এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ৯

0
984

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৯
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

– ‘ সবার সামনে আমাকে আর আমার মা কে এভাবে অপমান না করলেও পারতে তুমি ‘ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো সুবর্ণা। তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে আক্রোশে।

মোহন বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। সুবর্ণার কথায় তাকে গুরুত্ব দিতে দেখা গেলো না। সে কাজে মনোযোগ রেখেই বললো,
– ‘ আমি কাওকে অপমান করিনি। ‘

সুবর্ণা আগের মতোই ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
-‘ অবশ্যই অপমান করেছো। শাশুড়ীর সামনে মা কে ছোট করে দিয়েছো। তাছাড়া আমার ভাই কোন দিক দিয়ে কম যে তুমি মিলির সাথে  বিয়ে দিতে রাজি না ! ‘

এবারে মোহন চোখ তুলে তাকালো সুবর্ণার দিকে। তার চোখের দৃষ্টি শীতল।
– ‘ আমার বোনের বিয়ের সিদ্ধান্ত আমি নিবো। সেটা তোমার থেকে শুনবো না। তোমার মা একটা প্রোপোজাল দিয়েছে আমরা না করে দিয়েছি। এটাতে যদি নিজেকে ছোট লাগে তোমাদের কাছে তাহলে আমার কিছু করার নেই। ‘
– ‘ কিহ!  এতো বড় কথাটা তুমি বলতে পারলে! ‘ সুবর্ণা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে।

– ‘ হ্যাঁ পারলাম। এই নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না আমি। ‘ কথা শেষ করে মোহন আবারও কাজে মনোযোগ দিলো।  সুবর্ণা আহত স্বরে বললো,
– ‘ ওহ। তাহলে আমি তো তোমাদের পরিবারের কেউ না। আমার কথার দাম নেই এখানে। ‘

সুবর্ণার কথার ধরনে মোহনের খারাপ লাগলো। সে একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘ তোমার কথার দাম অবশ্যই আছে। তবে তুমি যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তবে আমি মেনে নিতাম। ‘ 
সুবর্ণা আর কিছু বললো না। গট গট করে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো।

সৌরভ রাতের খাবার খায়নি। তোহা ভাইয়ের খাবারটা রুমে নিয়ে এসেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল সৌরভ। তার দৃষ্টি দূরের কোন এক প্রান্তে। চোখ জোড়া বিষণ্ন। উদাস মন। কত গুলো দিন হয়ে গেলো ছায়া তাকে ছেড়ে চলে গেছে । পুলিশ এখনো আসামীর কোন সন্ধান পায়নি। এখনো মোজাম্মেল শিকদার থানায় আছে। পুলিশের ধারনা তাকে এবার ছেড়ে দিতে হবে। মোজাম্মেল শিকদার ক্ষমতাধারী লোক। খুনের প্রমান ছাড়া শুধু একটা ম্যাসেজের উপর ভিত্তি করে তাদের মতো লোকদের থানায় আটকে রাখা যায় না। শক্ত উকিল ধরেছেন তিনি। এদিকে অন্য কোন ক্লু পুলিশ এখনো খুঁজে পায়নি। তদন্ত চলছে তাদের মতো। হাজারটা তদন্তের ভিড়ে ছায়ার মামলাটা কোন এক ফাইলে পড়ে আছে। কী হবে ভেবে পাচ্ছে না সৌরভ। তার শরীর, মন ক্লান্ত। ছায়াহীন সব কিছু যেন নেতিয়ে পড়েছে। রেস্টুরেন্ট থেকে আনা ফুটেজটা মিলিকে দেয়া হয়েছে। ছেলেটা নাকি তাদের পাশের এলাকার। মিলি কয়েকবার দেখেছে ছেলেটাকে। তেমন ভাবে পরিচয় নেই। তাহলে ছায়ার সাথে কিভাবে থাকে সেই ছেলে! মাথার ভেতর সব কিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে সৌরভের। মিলি বলেছে ছেলের ফোন নাম্বার জোগার করে দিবে। ছেলেটার সাথে দেখা করে কথা বলতে হবে।

কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে সৌরভ পেছন ফিরে তাকালো।
– ‘ কিরে তুই ! ‘
তোহা হালকা ভাবে বললো,
– ‘ খাবে চলো। ‘
সৌরভ কথা বাড়ায় না। বোনের সাথে চুপচাপ গিয়ে খেতে বসে। তোহার খুব কষ্ট হয় ভাইকে এভাবে দেখতে। সে নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। খুব কান্না পায়। খুব ইচ্ছে করে, ভাইয়ের দুঃখ গুলো যদি ভুলিয়ে দিতে পারতো।
– ‘ ভাইয়া চলো কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি।  দুদিনের জন্য। ‘

– ‘ কোথায় যাবি ?’ খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলে কথাটা সৌরভ। চোখ তুলে না। তোহা বুঝতে পারে সৌরভের কন্ঠ ধরে গেছে। হয়তো চোখ দুটোও ভিজে উঠেছে। বোনের কাছ থেকে লুকানোর জন্য মাথা নত করে রেখেছে।

– ‘ জানি না। ‘ তোহার কষ্ট হয়। সে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়।  সৌরভ মাথা তুলে তাকায় বোনের যাবার পানে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আছে। জমেছে হাজারো অশ্রু বিন্দু।

মিলি ভার্সিটি থেকে পরীক্ষা শেষ করে বাসায় এসে ফোন দেয় সৌরভকে। কল দেয়ার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে সৌরভ। যেন সে ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো। কখন মিলি ফোন দিবে সে অপেক্ষায়।
– ‘ হ্যাঁ মিলি বলো। কোন খবর পেলে ?’

– ‘ আমার এক বন্ধু সে এলাকায় থাকে। তাদের  বাসার পাশেই ছেলেটার বাসা। তার থেকেই জানতে পারি ছেলেটার নাম তুহিন।  বাবা মারা গেছে অনেকদিন হলো। ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। মা কে নিয়ে এক বছর হলো ঢাকায়ই থাকে। এখানে আসে না অনেক দিন । ‘

– ‘ কোন নাম্বার নেই ? বা বাসার অ্যাড্রেস ? ‘
– ‘ না। আর কিছুই নাকি সে জানে না। ‘
– ‘ তাহলে কিভাবে সম্ভব ! এত বড় শহরে খুঁজে পাবো কিভাবে ? ‘ হতাশ হয়ে বললো সৌরভ।
মিলি নিজেও বুঝতে পারছে না কী বলবে। তার কাছেও খারাপ লাগছে। সৌরভ কত কিছু করে যাচ্ছে তার বোনের জন্য। অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। তা না হলে সে ঢাকায় চলে যেতো। অন্তত কিছু করতে না পারলেও তো বোনের হত্যাকারীকে খোঁজার সময় সৌরভের পাশে থাকতে পারতো। এতেই মনকে কিছুটা শান্ত রাখা যেত। মিলি ঠিক করলো পরীক্ষা শেষ করেই সে মা কে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে। থাকবে কিছুদিন সেখানে।

মিলিকে চুপ থাকতে দেখে সৌরভ আবারো বললো,
– ‘ থাক আমি দেখছি কী করা যায়। তোমরা চিন্তা করো না। বাসার সবার খেয়াল রেখো। ‘
– ‘ ঠিক আছে। ‘

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
তোহা আজ ক্লাসে এসেছে। ক্লাস শেষ করে বের হয়েছে রাজিবের সাথে। রাজিব অফিস শেষ করেই চলে এসেছে টিএসসি তে। দুজন মিলে এক পাশে বসেছে তারা। চারপাশে আরো অনেক অনেক মানুষ। এই জায়গাটা মানুষে গম গম করে সব সময়। রাজিবের একদম ভালো লাগে না। সে চায় তোহাকে নিয়ে নিরিবিলি কোন জায়গায় গিয়ে বসতে। একান্তে নিজেদের মাঝে কিছু সময় পার করতে। কিন্তু তোহাকে কিছু বলার সাহস হয়ে উঠে না। যদি সে রেগে যায় ! তোহাকে রাগাতে চায় না রাজিব। সব সময় তোহার মতামত কে সে প্রাধান্য দেয়। তাদের সম্পর্কটা অল্প দিনের। তবে তোহা রাজিবকে পছন্দ করতো সেই অনেক আগে থেকে। রাজিব জানতো না। জানলো কিছুদিন আগে। আর যখন জানতে পারলো তোহা তাকে এতো পছন্দ করে তখন কাছে টেনে নিলো তোহাকে। মেয়েটাকে তার বেশ লাগে। কি মিষ্টি করে কথা বলে, তাকে ভালোবাসে। অল্প দিনের এই সম্পর্কে খুব বেশি ঘুরতে বের হয়নি তারা। হাতে গোনা কয়েকদিন। সময় হয়ে উঠে না সেভাবে কারোর। তারা দুজনই চায় সম্পর্কটা পূর্ণতা পাক। আর এই পূর্ণতা পাবার জন্য তোহার ভূমিকা হয়তো অনেকাংশে। তোহাই তার ভাই সৌরভকে রাজি করিয়েছে। সৌরভ তোহাকে এতোই পছন্দ করে যে যখন জানলো তোহা রাজিবকে পছন্দ করে তখন আর অমত করেনি। বোন আর বন্ধুর সুখেই যেন তার সুখ! এদিকে রাজিব কখনোই রাজি হতো না যদি সৌরভের অমত থাকতো। বন্ধুর মতের বাহিরে গিয়ে এ সম্পর্ক গড়ার কোন সাধ্য তার ছিলো না। সে জানতো সৌরভ রাজি হবে। সে কঠোর নয়। ছেলেটা যে তাদের অনেক ভালোবাসে।

রাজিবের সাথে দেখা করে তোহা বাসায় ফিরলো সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে। দরজা পেরিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো সোফায় কেউ একজন বসে আছে। দিপু। তাদের পাশের বাসায় থাকে। শাহাবুদ্দিন  মেডিকেলে ইন্টার্নি করছে। লম্বা, ফর্সা, সুঠাম দেহ। চোখে চশমা আর সেই চশমার আড়ালে চোখটায় কেমন অস্বস্তি। সেই সাথে লাজুক একটা মুখ। ছেলেরা লাজুক হয় নাকি ? জানা নেই তোহার। এই ছেলেকে সে যতদিন দেখেছে এভাবে লাজুক ভাবেই দেখেছে। তোহাকে দেখেই দিপু উঠে দাঁড়ালো। চশমা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তোহার খুব হাসি পাচ্ছিলো। সে নিজের হাসিটা ঠোঁট চেপে আটকে বললো,
– ‘ কেমন আছেন ? ‘
দিপু আবারো চশমা ঠিক করলো। তোতলাতে তোতলাতে কোন রকমে বললো,
– ‘ ভ..ভভালো। ‘

ছেলেটা তোতলাচ্ছে ! তাকে ভয় পায় নাকি?  তোহা নিজের হাসিটা লুকিয়ে গম্ভীর মুখ করে বললো,
– ‘ এখানে হঠাৎ ! ‘

দিপু মুখ নিচের দিকে নামিয়ে নিলো। এই মেয়ের চোখের দিকে তাকানো তার সম্ভব না। দুনিয়া কেমন ওলট পালট লাগে। হার্টবিট বেড়ে যায়। তবুও এক নজর দেখতে ভালো লাগে। মনে হয় তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া তার তৃষ্ণা কাটাতে পেরেছে। দিপু হালকা স্বরে বললো,
– ‘ ভাইয়া আসতে বলেছিলো। ‘
– ‘ দাঁড়িয়ে কেনো! তাহলে বসুন। ‘ বলেই তোহা আর সেখানে দাঁড়ালো না। উপরে চলে গেলো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে