কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৭+৮
আরশি খানিক জিরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকছিলো। তিরা বাধা দিয়ে বললো,
“একী তুই এখন রান্নাঘরে কেন যাচ্ছিস?”
“রান্না করতে যাচ্ছি।”
তিরা হাসি হাসি মুখ করে বললো,
“তুই বাজার থেকে এতো কষ্ট করে এলি। তুই রেস্ট নে। আজকের রান্না আমি করবো।”
আরশি অবাক হয়ে বললো,
“কে করবে?”
“কেন আমি।”
“আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে?”
“ধ্যাত! আমি কি একটা দিন আমার ভাইবোনকে রান্না করে খাওয়াতে পারি না?”
“পারিস কিন্তু ইতিপূর্বে এই ঘটনা কখনো ঘটেনি তো তাই হজম করতে কষ্ট হচ্ছে!
” তুই চুপচাপ বসে থাক। আজ রান্না আমি করবো।”
তিরা চলে গেলো রান্না করতে। আরশির হাতে কোনো কাজ ছিলো না তাই ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ বইটি পড়তে বসলো। পরীক্ষা ছিলো বলে বইটি এর আগে দু এক পাতা করে পড়েছে। এখন থেকে একদম মন ভরে পড়তে পারবে।
কাব্য মোটামুটি চিন্তায় পড়ে গেছে। এতদিন তার আরশিকে দেখতে ভালো লাগতো তাই দেখতো। কিন্তু আজ তাকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে এটা শুধুই ভালোলাগা না। সে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে আরশিতে। সারাদিন শুধু আরশির ভাবনাই ঘুরে ফিরে আসছে। আরশি কি তাহলে ভালো লাগার চেয়েও বেশিকিছু? কিন্তু আরশির তো তার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। অবশ্য থাকার কথাও না যেহেতু আরশি জানে তার বোন কাব্যর ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী। বোন যাকে পছন্দ করে আরশির মতো মেয়ে তার দিকে ফিরেও তাকাবে না এটাই তো স্বাভাবিক। তাই তার প্রতি তিরার আগ্রহটা কমাতে হবে। তিরাকে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে দিতে হবে কাব্য তার ব্যাপারে আগ্রহী নয়।
দুপুরে খেতে বসে আরশি তিরাকে বললো,
“কোত্থেকে শিখলি এতো ভালো রান্না?”
তিরা খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি ভালো হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“নাকি আমাকে খুশি করার জন্য বলছিস?”
“আরে না। সত্যি ভালো হয়েছে। এর আগে কখনো ভালো হয়েছে বলেছি?”
তিরা হেসে বললো,
“না।”
“আমি শুধু শুধু মিথ্যে বলিনা।”
“তা অবশ্য আমি জানি।”
“আচ্ছা তিরা এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“চল আমরা ভাবীকে একবার দেখে আসি৷ গতমাসে তো পড়া পড়া করে একবারও যেতে পারলাম না।”
“চল কবে যাবি?”
“কাল সকাল সকাল চলে যাব। সারাদিন ভাবীর কাছে থেকে রাতে ফিরে আসবো।”
“আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। একসময় তিরা বললো,
“আরু আমার একটা আবদার আছে। তোকে পূরণ করতেই হবে। মানে কোনোভাবে না করা যাবে না।”
“ও আচ্ছা! আজকের এই রান্নাবান্না তাহলে ঘুষ ছিলো?”
“হ্যাঁ।”
আরশি হেসে বললো,
“আচ্ছা বল কি কথা। সাধ্যের মধ্যে হলে আমার ছোট্ট বোনের আবদার অবশ্যই পূরণ করবো।”
“তোর সাধ্যের মধ্যেই।”
“আচ্ছা তো বল।”
“আমি আর তুই একটা ফটোশ্যুটে যাবো।”
“ধুর এইসব ছবি টবি তুলতে আমার একদম ভালো লাগেনা তিরা।”
“যাবিনা?”
“সাথে যেতে পারি তবে আমাকে ছবি তোলার জন্য জ্বালাবি না। তুই তুলিস।”
“থ্যাংকস আরু আমি জানতাম তুই আমার কথা ফেলতে পারবি না।”
“কোথায় যাবি ছবি তুলতে?”
“সেটা কাব্য ঠিক করবে।”
“ফটোগ্রাফার কি তোর কালা চণ্ডীদাস?”
“হ্যাঁ। দারুন ছবি তোলে কাব্য।”
“আমি যাবো না।”
তিরা অবাক হয়ে বললো,
“মাত্র না বললি যাবি?”
“তুই তো আগে বলিসনি যে ওই লোকিটার সাথে ছবি তুলতে যাবি।”
“তুই বারবার লোকটা লোকটা বলিস কেন? ওকে তো দেখতে আমাদের বয়সীই লাগে। বয়স তো জানিনা কিন্তু পড়াশুনার হিসেবে ও আমাদের থেকে ৩ বছরের বড় মাত্র।”
“সাড়ে তিন বছর হবে।”
“হোক। তুই ওকে আর একবারও লোকটা বলবি না খবরদার বলে দিচ্ছি।”
“আচ্ছা। আমি জানতাম না ওনার সাথে যাচ্ছিস তাই রাজী হয়েছিলাম। ওনার সাথে আমি কোথাও যাবো না।”
“কেন? ও কি তোকে খেয়ে ফেলবে?”
“না আমি যাব না কারণ ওনাকে আমি অপছন্দ করি।”
“অপছন্দ করার কারণ?”
“প্রথমত, সিগারেটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না। বেশিক্ষণ এই গন্ধের মধ্যে থাকলে আমার মাথাব্যথা হবে। তুই ভালো করেই জানিস আমার মাইগ্রেন আছে।”
“এর সমাধান আছে তুই দূরে দূরে থাকবি। আর কোনো কারণ আছে?”
“আছে। দ্বিতীয়ত, উনি প্রচন্ড অসভ্য। এতো অসভ্যতা তুই তো হেসে উড়িয়ে দিস কিন্তু আমি হজম করতে পারিনা।”
“ছেলেরা তো একটু অসভ্য হবেই। নাহলে সে ছেলে বোরিং।”
“এজন্যই আমি ছেলেদের সাথে মিশি না।”
“আচ্ছা ধর তোর এরেঞ্জ ম্যারেজ হলো। তোর স্বামী কাব্যর চেয়ে বেশি সিগারেট খায়। কাব্যর চেয়েও বেশি অসভ্য, তখন তুই কী করবি?”
“এরকমটা হওয়ার চান্স নেই কারণ আমি সব জেনেশুনেই বিয়ে করবো।”
“হাহ। এতো কথা আমি জানিনা। আমার সাথে যেতে হবে ব্যাস। আমি একা যেতে পারবো না ওর সাথে।”
“একা যেতে পারবি না কেন? তুই কি বাসরঘরেও ওর সাথে আমাকে নিয়ে যাবি?”
“ধুর কয়দিন টেকে তার নাই ঠিক আর তুই আছিস বাসরঘর নিয়ে!”
“তুই সেদিন বিধবা হওয়ার কথা চিন্তা করলি যখন আমি তোর বাসরঘরের কথা চিন্তা করলে সেটা খুব একটা বেশিকিছু না।”
“এত কথা শুনতে চাইনা আরশি। আমি ছবি তুলতে যাবো তোর আমার সাথে যেতে হবে।”
“আমি যাবো না।”
“তুই যাবি।”
“আমি যাবো না। তুই ভালো করেই জানিস আমি এক কথা একবার না বলে দিলে তা আর হ্যাঁ হয়না।”
তিরা হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরশি চুপচাপ খেতে লাগলো।
তিরা ও আরশিকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো রশ্নি। দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তোরা আসবি বললি না যে?”
তিরা বললো,
“সারপ্রাইজ!”
আরশি বললো,
“কেমন আছো ভাবী আম্মু?”
“ভালো। তোদেরকে খুব মিস করছি। অনেক কষ্ট হচ্ছে না তোদের?”
তিরা বললো,
“কষ্ট কোত্থেকে হবে? তোমার মত আরেকজনকে যে রেখে এসেছো। আরশি ঠিক তোমার মতো করেই সংসারটা সামলায় জানো?”
রশ্নি আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো
“তাতো হবেই। বাচ্চাটা কত লক্ষী।”
আরশি হাসলো। তিরা বললো,
“ওকে আর বাচ্চা বলোনা৷ এই বয়সেই সে বুড়ো হয়ে গেছে। একটা ফটোশ্যুটে যেতে বললাম। তার সেকী ভাব সে যাবেই না।”
“ওমা কেন আরশি যাবিনা কেন?”
“ওর কালা চণ্ডীদাসের সাথে ও যাক। আমি কেন যাবো?”
ভাবী অবাক হয়ে বললো,
“কালা চণ্ডীদাস টা কে আবার? তিরার বয়ফ্রেন্ড না কতো ফরসা।”
আরশি হেসে বললো,
“ওটা কবেই বাদ!”
রশ্নি হেসে বললো,
“এ আবার কে?”
তিরা বললো,
“ভাবী তুমি আরশির কথায় নাচছো? কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?”
“আচ্ছা সরি সরি ছেলেটা কে?”
“তুমি চেনো তাকে।”
“আমি চিনি! কে?”
“আমাদের নীচতলায় যে ভাড়াটে এসেছে সে।”
“ওমা কাব্য!”
“হ্যাঁ।”
“ছি ছি আরশি কাব্যকে তুই এভাবে পছাচ্ছিস? কতো সুইট একটা ছেলে!”
আরশি বললো,
“কীভাবে সুইট বলো এতো সিগারেট খায় যে আমার ওনাকে দেখলে ঘেন্না লাগে।”
রশ্নি হেসে বললো,
“হ্যাঁ তা একটু সিগারেট বেশি খায়। তবে ছেলেটা সত্যি ভালো। মনে নেই তোর ভাইয়া আর আমি যে সেইন্ট মার্টিনস আইল্যান্ড গেলাম? তখন কক্সবাজারে যতদিন ছিলাম ওদের বাসায়ই তো থাকতে হলো। তখনই কাব্যর সাথে পরিচয়।”
তিরা বললো,
“দেখেছিস ভাবী ঠিক চিনেছে ওকে। আর তুই হুদাই ওকে খারাপ প্রমাণ করার চেষ্টা করিস সবসময়।”
“খারাপ প্রমাণ করার চেষ্টা করবো কেন ও কি আমার শত্রু? আমার যা মনে হয় আমি শুধু তাই বলি।”
রশ্নি বললো,
“তবে তিরা ছেলে সিগারেট কিন্তু সত্যিই বেশি খায়। এক সন্ধ্যার এক্সাম্পল দেই শোন। আমরা বীচে যাব। আমি, সাহিল, অনন্ত, অনন্তর বৌ, কাব্য আর কাব্যর ছোটো ভাই অর্নব এই কয়জন বেরিয়েছি। অনন্ত গাড়ি বের করছে। গাড়িতে ওঠার আগে কাব্য বলে কি তোমরা ওঠো আমি একটা সিগারেট খেয়ে নিই, গাড়িতে উঠলে তো আর খেতে পারবো না। এরপর সিগারেট খেয়ে উঠলো। বীচে যেতে জাস্ট ১৫ মিনিট লেগেছে, গাড়ি থেকে নেমে আবার সিগারেট খেলো। আমরা এক ঘন্টা ডেক চেয়ারে বসে কাটালাম। আমি গুনেছি সে ওই এক ঘন্টায় ৫ টা সিগারেট খেয়েছে। এরপর গেছি কাঁকড়া খেতে। কাব্য বলে, তোমরা বসো অর্ডার দাও আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি। এরপর সিগারেট খেয়ে এসে কাঁকড়া খেলো। কাঁকড়া খেয়ে বেরিয়ে আবার সিগারেট খেলো। এরপর আমরা বার্মিজ মার্কেট ঘুরলাম, কেনাকাটা করলাম ততক্ষণে আরো দুটো খেলো। এরপর হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত গেলাম তখন আবার বলে, তোমরা ওঠো আমি একটা সিগারেট খেয়ে নিই। বুঝতে পারছিস এক সন্ধ্যায় সে কতগুলো সিগারেট খেয়েছে?”
তিরা চোখ বড় বড় করে বললো,
“ও ভাবী তাহলে তো সত্যিই বিপদ!”
“কীসের বিপদ? কচুর বিপদ। কাব্য কত দারুণ একটা ছেলে জানিস? আর ওর ফ্যামিলির মতো ফ্যামিলি সব মেয়ের স্বপ্ন। কাব্যর মা যে কতো অসাধারণ তুই কল্পনাও করতে পারবি না। এমন শাশুড়ী পেলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে যেকোনো মেয়ের। দুদিন থেকে আমি মায়ায় পড়ে গেছি। ওই সিগারেট একটা সমস্যা হলো? ছাড়িয়ে ফেলবি। সিগারেট খেলে চুমু খেতে দিবিনা। ব্যাস সিগারেট ও ছাড়বে ওর বাপ ছাড়বে।”
আরশি হেসে ফেললো। তিরার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো,
“ভাবী এইজন্যই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি। এইসব বুদ্ধি আমার মাথায় জীবনেও আসবে না।”
এরপর আরশিকে দেখিয়ে তিরা আবার বললো,
“আর তোমার এই বুড়ী বোরিং ননদের মাথায় তো আরো এসব বুদ্ধি আসবে না। ও এতদিন আমাকে শুধু ভয় দেখিয়েছে কাব্যর সিগারেট খাওয়া নিয়ে। ভালোবাসার কিচ্ছু বোঝেনা ও।”
রশ্নি আরশিকে টেনে বুকে নিয়ে তিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই এই খবরদার আমার ননদকে বুড়ী বোরিং বলবিনা। আমার ননদ যেমন আছে তেমনই খুব ভালো আছে। একদিন এক রাজপুত্র এসে ওকে ভালোবাসা বোঝাবে। তখন ও সব বুঝবে।”
তিরা গাল ফুলিয়ে বললো,
“ও এখন আমি পর হয় গেলাম।”
রশ্নি বুকের আরেক পাশে তিরাকে টেনে নিয়ে বললো,
“না তো। তুইও তো আমার ননদ। আমার তিরিং বিরিং ননদ।”
চলবে…
কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৮
রাতের বেলা আরশি ও তিরা বাড়ি ফিরলো। গেটের সামনে নামতেই দেখতে পেলো কাব্য গেটের ভেতরে, গেটে তালা দিচ্ছে। তিরা বললো,
“কাব্য তালা দিও না।”
কাব্য তাকাতেই দুই বোনকে দেখতে পেলো। আরশি ভাড়া দিচ্ছিলো। তিরা গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কাব্য ওদেরকে দেখে আবার তালাটা খুলে দিলো। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“কোত্থেকে এলে?”
তিরা বললো,
“ভাবীকে দেখতে গিয়েছিলাম। তুমি কোত্থেকে এলে?”
“অফিস থেকে। রশ্নি ভাবী কেমন আছে?”
“খুব ভালো আছে।”
“ভাবীর তো বোধহয় ডেলিভারির সময় হয়ে এসেছে তাই না?”
“আর দুমাস বাকী।”
কাব্য ও তিরা গেটের সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলো। আরশি ঢুকে যখন তালা দিচ্ছিলো, কাব্য অবাক হয়ে দেখতে লাগলো আরশিকে। ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ী বেড়াতে গেলেও কেউ এভাবে যায়? ভাল জামা পড়েছে ঠিকাছে কিন্তু কোনো সাজগোজ নেই? এইতো তিরা কত সুন্দর সেজেগুজে আছে। সাজলে তো মেয়েদের সুন্দর লাগে তাহলে আরশির কেন নিজেকে সুন্দর করার কোনো চেষ্টা নেই? তাও ভাগ্য ভালো চুলটা খোঁপা থেকে ঝুটিতে নেমেছে। কিন্তু বাকীসব এমন কেন? এত সুন্দর ঠোঁটে একটু লিপস্টিক অন্তত দিতে পারতো? লিপস্টিকেরা ধন্য হয়ে যেতো! ওই কাকচক্ষু জ্বলের দিঘির মত চোখে একটু কাজলের ছোঁয়া তো লাগাতে পারতো। কাজলেরা ধন্য হয়ে যেতো! পরক্ষণেই কাব্য ভাবলো ভালো হয়েছে আরশি সাজেনা। সাজলে তো আর নিজেকে রক্ষা করা যেতো না। এমনিতেই প্রতিবার দেখায় কেমন অস্থির অস্থির লাগে!
আরশি তালা লাগিয়ে আর অপেক্ষা করলো না। জানে তিরা এখন কাব্যর সাথে কথা বলবে তাই একাই উপরে চলে গেলো। কাব্য নিরাশ হলো। দাঁড়িয়েছিল কার জন্য আর হলো কী! কাব্য নিজের ফ্ল্যাটের দিকে যেতে যেতে বললো,
“কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছো যে? উপরে যাবে না?”
কাব্যর ফ্ল্যাটের সামনে থেকেই দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি শুরু হয়েছে। তিরাও কাব্যর সাথে সিঁড়ি পর্যন্ত গেলো। তারপর বললো,
“খুব খারাপ একটা খবর আছে কাব্য।”
“কী খবর?”
“আমাদের ফটোশ্যুটে যাওয়া হচ্ছে না।”
“কেন?”
“আরশি যেতে চাচ্ছে না।”
নীরবে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো কাব্য। আরশি যাবে না সেটা খারাপ খবর বটে। তবে তারচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে আরশি যাবে না বলে যাওয়াটাই ক্যান্সেল হলো। তিরার সাথে একা না যাওয়ার জন্য এখন অজুহাত তৈরি করতে হবে না। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“আরশি যাবে না কেন?”
“বোরিং মেয়েটা কোথাও যায় নাকি? আজকাল এমন মেয়ে দুনিয়াতে আছে বলো যার কিনা ছবি তুলতে ভালো লাগে না? আর কেউ না থাকলেও আমাদের আরশি আছে। ওর ছবি তুলতে ভালো লাগে না। বললাম যে ঠিকাছে তোর তুলতে হবে না তুই আমার সাথে চল শুধু তাও যাবেনা, যত্তসব! আরে বাবা সিগারেট কি দুনিয়াতে তুমি একা খাও? কত মানুষই তো খাচ্ছে। আরশি প্রতিদিন যে বাতাস গ্রহণ করছে সেই বাতাস কি সিগারেটের ধোয়ামুক্ত নাকি?”
কাব্য কিছুটা ভয় পেয়ে বললো,
“কেন আরশির কি সিগারেটে কোনো সমস্যা আছে?”
“হ্যাঁ ওতো সিগারেটের গন্ধ সহ্যই করতে পারে না। বেশিক্ষণ এই গন্ধের মধ্যে থাকলে বা ওর পাশে বসে কেউ সিগারেট খেলে ওর মাথাব্যথা হয়, মাইগ্রেনের ব্যথা। মাইগ্রেনের ব্যথা মাঝেমাঝে এমন প্রকট হয় যে আরু বমি করে দেয়।”
কাব্যর নিজেকে সাঁতার না জানা জলে পড়া কোনো প্রাণীর মত মনে হলো। প্রচন্ড হতাশ হলো। বললো,
“ও আচ্ছা। ঠিকাছে তুমি উপরে যাও তিরা। সারাদিন অফিস করে এসেছি তো, প্রচন্ড টায়ার্ড এখন আমি। ভেতরে গিয়ে রেস্ট নিই।”
“আচ্ছা কিন্তু বলো রাতে ফোন করলে বিরক্ত হবে না তো?”
কাব্য কাচুমাচু হয়ে বললো,
“আজ না তিরা। আমি প্রচন্ড টায়ার্ড। কাল কথা হবে।”
তিরা মন খারাপ করে বললো,
“ওকে।”
পরক্ষণেই তিরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো,
“এই কাব্য চিকেন খাবে? আমি নিজ হাতে রান্না করেছি।”
“নাহ আমি ডিনার করে এসেছি। আরেকদিন খাবো।”
“ওকে।”
তিরা উপরে চলে গেলে কাব্য ভেতরে ঢুকলো। লাইট ফ্যান চালিয়ে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললো। মোবাইল, সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার সেন্টার টেবিলের উপর রেখে ধুপ করে বসে পড়লো সোফায়। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ভাবতে লাগলো, তার মানে আরশি ও তার মাঝে বিশাল এক বাধা হয়ে দাঁড়াবে তার প্রাণের সিগারেট! ওকে পেতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে? সাথে সাথেই কাব্য ব্যথাতুর চোখে তাকালো সিগারেটের প্যাকেটের দিকে। প্যাকেট টি যেন কথা বলে উঠলো,
“ছি কাব্য এতো বছর ধরে আমি তোর সঙ্গী। তোর স্কুলের টিচারের বেতের বারি, বাবার বেল্টের বারি, মায়ের ডালঘুটনির বারি, দাদীর ঝাটার বারি, কোনোকিছুই আমাকে তোর থেকে আলাদা করতে পারলো না। আর আজ সামান্য একটা মেয়ের জন্য তুই আমাকে ছাড়ার কথাও ভেবে ফেলেছিস? এত পাষান তুই?”
কাব্যর বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো। মাথাটা খানিক ঠান্ডা হলো। এবার মাথাটা কাজ করতে লাগলো। আরশি অনেক ভালো অনেক লক্ষী একটা মেয়ে। ওর মতো হারামী আরশির যোগ্য না। তাছাড়া এমনও হতে পারে আরশি ওর সাময়িক মোহ। সুতরাং এতো বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কাব্য এখন থেকে দোয়া করবে আরশি যেন আরশির মতোই একটা লক্ষী ছেলে পেয়ে যায়। প্রয়োজনে সাহিল ভাইয়ার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে নিজে ছেলে খুঁজবে আরশির জন্য। তবে হ্যাঁ আরশির বিষন্নতার কারণ তো তাকে জানতেই হবে। বন্ধু হিসেবে নাহয় জেনে নেয়া যাবে কোনো একদিন। কিন্তু আরশি তো ওর বন্ধুও হবে না। এক কাপ চা হাতে ধরিয়ে সবসময় ভেতরে চলে গেছে। একসাথে বসে এক কাপ চাও কোনোদিন খায়নি। কারণটা এতদিন না বুঝলেও আজ বুঝতে পারছে। আচ্ছা তাহলে নাহয় বড় ভাই হিসেবে.. নাউজুবিল্লাহ সে আর যাই হোক আরশির বড় ভাই হতে পারবে না। এটা ভাবনাতেও অসম্ভব। সে নাহয় ভাইয়ের বন্ধুর ছোটোভাই বা প্রতিবেশী হিসেবেই একদিন জেনে নেবে ওই স্নিগ্ধ মুখের বিষন্নতার কারণ। ওটা তাকে জানতেই হবে! ফ্রেশ হয়ে রান্না বসাতে গেলো কাব্য। নাহয় খিদেয় পেট লেগে যাবে পিঠের সাথে।
রাত বেশি হয়নি কিন্তু ক্লান্ত থাকায় তিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আরশি তখনো ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ বইটি পড়ছিলো। পৃষ্ঠা ওলটাতেই একটা কাগজের বুকমার্ক পেলো। বুকমার্কটি হাতে বানানো। মজার ব্যাপার হচ্ছে বুকমার্কটিতে কিছু লেখা রয়েছে। আরশি আগ্রহ নিয়ে লেখাগুলো পড়লো। বইয়ের ওই পাতায় যে অংশটুকু আছে তা পড়ে কাব্য নিজের অনুভূতিগুলো বুকমার্কের উপরে লিখেছে। কাব্যর অনুভূতিগুলো আরশিকে অন্যভাবে ভাবতে শেখালো। দারুণ লাগলো ব্যাপারটা। আরশি তো এভাবে ভাবেনি। ধীরে ধীরে আরশি পরবর্তী পাতাগুলো চেক করলো। মাঝেমাঝেই এরকম বুকমার্ক দেয়া। সবগুলোতেই কিছু না কিছু লেখা। আরশি অন্য বুকমার্কগুলো আগেই পড়লো না। কাহিনীর সাথে না পড়লে মজা পাওয়া যাবে না। তাই তুমুল আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়তে লাগলো পরবর্তী বুকমার্কের অপেক্ষায়, সেটাতে কি লেখা আছে তা পড়ার জন্য।
আরশির যখন বইটি পড়া শেষ হলো তখন সকাল ৭ টা বাজে। তিরা তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। রশ্নি বাবার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে সাহিল সাধারণত বাইরে নাস্তা করে। কিন্তু আরশি ভাবলো জেগে যখন আছে আজ সাহিলের জন্য নাস্তা বানাবে। আরশি উঠে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে সাহিলকে ডাকলো খেতে আসতে। সাহিল অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিলো। আরশি নাস্তা বানিয়েছে শুনে বললো,
“তুই কষ্ট করে নাস্তা বানাতে গেলি কেন? অফিসের ক্যান্টিন থেকে তো প্রতিদিন খেয়ে নিই।”
“আজ জেগে ছিলাম ভাইয়া। তাই ভাবলাম বানিয়ে ফেলি।”
“আচ্ছা কষ্ট করে বানিয়েছিস যখন তখন খেয়েই ফেলি চল।”
খেতে বসে সাহিল জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবীকে কেমন দেখলি?”
“ভালোই তবে মনে হচ্ছে ভাবী আমাদের নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করে। আমি বুঝিয়ে বলেছি যে আমরা ভালো আছি। কতটুকু বুঝেছে তা অবশ্য জানিনা। তুমিও একটু বুঝিয়ে বলো।”
সাহিল খেতে খেতে বললো,
“বলেছি কাজ হয়না। যতদিন না সে নিজে আসছে ততদিন নিশ্চিন্ত হবে না। বাদ দে। পরীক্ষা তো শেষ এখন তিরার সাথে যাবি নাকি খুলনা?”
“কেন?”
“ঘুরতে।”
“না।”
“কেন? ফুপী বারবার বলছিল তোকে যাতে তিরার সাথে পাঠিয়ে দেই।”
আরশি নিজের প্লেটে খাবার নিতে নিতে বললো,
“ফুপী আমাকেও বলেছে তবে ভাইয়া আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আমি এ বাড়িতেই বেশ আছি। এখানেই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। আমি কোথাও যাবো না।”
আরশি খেতে শুরু করলো। সাহিল কিছুক্ষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। কি করলে যে আরশি একটু খুশি হবে তা বুঝে উঠতে পারে না সে। কোনো কিছুতেই আরশি পুলকিত হয়না, বিচলিতবোধ করে না। কোনো কিছুই যেন ওকে ছুঁতে পারে না। আরশি কি আর কখনোই স্বাভাবিক হবে না?
সাহিল চলে গেলে আরশি তিরাকে ডাকলো। কিন্তু তিরার ওঠার নাম নেই। আরশি বিছানার উপর পড়ে থাকা বইটা খুলে বুকমার্কগুলো আবার পড়লো। ব্যাপারটা দারুণ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে তার কাছে। বুকমার্কগুলো যখন আবার গুছিয়ে রাখছিলো তখন একটি বুকমার্ক সে খুঁজে পেলো না যেটা তার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিলো। হন্যে হয়ে বিছানা, বালিশ, খাটের নীচ সব জায়গায় খুঁজে ফেললো কিন্তু কোথাও পেলো না। এটা কোনো কাজ হলো? কারো এত সুন্দর সৃষ্টি এভাবে হারিয়ে ফেললো সে? এত দায়িত্বজ্ঞানহীন তো সে নয় তবে কীভাবে জিনিসটা হারিয়ে ফেললো! বইটা আজ ফেরত দিয়ে দেবে আর আজই এমন একটা ঘটনা ঘটলো! এরপর আর বই ধার আনার মত মুখ থাকবে না তার।
নিচে ঘুটঘুট শব্দ শুনে আরশি বুঝতে পারলো কাব্য জেগেছে। ঘড়িতে বাজে ৯ টা। খুব বেশি সকাল নয়। এখন একজন মানুষকে ফোন দেয়াই যায়। ফোন দিয়ে মাফ চেয়ে নেয়া উচিৎ। নাহয় বই ফেরত দেয়ার সময় খুব লজ্জা লাগবে। আরশি তিরাকে ডাকলো। তিরার ওঠার নাম নেই। বাধ্য হয়ে নিজেই তিরার মোবাইল থেকে কাব্যকে কল করলো। কিন্তু তিরার মোবাইলে ব্যালেন্স না থাকায় কল গেলো না। এবার নিজের মোবাইলে নাম্বারটা তুলে ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন ধরলো কাব্য,
“হ্যালো আসসালামু ওয়ালাইকুম। কে বলছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আরশি বলছি।”
কাব্য বিশাল আকারের একটা ধাক্কা খেলো। যে মেয়ে দেখা হলেও প্রয়োজন ছাড়া ওর সাথে কথা বলে না সেই মেয়ে ওকে ফোন করেছে! তার উপর আরশির কাছে ওর নাম্বার থাকার কথা নয়। তিরার কাছ থেকে নিয়েছে হয়তো। বিস্ময় ও কৌতূহল লুকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আরে আরশি! কি ব্যাপার কেমন আছেন?”
“ভালো আছি৷ তবে আমি একটা গন্ডগোল করে ফেলেছি।”
“কী হয়েছে?”
“মাফ করবেন আপনার ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ বইটিতে যে বুকমার্কগুলো ছিলো সেখান থেকে একটি বুকমার্ক আমি হারিয়ে ফেলেছি।”
“এটা কোনো ব্যাপার না। ওগুলো শুধুমাত্র সাময়িক মনের ভাব প্রকাশের জন্য লেখা। নিজের হাতের লেখার প্রতি আমার আবার খুব মায়া তাই রেখে দিয়েছি।”
“আইডিয়া টা দারুন।”
“থ্যাংকস। এটা আমার একটা শখ বলতে পারেন।”
“আপনি সত্যি রাগ করেননি তো? আপনার শখের একটা জিনিস হারিয়ে ফেললাম!”
“একদম না। আমার শত শত বইয়ের সবগুলোতেই এরকম বুকমার্ক আছে। শত শত বুকমার্ক লিখেছি। কোথায় কী লিখেছি এখন নিজেরও মনে নেই। সেখান থেকে দু চারটি হারালে কিছুই যাবে আসবে না। নিশ্চয়ই বুকমার্কটি ভালো কিছুর জন্যই হারিয়েছে।”
“মানে?”
“জানেন না যা হয় ভালোর জন্যই হয়?”
“হুম। ঠিকাছে রাখি তাহলে। ভালো থাকবেন।”
“আচ্ছা, আপনিও ভালো থাকবেন।”
ফোন রাখতেই কাব্যর চোখ পড়লো সিগারেটের প্যাকেটের দিকে। ওর মনে হলো প্যাকেট টা বলছে,
“ওরে মুখপোড়া হারামজাদা! আবার যাচ্ছিস ওদিকে!”
কাব্য বিরক্ত হয়ে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো। সিগারেটে একটা টান দিয়ে নাম্বারটা সেভ করলো।
চলবে…