ওয়াদা ২২
রুমে এসে পায়চারী করছি আর ভাবছি। তন্নি তারমানে সবটাই জানে। আর রাত্রিকে ওই মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এখানে এনেছে ওদের দুজনার সম্পর্ক ঠিক করার জন্য। আমায় তন্নির সাথে কথা বলতে হবে। আমি আর তন্নি দুজনে মিলে ওদের দুজনকে আবার এক করে দিবো। রাতে শোয়ার সময় তন্নির সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবো। এখন নিচে যাই। তারপর সোজা নিচে চলে এলাম। সবাই তন্নিকে ঘিরে বসে আছে। আমিও ওদের কাছে গিয়ে বসলাম
-দোস্ত আমাদের অনিক কিন্তু ফেসে গেছে।(তুবা)
-মানে?(আমি)
-আরে ওই দিকে দেখ।(তুবা)
আমরা সবাই পেছন ফিরে তাকালাম। অনিক রাত্রির ছবি তুলছে। রাত্রি তুলতে চাইছে না কিন্তু ও বার বার জোড় করছে।
-নাশু তুইতো এতো সময় ছিলি না। অনিক তো আঠার মতো ওর পিছে লেগে আছে। আমাদের কারোর একটা ছবিও তুললো না এতো করে বললাম অথচ দেখ রাত্রির পিছে ছবি তোলার জন্য কিভাবে ঘুরছে।(জয়া)
-অনিক এই দিকে একটু আয়তো।(তন্নি)
-দোস্ত একটু পরে আসি প্লিজ।(অনিক)
-না এখনি আয়। তোর সাথে কিছু কথা আছে।(তন্নি)
-আচ্ছা আসছি।(একটু মন খারাপ করে। আর রাত্রিকে কিছু একটা বলে এদিকে আসতে লাগলো।)
-ওই ওকে আবার ডাকলি কেন? দেখছিস না তুই ডাকাতে ব্যাচারার মন খারাপ হয়ে গেলো।(তুবা বলার সাথে সাথে সবাই হেসে দিলো।)
কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কিছু। মেঘ আর রাত্রির ব্রেকআপ হলেও ওরা দুজন দুজনকে এখনো ভালোবাসে। মেঘ যা রাগি যদি জানতে পারে অনিক রাত্রিকে পটানোর চেষ্টা করছে তাহলে যে কি করবে।
ভাবতে ভাবতে অনিক চলে এলো।
-কি বলবি তাড়াতাড়ি বল।(অনিক)
-তুই রাত্রির সাথে কি করছিস?(তন্নি)
-কি করছি মানে। আমিতো জাস্ট ওর ছবি তুলছি।(অনিক)
-তাই না। তুমি ছবি তোলার পাশাপাশি যেটা করছো সেটা আমরা সবাই দেখতে পারছি।(জয়া)
-ধুর তোরা যা ভাবছিস তেমন কিছুই না।(অনিক)
-সত্যিতো?(তন্নি)
-ইয়ে,,,,মা,,,নে।(অনিক একটু তুতলিয়ে)
-থাক আমরা সবাই বুঝেছি। আর ইয়ে মানে বলা লাগবে না।(জয়া বলতেই সবাই হাসলো)
-অনিক লাভ নেই রে।(তন্নি)
-মানে?(অনিক)
-লাভ নেই মানে ওর বি এফ আছে।(তন্নি)
-কিহ্???(অনিক বেশ অবাক হয়ে) ওর বিএফ আছে? ধুর আমার কপলাটাই খারাপ যেই মেয়েটাকে নিয়ে একটু কল্পনার সাগরে ডুব দি সেই মেয়েটিরি বিএফ থাকে। (মন খারাপ করে চেয়ারে বসে পরলো)
-কি করবি বল। তুই বেছে বেছে এমন মেয়েকেই পছন্দ করিস। (তুবা)
-আচ্ছা বাদ দে। চল তোদের সবার ছবি তুলি।(অনিক)
-কি,,। এতো সময় ধরে বললাম আমাদের ছবি তুলতে তুললি না আর এখন নিজে থেকে তুলতে চাইছিস। কেন রাত্রির ছবি তোলা শেষ আর তুলবি না।(জয়া হাসতে হাসতে বললো)
-দেখ দোস্ত তোরা খুব ভালো করেই জানিস আমি অন্যের জিনিসের উপর নজর দি না। সো ওর ছবি তোলার কোনো মানেই হয় না।(অনিক)
-হুম বুঝলাম।(তুবা অনিকের গালটা টেনে বললো)
তারপর অনিক আমাদের সবার ছবি তুললো। অনেক ছবি তুলেছি আমরা। সবাই মিলে খুব মজা করলাম। কিন্তু শুভটা যে কোথায় গেছে। ছাদের পর থেকে ওকে আর দেখিনি।
-আচ্ছা তোরা থাক আমি আসছি।(আমি)
-কি রে কোথায় যাচ্ছিস?
-আসছি একটু কাজ আছে।
আমি শুভকে খুজতে খুজতে উপরে এলাম। রাত্রির রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম মেঘ রাত্রির হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে।
-হাত কিভাবে কাটলে?(মেঘ)
-পা পিছলে পরে গেছিলাম। ওখানে একটা গ্লাস ভাঙা ছিলো তাতে কেটে গেছে।(রাত্রি)
-তুমি একটুও বদলালে না। আগের মতই আছো। যখন তখন যেখানে সেখানে পরে যাও।
-কিন্তু তুমি অনেক বদলে গেছো। আগের মতো হাসোনা, মজা করোনা। অনেকটা বদলে গেছো।
-সময়ের সাথে সাথে সব কিছুরই বদল হয়।
-আমায় খুব ঘৃনা করো তাই না?
-(চুপ থেকে ব্যান্ডেজ করছে)
-আমাদের সম্পর্কটা কি আবার আগের মতো হতে পারে না?
-তুমি নিজেই সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছ।
-একবার কি ক্ষমা করা যায় না? একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না?
-আমি চাইলেও হয়তো তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না।
-তুমি না খুব অদ্ভুদ হয়ে গেছো। যারা তোমায় ভালোবাসে তুমি তাদেরকেও কষ্ট দাও, যাদের তুমি ভালোবাসো তাদেরকেও কষ্ট দাও আবার সবাইকে কষ্ট দিয়ে নিজেও কষ্ট পাও।
-এটা তোমার ভুল ধারনা। আমার কষ্ট হয়না। কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি কষ্ট পাইনা।
-তাহলে এতো বদলে গেলে কেন?
-বদলটার হয়তো দরকার ছিলো তাই।
-তোমার কি মনে হয়না আমায় একটা সুযোগ দেওয়া উচিত?
-না হয়না।
-ওই এখানে কি করছো?(শুভ পেছন থেকে আস্তে আস্তে কানে কানে বললো)
আমি ওর কথায় একটু চমকে উঠলাম।
-ওহ্ তুমি?
-কেন অন্য কারোর আসার কথা ছিলো বুঝি?
-চুপ। আস্তে বলো।
-ওকে। কিন্তু তুমি এখানে কি করছো।
-চলো এখান থেকে তারপর বলছি।(বলে ওকে নিচে নিয়ে এলাম)
-বললে নাতো তুমি ওখানে আড়ি পেতে কি শুনছিলে?
তারপর শুভকে সবটা বললাম। ও বললো চিন্তা করোনা আমি আছি তোমার পাশে। কোনো সাহায্য লাগলে আমায় অবশ্যই বলবে।
-হুম।
-ওদের দুজনকে যে এক হতেই হবে না হলে আমি যে সমস্যায় পরে যাবো।(বিড় বিড় করে বললো)
-তুমি সমস্যায় পরবে মানে?
-কই কি সমস্যা?
-এই যে এখনি বললে যে ওরা এক না হলে তোমার সমস্যা।
-আরে না আমার আবার কি সমস্যা হবে। তুমি কি শুনতে কি শুনেছ। চলো সবাই মিলে আড্ডা দি।
-কিন্তু তুমি,,,,,,,,,,,
-উফ চলোতো। (বলে জোড় করেই নিয়ে গেলো)
তারপর সবাই মিলে অনেক মজা করলাম। নাচ, গান সবকিছু হলো। রাত্রি নাচলো ও খুব সুন্দর নাচতে পারে। খুব ভালোভাবে আর আনন্দের সাথেই হলুদ অনুষ্ঠানটা শেষ হলো। রাতে শোয়ার সময় আন্টি মানে তন্নির মা তন্নিকে আজ রাতটা তার সাথে শুতে বললো। হয়তো কাল থেকে মেয়েকে এমন কাছে নাও পেতে পারে তাই আজকে মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চাইছে। তন্নি চলে গেলো। ভেবেছিলাম রাতে তন্নির কাছে রাত্রির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবো কিন্তু তা আর হলো না। রাতে আমার সাথে নিশাত শুলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি নিশাত পুরো রেডি।
-ওই এতো সকালে সাজগোজ করছিস কেন?
-বেশি বক বক না করে টাইমটা একটু দেখ।
আমি মোবাইলটা হাতে নিলাম টাইমটা দেখার জন্য। টাইম দেখে আমার চোখ কপালে উঠলো ১২:০০ বাজে। মানে কি।
-ওই ১২:০০ বাজে কি করে?
-ঘরির কাটা ঘুরে ঘুরে।(নিশাত)
-ফাজলামি বন্ধ করো। এতো বেলা হয়ে গেছে তুই আমায় ডাকিস নি কেন?
-শুধু আমি না বাড়ি শুদ্ধু সবাই তোকে ডেকেছে। কিন্তু তুই বলেছিলস যে বরযাত্রী আসার একটু আগে তোকে ডাকতে।
তার আগে কেউ যেন তোকে বিরক্ত না করে।
-ওই আমি কখন এই কথা বললাম।
-সকালে তুইতো বললি।
-আমি?
-হুম তুই। এখন এতো না ভেবে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। বরযাত্রী রওনা দিয়েছে।(বলে চলে গেলো)
এটা কি হলো। আমিতো কখনো এমন করি না। এতো ঘুম কিভাবে হলো। এতো ভেবে লাভ নেই তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম। একটা হলুদ রংয়ের ল্যাহেঙ্গা, চুল খোপা, চোখে মোটা করে কাজল আর ঠোটে হালকা গোলাপি লিপিস্টিক দিলাম। হাতে রেশমি চুরি আর পায়ে পায়েল পরেছি। চুরি আর পায়েলের ঝুন ঝুন শব্দটা বেশ ভালই লাগছে। আমি আয়নার সামনে হাত নাড়াছি তখনি শুভ এলো।
-নাশু তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।(শুভ)
-তার আগে বলোতো আমায় কেমন লাগছে?
-হুম ভালো লাগছে। নাশু,,,,
-শুধু ভালো লাগছে? তার মানে খারাপ দেখাচ্ছে তাই না।
-নাশু তুমি যাই পড়ো না কেন তোমায় তাতেই সুন্দর লাগে। এখন আমার কথাটা শুনো প্লিজ।
-শুভ তোমার কি হয়েছে। এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
-নাশু এখন আমি তোমায় যে কথা গুলো বলবো তুমি প্লিজ ঠান্ডা মাথায় শুনবে।
-কি হয়েছে শুভ।
-নাশু তুমি আমায় ভালোবাসোতো?
-এটা আবার কেমন প্রশ্ন শুভ?
-আমি যা জিজ্ঞাসা করছি তার উত্তর দাও।
-হ্যা বাসি। কিন্তু তুৃমি,,,,
-কতটা ভালোবাসো?
-নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।
-আমায় বিশ্বাস করোতো?
-নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি তোমায়। শুভ তোমার কি হয়েছে। এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়। বলোনা কি হয়েছে?
-নাশু তুমিতো আমায় নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসো, বিশ্বাস করো, ভরসা করো। আমার জন্য সবকিছু করতে পারো। তাইতো।
-হুম তাই খুব ভালোবাসি।
-আমার সাথে সারাটা জীবন কাটাতে চাও?
-হ্যা আমি তোমার সাথে সারাটা জীবন কাটাতে চাই। তোমার হাত ধরে তোমার কাধে মাথা রেখে পথ চলতে চাই। সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে চাই। সব সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে চাই।
-তাহলে আজ রাত নয়টায় তুমি তন্নিদের বাড়ির বাইরে আসবে।
-বাড়ির বাইরে আসবো কেন।
-কারণ আজ রাতে আমরা পালাচ্ছি।
-পালাচ্ছি মানে?
-পালাচ্ছি মানে। নাশু আজ রাতে আমরা পালিয়ে বিয়ে করবো।
-কিহ্? শুভ তুমি আমার সাথে মজা করছো তাই না?
-নাহ্ নাশু মজা করছি না। তুমি যদি সত্যি আমায় ভালোবাসো আমার সাথে থাকতে চাও তাহলে আজ তোমায় আমার সাথে পালাতে হবে।
-কি বলছো কি তুমি শুভ। তোমার মাথা ঠিক আছেতো?
-আমার মাথা একদমি ঠিক আছে।
-না ঠিক নেই। ঠিক থাকলে তুমি এমন কথা কখনই বলতে পারতে না। আর তাছাড়া হঠ্যাৎ করে কি এমন হলো যে তুমি এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলে।
-দেখ নাশু তুমি যদি আমার সাথে থাকতে চাও তাহলে আমার কাছে পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
-শুভ আমি মা, নিশাত সবাইকে এইভাবে ঠকাতে পারবো না। আমি যদি এটা করি তাহলে আমার পরিবারের সাথে অন্যায় করা হবে, আমার পরিবারে সম্মান নষ্ট হবে। সবাই আমার পরিবারের দিকে আঙ্গুল তুলবে। আমি কখনো মায়ের সামনে দাড়াতে পারবো না। আমি পারবো না শুভ। আমি পারবো না।
-আমায় ছেড়ে থাকতে পারবে?
-মানে?
-মানে আজ যদি তুমি আমার সাথে না যাও তাহলে তোমায় আমাকে সারাজীবনের জন্য হারাতে হবে নাশু।
(খুব অসহায় হয়ে বললো)
-শুভ?
-আমি এখন চলে যাচ্ছি। রাত নয়টা বাড়ির সামনে এসে দাড়াবো। যদি তুমি আমায় সত্যি ভালোবাসে থাকো তাহলে এসো। আর আমার বিশ্বাস আমার নাশু আমায় ফিরিয়ে দেবে না। সে তার শুভকে কখনো হারাতে চাইবে না। সে আসবে তার ভালোবাসার টানে। বাই।(বলেই চলে গেলো)
আর আমি খাটের উপর বসে পরলাম। কি হচ্ছে এসব। শুভ এগুলো কি বলে গেলো।
চলবে,,,
#মেহজাবিন_নাশরাহ