এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৮
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
-‘ তুমি কি বলতে পারবে ছেলেটা দেখতে কেমন ছিলো?’ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো সৌরভ। সে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রাজিব বললো,
– ‘ তুই শান্ত হ আমি কথা বলছি। ‘
রাজিব ছেলেটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। খুব বিনয়ের সাথে বললো,
– ‘ ভাই আপনি যার কথা বলছেন তিনি খুন হয়েছেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ‘
রাজিবের কথা শুনে ছেলেটা চমকে গেলো। রাজিব শান্ত স্বরে বললো,
– ‘ এখন তো বুঝতেই পারছেন আমরা কেমন ঝামেলায় আছি। পুলিশ এখনো আসামী খুঁজে পায়নি। এদিকে আমাদের মনের অবস্থাও ভালো না। আপনি কি আমাদের এ বিষয়ে একটু হেল্প করতে পারবেন ? ‘
ছেলেটা ভয় পেয়েছে বুঝা গেলো। সে ঢোক গিলে বললো,
– ‘ এসব ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো। তাছাড়া আমিই বা আপনাদের কিভাবে সাহায্য করবো ? ‘
রাজিব রেস্টুরেন্ট এর চারপাশে ভালো ভাবে চোখ বুলালো। বললো,
– ‘ আপনাদের এখানে সিসি ক্যামেরা আছে তো তাই না ? ‘
– ‘ জি আছে। ‘
– ‘ তাহলে তো হলোই। আমাদের সেদিনের ফুটেজটা দেখাতে পারবেন? ‘
ছেলেটা যেন ছায়ার কথা বলেই ভুল করেছে। এখন এসব ঝামেলায় পরতে হলো তাকে। বিরক্ত নিয়ে বললো,
– ‘ সমস্যা আছে। ‘
– ‘ কি সমস্যা ? ‘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো সৌরভ।
– ‘ আগের মাসের ফুটেজ আছে বলে মনে হয় না। প্রতি মাস শেষে সাধারনত সব রিফ্রেশ করা হয়। ‘
যে আশার আলোটা পেয়ে ছিলো সেটাও যেন ধপ করে নিভে গেলো। তবুও মনের মাঝে কিছুটা আশা নিয়ে সৌরভ বললো,
– ‘ একবার চেক করবে প্লিজ ? ‘
বিরক্তি নিয়েই ছেলেটা বললো,
– ‘ আসুন আমার সাথে। ‘
সৌরভ আর রাজিব পিছু পিছু গেলো। ম্যানেজারের কাছে গিয়ে জানতে পারলো ফুটেজ আছে। তিনি খুঁজতে লাগলেন দু সপ্তাহ আগের ফুটেজটা। পেয়েও গেলেন।
রেস্টুরেন্টে এর ভিতর এক পাশের একটা টেবিলে বসা ছায়া। পরনে কালো সুতি শাড়ি। সুন্দর করে সেজেছে। তবে মুখে হাসির কোন রেখা নেই। তার উল্টো পাশে মুখোমুখি বসেছে একটা ছেলে। ছেলেটা দেখতে বেশ সুন্দর। তারা গম্ভীর মুখে কিছু নিয়ে কথা বলছে। তারপর ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। দুজন খেতে খেতেও অনেক আলোচনা করলো। ব্যাস এটুকুই শুধু দেখলো ফুটেজে। রাজিব ছেলেটিকে আগে কখনো দেখেনি। এমনকি সৌরভ ও এই ছেলেকে চিনে না। কি আশ্চর্য! কে এই ছেলে ? সৌরভ অনেক ভেবেও বের করতে পেলো না এ কে। তবুও কোন একটা জায়গায় খটকা লাগছে। মনে হচ্ছে একে খুঁজে বের করতে পারলে এ হত্যা কান্ডের বিষয়ে কিছু অন্ততো জানা যাবে। সৌরভ রেস্টুরেন্ট এর ম্যানেজারকে বললো,
– ‘ আপনি কি আমাদের এই ফুটেজটা একটু দিতে পারবেন ? ‘
ওয়েটার ছেলেটি ম্যানেজারকে ইতোমধ্যে সব বুঝিয়ে বলেছে। তিনি মুখে সৌজন্যতা বজায় রেখে বললেন,
– হ্যাঁ, অবশ্যই।
সৌরভ আর রাজিব ফুটেজ নিয়ে সেদিনের মতো চলে আসে। সৌরভের কেনো যেন সেই জায়গাটিতে তখন আর ভালো লাগছিলো না। ছায়া তাকে ছায়ার মতোই আকড়ে ধরেছে। যেখানে যাচ্ছে সেখানেই যেন পিছু নিচ্ছে। সৌরভের মাথাটা কেমন যন্ত্রণা করে ইদানিং। দেলোয়ার হোসেনকে ছায়ার সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়া ছেলেটির কথা বলেনি সৌরভ। তার ধারনা, ছায়া কোন ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে যেতেই পারে। এ নিয়ে পুলিশকে জানালে তারা তেমন কিছুই করবে না বরং একটা রসালো গল্প সাজাবে । আর সেটা শুনতে মোটেও সৌরভের ভালো লাগবে না।
অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে সুবর্ণা যেন বেজায় রাগ করেছে। নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে থাকে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। মোহনকে প্রায়ই খোটা শুনতে হয়, তোমার তো মা, বোন আর দেশই সব। এদিকে স্ত্রী, সন্তান না খেয়ে মরুক। মোহন সে কথা শুনে বলে,
– ‘ তোমরা না খেয়ে মরছো ? কই জানতাম না তো! ‘
সুবর্ণা আরো রেগে যায়। ‘ মজা করবে না বলছি।
– ‘ সব কিছু সে দেশে ফেলে এখানে চলে এসেছো। দুদিন পর না খেয়েই থাকতে হবে। ‘
– থাকতে হলে সবাইকেই থাকতে হবে। তুমি একা তো থাকবে না। আমি না খেয়ে থাকলে তুমি থাকতে পারবে না ?
– ‘ না পারবো না। আমার একটা মেয়ে আছে। তার ভবিষ্যৎ আমাকে দেখতে হবে। ‘
তারপর মোহন আর কিছু বলে না। এভাবেই চলছে দিন। সুবর্ণা থাকে তার নিজের মতো। সকলকে নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু সেই মাথা ব্যাথাটা হঠাৎ করেই পেয়ে বসলো তাকে। মিলির অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আরো চারটা বাকি। এর মাঝে হুট করে একদিন সুবর্ণার মা আর তার ভাই চলে আসে বাসায়। সুবর্ণার ভাই শামিম নিজের বাবার ব্যাবসা দেখাশুনা করে। সুবর্ণার পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি। বাবার ব্যাবসা বলতে বাজারে কিছু দোকান সেগুলোর দেখভালের দায়িত্বে আছে শামিম। পড়াশুনা বলতে মাধ্যমিকেরর গন্ডি টপকেছিলো। তারপর আর হয়নি। পান খেয়ে মুখ ভর্তি করে রাখা তার সব থেকে পছন্দের কাজ। দেখলেই যে কারোর গা ঘিনঘিন করবে। সুবর্ণার ফ্যামিলির অবস্থা নিয়ে কারোর কোন মাথা ব্যাথা নেই। মোহরের পরিবার সুবর্ণাকে মিলি ছায়ার থেকে আলাদা করে দেখেনি কখনো।
সন্ধ্যায় মিলি পড়তে বসে। ড্রইং রুমে সুবর্ণা তার মা আর আমেনা বেগম বসে কথা বলছিলো। সুবর্ণাকে আজ বেশ খুশি খুশি দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরার পর থেকে তাকে এমনটা দেখা যায়নি। আমেনা বেগমের মনটাও তাই বেশ ভালো। বাড়িতে কেউ মনমরা হয়ে থাকে সেটা দেখতে একদম ভালো লাগছিলো না। আজ যেন বহুদিন পর সকলে হাসি মজায় মেতে আছে। তবে আমেনা বেগমের হাসিটা মিলিয়ে গেলো কিছুক্ষণ পরই। সুবর্ণা প্রফুল্লতার সাথে শাশুড়ীর কাছে এসে বললো,
– ‘ মা আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ‘
এমন সময় মোহন ড্রইং রুমে উপস্থিত হলো। আমেনা বেগমের আগে সে নিজেই বললো,
– ‘ কি সিদ্ধান্ত নিলে ? ‘
মোহনের এই মুহূর্তে উপস্থিতি সুবর্ণার ভালো লাগলো না। মোহনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
– ‘ আমি চাই মিলির বিয়েটা নিজেদের মধ্যেই হোক। ওর তো কিছুদিন পরই পরীক্ষা শেষ। শামিম ভালো ছেলে। সে মিলিকে পছন্দ করে। মা ও চায় ওর সাথে বিয়েটা হলে আত্মীতা আরো গভীর হোক। ‘
সুবর্ণার কথার সাথে তাল মিলিয়ে তার মা বললেন,
– হ্যাঁ। আমিই চাচ্ছিলাম। মিলি মা কে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে।
আমেনা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি কি বলবেন বুঝতে পাচ্ছেন না। শামিমের মতো ছেলের সাথে কিছুতেই মিলির বিয়ে সম্ভব না। মিলির বাবা শুনলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। তিনি কিছু বলার আগেই মোহন বলে উঠলো,
– ‘ আত্মীয়তা যথেষ্ট গভীর আছে। এর বেশি দরকার নেই। তাছাড়া সুবর্ণা তুমি আমার বোনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বন্ধ করো। ‘
মোহনের চোখে মুখে আগুনের তেজ দেখা যাচ্ছে। সুবর্ণার আজ হঠাৎ এতো হাসিখুশি থাকার কারণটা এবারে সে বুঝতে পারলো। মনে মনে তাহলে এ কদিনে এসব ভেবে বের করেছে। এ মেয়ে সব সময় চিন্তা করেছে নিজের ফ্যামিলির আখের গোছানোর কথা। শ্বশুড় বাড়ির কথা মন থেকে কখনো ভাবেনি। মোহন আর সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। হন হন করে নিজের রুমে চলে গেলো। সুবর্ণার মুখে পড়েছে অপমানের তীব্র রেখা। শাশুড়ীর সামনে তাকে আর তার মাকে এভাবে অপমান করলো মোহন এটা তার হজম করতে সময় লাগলো।
বিছানায় ফোনটা বাঁজছে। মিলি টেবিল ছেড়ে উঠে ফোন হাতে নিলো। সৌরভ ফোন দিয়েছে।
– ‘ হ্যাঁ দুলাভাই। বলেন। ‘
– ‘ শুনো মিলি জরুরী বিষয়ে কথা আছে। ‘
– ‘ কি হয়েছে ? কোন সমস্যা ? ‘
সৌরভ একটু থামলো। সময় নিয়ে বললো,
– ‘ কিছুদিন আগে আমি আর রাজিব একটা রেস্টুরেন্টে যাই। শহর থেকে দূরে একটা জায়গা। সেখানটায় আমি আর ছায়া মাঝে মাঝে যেতাম। আমি কোনোভাবে জানতে পারি সেখানে ছায়ার সাথে একটা লোক একদিন দেখা করতে যায়। আমি তাদের থেকে সিসি টিভির ফুটেজটা নিয়েছি। তোমাকে পাঠাচ্ছি এখনই। তুমি দেখে বলো লোকটা কে তুমি চিনো কী না। ‘
সৌরভের কথার আগ পিছ কিছুই বুঝতে পারলো না মিলি। তার বোনের সাথে অন্য ছেলে! বিষটা কেমন লাগলো মিলির কাছে।
– ‘ আচ্ছা দুলাভাই। পাঠান। ‘ মিলির কন্ঠে উদ্দীপনা। সে অপেক্ষা করতে লাগলো ফুটেজ আসার।
চলবে….