এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৪
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
‘সৌরভ। বস আজও খুব বিরক্ত করছে । ‘
ব্যাস এটুকুই ছিলো ম্যাসেজটা। ছায়ার নাম্বার থেকে। দেলোয়ার হোসেন ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে বললেন,
-‘ ম্যাসেজটা আপনার স্ত্রী পাঠিয়েছিলেন ?’
-‘ জি ‘ হালকা স্বরে বললো সৌরভ।
– ‘কবের ম্যাসেজ এটা ?’
সৌরভ নিজের ফোনটা আবার হাতে তুলে নিয়ে ম্যাসেজ আসার সময়টা দেখলো। দৃঢ় কন্ঠে বললো,
– ‘ঘটনার দিন। সন্ধ্যা ছয়টা চৌত্রিশ মিনিট।’
দেলোয়ার হোসেন এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
– ‘ সন্ধ্যায় আপনাকে কি ডেড বডি ম্যাসেজ পাঠিয়েছে ? সে সময় অলরেডি আপনার স্ত্রী ডেড ছিলো। তার ফোন আমরা কালেক্ট করেছিলাম। আর তারপরই আপনাকে ফোন দিয়ে জানানো হয় বিষয়টা। ‘
সৌরভ কিছু বললো না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অফিসার আবার বললেন,
– ‘ আমরা স্পটে যাই বিকেল পাঁচটার পর। সেখানে গিয়ে লাশ ব্রিজের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। তারমানে আপনার স্ত্রীর মৃত্যু হয় আরো অনেক আগে। তো আপনার এখানে সন্ধ্যায় ম্যাসেজ যাবার কোন প্রশ্নই আসে না। কারণ তখন আপনার স্ত্রীর ফোনটাও আমাদের সংগ্রহে ছিলো। আর ফোনে ছিলো ফিংগার প্রিন্ট পাসওয়ার্ড দেয়া। যে কারণে সেটা খোলাও যায়নি। ‘
সৌরভ আরো খানিক সময় চুপ থেকে বলে,
– ‘ আমার ফোনটা আমি সন্ধ্যায় অন করি। কারণ আমাদের অফিসে ফোন অন রেখে কাজ করার রুলস নেই। তাই অফ করেই রাখা হয়। অফিস শেষে যখন আমরা বাহিরে শপিং করতে যাই তখন বোনকে ফোন করার সময় ফোনটা অন করা হয়। আর সে সময়ই ম্যাসেজটা এসেছে। ‘
– ‘ তাহলে সেটা আপনি এ দুদিন বলেননি কেনো! ‘ অফিসার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেন।
সৌরভ আগের মতোই স্বভাবিক থেকে বলে,
-‘ কারণ সে মুহূর্তেই আপনারা আমাকে ছায়ার মৃত্যুর খবরটা দেন। আমি ছুটে যাই হসপিটাল। তখন ম্যাসেজ লক্ষ্য করা হয়নি। আর পরের দিনও আমি ফোনের খেয়ালে ছিলাম না। ম্যাসেজটা দেখি আমি কাল রাতে। ‘
অফিসার শান্ত হলেন। কিছু একটা ভেবে বললেন,
– ‘ তো এই ম্যাসেজে বোঝা যাচ্ছে আপনার স্ত্রীকে তার বস বিরক্ত করতো। রাইট ? ‘
– ‘ জি। ‘
– ‘ কে উনি ? ‘
– ‘ ছায়ার আগের অফিসের বস। মিস্টার মোজাম্মেল শিকদার। ‘
– ‘আপনি ঘটনা প্লিজ খুলে বলুন আমাকে।’
সৌরভ একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করলো। তারপর ছায়ার অফিসের মালিক মোজাম্মেল শিকদারের বিষয়ে বললো।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মিলি তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মায়ের চোখে পানি। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছেন। মিলি বাচ্চা মেয়ের মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। তার গলা ধরে আসছে। খুব বেশি মিস করছে নিজের বড় বোনটাকে। মিলি মাকে আরো ভালো করে দুহাতে আঁকড়ে ধরে শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,
-‘ বাবা কোথায় মা ? ‘
আমেনা বেগমের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না। কান্নার দমক চেপে বহু কষ্টে তিনি বললেন,
– ‘ ছাদে গেছে। ‘
– ‘মা। ভাইয়া কে একটা ভিডিও কল দেই? ‘
আমেনা বেগম কিছু বললেন না। তিনি নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছেন। মিলি মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসলো। নিজের ফোনটা নিয়ে এসে কল দিলো মোহন এর নাম্বারে। ফোন রিসিভ করলো মোহনের স্ত্রী সুবর্ণা। মোহন, মিলি আর ছায়ার বড় ভাই। অস্ট্রেলিয়া থাকে। সেখানে তার বিশাল বিজনেস। ঢাকাতেও একটা কোম্পানির সাথে শেয়ারে আছে মোহন। তাদের একটা চার বছরের মেয়ে আছে। মায়া। নামটা রেখেছিলো মিলি। তার নিজের নামের মাথে মিলিয়ে। যদিও এ নামে সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলো ছায়া। সে আনন্দিত হয়ে বলেছিলো, ‘ ছায়া, মায়া। বাহ! ভারী সুন্দর। ‘
মোহন প্রতি বছর ঈদে বাড়িতে আসে। অস্ট্রেলিয়া বিজনেস করা নিয়ে তার বিশাল কাহিনী। অনেক সময় লেগেছে সেখানে স্যাটেল হতে। করতে হয়েছে অনেক পরিশ্রম। তবে দেশের প্রতি, পরিবারের প্রতি টান কমেনি। সে কারণেই প্রতি বছর দেশে আসা হয় তার। ছায়ার হঠাৎ মৃত্যুতে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। মোহন চেষ্টা করেও আসতে পারেনি। রাতে সংবাদ পেয়েছে তবে টিকিট পায়নি। পরদিন সকালেই কবর হয়ে যায় ছায়ার। তার আর আসা হয়নি। মনটা একদম ভেঙে গেছে। নিজের আদরের বোনটা ছেড়ে চলে গেলো আর সে কী না দূর দেশে পরে রইলো! একটা বার দেখার জন্যও আসতে পারলো না! বড্ড বেশি অভিমান জমেছে নিজের উপর। বড্ড বেশি।
সুবর্ণা অনেকটা সময় শাশুড়ী আর ননদের সাথে কথা বললো। মোহন একটু বাহিরে গিয়েছে। ভুলে ফোন রেখে গেছে বাসায়। তাই তার সাথে আর কথা হলো না।
সৌরভ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। ঘড়িতে সময় রাত একটা। তোহা খাবার দিয়ে গিয়েছিলো রুমে। এখনো খাওয়া হয়নি। ছায়াকে ছাড়া এ নিসঙ্গতার জীবন একদমই অসহনীয় লাগছে তার। মাঝে মাঝে রাত জেগে কাজ করতে হতো সৌরভকে। শেয়ার বাজারের বিজনেস গুলোর খোঁজ রাখতে হতো। তখন এভাবে না খেয়ে কাজে ডুবে থাকলে ছায়া রেগে আগুন হয়ে যেতো। শেষ কয়েকটা মাস ছায়া অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলো। একদম অন্যরকম। তার মাঝে অনেক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ্য করছিলো সৌরভ। সেই আনমনা হয়ে থাকার কারণ গুলোও সৌরভের অজানা নয়।
বেশ কিছুদিন আগে সৌরভ অফিস শেষ করে বাসায় এসে দেখে ছায়া নিজের রুমে শুয়ে আছে। সেদিন রাতের খাবারও খায়নি সে। ডিনারের জন্য ডাকলে বলেছিলো ইচ্ছে করছে না। খাবে না। তারপর ঘুমোতে যাবার সময় সৌরভ ছায়ার কাছে গিয়ে তার হাতটা ধরে বলেছিলো,
– ‘ অনেক দিন ধরে লক্ষ্য করছি তুমি অন্যমনস্ক হয়ে আছো। ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করছো না। কিছু কি হয়েছে ? ‘
ছায়া বিছানা থেকে উঠে বসে বলেছিলো,
-‘ আমার অফিসের বসকে ঠিক লাগছে না। ‘
সৌরভ ভ্রু কুঁচকে বলেছিলো,
– ‘ ঠিক লাগছে না মানে? ‘
-‘ উনি সাধারণত বেশি সময়ের জন্য অফিসে আসেন না। সকাল দিকে আসলে লাঞ্চ টাইমেই চলে যান। দেখা যায় এগারো টার দিকে আসলে দু ঘন্টা কাজ গুলো দেখে লাঞ্চেই বের হয়ে যান। ম্যানেজার সাহেবই সব দেখাশুনা করেন। কিছুদিন আগে একটা ফাইল সাইন করাতে উনার রুমে গেলাম। উনি আমার দিকে কিভাবে যেনো তাকিয়ে ছিলেন। এরপর আরেক দিন আমি লক্ষ্য করেছি উনি আমার শরীরের দিকে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে থাকেন। সেই দৃষ্টিটা কতটা নোংরা তা শুধু আমিই বুঝতে পারি। ‘
এটুকু বলে ছায়া থামে। সৌরভ কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। সে শুধু ছায়ার হাত ধরে বলেছিলো,
– ‘ চিন্তা করো না। সব জায়গায় এমন ধরনের কিছু লোক থাকে। এদের এড়িয়ে চলে একটু সাবধানে থাকবে। ‘
এরপর অনেক গুলো দিন যায়। ছায়া তেমন কিছু বলেনি তার বস সম্পর্কে। তারপর আসে এক শনিবার। সৌরভের অফিস বন্ধ। সে বাসাই ছিলো। ছায়া অফিস থেকে এসে অস্থির চিত্তে বলে, সে আর এ অফিসে জব করবে না। সৌরভ কারণ জানতে চাইলে ছায়া কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলো,
– ‘ আমি আজও উনার রুমে গিয়েছিলাম একটা ফাইল নিয়ে। উনি উঠে এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফাইলটায় সাইন করলেন। তারপর হঠাৎ আমার কোমড় নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। আমি কোনভাবে ছুটে চলে এসেছি। অফিস বলে কোন ঝামেলা করতে পারেনি। ‘
একথা শুনে সৌরভের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো। সে ছায়াকে সেদিন বলে দেয় পরের দিনই যেন অফিসে রেজিগনেশন লেটার দিয়ে দেয়। ছায়াও সৌরভের কথা মতো রেজিগনেশন দেয়। সেই অফিস ছেড়ে দিয়ে জয়েন করে অন্য একটা অফিসে। কিন্তু সেটাও কোনভাবে সেই লোক টের পায়। নতুন অফিস থেকে ফেরার পথে একদিন তিনি ছায়ার পথ আটকায়। ছায়াকে বিভিন্ন ভাবে অফার করে নিজের কাছে নেবার। সেটা ছায়ার ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক। এরপর অবশ্য তেমন কোন কিছু আর হয়নি। ছায়া তাকে এ বিষয়ে আর কিছুই জানায়নি। তবে ছায়া সব সময় ভয়ে থাকতো। এই বুঝি লোকটা আবার তার পথ আটকায়। এই বুঝি তার কোন ক্ষতি করে দেয়।
চলবে….