#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব – ১৪ ||
_________________________________
যীনাতের চারপাশে টকটকা লাল গোলাপের পাঁপড়ি শূন্যে ভাসছে। যীনাত বেশ খুশি মনে সবটা দেখছে। হঠাৎ যীনাতের চারপাশ থেকে পাপড়ি গুলো ভেসে একটা কাঠির মতো কিছুতে গিয়ে বসতে লাগে। আস্তে আস্তে সব পাপড়ি মিলে এক লাল টকটকা গোলাপে পরিণত হয়! এতো সুন্দর গোলাপ যীনাত আগে কখনো দেখেনি।গোলাপ টা যীনাতের হাতে চলে আসে।
হঠাৎ যীনাতের ঘুম ভেঙে গেলো। আশেপাশে তাকিয়ে ভাবে,”আমি কি তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম? ওটা আবার কেমন গোলাপ? ধুর এসব ভেবে কাজ নেই নামাজটা আগে শেষ আসি।”
সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে যীনাত চলে গেলো ওযু করতে। ওযু শেষ করে নামাজ আদায় করে নেয়। তারপর চলে যায় নিচে। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে বিভিন্ন কাজে। এমন হওয়ারই কথা আজ যে রিকেশের বিয়ে তাই এই ভোর সকালে থেকেই একেকজন একেক কাজে বিজি। যীনাত জাইফের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে জাইফের ঘর এখনো বন্ধ। যীনাত বেশি কিছু না ভেবে নিচে চলে আসে এবং সবার কাজ দেখতে থাকে। একদিকে খেয়াল করলো কমলা দেবী একজায়গায় বসে সবার কাজ পরিচালনা করছে। যীনাত মুচকি হেসে কমলা দেবীর কাছে গিয়ে বসে। কমলা দেবী একপলক যীনাতের দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মনোযোগী হয়।
– ঠাম্মি।
– কইয়া ফেল।
– একা বসে আছো খারাপ লাগছে না?
কমলা দেবী হেসে বলে,”কই একলা বইয়া রইসি দেহোস না কামের লেইগা কেমন চিল্লান লাগতাসে।”
– তবুও একাই তো!
– হ তাও ঠিগ। যা এহন খাইয়া আয়।
– না তোমার সাথে খাইবো গো কমলা রানী!
কমলা দেবী হেসে বলে,”যাহ মাইয়া রানী কইয়া লজ্জা ক্যান দেস?”
– লজ্জা কেন দিবো গো কমলা রানী আমি তো সত্যি কথাই কইলাম! এখন সত্যি বললেও দোষ বুঝি?
– নাহ দোশ ক্যান হইবো আচ্ছা তুই এইহানের কাম গুলা দেখ আই পাকের ঘর থেইকা দেইখা আহি ওইহানে সব ঠিকাছে কিনা।
– ঠিক আছে।(মুচকি হেসে)
যীনাতকে বসিয়ে রেখে কমলা দেবী রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। কমলা দেবী রান্নাঘরে গিয়ে দেখে তিন্নি এক মিনির থেকে জোর করে কফি নিচ্ছে। কমলা দেবী ভ্রু কুচকালো এবং তখনই তিন্নিদের দিকে গেলো।
– কিরে মিনি এই লতী মাইয়ায় তোর থেইকা এমন কাড়াকাড়ি লাগাইসে ক্যান রে? ব্যাপার কি?
কমলা দেবীকে দেখে তিন্নি ভয়ে একটা শুকনো ঢোক দেয়। মিনি বলে,”দেহো না কর্তামা এই দিদি ছোডদার কফি নাকি নিজে হেরে দিয়া আইবো এহন তুমিই কও হেরে কেমনে দিমু?”
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে কমলা দেবী। এতো বড় সাহস সে কিনা জাইফের রুমে যাবে জাইফের কফি দিয়ে আসতে? এটা কমলা দেবী বেচে থাকতে কোনোভাবেই যেতে দিবে না। কমলা দেবী কোমড়ে দু’হাত দিয়ে রেগে বলে,”ওই লতী মাইয়া তোর শিক্ষা হয়নাই ওইদিনের কথাতে নাকি তোর আরও মলম লাগবো? মিনি তুই কফিডা ওর থেইকা লইয়া জাইফরে দিয়া আয় আমি এর ব্যবস্থা করতাসি!”
কমলা দেবীর কথা মতো মিনি তিন্নির হাত থেকে কফিটা কেড়ে নিয়ে চলে গেলো জাইগের ঘরে। আর কমলা দেবী তিন্নি কে নিয়ে চলে গেলো বাইরে কাজ করাতে। এই মেয়েরে কাজ না দিলে এই মেয়ে আবার জাইফের ধারে কাছে ঘেষার চেষ্টা করবে যা কোনোভাবেই কমলা দেবী চাননা। তাই গাধার মতো খাটাতে থাকে তিন্নিকে। তিন্নি বেচারী কাজ করতে করতে শেষ আর উপরের বেলকনি থেকে জাইফ তিন্নির গাধার খাটুনি দেখছে, হাসছে আর কফি খাচ্ছে। তিন্নির কুকলাপ সব মিনি জাইফকে বলেছে। তিন্নি মনে হয়না দ্বিতীয় বার আর এ মুখো হবে।
৩ ঘন্টা পর রিকেশের হলুদ এবং গোসল শেষ হলো। যীনাত দূর থেকে চুপচাপ সব দেখেছে। বেশ মজা করছে সবাই মিলে। এভাবে মজা টজা শেষ করে সকল রীতি শেষ করে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। যীনাত রুমে গিয়ে আর বের হয়না কারণ জাইফ বলেছে যেনো সে রুমের মাঝেই থাকে। খাবারও মিনি এসে দিয়ে যায়। জাইফ সকল কাজ সামলাতে অনেক বেশি বিজি তার এখন আর কোনো দিকেই খেয়াল নেই। যতোই হোক ছোট ভাই বলে কথা তার উপর এতো বড় আয়োজন তো আর মুখের কথা নয়! যীনাতের বিকালের দিকে বরিং লাগছিলো তাই সে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে। রুমে থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে যায়। সেখানে খেয়াল করে একটা লাকরির দরজা। মূলত এটাই পেছনের দরজা। যীনাত কৌতুহলবশত সেই দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। জায়গাটা বেশ নির্জন। মাঝে দিয়ে সরু রাস্তা আর দুপাশে গাছপালা। এই বাড়ির আশেপাশে কোনো বাসা বাড়ী নেই। আর এই রাস্তাটা হাটার জন্য বেস্ট! যীনাতও হাটছে। হাটতে হাটতে কতোটা দূরে চলে আসে তার নিজেরই খেয়াল নেই। হঠাৎ খেয়াল করে দূরে এক পাগল মাথা চুলকাতে চুলকাতে কিসব হাবিজাবি বলে চেঁচাচ্ছে। যীনাত সামান্য ভ্রু কুচকালো। পাগলটা যীনাতকে দেখতেই কিছুটা এগিয়ে আসলো আর যীনাতকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো তার ইয়ায়া বড় বড় ময়লা লাগা চুল চুলকাতে চুলকাতে! হঠাৎ সে জোরে বলে উঠে,”যীনাত! তোরে আমি পাইসি এইবার তোরে আমার হাত থেকে কেউ-ই বাচাতে পারবে না কেউ নায়ায়ায়া!!”
বলে দৌড়িয়ে যীনাতের দিকে আসতে লাগে। যীনাতও ভয় পেয়ে যায়। এই পাগল তাকে কি করে চিনলো? যখনই দেখলো পাগলটা যীনাতের দিকে আসছে তখনই যীনাত পিছে ফিরে প্রাণপাত ছুটতে লাগলো।কিন্তু পাগলটা তার পিছুই ছাড়ছে না বারবার চেঁচিয়ে বলছে,”দাঁড়া যীনাত দাড়া এভাবে আমাকে ছুটাইস না নইলে তোর কপালে ভিষণ রকম দুঃখ আছে! তোরে বলসি থামতে! থাম তুই!!! যীনায়ায়ায়ায়াত দাড়ায়ায়ায়ায়া!!!”
কিন্তু যীনাত একবারের জন্যেও দাঁড়ায় না সে যেভাবে পারছে ছুটছেই। ছুটতে ছুটতে একসময় যীনাত কিছুর সাথে উষ্টা খেয়ে পড়ে যায় এবং পায়ে খুব ব্যথা পায়। যীনাত কিছুটা শব্দ করে “আহহ” বলে উঠে। আবার পায়ের দিকে না তাকিয়ে পিছে ফিরে এবং দেখে পাগল তার দিকেই আসছে। যীনাত হাত দিয়ে লেসড়ে লেসড়ে পিছের দিকে যেতে লাগে আর বারবার আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগে। এমন বিপদে একমাত্র তাকে আল্লাহ-ই বাচাতে পারে। পাগল টা যীনাতের পায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং হাটুতে দু হাত রেখে হাপাতে লাগে। হাপাতে হাপাতেই পাগলটা বলে উঠে,”আর পালা পালা পালা খুব করে পালা!”
বলেই হেহে করে পাগলের মতো হাসভহে আর হাত তালি দিচ্ছে। এদিকে যীনাত ভয়ে থরথর করে কাপছে। বারবার ঢোক গিলছে যীনাত তার প্রচন্ড তৃষ্ণাও পেয়েছে। পাগলটা আবার হেসে হেসে বলে,”সেদিনও তুই এভাবে ভয় পেয়ে ছিলি আর পানি পানি করছি আজও হিহিহি!!”
পাগলের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো যীনাত! কি বলছে এই পাগল? এর আগেও কি এই পাগলটার সাথে তার দেখা হয়ে হয়েছিলো? নাহ কখনো দেখা হয়নি তো যীনাতের তাহলে?
– এখন আমাকে ‘ওয়ারদূন আসরার’ দে নইলে তোকে আমি তুলে নিয়ে বিয়ে করবো তারপর তোকে ভোগ করে ডোবায়….
বলেই আবার পাগলের মতো হাসতে থাকে তাও অনেকটা জোরে। যীনাত হা হয়ে পাগলটার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ওয়ারদূন আসরার’ মানে? সে কিভাবে জানলো ওয়ারদূন আসরার এর কথা আর ওয়ারদূন আসরার কোথায় সেটা যীনাত কি করে জানবে? আর পাগল টা তাকে বিয়ে করে ভোগ করবে মানে কি? আল্লাহ এ কোন মুসিবতে ফেললে?
যীনাতকে চুপ থাকতে দেখে পাগল্টা হুংকার দিয়ে যেই যীনাতের হাত ধরতে নিবে এমন সময়ই কোনো এক অদৃশ্য দেয়ালের ফলে পাগলটা দূরে ছিটকে পড়ে। পাগলটা হাতে আর পায়ে কিছুটা চট পায়। তারপর আবার উঠে দাঁড়ায় আর যীনাতের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। যেই আবার যীনাতের দিকে আসতে নিবে ওমনি তার পথ আটকে দাঁড়ায় সেই ১৭ ফিটের ৭ মাথাওয়ালা সাপটা। যীনাত চোখ বড় বড় করে সাপটার দিকে তাকায়। এই সাপ আবার কোথা থেকে এলো আর কেন-ই বা এলো। ৭ মাথার ৭টা ছোবলের হাত থেকে অনেক কষ্টে পাগলটা পালিয়ে পালিয়ে রক্ষা পায়। কিন্তু এরকম আর কতোক্ষণ! এর একটা ছোবল তার গায়ে লাগলে আজ তার মৃত্যু নিশ্চিত। সাপটা আবার ছোবল দেয়ার আগেই পাগলটা পালিয়ে যায় আর জোরে জোরে বলে,”যীনাত আজ তুই আমার হাত থেকে বাচলেও পরে নিস্তার পাবি না কারণ আমি তোর জমরাজ! জমরাজ যাকে টার্গেট করে তার প্রাণ সে যেকোনো মূল্যে নিয়েই ছাড়ে!”
বলেই চলে যায়। যীনাত অবাক হয়ে পাগলটার কথা শুনে। এর মানে কি পাগলটা হিন্দু? এই পাগলটা আরেকটু হলেই যীনাতকে শেষ করে ফেলতো। যাইহোক আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভেবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু স্বস্তি আসলো কোথা থেকে সাপটা তো তার দিকেই আসছে। সাপটা-ই যে আজ তার প্রাণ বাচিয়েছে। তবে সাপটা যে কোনো সাধারণ সাপ নয় সেটা যীনাত এমন অবাস্তব সাপ দেখেই বুঝে গেছে। সাপটা এমন ভাব করছে যেনো সে যীনাতের গোলাম! যীনাত হা হয়ে সাপটার দিকে তাকিয়ে রয়। সাপটা কিছুই বলছে না শুধু “হিসস হিসস” করেই চলেছে। হঠাৎ সাতটা মাথাই একসাথে পেচিয়ে গেলো তা দেখে যীনাত ফিক করে হেসে দেয়। সাত মাথাওয়ালা সাপ টা যেনো চাঁদ হাতে পেয়েছে। তারা চেয়েছিলোই যেনো তাদের মালিক কোনো কারণে কষ্ট না পায়। আরও বিভিন্ন ভাবে সাপটা হাসায় যীনাতকে। দূর থেকে কিছু একটা তাদের অপলক ভাবে দেখছে। শেষে সেই অদৃশ্য জিনিসটা বলছে,”নাহ আমি কোনো ভুল মানুষকে দায়িত্ব দেইনি।”
বলেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। যীনাত হঠাৎ থেমে গিয়ে ভাবতে লাগে সে তো সাধারণ মানুষ তাহলে একজন সাধারণ মানুষকে একটা অবাস্তব সাপ কি করে তার কথা শুনছে তাকে হাসাচ্ছে তাকে রক্ষা করছে? কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করে,”আচ্ছা আপনারা কারা? কেন আমায় এভাবে ফলো করছেন?”
৭টা মাথা একে অপরের দিকে তাকালো মনে হয়না কেউ কিছু বুঝেছে। যীনাত বেশ বুঝলো ওরা তার কথার কিছুই বুঝেনি। কিন্তু এতোক্ষণ কি করে বুঝলো? আচ্ছা যাইহোক পরে এই সাপের রহস্য জানা যাবে তবে ওই পাগল টা কে ছিলো? তার কথাবার্তায় যা যীনাত বুঝেছে তাতে মনে হচ্ছে পাগলটা হিন্দু। আর তাকে হাসিল কেন করতে চায়?
সাপগুলো যেনো যীনাতের মনের কথা পড়তে পারলো আরামসে। তারপর সবচেয়ে বড় মাথা ওয়ালা সাপটা যীনাতের কপালে তার মাথা ছোঁয়াতেই যীনাত সেন্সলেস হয়ে গেলো! কিন্তু মজার বিষয় হলো যারা যীনাতের মুখের কথা বুঝলো না তারা মনের কথা বুঝলো কি করে? এ আবার কেমন অদ্ভুত শক্তি?
———————————-
চলবে!!!
(পরের পর্বে ছোট একটা চমক আছে আশা করছি ভালো লাগবে।)