এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৬
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
লকাপের ভেতর এক পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে মোজাম্মেল শিকদার। চল্লিশোর্ধ্ব লোকটির চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় এলো মেলো চুল। পানসে চোখ। এরকম বয়সে জেলে আসতে হবে কখনো হয়তো ভাবেনি। সে কারণে বিষয়টা হজম করতে পারছে না। অথচ তার অপকর্ম তাকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। মানুষ বড়ই নির্মম জাতি। কঠোর তাদের মন। তারা চায় নিজের ইচ্ছা স্বধীন চলতে। চাইলে দুএকটা অপকর্ম করবে কিন্তু কেউ তাদের কিছু বলবে না। তারা থাকবে নিরাপদে, ঝামেলাহীন। দু একটা অন্যায় কাজ করলে যেন দোষের কিছু নেই। দোষটা হয় তাদের সে অন্যায়ের জন্য শাস্তি দিলে।
সৌরভ ধীর পায়ে লকাপের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মোজাম্মেল শিকদার লোকটিকে সে আগে কখনো দেখেনি। যেটুকু শুনেছে সেটুকুও ছায়ার থেকে। লোকটির মুখ দেখে কেউ বুঝতে পারবে না এ চেহারার আড়ালে একটা নোংরা মন লুকিয়ে আছে। আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষই এমন। তারাও দেখতে আর দশটা মানুষের মতোই। তাই এদের মাঝে কোনো বিকৃত মস্তিস্কের মানুষকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। মানুষের মুখে যদি ফুটে উঠতো তার মনে কি চলছে তাহলে হয়তো প্রতিটি মানুষ সতর্ক হয়ে, সাবধানে চলতে পারতো। আর কোন জীবন নষ্ট হতো না।
সৌরভ এর মুখের দিকে মোজাম্মেল শিকদার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। চিন্তে পেরেছেন কী না বুঝা গেল না। না চিনারই কথা। তাদের আগে কখনো দেখা হয়নি। মোজাম্মেল শিকদার আবার মাথা নামিয়ে ফেললেন। তাকিয়ে রইলেন মেঝের দিকে। সৌরভ হালকা ভাবে ডাকলো,
– ‘ শুনুন। ‘
মোজাম্মেল শিকদার এগিয়ে এলেন। দাঁড়ালেন সৌরভের মুখোমুখি।
– ‘ কেনো মেরেছেন আমার স্ত্রী কে? ‘ সৌরভের গলা কাঁপছিলো।
মোজাম্মেল শিকদার এবারে হয়তো বুঝতে পেলেন এই ছেলেটিই ছায়ার স্বামী। যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। তিনি হুট করে সৌরভের হাত চেপে ধরলেন নিজের দুহাতের মুঠোয়। আকস্মিক ঘটনায় সৌরভ কিছুটা চমকালো। কিন্তু তাকে বিচলিত দেখা গেলো না। কারণ মোজাম্মেল শিকদারের চোখ মুখে তখন অস্থিরতা। তিনি বললেন,
– ‘ আমি আপনার স্ত্রী কে খুন করিনি। বিশ্বাস করুন আমি কিছু করিনি। ‘
সৌরভ কিছুই বললো না। এতোক্ষণ এই লোকটিকে ভালো লাগলেও এখন তার রাগ হচ্ছে। তবুও সে নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা করছে। মোজাম্মেল শিকদার আবার বললেন,
– ‘ আমার বাসায় স্ত্রী, সন্তান আছে। তারা ভেঙে পরেছে। আমি না থাকলে তারা মরে যাবে। বিশ্বাস করুন আমি মারিনি ছায়াকে। ‘
সৌরভ সেখানে আর দাঁড়ালো না। হন হন করে হেঁটে চলে আসলো অফিসারের রুমে। সেখানে দেলোয়ার হোসেন আর রাজিব বসে আছে। রাজিবের পাশের চেয়ারটায় গিয়ে সৌরভ বসলো। তার চোখ গুলো লাল হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ সেখানে থাকলে সে লোকটিকে মেরেই ফেলতো। অফিসার সৌরভেরর দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। সৌরভ ঢক ঢক করে সবটা পানি খেলো। পর পর কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো।
– ‘ উনি তো বলছেন কাওকে খুন করেননি। ‘
সৌরভের কথা শুনে অফিসার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। মুখ শক্ত রেখে বললেন,
– ‘ কোন খুনিকে বলতে শুনেছেন ? যে সে ধরা পরার পর বলছে , হ্যাঁ আমিই খুন করেছি। ‘
সৌরভ কিছু বললো না। অফিসার আবার বললেন,
– ‘ আমরা যখন তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে বলি, ছায়া আপনার অফিসে জব করতো ? ‘ তখনই উনি ঢোক গিলতে শুরু করেন। তারপর শুরু করেন যত এলোমেলো কথা। এখন এসে বলছে খুন করেনি। তাহলে সেই ম্যাসেজ আপনার স্ত্রী দিয়েছিলো কেন! এখানে সমস্ত সন্দেহ তো একমাত্র উনার দিকেই যাচ্ছে।
সৌরভ নিশ্চুপ। অফিসারের কথা ঠিক। তাছাড়া ছায়া অনেকবার এই লোকের বিরক্তির শিকার হয়েছে এসব মিথ্যা নয়। এই লোক অফিসের বাহিরেও ছায়াকে ফলো করতো। আর সেদিন ছায়ার সেই ম্যাসেজ। সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে এই হত্যার পেছনে মোজাম্মেল এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হাত আছে। লোকটা অতি ধুরন্ধর মানুষ।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
সৌরভ বাসায় ফিরলো সন্ধ্যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শরীরের ক্লান্তি থেকে মনের ক্লান্তিটা যেন বেশি। দুচোখ জুড়ে ঘুম আসছে । সে চোখ বন্ধ করতেই ছায়ার মুখটা ভেসে উঠলো। ঘুমানো আর হলো না। কিছুক্ষণ পর কফি হাতে রুমে আসলো তোহা। সৌরভের দিকে কফি এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
– ‘ ওদিকের কি খবর ? পুলিশ কিছু জানতে পারলো ? ‘
– ‘ মোজাম্মেল শিকদার কে অ্যারেস্ট করেছে।’
– ‘ মোজাম্মেল শিকদার ? ‘ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তোহা।
– ‘ হুম। এই মুহূর্তে প্রথম সন্দেহের তালিকায় উনিই আছেন। ‘
সৌরভ তোহাকে মোজাম্মেল শিকদার বিষয়ে সবটা বললো। সব শুনে তোহা বললো,
– ‘ ওই লোকরে সামনে পেলে আমি নিজেই মেরে ফেলবো। কত বড় খারাপ হলে মানুষ এরকম বয়সে এসেও নিজের পুরুষত্ব ফলাতে চায় অন্য একটা মেয়ের উপর। ‘
এরপর সৌরভ আর তোহার সাথে এ বিষয়ে কথা বলেনি। রাতে ডিনার করে সে শুয়ে পরে। তবে ঘুম কিছুতেই হয় না। মোজাম্মেল শিকদার ধরা পরাতেও সৌরভের অস্থিরতা কিছুতেই কমছে না। সৌরভ ফোনটা নিয়ে দেলোয়ার হোসেনের নাম্বারে ডায়েল করল।
– ‘ হ্যাঁ সৌরভ সাহেব। বলুন। ‘
সৌরভ ইতস্ত করে বলে,
– ‘ আমার মনে হয় মোজাম্মেল শিকদার খুনটা করেননি। ‘
– ‘ এমনটা মনে হবার কারণ ? ‘
– ‘ জানি না। আমার মনে কেমন খটকা লাগছে। খুনটা হয়তো অন্য কাওকে দিয়ে করানো হয়েছে। তিনি নিজে করেননি। ‘
দেলোয়ার হোসেনের মুখের এক্সপ্রেশনটা ফোনের মাঝে বুঝা গেলো না। কিন্তু তার কন্ঠ বেশ ভারী আর গম্ভীর। তিনি কাঠ কাঠ স্বরে বললেন,
– ‘ দেখুন, খুনটা যদি অন্য কাওকে দিয়েও করানো হয় সেটাও মোজাম্মেল শিকদার এর মাধ্যমেই তো হয়েছে। কান টানলেই মাথা আসে। আর যদি মাথাটাই আগে পাওয়া যায় তো কানের সন্ধান খুব সহজেই পাওয়া যাবে।’
অফিসারের কথায় যুক্তি আছে। তিনি যা বলেছেন সবই ঠিক। সৌরভের ধারনা খুনটা অন্যকাওকে দিয়ে করানো হয়েছে। তবে অন্যকেউ যদি করেও থাকে সেটা তো মোজাম্মেল শিকদারের হুকুমেই। তিনি কি ভারা করে লোক দিয়ে মেরেছেন ? নাকি তার সাথে আরো কেউ যুক্ত ছিলো এ কাজে? এসব কথা বের করতে হলে উনার থেকেই বের করতে হবে। আর এ কাজ এখন পুলিশের। তার আপাততো কোন কিছু করার নেই আর।
মোহনদের ফ্লাইট ছিলো রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে। তারা বাংলাদেশ এসে পৌঁছেছে সকাল নয়টার দিকে। এয়ারপোর্ট থেকে ডিরেক্ট চলে এসেছে সৌরভের বাসায়। মিলি মোহনকে দেখা মাত্র গিয়ে জড়িয়ে ধরে। তারপর অনেক্ষণ চাপা কান্না কাঁদে দু ভাই বোন। মোহনদের থাকার জন্য আলাদা ঘর দেয়া হয়। মিলি আগে থেকেই তোহাকে নিয়ে সব রেডি করে রেখেছিলো। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় তারা। সৌরভ এর সাথে তাদের দেখা হয় সকালের নাস্তার টেবিলে। মোহন অবশ্য ছায়াকে নিয়ে কোন কথা জানতে চায়নি সৌরভ এর সামনে। সে জানে সৌরভ এর মনের অবস্থা এখন কেমন। তাই এ নিয়ে কোন আলোচনা করেনি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছিলো নিজেদের মাঝে। মোহন খেতে খেতে বলে,
– ‘ বুঝলে সৌরভ। এবারে একেবারেই চলে এলাম দেশে। ভাবছি মাঝে মাঝে গিয়ে ব্যাবসা গুলো দেখে আসবো শুধু। ‘
সৌরভ হালকা হেসে বললো,
– ‘ ভালো করেছেন ভাইয়া। আর আপনারা কিন্তু এখনি চলে যাবার কথা মুখেও নিবেন না। এখানে থাকবেন। তোহার বিয়ের পর যাবেন। ‘
– তোহার বিয়ে ? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মিলি। তার মুখে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা সেই সাথে কৌতুহল।
তোহা সৌরভের সাথেই বসা ছিলো। এমন একটা পরিস্থিতিতে পরে তার বেশ লজ্জা লাগতে শুরু করেছে। সৌরভ বললো,
– ‘ হ্যাঁ। আমার বন্ধু রাজিবের সাথে। ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে। কিছুদিন আগেই জানতে পারি বিষয়টা। আমি আর অমত করিনি। বিয়ের কথাটা আগানোর আগেই সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ‘
সৌরভের মুখে একটা ছাই রঙা আভার সৃষ্টি হয়েছে। উপস্থিত সকলে সেটা লক্ষ্য করলো। মোহন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই বললো,
– ‘ তা তে কি হয়েছে। এবারে সব হবে। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করো। এখন বাড়ি গিয়ে সব গুছিয়ে আসি। তারপর বিয়েতে লম্বা সময়ের জন্য চলে আসবো। অনেক মজা করবো সকলে মিলে।’
মোহনের কথার সাথে তাল মিলিয়ে মিলি বললো,
– ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। ধুম ধাম করে বিয়ে হবে আমাদের তোহার। ‘
তোহা লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। সেটা দেখে সুবর্ণা বললো,
– ‘ আরে মেয়ে যে এখনই লজ্জায় মরে যাচ্ছে। তোমরা থামো তো। ‘
উপস্থিত সকলে হাসলো। সেই হাসিটা শুধুই লোক দেখানো। একে অন্যের থেকে শোকটা লুকানোর জন্য। এ জগৎ সংসারের নিয়মই দুঃখ কে সামলে উঠে আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করা। প্রতিটি মানুষ সেটাই করে থাকে। শোক নিয়ে কে বা থাকতে চায়! কে বা দুঃখ কে বরণ করে স্মৃতি নিয়ে বাঁচে। সকলে ব্যস্ত সুখী হতে।
চলবে…