এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৬
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
রাজিবের কিছু বন্ধুরা এসেছে বাসায়। তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো তোহাকে। সব সময় বন্ধুরা এক সাথে হলে সেখানে সৌরভও থাকতো। কিন্তু এখন এটা যেহেতু বোনের শ্বশুর বাড়ি তাই সে যখন তখন আসতে পারে না বলে আসেনি। তোহাকে নিতে বউভাতে একদম আসবে বলেছে। এতো গুলো ছেলের মাঝে বসে কথা বলতে তোহার অস্বস্তি লাগছিলো। তবে রাজিবের কারণে থাকতে হচ্ছে তাকে। যদিও রাজিব তোহার পাশে বসে আছে তার হাত ধরে। তাই সাহস পাচ্ছে তোহা। বন্ধুরা সবাই বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেও তোহা চুপচাপই রয়েছে। লম্বা করে একটা ছেলে বললো,
– মাশাল্লাহ রাজিব! তোর চয়েজ আছে বলতে হবে। ভাবি দেখতে খুব মিষ্টি।
ছেলেটির কথার মাঝে একটা মাধুর্য আছে। তোহার ভালো লাগলো। সে হালকা হেসে মাথা নিচু করে রইলো। পাশ থেকে কথার পিঠে অন্য একটি ছেলে বলে উঠলো,
– ‘ মিষ্টি কি খেয়ে দেখবি না কি ? ‘
কথাটি শেষ করে ছেলেটি তোহার দিকে একটু নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকালো। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠলো তোহার। তবে অন্য বন্ধুরা হয়তো জানে ওই ছেলেটার কথাবার্তাই এমন। তাই তাদের মাঝে একজন বললো,
– ‘ আরে বাদল! তোর কথার ধরন আর ঠিক হলো না। সব জায়গায় শয়তানি করতে নেই। ভাবি তো জানে না তুই মজা করছিস। বেচারি বিব্রত বোধ করবে। ‘
রাজিবও ভ্রু কুঁচকে তাকালো বন্ধুর দিকে। স্ত্রীর সামনে বন্ধুর এমন ধরনের কথায় বেশ বিরক্ত সে।
বাদল নামের ছেলেটা অদ্ভুত হাসলো। তখন তোহার রুম থেকে ফোন বাজার শব্দ কানে আসতেই তোহা উঠে চলে গেলো রুমে। পেছন পেছন রাজিবও এলো।
তোহা ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিলির কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
– ‘ কী করা হচ্ছিলো তোহা রাণী ? ‘
তোহা হাসলো। প্রাণ জুড়ানো হাসি।
– ‘ ওর বন্ধুরা এসেছে। তাদের সাথেই কথা বলছিলাম। ‘
– ‘ তাহলে কথা বলো। পরে কল দিবো না হয় আমি। ‘
– ‘ আরে না না। ওরা আছে থাকুক। এখন বলো তোমরা কাল আসছো তো ? ‘
– ‘ হুম আসছি। ‘
তোহা আর মিলির কথার মাঝে রাজিব তোহার ঘাড়ে নাক ঘঁষতে শুরু করেছে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে সে তোহাকে। তোহা হাসি চেপে রেখে কথা বলছিলো। কথা শেষ হতেই ফোন রেখে পাশ ফিরে তাকালো। রাজিবের গলা জড়িয়ে ধরে ভ্রু উঁচিয়ে যখন তাকিয়ে ছিলো তখন রাজিব তোহার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। এমন সময় দরজার পাশ থেকে বাদল কেঁশে উঠলো। তোহা দ্রুত সরে দাঁড়িয়ে কাপড় ঠিক করে নিয়ে মাথায় দিলো। বাদল হালকা হেসে বললো,
– ‘ নতুন বউ পেয়ে নরছিসই না যে। আমাদেরও সময় দে। ‘
রাজিব কটমট করে তাকালো বাদলের দিকে। এই ছেলে সব সময় এমন। তবে তোহা এই পরিবারে নতুন বলে তার সামনে ঝামেলা করতে চাচ্ছে না রাজিব। বাদল কথা শেষ করে চলে যেতেই সে তোহাকে বললো,
– ‘ ওদের সামনে আর যেতে হবে না তোমাকে। বেশি শয়তানি করছে। তুমি বরং থাকো রুমে। ‘
তারপর রাজিব বেড়িয়ে গেলো ড্রইং রুমে। তোহা মাথা থেকে কাপড় টা সরিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে বিছানায় বসলো । এতো গুলো ভালো বন্ধুর মাঝে এমন দু একটা না থাকলে কি চলে না? কেমন বিশ্রী স্বভাব এদের!
সৌরভ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরার পর ড্রইং রুমে সকলকে এক সাথে ডাকা হলো। সবাই এসে দেখলো সৌরভের সামনে রাখা অনেক গুলো শপিং ব্যাগ। মিলি অবাক হয়ে বললো,
– ‘ এতো শপিং ? ‘
– ‘ হ্যাঁ। কাল তো তোহার শ্বশুর বাড়ি যাবো তাই তাদের জন্য কিছু শপিং করলাম। ‘
– ‘ বেশ ভালো করেছেন। ‘
সৌরভ এগিয়ে গিয়ে আমেনা বেগমের হাতে একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে বললো,
– ‘ এটা আপনার জন্য মা। কাল পরবেন। ‘
আমেনা বেগম হাসি মুখে বললেন,
– ‘ আমাদের জন্য কেনো আবার! তাছাড়া কাল তো আমি বাসায়ই থাকবো। তোমরা গিয়ে তোহাকে নিয়ে আসবে। ‘
– ‘ না। আপনারা সবাই যাবেন। ‘
– না বাবা। বাসায় আমরা থাকি। তোমরা ছেলে মেয়েরা যাও। এদিকটায়ও তো কাওকে থাকতে হবে।
সৌরভ অনেক জোড়াজুড়ি করেও লাভ হলো না। আমেনা বেগম যেতে রাজি হলেন না। তারপর সৌরভ শপিং ব্যাগ গুলো একে একে সকলের হাতে দিলেন। বাড়ির সকলের জন্য সে শপিং করে নিয়ে এসেছে। মিলির হাতে শপিং ব্যাগটা দেয়ার সময় মিলি বললো,
– ‘ এটা নিয়ে যান আপনার সাথে। পরে এসে নিয়ে নিবো আমি। ‘
সৌরভ একবার উপস্থিত সকলের দিকে তাকালো। সবার সামনে মিলির এমন কথায় কে কী ভাবছে এটা ভেবেই সৌরভের অস্বস্তি লাগতে লাগলো। মিলির সাথে এখন কথা না বাড়ানোই ভালো। তাই সে মিলির শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
সৌরভ রুমে যেতেই পেছন পেছন মিলিও গেলো। রুমে ঢুকেই বললো,
– ‘দেন তো শপিং ব্যাগটা।’
সৌরভ ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে দিলো শপিং ব্যাগ। বললো,
– ‘ সকলে কী ভাবলো তোমার এমন কান্ডে ?’
– ‘ কী ভাববে? আপনার সাথে কী আমি প্রেম করছি নাকি যে কিছু মনে করবে !’ ব্যাগ থেকে ড্রেসটা বের করে দেখতে দেখতে আনমনে বললো মিলি।
সৌরভ বিষম খেলো। কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
– ‘ ড্রেস পছন্দ হয়েছে ? ‘
মিলি সাদার মাঝে গোলাপি সুতোর কাজের জামাটা দেখে বললো,
– ‘ খুব। তবে আপনি আমার জামার সাইজ বুঝলেন কী ভাবে ? ‘
– ‘ তুমি আর ছায়া তো একরকমই। ছায়ার মাপ জানা ছিলো। সেই মাপেই এনেছি। ‘
মিলি কিছু বললো না। খুটিয়ে খুটিয়ে জামা দেখছে এমন ভাব নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো সে।
পরদিন সকালে সকলে মিলে তৈরী হয়ে নিলো রাজিবের বাসায় যাওয়ার জন্য। গাড়িতে সৌরভ আর মোহন সামনে বসলো। সুবর্ণা মায়া আর মিলি বসেছে পিছনের সিটে। সৌরভের কিনে আনা ড্রেস গুলো সকলে পরেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে সৌরভ যখন ড্রাইভ করছিলো তখন তার চোখ গেলো গাড়ির লুকিং গ্লাসে। মিলি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়ে তার মিষ্টি হাসি। গাড়ির জানালার কাচের ফাঁক গেলে হাওয়ার ঝাপটা এসে স্নিগ্ধ চুল গুলোকে এলোমেলো করে উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সৌরভের চোখে চোখ পড়তেই মিলি চোখ টিপলো । সাথে সাথে সৌরভ চোখ বন্ধ করে ঘাড় দুপাশে ঝাকিয়ে মনোযোগ সরিয়ে নিলো ড্রাইভিং করায়।
গাড়ি থেকে নেমে মোহন, সুবর্ণা আর মায়া আগে আগে গেইটের দিকে হাঁটতে লাগলো। মিলি নামলো সবার শেষে। সৌরভ নেমে এসে মিলিকে না দেখার ভান করেই যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন মিলি পেছন থেকে ডেকে বললো,
– ‘ এই যে শুনুন। ‘
না চাইতেও পেছন ফিরে তাকাতে হলো সৌরভকে। সে এগিয়ে এসে মিলিকে বললো,
– ‘ আরে এখনো দাঁড়িয়ে কেনো তুমি! চলো ভেতরে চলো। ‘
মিলি সৌরভ কে একবার উপর নিচ ভালো করে দেখে নিয়ে বললো,
– ‘ ভেতরে তো যাবোই। তার আগে বলুন আপনি আজও সাদা পাঞ্জাবী পরলেন কেনো! সব সময়ই দেখি পাঞ্জাবী পরলে সাদা কালারটাই পরেন। ‘
তারপর কিছু একটা ভেবে আবারো বললো,
– ‘ও মা। আজ তো আমিও সাদা ড্রেস পরেছি। আপনি আমার ড্রেসের সাথে নিজের পোশাক ম্যাচিং করে পরেননি তো আবার ? ‘
সৌরভ চোখ বড় বড় করে তাকালো মিলির দিকে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
– ‘ আমার সাদা রঙ ভালো লাগে বেশি। তোমার সাথে ম্যাচিং করে পরতে যাবো কেনো! ‘
– ‘ কেনো! আমার সাথে ম্যাচিং করে পরা যাবে না নাকি! হুহ ‘ সৌরভের দিকে দু পা এগিয়ে এসে কথাটি বলেই মিলি চলে গেলো গেইটের ভেতর। সৌরভ কিছু বুঝতে না পেরে মুখ বাঁকা করে তাকিয়ে রইলো মিলির যাবার পানে। তার চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করছে। মিলির এমন অদ্ভুত ব্যাবহার তাকে খুব ভাবাচ্ছে। অথচ সে বুঝতেও পারছে না মিলি তাকে নিয়ে মনে মনে হাজারো স্বপ্ন বুনে ফেলেছে।
চলবে…