বিয়ে করার কথা। নিজের অনাগত সন্তানকে হত্যা করার কথা। ইউনিভার্সিটি হোস্টেলের ডাইনি পিয়ার কথা। এলিজার কথা। এবং আরো অনেকের কথা।
মেহরাব কথাগুলো শুনে কেমন কেঁপে উঠলো। সে তার চশমা খুলে আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো,’সবকিছু মেনে নিলেও একটা বিষয় কিছুতেই আমি মেনে নিতে পারছি না?’
আমি ভয়মাখা গলায় বললাম,’কোন বিষয়টা?’
মেহরাব বললো,’এবরোশনের ব্যপারটা!কেন এমন করলেন আপনারা?একটা পবিত্র জীবন।একটা নিস্পাপ জীবন কী করে শেষ করে ফেললেন আপনারা!’
আমি এই কথার কোন উত্তর দিতে পারি না। ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে।কান্না এসে যেতে চায়। কিন্তু কাঁদতেও পারি না!
মেহরাব তখন হুট করেই বললো,’আমি আপনাকে বিয়ে করবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।’
আমি চুপ করে রইলাম।
সে বললো,’কী শর্ত জানতে চাইবেন না?’
আমি বললাম,’বলুন।’
মেহরাব বললো,’আপনাকে আবার ফিরে যেতে হবে ঢাকায়। আবার পড়াশোনাটা রান করতে হবে।’
ওর কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ভয়ে কেঁপে উঠলো সমগ্র শরীর!কী সর্বনাশের কথা!এটা কোনভাবেই যে আর সম্ভব না।শুধু এই অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্যই যেখানে আমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছি আর উনি সেখানে বলছেন আমাকে আবার ঢাকায় যেতে হবে!
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’এটা কখনোই সম্ভব না!’
মেহরাব বললো,’কেন সম্ভব না?’
আমি বললাম,’আমি ওখানে গেলে এমনিতেই মরে যাবো।ওরা আমায় নিয়ে তামাশা করতে করতে আমায় শেষ করে দিবে!’
মেহরাব হাসলো। হেসে বললো,’আর এখন যদি আপনি ঢাকায় না যান তবে আপনার কী হবে জানেন? আপনি আর কাউকেই বিয়ে করতে পারবেন না।ইভেন বাড়িতেও থাকতে পারবেন না।কারণ আপনার সম্পর্কে আমি সবকিছু জেনে গেছি। এখন যদি আপনি আমার কথা না শুনেন তবে আপনার বিষয়ে জানা কথা আমি সবার কাছে বলে দিবো!’
মেহরাবের কথা শুনে আমার নিজেকে এতো অসহায় মনে হলো!আমি ওর দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে তখন বললাম,’মেহরাব,প্লিজ আপনি আমার সাথে এতো বড়ো নিষ্ঠুরতাটা করবেন না।আমি সহ্য করতে পারবো না!’
মেহরাব আবার হাসলো। হেসে বললো,’আমি আপনার সাথে নিঠুর আচরণ করছি না।আমি আপনাকে উপযুক্ত করতে চাচ্ছি।আমি আপনার মাধ্যমে এদেশের হাজার হাজার নারীকে একটা শিক্ষা দিতে চাচ্ছি।আমি আপনাকে একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছি।আমি চাই আপনি নারী জাগরণের নতুন দূত হোন।আমি চাই আপনি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হোন।আমি চাই আপনি আপনার ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটান।আমি চাই আপনি পরাজিত নয়,জয়ী হিসেবে আরেকবার গ্রামে ফিরুন। তারপর আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে।ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিয়ে হবে। এবং বিয়ের দিন আমি গলা ফাটিয়ে মানুষদের বলবো,আমি এমন এক মেয়েকে বিয়ে করছি যে ছিল তার সন্তান হত্যার সহযোগী।আমি আজ এমন এক মেয়েকে গ্রহণ করছি যে ছিল অন্যের স্ত্রী।আমি এমন এক মেয়েকে আমার নিজের করে নিচ্ছি যে অন্য একটা পুরুষের কাছে প্রতারিত হয়েছে। প্রতারিত মেয়েটা তার সহজাত মেয়েদের কাছে আরো বেশি প্রতারিত হয়েছিল, অবহেলা-অবজ্ঞার শিকার হয়েছিল। লজ্জিত হয়েছিল,কেঁদেছিল। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সে সংগ্রাম করে গিয়েছিল । সংগ্রাম করে সেই মেয়ে আজ সফল।সে আজ বিজয়ী।আমি আজ বিজয়ী এক মেয়েকে বিয়ে করছি,যে আজ সকল নারীর জন্য অনুপ্রেরণা!’
মেহরাবের এই কথাগুলো শুনে আমি ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলাম।আর আমি তখন বললাম,’আমি ঢাকা যেতে চাই। কিন্তু ওখানে পড়তে চাই না।অন্য একটা ইউনিভার্সিটিতে নতুন করে এডমিশন নিতে চাই। নতুন হোস্টেলে উঠতে চাই!’
মেহরাব বললো,’তাহলে আর এটা সংগ্রাম থাকবে না।সহজ কিছুই হবে।আর আপনাকে দেখে নারীরা অনুপ্রেরণাও পাবে না।আমি চাই আপনি সংগ্রাম করুন।যারা আপনাকে নিয়ে মজা করছে এক এক করে তাদের শিক্ষা দিন। আপনি যদি এক রাতে এলিজা আর তার বন্ধুদের শিক্ষা দিতে পারেন তবে অন্যদের কেন পারবেন না? অবশ্যই পারবেন।মনে রাখবেন,মালালা কিংবা রোকেয়া ওরা কেউই একদিনে হয়ে যায় না। কিংবা সংগ্রাম ছাড়াও এদের কেউ চিনে ফেলে না। এদের কথা কেউ স্মরণ রাখে না। একজন রোকেয়া কিংবা মালালা হতে গেলে বৈরী আবহাওয়াতেও আপনাকে উড়তে শিখতে হবে।উত্থাল সমুদ্রে সাঁতরাতে জানতে হবে। সাঁতরে ঝাপটে ওপারে যেতে পারলেই আপনি সফল। ওখানেই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য আলো।আজ যারা আপনাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করছে একদিন এই আপনাকে নিয়েই তারা গর্ব করবে। লোকেদের কাছে আপনার হোস্টেলের মেয়েরা কিংবা ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা বড় করে পরিচয় দিবে যে, আপনি ওদের কাছের কেউ। অর্থাৎ আপনার সফলতা ওদেরকেও আলোকিত করবে!’
মেহরাবের এতো সুন্দর সুন্দর কথার পরেও কিছুতেই না বলা যায় না। এমন আলোকিত একজন মানুষকে এভাবে ফিরিয়ে দেয়া যায় না। ফাগুনের বাতাস তখনও বইছে।সেই বাতাসে আমের মুকুল ঘ্রাণ চড়াচ্ছে।মেহরাবের পাঞ্জাবি তিরতির করে কাঁপছে। আমার শাড়ির আঁচল উড়ছে।কী যে ভালো লাগছে তখন।এই সময় ঠিক, মেহরাবের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,’মেহরাব,আমি আপনার শর্তে রাজি।’

___ প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত___


দ্বিতীয় অধ্যায় লিখবো আর মাস খানেক পর।আপাতত আমার পরীক্ষার জন্য লিখালিখি থেকে ছুটি নিচ্ছি। এতো দিন ধরে যারা কষ্ট করে আমার গল্প পড়েছেন তাদেরকে জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা। ভালো থাকবেন সবাই।আর আমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করবেন কিন্তু!
__*__*__

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে