#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব – ১৬ ||
এভাবে প্রায় কিছুদিন যীনাত সেই ছেলেটাকে নিজের পিছু নিতে দেখেছে। একদিন তো ছেলেটা কোনোরকম কথা ছাড়াই যীনাতের হাত ধরে টেনে কোথাও নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। যীনাতের ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেছিলো তাই রেগে এক চড় মেরে দিয়েছিলো ছেলেটাকে।
– কে আপনি আপনার সাহস কি করে হয় আমার হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার। মেয়ে মানুষ দেখলে কি গায়ে পরতে মন চায়? চরিত্রহীন লোক একটা!! এতোদিন ফলো করছিলেন আর আজ কিনা… ছিহ!!!
বলেই পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলো ওমনি ছেলেটা আবার যীনাতের হাত ধরে আটকায়। ছেলেটার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট!
– খুব তেজ না তোর? তুই আমার বুঝলি তুই শুধু আমার। আর সেই আমাকেই চড় মেরে অপমান করেছিস? তোকে ছুয়েছি বেশ করেছি আরও ছুবো দেখি তুই কি করতে পারিস।
বলেই জোরজবরদস্তি করে একটা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে কোনো এক জায়গায় চলে গেলো।
★
যীনাতকে একটা ফার্মহাউজে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আর যীনাত তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পরে গেলো। ছেলেটা পাগলের মতো হেসে বলে,”তুই আমার যীনাত এই কিশোর নারায়ানের! তোকে এতো জলদি ছেড়ে দিবো ভাবলি কি করে? আজ তোকে ৭জম্ম সামনে রেখে বিয়ে করবো!
যীনাত উঠে দাঁড়িয়ে আবার চড় মেরে বসলো কিশোরকে! এবার কিশোর রাগ সামলাতে না পেরে যীনাতকে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে আরেক চড় মারে। যীনাত তাল সামলাতে না পেরে আবার ফ্লোরে পড়ে যায়। এতোটাই জোরে ছিলো চড় টা যার কারণে ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে যায়। কিশোর এবার যীনাতের মুখোশ টান দিয়ে ছিড়ে ফেলে যার ফলে মুখোশে থাকা কিছু পিন যীনাতের কানে, গালে আর মাথায় ঢুকে ঢুকে বেরিয়ে যায়। যীনাত যন্ত্রণায় “আল্লাহ” বলে চিৎকার করে। কিশোর পাগলের মতো হেসে বলে,”যতো পারিস চেচা আজ তোর আল্লাহও তোকে আমার হাত থেকে বাচাতে পারবে না আর না ওই ওয়ারদূন আসরার!”
‘ওয়ারদূন আসরার’ শুনে যীনাত থমকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো কিশোরের দিকে। কিশোর কি করে জানলো ওয়ারদূন আসরারের কথা? যীনাতের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে হাসতে হাসতে বলে,”তুই কি ভেবেছিস আমি কিছুই জানিনা? হাহা আমি সব জানি তাইতো তোকে বিয়ে করে আপন করতে চাই! এতে করে তুইও আমার হয়ে গেলি সাথে সেই ওয়ারদূন আসরারের শক্তিও আমার”
– জীবনেও না তোর মতো জানোয়ারকে কোনোকালেই বিয়ে করবো না। আর না ওই ওয়ারদূন আসরার তোকে দিবো! তুই মরবি জানোয়ার মরবি তুই!
কিশোর হেসে পকেট থেকে মরিচের গুড়া বের করে যীনাতের ক্ষতগুলোতে চাপ দিয়ে ধরলো। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে যীনাতের গোঙ্গানি ছাড়া আর কোনো শব্দই যেনো আসছে না। যীনাতের আর্তচিৎকার যেনো চার দেয়ালের সাথে ক্রমশ বারি খাচ্ছে আর জোরে জোরে প্রতিধবনি সৃষ্টি হচ্ছে। যীনাত এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেলো। কিশোর হাসতে হাসতে যীনাতের মাথার কাছে হাটু গেড়ে বসে কিছুটা ন্যাকামি করে বলে,”আহারে আমার জানটা কতো কষ্ট পাচ্ছে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি জান কিন্তু কি করার বলো তুমি-ই তো আমাকে রাগিয়ে দাও। যদি ঠিকঠাক ভাবে বিয়েতে রাজি হয়ে যেতে তাহলে তো তোমার এই হাল হতো না বলো।[এবার নিজের চোখমুখ ক্রমশ লাল করে বলা শুরু করে] তুই আমার না তো কারো না। আর ওই ওয়ারদূন আসরার আমার চাই। তোকে দেখেই আমি বুঝে ফেলি তোর কাছেই ‘ওয়ারদূন আসরার’ দেখেছিস আমি কতোটা পাক্কা খেলোয়াড়? সর্দার কে এই ওয়ারদূন আসরার তুলে দিতে পারলেই সে আমাকে আমার কালোজাদুতে আরও শক্তিশালী করে ফেলবে এবং আমি শয়তানের খুব কাছাকাছি যেতে পারবো!!”
বলেই জোরে জোরে হাসতে থাকলো। পরেরদিন বিকালের দিকে যীনাত চোখ খুলে নিজেকে একটা বিছানায় আবিষ্কার করলো! কষ্ট করে উঠে বসতেই মুখের জ্বালা গুলোতে কিছুটা ভ্রু কুচকে ফেলে। এমন সময়ই কিশোর রুমে ঢুকে হাতে কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে।
– জান তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও পুরোহিত চলে আসবে কিছুক্ষণের মাঝে আমাদের বিয়ে টা তো করতে হবে নাকি?
– আমার প্রাণ থাকতে কখনো তোর মতো অমানুষকে আমি বিয়ে করবো না তার উপর ভিন্ন ধর্মের কোনো ছেলেকে!
কিশোর স্বাভাবিকভাবে হেসেই বলে,”কিছুই যে করার নেই জান এখন তুমি যা ইচ্ছা বলতে পারো কিচ্ছু বলবো না তবে বিয়েটা হওয়া জরুরি!”
যীনাত থু থু ফেলার ভঙ্গি করে বলে,”থুহ! তোর মতো একটা জানোয়ার অমানুষকে বিয়ে করবো? এর থেকে আমার মরণও বেশ ভালো।
এবার কিশোরের মাথায় রাগ চটে গেলো। সে যীনাতের চুলের মুঠি ধরে খাটের কর্ণারের সাথে দেয় জোরে বারি। যীনাত চেচিয়ে উঠে ব্যথায়। কপাল বেয়ে অনবরত রক্ত ঝড়ছে তা দেখে যেনো পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে কিশোর।
– আরও বল আমি অমুক তমুক! তুই আমায় বিয়ে করবি না তো তোর ঘাড় করবে।
বলেই প্যাকেট থেকে একটা ইঞ্জেকশন বের করে সেটায় মেডিসিন দিয়ে যীনাতের রাতের পালস এ ইঞ্জেকশন টা খুব জোরে ঢুকিয়ে দেয়। যীনাত আবার চিল্লিয়ে উঠলো যন্ত্রণায়। ইনজেকশন টাতে ছিলো প্যারালাইজড করার মেডিসিন।
(এরপরের ঘটনা ট্রেইলার এবং যীনাতের স্বপ্নে আপনারা জেনেছেন)
যীনাতের দুইদিন নিখোঁজ দেখে ফয়েজ পুলিশের কাছে ডায়েরি করে। পুলিশ চারপাশে ইনফর্মার লাগিয়ে দেয়। ৩দিন পর একজন ইনফর্মার জানায় মালিবপুর গ্রামের একজন লোক নাকি একটা ছেলের সাথে যীনাতকে দেখেছিলো। সেই খবর পেতেই সকলে এই ফার্মহাউজে চলে যায়। সেখানে কাউকে দেখতে পায়না তবে এক রুমে তীব্র এসির মাঝ থেকেই যীনাতকে উদ্ধার করে তারা। যীনাতের হাত পা পুরো শরীর ঠান্ডার বরফে পরিণত হয়েছিলো। মেয়ের এমন হাল ফয়েজ সহ্য করতে পারেনা। সেদিন যীনাতের বাচার এক পার্সেন্ট চান্স ছিলো না তবুও পুলিশ তাদের ভালো এবং উন্নতমানের একটা হসপিটালে এডমিট করায়। যীনাতের অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিলো যে সব ডাক্তারই আশা ছেড়ে দিয়েছেন কিন্তু ফয়েজ আর পুলিশ কমিশনারের অনুরোধে তারা চিকিৎসা করতে বাধ্য হয়। তারা তো অনেক আগেই ধরে নিয়েছে যীনাত বাচবে না তবুও লাইফ সাপোর্টে রাখা হলো কিছুদিন। কিন্তু কাজ কিছুতেই হচ্ছে না। তবে অদ্ভুত ভাবে যীনাত বেচে ফিরে কিন্তু কি করে কেউ বুঝতে পারেনা। সকল ধরণের চিকিৎসা দেয়া হয়। ফয়েজ আর তার ভাইরা মিলে বাইরের থেকে ডাক্তার আনায় যাতে যীনাতকে সুস্থ করতে পারে। যীনাতের ক্ষত ছাড়াও তারা যীনাতের রক্তের সাথে প্যারালাইজড এর মেডিসিন পায়। কিন্তু সেটা পরের দিনই আকর্ষিক ভাবে গায়েব হয়ে যায়। ব্যাপারটায় প্রতি ডাক্তারই অবাক হয়ে যায়। এদিকে পুলিশ কমিশনার ফার্মহাউজের মালিকের খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে তার নাম কিশোর নারায়ান এবং সে দুইদিন আগেই এক বড় রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ভার্সিটির চারপাশের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জানা যায় কিশোর নারায়াণ অনেকদিন ধরেই যীনাতকে ফলো করেছে এবং যীনাতকে নিয়েও যাচ্ছিলো। এটা দেখে কারো বুঝতে বাকি নেই এসবের পিছে কে আছে। তবে এখন আর কিছুই বলার নেই কারণ যে অপরাধী সে আগেই রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।
একসপ্তাহ পরে যীনাত কোমায় চলে যায়। প্রায় ৭মাস পর জ্ঞান ফিরেছে। যীনাত যখন সুস্থ হলো তখন যীনাত সকলকে শুধু এইটুকুই জিজ্ঞেস করতো,”আচ্ছা আমার কি হয়েছিলো? আমি হসপিটালে কেনো?”
যীনাতের এমন ব্যবহারের কারণে ডাক্তার রা জানায়, “মাথায় গুরুতর আঘাতের কারণে বিগত কিছু মাসের কথা তার স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। তাই আপনারা কেউ কখনো তাকে সেসব কিছু মনে করাতে যাবেন না নাহলে বড় কোনো সমস্যা ঘটে যেতে পারে।”
ডাক্তারের কথায় সকলেই ভয় পেয়ে যায় তাই যীনাতের ভালোর জন্য কেউ আর যীনাতকে কোনো প্রশ্ন করেনি।
★বর্তমান★
যীনাত ধীরে ধীরে চোখ খুকে নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করলো। আস্তে আস্তে চোখ মেলে উঠে বসে। হঠাৎ মাথায় বিজলির মতো শক খায় যেনো। সাথে সাথে দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে চোখ বুজে। দু এক মিনিট সেভাবেই থাকে তারপর স্বাভাবিক হতেই আস্তে আস্তে তার সব মনে পড়ে যায়। হ্যাঁ যীনাতের স্মৃতিশক্তি ফিরেছে। এমন সময়ই জাইফ খাবার হাতে নিয়ে যীনাতের ঘরে প্রবেশ করলো। যীনাতকে বসে চারপাশে তাকাতে দেখে জাইফ চটজলদি খাবারটা রেখে যীনাতকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,”আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি তিনি তোমাকে সুস্থ রেখেছে। কিছুক্ষণের জন্যে তো মনে হচ্ছিলো আমার প্রাণটাই বেরিয়ে যাচ্ছিলো।”
যীনাত চুপটি করে জাইফের বুকে মাথা রেখে বসে আছে। কেন জানিনা জাইফের বুকে সে অনেকটা শান্তি উপভোগ করছে। এটা আবার কেমন অনুভূতি? জাইফ যীনাতকে ছেড়ে বলে,”তুমি কই ছিলে যীনাত? জানো কতোটা টেনশন হচ্ছিলো আমার? আর তুমি বাগানে সেন্সলেসই বা কেন ছিলে?”
জাইফের কথা এড়িয়ে গিয়ে যীনাত জিজ্ঞেস করে,”আপনি রিকেশ ভাইয়ার বিয়েতে যাননি?”
– গিয়েছিলাম! দাদু পাঠিয়ে দিসে আমাকে তোমার কাছে যদি কিছু প্রয়োজন হয় আর আমার নিজেরও সেখানে মন টিকছিলো না তোমায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম তাই….
– হুম বুঝেছি তা আমার প্রতি এতো কেয়ারিং এর মানে কি বলতে পারেন?
যীনাতের কথায় জাইফ কিছুটা থতমত খেয়ে ফেলে। হাসি মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে যায়। বেচারা চিন্তায় পরে যায়, কি বলবে যীনাতকে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বলে,”তুমি আমার অর্ধাঙ্গীনি! তাই তোমার ভালো খারাপ দেখার দায়িত্ব এবং অধিকার দুটোই আমার আছে। তাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা, কেয়ার করবো না তো কাকে নিয়ে করবো হুম?”
যীনাত একটা মিষ্টি হাসি দেয়। আর জাইফও সেই হাসির সাথে তাল মেলায়। তারপর হাসি ছেড়ে বলে,”অনেক কথা বলা হয়েছে এখন খেতে হবে আসো। সেন্সলেস অবস্থায় তোমায় তো মনে হচ্ছিলো তোমার শরীর দুর্বল।”
জাইফ নিজ হাতে খুবই যত্নে যীনাতকে খাইয়ে দিতে থাকে। জাইফের কেয়ারগুলো যীনাতের অনেকটা ভালো লাগে আর ওদিকে কিশোরের অত্যাচারের কথা মাথায় আসলেই ভয়ে শিউরে উঠে। তবুও যীনাত নিজেকে যথাযথ ভাবে সংগত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে করে তার মাঝে কি চলছে সেটা বাহিরে কেউ যেনো বুঝতে না পারে।
★
রাতে যীনাত বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে ভাবছে ওয়ারদূন আসরার এর কথা। সে এখন কোথায় আছে? সে সুস্থ হওয়ার পর থেকে তো তাকে সেই ড্রয়ারে পায়নি যীনাত। তাহলে কোথায় চলে গেলো? কার কাছে আছে সে সুরক্ষিত কিনা, যীনাতের সাথে দেখা কেন করছে না এসবই মাথায় ঘুরঘুর করছে। ওয়ারদূন আসরার তো তার প্রকৃত বন্ধু ছিলো। এমন বন্ধু পাওয়া বড়ই মুশকিল। আচ্ছা এই সাপটার সাথে ওয়ারদূন আসরারের কোনো যোগাযোগ আছে? যদি থাকে তাহলে তো একমাত্র সাপটাই বলতে পারবে ওয়ারদূন আসরার কোথায়। কিন্তু সাপটাকে কই পাবে সে?
এসব আকাশ পাতাল ভাবছে যীনাত। হঠাৎ খট করে কেউ তার রুমের দরজা খুললো। যীনাতের কানে শব্দ আসতেই সে লাফ দিয়ে উঠে বসে এবং উত্তেজিত হয়ে বলে,”কে, কে ওখানে?”
জাইফ ফোনের ফ্ল্যাশ নিজের দিকে দিয়ে বলে,”আমি হলাম ভূত! এসেছি তোমায় ঘাড় মটকাতে।”(ভারি কন্ঠে)
জাইফের ফাইজলামিতে যীনাত ফিক করে হেসে দেয়। জাইফ দরজা লক করে লাইট জ্বালিয়ে যীনাতের পাশে এসে বসলো।
– কেউ আসেনি এখনো?
– এতো তাড়াতাড়ি আসবে না এখনই হয়তো ওদের বিয়ে শুরু হয়েছে।
– ওওও আন্টি???
– ঘুমিয়ে পড়েছে সব চেক করেই এসেছি বুঝলে?
যীনাত মুচকি হাসে। জাইফ আবার জিজ্ঞেস করে,”এখনো জেগে আছো যে? আমি তো ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছিলে!”
– এমনিহ ঘুম আসছিলো না।
এভাবে অনেকক্ষণ দুজন মিলে গল্প করলো। যীনাত গল্প করতে করতেই ঘুমিয়ে গেলো। যীনাতের ঘুমন্ত চেহারা দেখে জাইফের বেশ ইচ্ছে করছে যীনাতকে নিজের বুকে আগলে রাখতে। জাইফ যীনাতের আরেক পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
———————————
চলবে!!!