#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“০৫”
——————————-
জাইফ ছুটে গিয়ে দেখে দরজা লক করা। বেশি দেরি না করে জাইফ আবার নিজের ঘরে যায় এবং যীনাতের রুমের ডুপলিকেট চাবিটা নিয়ে দরজা খুলে। লাইট জ্বালিয়ে দেখে যীনাত কাতরাচ্ছে পানি, পানি করে। জাইফ তাড়াতাড়ি করে যীনাতকে গিয়ে পানি খাওয়ালো। যীনাত পানি খেয়ে কিছুটা শান্ত হয় এবং জাইফের বুকে ঢলে পড়ে। যীনাতের গায়ে হাত দিতেই জাইফ চমকে যায়। যীনাতের গা আগুনের মতো গরম হয়ে আছে তার মানে নিশ্চয়ই জ্বর এসেছে গায়ে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তো ভালোই ছিলো হঠাৎ এমন গা কাঁপিয়ে জ্বর কেন এলো? জাইফ যীনাতকে শুইয়ে দিয়ে মেডিসিন আনার জন্য উঠতেই যীনাত জাইফের হাত ধরে আটকায় এবং জ্বরের ঘোরে বলতে লাগে,”প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না আমার খুব লাগছে। যাবেন না প্লিজ আমার সাথে থাকুন।”
জাইফের এবার যীনাতের প্রতি বড্ড মায়া লাগছে। কিন্তু হঠাৎ এমন গা কাঁপানো জ্বর আসলো কেন? শেষে উপায় না পেয়ে জাইফ যীনাতের পাশে শুয়ে পড়ে। জাইফের প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও এখন অস্বস্তি ভুলে চিন্তায় পড়ে গেছে। যীনাত জাইফকে টেনে জাউফের বুকে বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে পড়ে আর বারবার বলছে,,”ওরা আমাকে মেরে ফেলবে আমি কোথাও যাবো না। আমাকে একা ফেলে যাবেন না।”
যীনাতের কথায় জাইফ শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে যাতে কিছুটা হলেও যীনাতের জ্বর কমে। এছাড়া আর কোনো উপায়ই দেখছে না সে। পরে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে যীনাতের সাথে।
★
পাখিদের কিঁচিরমিঁচিরে যীনাতের ঘুম ভাঙে। পিটপিট করে চারপাশে একটু আকটু তাকায় তারপর আবার ঘুমাবে ওমনি ফিল করে কোনো এক শক্ত কিছুর উপর সে শুয়ে আছে। চোখ খুলে দেখে জাইফকে সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলো। যীনাত লাফ দিয়ে উঠে বসলো আর চোখ বড় বড় করে জাইফের দিকে তাকিয়ে রয়। জাইফ চোখমুখে বিরক্তি ভাব নিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। যীনাত চুপচাপ মনে করার চেষ্টা করতে লাগে কাল রাতে ঠিক কি হয়েছিলো। সবটা মনে পড়তেই যীনাত যেনো লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। কি রকম বেহায়াপনা করেছে সে কাল রাতে। এখন জাইফ তাকে কি ভাববে? সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জাইফকে ডাকতে শুরু করে কারণ যদি জাইফকে যীনাতের রুমে কেউ একজন দেখতে পায় তাকে সমূহ বিপদ।
– এইযে শুনুন!
—————
– এই উঠুন ভোর হয়ে গেছে!
—————-
এবার যীনাতের মাথায় যেনো রাগ উঠে যায়। মন চাচ্ছে কান টান দিয়ে ঘুম থেকে উঠাতে। কিন্তু না এগুলো করলে আরও মান সম্মান যাবে। তাই আরও কিছুক্ষণ ডাকে কিন্তু জাইফের কোনো রেসপন্সই নেই। তাই যীনাত আর দেরি না করে ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে আসে। ফজরের নামাজ কাযা ছিলো। মোনাজাত শেষ করে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখে জাইফ এক হাত মাথায় দিয়ে শুয়ে কাত হয়ে যীনাতের দিকেই তাকিয়ে আছে। যীনাত সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলে এবং জায়নামাজ ভাজ করায় মনোযোগী হলো।
যখন যীনাত মোনাজাত করছিলো তখনই হঠাৎ জাইফের ঘুম ভেঙে যায়। জাইফ এদিক ওদিক তাকিয়ে যীনাতকে মোনাজাতরত অবস্থায় দেখে। মোনাজাত ধরার পরেও কোনো মেয়েকে এতোটা অপরূপ লাগে সেটা আগে কখনো ভাবেনি জাইফ। যীনাতের জন্য জাইফের মন এতো কেন টানছে সেটা জাইফ জানেনা। হয়তো এটাই পবিত্র বন্ধনের শক্তি।❤️
যীনাত আবার যখন তাকালো দেখতে পেলো আগের মতো করেই জাইফ তার দিকে তাকিয়ে। যীনাত নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,”এভাবে কি দেখছেন?”
জাইফ যীনাতের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,”একটা কথা বলি?”
– জ্বী বলুন।
– নামাজরত অবস্থায়ও কি কোনো মেয়েকে এতোটা অপরূপ লাগে?
এবার যীনাত আরও লজ্জায় পড়ে গেলো। এই প্রশ্নের উত্তর কি আদৌ তার কাছে আছে? যীনাত বেশ বুঝলো জাইফ কোনো এক ঘোরের মাঝে আছে তাই গলা ঝেড়ে বলে,”দেখুন আপনাকে কেউ আমার রুমে দেখলে কেলেঙ্কারি বেধে যাবে।”
এতোক্ষণে জাইফের ধ্যান ভাঙে এবং চটজলদি উঠে বসে। তারপর বলে,”সরি সরি সরি আসলে আমার খেয়াল ছিলো না আমি এখুনি যাচ্ছি।”
বলেই বেডসাইড থেকে চাবির গোছা টা নিয়ে যীনাতের পাশ কাটিয়ে যেই চলে যেতে নিবে ওমনি দাঁড়িয়ে গিয়ে যীনাতের সামনে আসে এবং কোনো কথা না বলে যীনাতের কপালে হাত দিয়ে টেম্পারেচার চেক করে। নাহ সবকিছু স্বাভাবিক।
– আপনি আমার কপালে হাত দিলেন কেন?
– কাল আপনার হাড় কাঁপানো জ্বর এসেছে ম্যাডাম তাই টেম্পারেচার চেক করছিলাম স্বাভাবিক আছে কিনা নইলে ডক্তরকে কল দিয়ে আনাতাম।
– ওহ।
– যাইহোক কাল রাতে হঠাৎ তোমার ওই অবক্সথা কি করে হলো? আর জ্বরই বা কেন আসলো? কোনো কিছু নিয়ে কি ভয় পেয়েছিলে?
যীনাতের হঠাৎ কাল রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। ভয়ে একটা ঢক গিলে যীনাত, হয়তো সেই স্বপ্ন নিয়ে অতিমাত্রায় ভয় পেয়েছিলো যীনাত তাই হয়তো এভাবে জ্বর এসেছিলো। যীনাত স্বপ্নের ব্যাপারটা লুকিয়ে বলে,”আমিও বুঝতে পারছি না তবে এখন ঠিক আছি।”
– ওহ ঠিক আছে তুমি নিজের খেয়াল রেখো আমি গেলাম।
বলেই জাইফ নিজের রুমে চলে গেলো। জাইফ চলে যেতেই যেনো হাফ ছেড়ে বাচে যীনাত। তারপর বারান্দার থাই গ্লাস খুলে বারান্দায় চলে গেলো যীনাত। আজকে সকালটা বেশ মধুর লাগছে যীনাতের মনের বোঝা যেনো অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে। ঠান্ডা পরিবেশ, ফ্রেশ হাওয়া। সকালের বাতাসটা পুরোই দূষিতমুক্ত। মন খুলে নিশ্বাস নেয়া যাচ্ছে। হঠাৎ যীনাতের ছোটবেলার বাবার সাথে কাটানো সময় মনে পড়ে আর সাথে সাথেই চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। যীনাত হঠাৎ অনেক ফুলের সুবাস পাচ্ছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে গন্ধরাজ ফুলের বাগান। আর কিছুটা দূরে শুধুই গোলাপ আর গোলাপ। এতো ফুল দেখে যীনাতের খারাপ লাগা গুলো নিমিষেই ভালো লাগায় পরিণত হলো৷ যীনাত কিছুক্ষণ বারান্দায় কাটিয়ে রুমের বাইরে চলে আসে। নিচে নামতেই দেখে মিনি এক কাপ চা আর এক কাপ কফি নিয়ে যীনাতের দিকেই আসছে। যীনাতকে দেখে মিনি যীনাতের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”আরে দিদিমনি আন্নে এইহানে আই তো আন্নেরেই এই চা দিতে যাইতাম যাইহোক লন এই চা আই এই কোপি ছোটদাদারে দিয়া আহি।”
যীনাত মুচকি হেসে চা টা নিয়ে বলে,”ওটা কোপি হবে না মিনি আপু কফি হবে।”
মিনি বিস্ফোরিত চোখে যীনাতের দিকে তাকায়। যীনাত মিনির এমন দৃষ্টির মানে বুঝতে পারলো না।
– এ আন্নে কি কইলেন দিদিমনি? আই এই বাড়ির কামের মাইয়া আমারে আপু কওয়া লাগতো না আই আন্নের ছোড!
– আপু কি শুধু বড়দের বলতে হয় হও তুমি আমার ছোট বা বড় তোমায় আমি আপু বলেই ডাকবো। আর কি বললে তুমি এ বাড়ির কাজের মেয়ে? এটা বলা ঠিক নয় আমি তো তোমায় এই পরিবারের একজনই মনে করি!
মিনি ছলছল চোখে যীনাতের দিকে তাকায়। সত্যি এতো সম্মান কখনো তাকে কেউই দেয়নি। দূর থেকে দেবনাথ দেব এবং মল্লিকা দেবী সবটা দেখতে পায়। যীনাত নিজের হাত দিয়ে মিনির চোখ মুছে বলে,”বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন?”
– নাহ এমনি দিদিমনি যাইহোক আমি যাইয়া ছোট দাদারে কোপি ইয়ে মানে কফিডা দিয়া আহি।
বলে মিনি চলে গেলো। যীনাত হাসলো তারপর চা টা সোফায় বসে খেতে লাগে।
এইদিকে,
– আমু দাদা?
জাইফ পিছে না ফিরেই বলে,”হ্যাঁ আয়।”
জাইফকে দেখে মিনি যেনো একটা শক খায়।
– দাদা আন্নে এত্তো হজ্ঞালে ঘুম থেকে উইঠা পড়লেন?(অবাক হয়ে)
– কেন উঠতে পারিনা?
– না তা নয় আন্নে তো অফিস যাওয়ার আগে উডেন আর ততোক্ষণে কফি ঠান্ডাও হইয়া যায়।
– সে যাইহোক আজ উঠলাম। কফিটা রেখে চলে যা।
– আইচ্ছা।
বলেই কফিটা রেখে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে এমন সময় দরজার সামনে দাঁড়ায় এবং পিছনে ফিরে। মিনির তাকানো দেখে জাইফ বলে,”কিছু বলবি?”
মিনি মাথা নাড়ায়। জাইফ কফিটা নিয়ে এক চুমুক দিতে দিতে বলে,”বলে ফেল কি বলবি?”
– জানেন দাদা নতুন যেই দিদিমনিডা আইসে না হ্যায় অনেক ভালা মনের মানুষ।
– হঠাৎ এই কথা বললি কেন?
– আমি হের থেইক্কা অনেক ছোড তবুও আমারে আপু কইয়া ডাকসে জোর গলায় একবারও কথা কয়নাই। এইহানে এতোদিন ধইরা আছি আন্নে আর দিদিমনি ছাড়া কেউ ভালো কইরা আম্র লগে কথা কয়নাই।
মিনির কথায় জাইফ একটা তৃপ্তির হাসি দেয় তারপর বলে,”আর কিছু বলবে?”
– না জাইগা।
বলেই মিনি চলে গেলো আর জাইফ চুপচাপ কফি খাচ্ছে আর যীনাতের কথা বলছে। কফি শেষ করে কফির মগটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
যীনাতের খাওয়া শেষেই হঠাৎ শিড়ি থেকে শব্দ শুনতে পায়। যীনাত কাপটা টি-টেবিলে রেখে শিড়ির দিকে তাকায়। দেখে এক সার্ভেন্ট শিড়ি মুছছিলো ভুলবশত পানির বালতিটা তার পায়ে লেগে পড়ে যায়। সার্ভেন্টটি কিছুটা ব্যথা পেলেও নিজেকে সামলে নেয় আর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বালতিটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে নির্ঘাত আজ কমলা দেবীর থেকে রাম-ধোলাই খাবে। যীনাত এসে সবটা দেখে তারপর বলে,”তুমি ঠিক আছো তো?”
সার্ভেন্টটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”জি দিদিমনি আর আমারে ক্ষমা করেন আমি আসলে বুঝতে পারিনাই।”
আরও অনেক আকুতি মিনুতি করতে থাকে। বেচারী বেশ ভয় পেয়ে আছে সেটা যীনাত বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে। এমন সময়ই মিনি শিড়ি দিয়ে নেমে আসছিলো এমন সময় সবটা দেখে বলে,”এইডি তুই কি করলি এহন কর্তামায় তো অনেক বকবো।”
– মিনি আপু এগুলো না ভেবে সাবধানে ওনাকে নিচে নিয়ে আসো তো। উনি পায়ে ব্যথা পেয়েছে।
মিনি যীনাতের কথামতো খুব সাবধানে মেয়েটাকে নিয়ে নিচে আসে ততোক্ষণে যীনাত একটা চেয়ার আনে এবং মেয়েটাকে বসায়। যীনাত মেয়ে হাটুর কাছে হাটুগেড়ে বসে বলে,”মিনি আপু তুমি একটু ফাস্ট এইড বক্স টা নিয়ে আসো তো।”
মিনি মাথা নাড়িয়ে বক্স আনতে চলে গেলো। উপর থেকে জাইফ সবটা দেখছে এবং শুনছে। যীনাত মেয়েটার পা ধরতে নিতেই মেয়েটা পা সরিয়ে বলে,”ছ্যা ছ্যা ছ্যা দিদিমনি আন্নে আমার মালিক হোন আন্নে আমার পা ধরতে পারেন না।”
– আমি কারো মালিক নই যিনি উপরে আছেন তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ মালিক। একমাত্র তাকেই মালিক বলে সম্মোধন করবে তার নিকটে কেউ নয়। এখন পা টা দাও দেখি।
বলেই একপ্রকার জোর করে পা টা নিজের হাটুতে নেয়। দেখে পায়ের একসাইড ফুলে নীল আকার ধারণ করেছে৷ মিনি মেডিসিন বক্স আনতেই যীনাত পায়ে মলম মালিশ করে দেয় আর মেয়েটাকে বলে দেয় যেনো রেস্ট করে। তারপর যীনাত আর মিনি মিলে শিড়ি আর ফ্লোরের পানি পরিষ্কার করে যাতে করে মেয়েটাকে বকা শুনতে না হয়। সবটা খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলো জাইফ তাও অবাক হয়ে। এতোটা বিনয়ী?
——————————-
চলবে!!!
(গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম ধন্যবাদ)