এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ৩

0
1510

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৩
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

-‘আমরা লাশটা পেয়েছি বিকেলে একশো ফুট প্রথম ব্রিজের নিচে। পানিতে ভাসতে ভাসতে ব্রিজের কাছে চলে এসেছিলো। সেখানে বিকেলে অনেক মানুষ হাঁটতে যায়। তেমনি এক কাপল ঘুরতে গিয়েছিলো। লাশটা প্রথমে তাদের দৃষ্টিতেই পড়ে। বস্তার ভেতর ঢুকানো ছিলো। কোন ভাবে বস্তার মুখটা খুলে যাওয়ায় হাত বেড়িয়ে এসেছিলো। তখনই সেই দম্পতি বিষয়টা লক্ষ্য করে। আশেপাশের আরো অনেক লোক জড়ো হয়। পুলিশকে খবর দেয় তাদের মাঝেই একজন। তখন আমরা গিয়ে লাশ উদ্ধার করি পানি থেকে। ‘
অফিসার এটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। সৌরভ তখন অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ভরে আছে নোনাজলে। দুফোটা জল গাল বেয়ে গলা দিয়ে গড়িয়ে পরলো। ছায়াকে কেউ এতো কষ্ট দিয়ে মেরেছে সেটা ভাবতেও সৌরভের কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে।

অফিসার আবার বললেন,
-‘সাধারণত এ ধরনের হত্যায় কেউ কোন প্রমাণ রাখে না। সব কিছু লুকিয়ে ফেলে। মার্ডার করা হয় খুব প্ল্যান করে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আপনার স্ত্রীর লাশের সাথে তার অফিসের আইডি কার্ড, মোবাইল সহ পার্স ব্যাগটাও রাখা ছিলো। আরো একটি বিষয় আমরা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে জেনেছি। উনারর শরীরে আঘাতের কোন চিহ্ন নেই। তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছে।’

সৌরভ কিছু বলতে পারলো না। তার চোখ মুখের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। সে নিজেও জানে না ছায়াকে এভাবে কে হত্যা করবে। সৌরভের জানা মতে ছায়ার কোন শত্রু ছিলো না। বরং সকলে তাকে অল্পতেই পছন্দ করে ফেলতো। দেখা যেতো ছায়া নিজেই লোকজনদের একটু এড়িয়ে চলতো। খুব দরকার ছাড়া মেলামেশার স্বভাব তার মাঝে ছিলো না।

অফিসার সৌরভের থেকে তেমন কোন ক্লু পেলো না। বরং যতবারই সৌরভ শক্ত হয়ে কথা বলতে চেয়েছে ততোবার ছায়ার হত্যার কথা শুনে সে ভেতরে ভেতরে দুমরে মুচরে গেছে। চেষ্টা করেও জানা গেলো না সৌরভের থেকে কিছু।  যতটুকু বোঝা গেছে এই মেয়ের তেমন শত্রু নেই। কারণ তেমন কিছু হলে তার হাসব্যান্ড প্রতিটি কথা শুনে অবাক হতো না। কোন কিছু জানতে না পেরে অনেকটা হতাশ হয়েই ফেরত যেতে হলো দেলোয়ার হোসেনের।

মাঝ রাত। তোহা আর মিলি দুজন দুপাশ ফিরে শুয়ে আছে। কারো চোখেই ঘুম নেই। সব কিছু কেমন যেনো গুমোট হয়ে গেছে। মনের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে একটা ঘন কালো মেঘের ছায়া। সে মেঘ কখনো কখনো বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। তোহা উঠে এসে বেলকনিতে দাঁড়ালো। দুতলা বিশিষ্ট এ বাড়িটা তার বাবা তৈরী করেছিলেন। তবে বেশি দিন থাকার ভাগ্য হয়নি তার। অনেক আগেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি চলে গেছেন। মা আর ভাই ছিলো তার জীবনে। সেই ভাইয়ের বিয়ের পর যখন মা মারা গেলো তখনও তাকে কোন কষ্ট পেতে দেয়নি সৌরভ। ভাইয়ের বিয়ে হলে সেই সংসারে খুব কম মেয়েই বাবা মা ছাড়া সুখে থাকে। তবে তোহার বেলায় তেমন হলো না। ছায়া তার ভাবী হলেও মায়ের মতো স্নেহ করতো তাকে। সেই ভাই আর ভাবীকে নিয়ে সে খুব ভালো ছিলো। যে ভাই তাকে খুব যত্ন করে আগলে রেখেছিলো সেই ভাই আজ সব থেকে বেশি যন্ত্রনা বুকে নিয়ে বেঁচে আছে। ছায়া চলে গেছে ঠিকই তবে সাথে করে নিয়ে গেছে তার ভাইয়ের সমস্ত সুখ, বেঁচে থাকার ইচ্ছা।

ফোনের রিংটোন বাজছে। রাজিব ফোন করেছে। তোহা ফোন রিসিভ করে কানে ধরে রাখলো। কোন কথা বলছে না সে। রাজিব বললো,
– ‘ঘুমাওনি ?’
– ‘ঘুম আসছে না।’
– ‘রাতে খেয়েছো ?’
– ‘হুম।’
– ‘সৌরভ ?’
– ‘ভাইয়া রুমের দরজা বন্ধ করে আছে। তাকে ডেকেছিলাম। খেতে নামলো না।’
– ‘ঠিক আছে। তোমরা আর কিছু বলো না। কাল সকালে আমি আসবো। একবার থানায় যেতে হবে। পুলিশকে আমরা হেল্প না করলে তো চলবে না। সৌরভ যদি কোন কিছু জানে সেটাও জানাতে হবে তাদের।’
– ‘হুম।’

ড্রইং রুমে সকলে বসে নাস্তা করছে। সকাল সকাল সবার ঘুম ভেঙে যায় আজ। ঘুম ভেঙেছে বললে ভুল হবে। আসলে কারোর ঘুমই হয়নি। তোহা আর মিলি সকালে উঠে নামাজ পরেছে।  আমেনা বেগম নামাজ পরে মেয়ের নামে কোরআন তিলাওয়াত করেছেন। সকলের মনের অবস্থা খারাপ। তবুও সৌরভকে দেখে তার জন্যই যেনো নিজেদের সামলে রেখেছেন তারা। আশফাক আহমেদ বরাবরই কম কথা বলার মানুষ। তিনি নিজের ভেতরের কষ্ট বাহিরে প্রকাশ করতে পারছেন না। মূর্তিমান হয়ে বসে আছেন। মেয়েটাও ছিলো তার মতো। ভেতর লুকানো স্বভাবের। সৌরভকে তিনি শুরুতেই পছন্দ করে নিয়েছিলেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন ধুম ধাম করে। আজ তিনি বুঝতে পারছেন ছেলেটা সত্যি তার মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র ছিলো। কিন্তু কি হয়ে গেলো! যে মেয়ের সুখের কথা ভেবে এতো কিছু করলেন, সেই মেয়েই কী না চলে গেলো। সন্তানের লাশ যখন বাবা মা কে দেখতে হয় তখন এর থেকে বেশি কষ্ট দুনিয়াতে আর কী বা থাকে!  

আমেনা বেগম তোহাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– ‘মা। তুমি একবার সৌরভ বাবাকে ডেকে আনো।  ছেলেটা ঠিক ভাবে কিচ্ছু খাচ্ছে না। এভাবে থাকলে তো মরে যাবে আমার বাচ্চাটা।’

তোহা মুখ নিচু করে রইলো। সে অনেকবার ডেকেছে তার ভাইকে। কিন্তু সৌরভ বের হচ্ছে না। আমেনা বেগমের ভেজা কন্ঠের সামনে তোহা কোন উত্তর দিতে পারলো না।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

কলিং বেল বাজছে। রহিমা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। রাজিব এসেছে। রাজিবকে দেখা মাত্র আমেনা বেগম যেনো একটু স্বস্তি পেলো। এই মুহূর্তে সৌরভকে কন্ট্রোল করতে পারবে একমাত্র সে। তিনি রাজিবকে ডাকলেন,
– ‘আসো বাবা। আসো। বসো চেয়ারটায়।’

রাজিব আমেনা বেগমের পাশের চেয়ারটায় বসলো। তোহার মুখের দিকে তাকালো একটাবার। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো সে। তোহার সাথে তার একটা সুন্দর সম্পর্ক। এ সম্পর্কের একটা নাম হবে কিছুদিন পর। আর এর মাঝে এমন একটা কান্ড হয়ে গেলো!

আমেনা বেগম রাজিবের প্লেটে নাস্তা দিচ্ছিলেন। সে সময় নেমে এলো সৌরভ। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবী, পাজামা। মুখটা ঘোলাটে দেখাচ্ছে। ফর্সা গায়ের রঙ যেন কিছুটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। সকলে সৌরভকে নেমে আসতে দেখে একটু অবাক হলো। সেই সাথে বুকের মাঝে চাপ দিলো একটা অসহ্যকর ব্যাথা। যদিও সৌরভকে তেমন বিচলিত দেখালো না। সে সুন্দর করে এসে চেয়ার টেনে বসলো। নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে খেতে লাগলো। সকলে এখন বেশ চিন্তিত। সৌরভ কী করতে চাচ্ছে বা কী হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারলো না। দুদিন পাগলের মতো হয়ে থাকা ছেলেটা এখন কী না স্বাভাবিক আচরণ করছে ! বেশ ধাক্কা খেলো উপস্থিত সকলে। তোহা কান্না ভেজা চোখে তাকালো রাজিবের দিকে। রাজিব চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে শান্ত হতে বললো।  তবে এসবের কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সৌরভের। সে নিজের  মতো খাওয়া শেষ করলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে রাজিবকে বললো,
-‘ চল। বের হবো। ‘
– ‘ কোথায় যাবো ? ‘ রাজিবের প্রশ্ন।
সৌরভ কোন উত্তর দিলো না। বের হবার আগে একবার আশফাক আহমেদ কে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে নিলো। সালাম করলো আমেনা বেগমকেও। আমেনা বেগম কিছু বুঝতে পারলেন না। তবুও সৌরভের মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন তিনি। সৌরভের চোখের কোণ ভারী হয়ে আসছে। সে নিজেকে বহু কষ্টে সামলালো। আমেনা বেগমের হাতটা ধরে বললো,
– ‘আমি আপনাকে কখনো ছায়ার মা ভাবিনি।  আমার নিজের মা ভেবেছি। থানায় যাচ্ছি মা। দোয়া করবেন। যারা ছায়ার এ অবস্থা করেছে তাদের খুঁজে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পুলিশকে আমি আমার সবটা দিয়ে সাহায্য করবো।’

কথাটা শেষ করে সেখানে আর দাঁড়ালো না সৌরভ। সে আর ভেঙে পরবে না। নিজের সাথেই প্রতিজ্ঞা করেছে। শক্ত হতে হবে তাকে।

দেলোয়ার হোসেনের সামনের দুটো চেয়ারে বসে আছে সৌরভ আর রাজিব। তিনি একটা মামলার ফাইল দেখছিলেন। সেটার কাজ শেষ করে তারপর কথা বলবেন বলে সৌরভদের একটু অপেক্ষা করতে বলেছেন। থানায় সব সময় বিভিন্ন মামলা আর তদন্তে ব্যস্ত থাকতে হয় পুলিশদের। একটা মামলা নিয়ে বসে থাকার মতো অবস্থায় তারা থাকেন না। এক সাথে সব দিক, সব মানুষের সমস্যা দেখতে হয় তাদের। সেই সাথে থাকে উপর মহলের চাপ। মিডিয়ার বিভিন্ন আলোচনা তো আছেই। হাতের ফাইল টা দেখে সেটা সাইডে রেখে অফিসার  সৌরভের উদ্দেশ্যে বললেন,
– ‘ হ্যাঁ। বলুন। আপনার সন্দেহ হয় কাকে ? বা কোন ক্লু অথবা কোন কিছু কি সন্দেহ জনক আছে যা আপনি জানুন ?’ 

সৌরভ নিজের মোবাইলটা বের করে দেলোয়ার হোসেন এর সামনে রাখলেন। ফোনের স্ক্রিনে একটা ম্যাসেজ দেখা যাচ্ছে শুধু। ম্যাসেজটা এসেছিলো দুদিন আগে। যেদিন ছায়ার মৃত্যু হয়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে