কনফিউশন পর্ব ৩১+৩২

0
1434

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩১+৩২

বেশকিছুদিন ধরে তিরার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ঠিকমতো খেতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না। অবস্থা বেগতিক দেখে যাদিদ তার মাকে বলেছে তিরাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। তিরা যেতে চাচ্ছিলো না কিন্তু শাশুড়ী জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো। কোনো রোগ নেই তার, শরীর দুর্বল। ডাক্তারের কাছে গেলে কী হবে? যাদিদের কাছে গেলেই ঠিক হয়ে যেতো সব। অবশ্য মাঝেমাঝে তার মনে হয় মানসিক ডাক্তারের কাছে গেলে সম্ভাবত কাজ হবে। পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেছে সে। তার ইদানীং মনে হয় যাদিদ যাদিদ করেই সে মরবে। রাত্রেবেলা শুয়ে থেকে যাদিদের ফোনের অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে মাঝরাতে তিরা নিজেই ফোন করলো। প্রথমবার রিসিভ হলো না, দ্বিতীয়বারও রিসিভ হলো না। এবার খানিকটা চিন্তাই হচ্ছিলো। তিরা একটানা ফোন করতেই লাগলো। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে ঘুমন্ত কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
“হ্যালো তিরা।”
তিরা খানিকটা অবাক হয়ে বললো,
“তুমি ঘুমুচ্ছো যাদিদ?”
“হুম।”
“হাও ইজ ইট পসিবল?”
যাদিদ চোখ ডলতে ডলতে বললো,
“হোয়াট?”
তিরা রেগে গিয়ে চিৎকার করলো,
“তুমি আমার সাথে কথা না বলে কী করে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে? তুমি জানো প্রতিদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করি। তোমার সাথে কথা না বললে আমার ঘুম আসেনা।”
যাদিদের মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হলো। কিন্তু সে তিরাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“আই ওয়াজ টায়ার্ড তিরা। প্রতিদিনই তো আমি সময়মতো ফোন করি। ঘুমানোর আগে অনেকক্ষণ কথা বলি৷ একদিন নাহয় কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়েছি তাই বলে তুমি এভাবে রিয়াক্ট করবে?”
“অবশ্যই রিয়াক্ট করবো। তুমি জানো আমি তোমার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ঘুমুতে পারিনা। আমি জেগে বসে রয়েছি তোমার ফোনের অপেক্ষায়। আর ওদিকে তুমি নাক ডেকে ঘুমুচ্ছো! একবার আমার কথা ভাবলে না? আমার সাথে কথা না বলে তোমার ঘুম আসে কীভাবে? আমি তো ভাবতেই পারছি না।”
যাদিদ এবার সত্যি অবাক হলো৷ রাগের চেয়ে বেশি যেটা হলো সেটা হতাশা।
“তিরা তোমার আমার সম্পর্ক কি শুধুই ফোনে কথা বলার?”
“যাদিদ ত্যাড়া কথা বলবে না। এতোটা স্বার্থপর তুমি ছি!”
এবার যাদিদ একটু কঠিন হলো,
“শোনো তিরা সম্পর্ক যদি শুধুই ফোনে কথা বলা আর দেখা করার হয় তাহলে এই সম্পর্ক রাখার দরকার নেই৷ ইউ ক্যান ডিভোর্স মি।”
এবার তিরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো,
“এতবড় কথাটা তুমি বলতে পারলে যাদিদ?”
“এছাড়া আর কি বলবো? একদিন কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়েছি, এই ছোটো ব্যাপারটাকে তুমি এতবড় ইস্যু করে ফেলেছো যে ঘুম থেকে উঠিয়ে চেচামেচি করছো আমার সাথে। ইটস হার্টিং মি। তুমি কথা না বলে ঘুমাতে পারো না এটা তোমার সমস্যা, আমার তো এধরনের সমস্যা নেই। বিয়ের পর থেকে শুধু অভিযোগই শুনে যাচ্ছি। আমি কি কোনো অভিযোগ করেছি? তুমি শুধুই নিজেরটাই বোঝো তিরা। উল্টোপাশের মানুষের অবস্থা সম্পর্কে বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই। তোমার একদম উচিৎ হয়নি এখন বিয়ে করা। তোমার এখন রমরমা প্রেম করার সময়। রমরমা প্রেম মানে বোঝো? মানে হচ্ছে সারারাত কারো সাথে কথা হবে, প্রতিদিন দেখা হবে। এমনটা চাই এখন তোমার।”
তিরা চিৎকার করে উঠলো,
“যাদিদ মুখ সামলে কথা বলো।”
ওদিকে যাদিদও চিৎকার করলো,
“শাট আপ, আগে নিজেকে সামলাও স্টুপিড গার্ল।”
যাদিদ ফোন কাটলো এবং বন্ধ করে রেখে দিলো। তিরা আবার ফোন দিলো, বারবার ফোন দিলো। কিন্তু ফোন বন্ধ। তিরা কান্নায় ভেঙে পড়লো। যাদিদের কাছে থেকে এরকম ব্যবহার মেনে নিতে পারছে না। সে যাদিদের বিয়ে করা বউ। এই বাজেকথা গুলো না বললেই কি হতো না? বিয়ের পরের প্রথম ৫ দিনের যাদিদ আর এই যাদিদ কি এক মানুষ?

যাদিদ ফোন বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলো। রাগে মাথাটা এতো গরম হয়ে রইলো যে সারারাতে আর ঘুমাতে পারলো না। রুমে ফিরে নিজের কাপড়টাও বদলায়নি সে, রাতে খায়নি পর্যন্ত। ভেবেছিলো তিরার সাথে কথা বলা শেষ করে তারপর খাবে। কিন্তু তিরাকে ফোন করবে বলে বিছানায় শুয়ে ফোন হাতে নিয়েই ঘুম। কখন ঘুমিয়েছে নিজেই টের পায়নি। এরপর ফোনটা হাত গড়িয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলো। এজন্যই তিরা এতোবার কল দেয়ার পরেও প্রথমে টের পায়নি যাদিদ। তিরার ব্যবহারে আজ সত্যিই হতাশ সে। একটা মেয়ে যে তার বিয়ে করা বউ, সে কেন তাকে বুঝতে পারবে না? ঘুম কীভাবে একটা অপরাধ হয়? ভালোবাসার মানুষ ঘুমালে তো বরং শান্তি লাগার কথা। সে তো তিরার দিকটা বুঝে বিয়ের পর থেকে প্রতিদিন তার অনেক পাগলামি সহ্য করে এসেছে, তাহলে তিরা কেন একদিন তার দিকটা বুঝতে পারবে না?

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩২

রশ্নি রান্না করছিলো। আরশি পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাবি আমাকে একটা হলুদ শাড়ি কিনে দেবে? সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ বানিয়ে দিতে হবে।”
শাড়ি আরশি নিজেও কিনতে পারে। কিন্তু রশ্নিকে বললে সে যে খুশিটা হবে সেটা মিস করতে চায় না আরশি। ননদের কথা শুনে রশ্নি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
“তুই শাড়ি পরবি?”
“হুম।”
“সত্যি! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা।”
আরশি হাসলো৷ রশ্নি বলল,
“আজ বিকেলেই যাব শাড়ি কিনতে।”
“আচ্ছা।”
রশ্নির যেন তর সইছিল না। দুপুরে খাওয়ার পরেই তৈরি হতে লাগলো। আরশি বলল,
“এত তাড়া নেই তো ভাবি।”
“অবশ্যই তাড়া আছে। ব্লাউজ বানাতে হবে না?আমার কতদিনের শখ তোকে শাড়ি পরা দেখব! যা যা তৈরি হয়ে নে।”

আরশি একটা বাদামী পাড়ের হলুদ শাড়ি কিনলো। তারপর ব্লাউজ বানাতে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরে ননদ ভাবি দুজনে মিলে শাড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। ঠিক তখন রশ্নি বলল,
“আমি কিন্তু আজও জানলাম না ছেলেটা কে?”
আরশি বুঝেও না বোঝার ভান করল,
“কোন ছেলেটা?”
রশ্নি হেসে বলল,
“যার জন্য অসম্ভব সম্ভব হতে চলেছে।”
আরশি হেসে বলল,
“হবে কেউ একজন।”
“আমি জানতে পারি না?”
“জানাব। যেদিন সে তার ভালোবাসার কথা আমাকে বলবে সেদিন আমি তোমাদের সবাইকে জানাব। তার আগ পর্যন্ত সে নাহয় শুধু আমার ভেতরেই থাকুক।”
“ঠিকাছে তোর যখন ইচ্ছে হবে বলিস। আমি অপেক্ষায় থাকব।”

তিরা আরো একটা নির্ঘুম রাত পার করে সকালে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখনই ফোনটা এলো। কাব্য ফোন করেছে। তিরা ফোন ধরে বলল,
“একী! এ কে ফোন করেছে আমাকে?”
“তোমার আব্বাজান।”
তিরা হেসে বলল,
“তা আব্বাজান হঠাৎ মেয়েকে মনে পড়ল?”
“আমি সুইডেন চলে যাচ্ছি।”
“ওমা তুমি আবার বিদেশে যাবে কেন?’
“পিএইচডি করতে।”
“বাবা রে এত পড়াশোনা করে কী করবে?”
কাব্য হেসে বলল,
“নাথিং।”
“আমার তো গ্রাজুয়েশন টাও আর করতে ইচ্ছা করে না।”
কাব্য আবারো হেসে বলল,
“আচ্ছা শোনো যে কারণে ফোন দিয়েছিলাম সেটা বলি।”
“বলো।”
“যাওয়ার আগে একবার দেখা হলে ভালো হতো না? এসোনা একবার ঢাকা। তুমি আমি আরশি আবার একসাথে, বেশ মজা হবে।”
“আরশিও অবশ্য অনেকবার আমাকে বলেছিলো ঢাকা যাওয়ার জন্য।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো, দুজন মানুষের কথা তো আর ফেলে দেয়া যায় না। চলে এসো।”
“কবে যাবে তুমি?”
“এই মাস এবাড়িতে আছি। এরপর বাসা ছেড়ে কক্সবাজার চলে যাবো। নেক্সট মান্থের লাস্ট উইকে ফ্লাইট। শেষ কদিন তো বাড়িতেই থাকতে হবে।”
“আচ্ছা তার মানে আসলে এই মাসেই আসতে হবে।”
“হ্যাঁ।”
“আমার অবশ্য কোনো পিছুটান নেই। গেলেই যেতে পারি। আমার স্বামী সংসার এসব হচ্ছে নামকোবাস্তে!”

আরশি সকালে গাছে পানি দিতে দিতে কাব্যর জানালায় উঁকি দিলো। কাব্য বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আজ অফিস নেই নাকি! আরশি হাতে পানি নিয়ে কাব্যর মুখে ছিটিয়ে দিলো। কাব্য সাথে সাথে চোখ মেলে তাকালো। ঘুম চোখে আরশিকে জানালায় দেখে হাসলো। বলল,
“গুড মর্নিং।”
“গুড মর্নিং। এখনো ঘুমুচ্ছো যে অফিস নেই?”
“আজ ছুটি নিয়েছি, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।”
“সেকী! জ্বর নাকি?”
“নাহ।”
“এদিকে এসো দেখি।”
কাব্য উঠে হাই তুলতে তুলতে জানালার কাছে গেলো। যেহেতু বাসাটা একটু উঁচু, ওদিকে আরশি দাঁড়িয়ে আছে বাগানে নিচুতে তাই কাব্য হাটু গেড়ে বসলো। আরশি জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে কপালে হাত দিল। এরপর বললো,
“জ্বর নেই তো।”
“আমি জানি।”
“ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও।”
“তোমার বাগানের কাজ শেষ?”
“নাহ। শেষ করে আসছি, বই নেব।”
“ওকে।”

কাব্য ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। চা বসিয়ে প্যানকেক বানানোর প্রস্তুতি নিলো। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আরশিকে দেখা যায়। সে এখন বিভিন্ন গাছের মাটি নিড়িয়ে দিচ্ছে। চুলগুলো একটা খোঁপা করা কিন্তু সামনে কিছু চুল বেড়িয়ে এসে বারবার চোখের উপর পড়ছে। আরশি বারবার মাটিমাখা হাতের উল্টোপিঠের সাহায্যে চুলগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে। কাব্য একটা শিষ দিতেই আরশি তাকালো। ইশারায় জানালার কাছে আসতে বলল। আরশি ওই অবস্থাতেই জানালার কাছে এসে বলল,
“কী?”
কাব্য জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে অবাধ্য চুলগুলোকে আরশির কানের পাশে ভালো করে গুঁজে দিল। আরশি আচমকা কেঁপে উঠলো, সুড়সুড়ি লাগলো কিন্তু কিছু বলল না। ভাললাগাটা খুব বেশিই ছিলো। কাব্য বলল,
“যাও কাজ শেষ করে এসো।”
আরশি কাজ করতে করতে ভাবছিলো কাব্য এতো খেয়াল করে কীভাবে? সারাক্ষণই কি তাকিয়ে থাকে তার দিকে?
আরশি কাজ শেষ করে সোজা কাব্যর রান্নাঘরে চলে এলো। কাব্য বলল,
“আচ্ছা এইযে তুমি হুটহাট আমার বাসার ভেতরে চলে আসো তোমার ভয় করে না?”
“তোমাকে কীসের ভয়?”
“ভয় আমাকে না, ধরো ভাবি যদি দেখে ফেলে?”
“দেখে ফেললে কিছুই হবে না, বলে দেব সব। আর আমার আসাতে যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে সরাসরি বলতে পারো। আর আসবো না।”
কাব্য শেষ প্যানকেকের গোলাটুকু হাতের সাহায্যে প্যানে ঢেলে দিলো। তারপর মাখা হাতটা আরশির গালে মুছে দিয়ে বলল,
“আসতেই হবে। সকাল বিকেল বারবার।”
আরশির মনে হলো এক্ষুণি তার দমবন্ধ হয়ে যাবে। তারপর আবার দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
“এহহে এটা কী করলে?”
কাব্য কেকের গোলাগুলো আরশির গালে লেপ্টে দিতে দিতে বলল,
“স্পেশাল গালকেক!”
আরশি এবার হেসে ফেলল। কাব্য বলল,
“অবশ্য বেক হওয়ার জন্য গালটাকে গরম করতে হবে।”
আরশি কাব্যর হাতের বাহুতে থাপ্পড় মেরে বলল,
“অসভ্য কোথাকার।”
কাব্য হেসে বলল,
“কেন আমি কি বলেছি আমি গরম করব?”
“উফফ।”

আরশি এবার প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। বেসিনের সামনে গিয়ে গালটা ধুতে ধুতে ভাবছিলো,
“কি দারুণ হতো যদি এই স্পেশাল গালকেকটা ধুয়ে না ফেলতে হতো? যদি সারাজীবন রেখে দেয়া যেতো!”

কাব্য দুজনের জন্য চা ও প্যানকেক ট্রেতে সাজিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো। আরশি তখন বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যু দিয়ে গাল মুছছে। কাব্য বলল,
“এসো আমার সাথে খাও একটু।”
আরশি পিরিচ দিয়ে চা ঢেকে রেখে একটা প্যানকেক তুলে নিল। কামড় দিয়ে বলল,
“তুমি প্যানকেক জিনিসটা এতো ভাল বানাও কী করে বলোতো?”
“কাব্য খেতে খেতে বলল,
“প্রাকটিস। আচ্ছা আজ কী বই নেবে?”
“হিমুর বই, তুমি বেছে দাও। নীলপদ্মর মতো ভাল বই দেবে। কি পিচ্চি পিচ্চি বই! একসাথে কয়েকটা দাও।”
“যোহুকুম।”
কাব্য খেতে খেতেই বইগুলো বের করল। আরশি কোনোমতে চা শেষ করেই বলল,
“আচ্ছা আমি উঠি। বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আরশি বইগুলো নিয়ে চলে গেল। কিন্তু কাব্য তখনো আরশির গালে কেকের গোলা লেপ্টে দেয়ার মুহুর্তটায় বুঁদ হয়ে রইলো!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে