এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৭
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
বউভাতের দিন বর কনেকে এক সাথে কনের বাড়িতে যাবার রীতি হলেও রাজিব যেতে পারলো না। রাজিবের মা মাঝে মাঝেই ঢাকায় এসে ছেলের সাথে থাকেন। তবে দীর্ঘ সময় নিয়ে কখনো থাকেন না। স্বামীর ভিটায় ফিরে যাবার জন্য পাগল হয়ে যান । তাই এবারও থাকতে রাজি না তিনি। ছেলে আর ছেলের বউকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছেন যাতে তাকে গ্রামে দিয়ে আসে। মা কে গ্রামে দিয়ে আসতে হবে রাজিবের। এদিকে অফিসেও যেতে হবে। মাঝে অনেক দিন সৌরভের সাথে ছুটোছুটি করতে গিয়ে অফিস থেকে ছুটি নেয়া হয়েছিলো। এখন আবার এভাবে বার বার ছুটি নিলে চাকরীটাই থাকবে না। তাই সব দিক ম্যানেজ করতে গিয়ে সৌরভদের সাথে তোহাকে একাই পাঠালো রাজিব। সে গেলো গ্রামে মা কে দিয়ে আসতে।
বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে আসায় অন্যরকম একটা অনুভুতি কাজ করছে ভিতরে ভিতরে। শাড়ি পরে সারা বাড়িতে এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তোহা। কখনো সুবর্ণার ঘরে গিয়ে আড্ডায় মেতে উঠছে আবার কখনো বা মিলির সাথে।
সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে মিলে ড্রইং রুমে বসে কথা বলছিলো। তখন সৌরভ আসে বাহির থেকে। সৌরভকে দেখে তোহা ডাকে,
– ‘ ভাইয়া এসো। বসো এখানে। ‘
তোহার ডাকে সৌরভ এগিয়ে এসে বসে বোনের পাশে। মিলি তাদের সোজা সামনের সোফায় বসে আছে। সৌরভের চুল গুলো এলোমেলো। গরমে নাকের ডগায় হালকা ঘাম জমেছে। সেদিকেই আনমনে তাকিয়ে আছে মিলি। তার বুকের ভেতর তখন ঢিপ ঢিপ শব্দ তুলে যাচ্ছে। মিলির এমন ভাবে তাকিয়া থাকাটা তোহাই প্রথমে লক্ষ্য করলো। সে সৌরভকে হাত দিয়ে আলতো করে খোঁচা দিলো। সৌরভ তোহার দিকে তাকাতেই তোহা চোখের ইশারায় মিলিকে দেখালো। তোহার ইশারা অনুসরণ করে তাকাতেই সৌরভের সাথে চোখে চোখ পরলো মিলির। মুখে দেখা গেলো এক রাশ লজ্জা। ঠোঁটের কোণে লুকানো হাসি। সৌরভ সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো অপ্রস্তুত হয়ে। মিলির সাথে সে যতটা সহজ ছিলো ইদানিং ততোটা সহজ নেই সে। আরো বেশি জটিল হয়ে গেছে তাদের মাঝের সম্পর্কটা। আজ কাল মিলিকে দেখলে সে এড়িয়ে যেতে চায়। নিজের ভিতরে কেমন একটা সংকোচ বোধ করে। কিছুটা অস্বস্তিও হয়। কিন্তু এমনটা কেনো হয় সে কারণ সৌরভ বুঝতে পারে না। তার আর মিলির সম্পর্কটা তো মজা করার, হাসি তামাশা করার। তবে এখন সেটা না হয়ে বিপরীত কিছু কেনো হচ্ছে! মিলিরও কি এমনটাই হচ্ছে ?
– ‘ আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। তোমরা বসে কথা বলো। ‘ বলেই উঠে চলে গেলো সৌরভ। মিলি হাসলো। ঠোঁট টিপে লুকানো হাসি।
রাতে ডিনার শেষ করে যে যার রুমে চলে গেছে। তোহা নিজের রুমে এসে দেখলো মিলি ফোনে কিছু একটা দেখছে। সে খুব সাবধানে এগিয়ে এলো মিলির দিকে। সতর্ক ভাবে এসে দাঁড়ালো মিলির পেছনে। তারপর মুখে ফুটে উঠলো তার রাজ্যের খুশির ঝিলিক। মিলির হাতে থাকা ফোনে সৌরভের একটা ছবি। তোহার বিয়ের দিন তোলা ছবিটা। মিলি সৌরভের ছবি দেখছে আর তখন ড্রইং রুমে সেভাবে তাকিয়ে ছিলো সৌরভের দিকে। এসব কিছু মিলিয়ে তোহা বুঝতে পারলো বিষয়টা। সে পেছন থেকে মিলির গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘ লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ভাইয়ের ছবি দেখা হচ্ছে ! ‘
মিলি চমকে উঠলো। ফোনটা দ্রুত পাশে উল্টে রেখে দিলো। তবে ততোক্ষণে যা বুঝার বুঝে গেছে তোহা। মিলি একটু কাঁচুমাচু করে বললো,
– ‘ কই না তো । ‘
তোহা হেসে বললো,
– ‘ দেখলাম তো আমার ভাইয়ের ছবিই দেখছিলে। তাছাড়া সন্ধ্যায় ড্রইং রুমে সেভাবে তাকিয়ে ছিলে সেটাও দেখেছি। ‘
ধরা পরে লজ্জায় ভেঙে পরলো মিলি। কী বলবে বুঝতে পারছিলো না। মাথা নিচু করে লজ্জা আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সে।
– ‘ ভালোবাসো আমার ভাইটাকে ? ‘
তোহার কথায় মিলি চোখ মেলে তাকালো তার দিকে। সে কী সৌরভকে ভালোবাসে ? এই অল্পদিনে কী কারো প্রতি ভালোবাসা হয়ে যায় ? উত্তর জানা নেই মিলির। সে শুধু জানে মানুষটার প্রতি এখন অন্যরকম অনুভুতি কাজ করে। মানুষটাকে দেখলে বুকের মাঝে শান্তির জোয়ার বয়ে যায়। এক ঝাক প্রজাপতি উড়ে যায় গা ঘেঁষে।
দুদিন ভাইয়ের কাছে থেকেই তোহা আবার চলে গেলো। রাজিব এসে নিয়ে গেছে ওকে। সংসার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে তোহা। নিজের মতো গুছিয়ে নিচ্ছে সব কিছু। ভালো লাগা কাজ করছে মনের মাঝে। অদ্ভুত ভালোলাগা। নিজের হাতে সংসারের সব হাল ধরাতে কী এক অবিশ্বাস্য আনন্দ! তা সে উপভোগ করছে।
সুবর্ণা আর মায়াকে নিয়ে মোহন কুমিল্লা চলে গেছে। মিলিকে একা রেখে যদিও তার বাবা মা যায়নি। তারা ঢাকায়ই আছেন। সৌরভের সাথে রোজ অফিস যাচ্ছে মিলি। আবার এক সাথে ফিরছে। বাসায় এসে রাতে সকলের সাথে এক টেবিলে বসে খাচ্ছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে রাতে খুব করে গল্প করছে। ঘুমুতে যাবার আগে রয়েছে সৌরভের দেয়া দৈনন্দিন অজস্র স্মৃতি। বেশ আছে মিলি। রূপকথার রাজকুমারীর মতো করে রাজকুমার কে দূর থেকে দিন কে দিন শুধু ভালোবেসেই যাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। সে চায় সৌরভ তার ভালোবাসা উপলব্ধি করুক। নিজ থেকে বুঝুক মিলি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তবে সেটা কী কখনো বুঝবে সৌরভ ? না বুঝলেও ক্ষতি নেই। এই মানুষটাকে সে দূর থেকেও আজীবন ভালোবেসে যেতে পারবে।
সৌরভ ছায়ার ছবির সামনে এক মনে দাঁড়িয়ে ছিলো। মনটা আজ বড্ড খারাপ লাগছে। বার বার মনে পড়ছে ছায়ার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো। অথচ ছায়ার মৃত্যুটা ধোঁয়াশাই রয়ে গেলো। কোন ভাবেই পারলো না খুনিকে খুঁজে বের করতে। বিষণ্ন মনে যখন সৌরভ বারান্দার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। তখনই আমেনা বেগম সৌরভের রুমে প্রবেশ করলেন। সৌরভ শাশুড়ী কে দেখে হাতে রাখা সিগারেট টা নিভিয়ে ফেলে দিলো। রুমের ভিতর এসে যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাবে বললো,
– ‘ বসুন মা। আপনি কষ্ট করে এলেন কেনো! আমাকে ডেকে পাঠাতে পারতেন। ‘
– ‘ ছেলের ঘরে মা আসতে পারে না বুঝি ? ‘
– ‘ অবশ্যই পারে। ‘ হাসি মুখে বললো সৌরভ।
আমেনা বেগম চুপ করে রইলেন। তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে মুখশ্রী। সৌরভ সেটা লক্ষ্য করে বললো,
– ‘ আপনাকে কেমন যেনো দেখাচ্ছে মা। কোন সমস্যা হয়েছে ? ‘
– ‘ তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি বাবা।’
– ‘ হ্যাঁ। বলুন। ‘
– ‘ ছায়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে অনেক দিন হলো। আমরা এখানে আছি। আমাদেরও বাড়ি ফিরে যেতে হবে। সারাজীবন তো এখানে থাকা সম্ভব না। তাছাড়া তোহার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমিই বা একা বাড়িতে থাকবে কী ভাবে ? আর কতদিনই বা এভাবে একা জীবন পার করবে ? তুমি আমার ছেলের মতো বলবো না। তুমি আমার আরেকটা ছেলে। মোহন যতটা, ঠিক ততোটাই তুমি। তাই একজন মা হিসেবে আমি চাই তুমি নিজের জীবন আবার নতুন ভাবে শুরু করো। বিয়ে করো। জীবন শুধু কারোর মায়া নিয়ে পার করা যায় না। জীবনে চলতে হলে এক জন সঙ্গীর খুব বেশি প্রয়োজন আছে। ‘
– ‘ আমি সবই বুঝতে পেরেছি মা। তবে এখন এসব সম্ভব না। ছায়াকে ভুলে অন্য কাওকে বিয়ে করে জীবন পার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। যদি বিয়ে করতেও হয় সেটা পরে দেখা যাবে। এখন এ সব নিয়ে ভাবছি না আমি। ‘ খুব শান্ত ভাবে বললো সৌরভ।
– ‘ কত দিন এভাবে পার করবে ? একা বাঁচা যায় না। জীবনে চলার পথে অনেক বাধা আসে। অনেক খারাপ পরিস্থিতি আসে। তখন আবেগ দিয়ে বাঁচা যাবে না। আর কারোর স্মৃতি নিয়ে জীবন পার করে দেয়াটা আবেগ ছাড়া কিছু না। আবেগ কে প্রশ্রয় দিলে চলে না। আমি তোমার বিয়ে দিয়ে তারপর নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে চাই। ‘
সৌরভ কিছুই বললো না। তাকে চুপ থাকতে দেখে আমেনা বেগম আবার বললেন,
– ‘ মিলিরও বিয়ের বয়স হয়েছে। এবার তার বিয়ের কথাটাও ভাবছি আমরা। তাই আমি চাই আমার ঘরের ছেলে ঘরে মায়ের কোলেই থাকুক। তোমার আর মিলির বিয়ে দিতে চাই আমি। যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে। ‘
সৌরভ অবাক হয়ে তাকালো শাশুড়ীর মুখের দিকে। বিস্ময় খেলা করছে তার চোখে মুখে।
– ‘ কী বলছেন মা। মিলি! আমি ওকে সে ভাবে দেখিইনি কখনো। মিলির বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই মিলে ওর জন্য অনেক ভালো ছেলে খুঁজে আনবো। তবে আমার সাথে না। মিলি নিজেও এটা মানতে পারবে না। আর আমিও না। ‘
আমেনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
– ‘ মিলি যে তোমাকে ভালোবাসে তা জানো ?’
সৌরভের মুখটা যেনো শুকিয়ে মিইয়ে গেলো। এরকম কিছুই হয়তো তার অবচেতন মন বুঝতে পারছিলো। কিন্তু সবটাই ছিলো ঝাপসা। সে একবারও ভাবেনি এমন কিছু হতে পারে। মিলি তাকে ভালোবাসে এটা তার জন্য চরম বিব্রতকর বিষয়। সত্যি মিলি তাকে ভালোবাসতে পারে এটা তার মাথায়ও আসেনি। সে শুধুই মিলির পাগলামো গুলো দেখে অবাক হয়েছে, চমকেছে। তবে কখনোই এই বিষয়টাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি।
চলবে…