এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৫
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
রাজিবের কিছু কাজিনরা তোহাকে রুমে বসিয়ে রেখে গেছে। সম্পূর্ণ রুমটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানার মাঝে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে তোহা। দরজার এদিক দিয়ে কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো সে। রাজিবের মা এসেছেন। তিনি ছেলের বউ এর পাশে এসে বসলেন। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। গায়ের চামড়া অনেকটা কুঁচকে গেছে। তবুও শক্তপোক্ত আছেন এখনো। তোহার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে তিনি বললেন,
– ‘ আমার ছেলেটাকে এখন তোমার হাতেই দিলাম মা। ওকে নিজের মতো গুছিয়ে নিও। ‘
শাশুড়ীর কথায় তোহা হালকা হাসলো। যাবার আগে এক জোড়া বালা তিনি ছেলের বউয়ের হাতে পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। তোহা বুঝতে পারলো মানুষটা অনেক সরল মনের। আগে থেকেই সে রাজিবের মা কে চিনতো। কিন্তু এখন চিনলো সম্পূর্ণ নতুন এক পরিচয়ে। এখন এই মানুষ গুলো তার নিজের লোক। নিজের পরিবার। কিছুক্ষণ পরই রাজিব রুমে এলো। দরজা লাগিয়ে এসে বসলো তোহার পাশে। তোহা তখন লজ্জায় বুকের সাথে চিবুক মিশিয়ে ফেলেছে। তোহার লজ্জামাখা মুখ দেখে রাজিব বাঁকা হাসে। তোহার মুখটা দুহাত দিয়ে উপরে তুলে ধরলো সে। আলতো করে নিজের ঠোঁট ছোয়ালো তোহার কপালে। ভালোবাসার মানুষের স্পর্শে তোহা তখন জগতের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি টের পাচ্ছে। দুটো মানুষ পরস্পরকে ভালোবেসে এক হবার পরে এতোটা কাছে এসে নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণ করার কোন প্রয়োজনও বোধ করছে না। এখন মানুষটা তার। সহজেই বিলিন হওয়া যায় এই মানুষটার মাঝে। তোহা আর রাজিবও তাই করলো। ওকে ওপরের কাছে নিজেকে স্বপে দিলো।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ির সকলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চারপাশে এখনো বিয়ে বাড়ির আলো জ্বল জ্বল করছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে সৌরভ। নিজেকে ভীষণ একা লাগছে। ছায়া চলে যাবার পর আজ তোহাও চলে গেলো অন্যের ঘরে। এখন নিজের মানুষ বলতে কে আছে তার ?
সৌরভের এলোমেলো ভাবনার ঘোর ভাঙলো কারোর হাসির শব্দে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো মিলি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে অনর্গল হাসছে সে। কিছু একটা দেখে যে হাসছে বুঝা যাচ্ছে। বিয়ের সাজগোছ কিছুই এখন নেই। একটা লং স্কার্ট এর সাথে সাদা টি শার্ট পড়া। চুল গুলো মাথায় খোঁপা করে রেখেছে। আজ কাল মিলির মাঝে ছায়াকে দেখতে পায় সৌরভ। কিন্তু তার এমন ভাবনাকে সে একদম প্রশ্রয় দিতে চায় না। এটা ঠিক না। অন্যায়। অথচ মিলি তার সাথে ইদানিং কী পাগলামোটাই না করছে! এখনই বা রুমে এসে হাসছে কেনো!
সৌরভ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মিলির সামনে। ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মিলি খুব সহজ ভাবে আগের মতোই হেসে বিছানায় গিয়ে বসে বললো,
– ‘ দেখুন তো ছবি গুলো। ‘
সৌরভ মিলির পাশে গিয়ে বসলো। মিলির ফোনের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলো বিয়ের অনুষ্ঠানে তার একার কিছু ছবি। ছবি গুলো অদ্ভুত। সৌরভ এক এক কাজ করছিলো সময় কেউ তুলেছে। একটা ছবিতেও সৌরভের চোখ মুখের ঠিক নেই। কে তুলেছে এই ছবি গুলো! রাগ উঠে গেলো সৌরভের। মিলি এক চোখ তুলে তাকালো সৌরভের মুখের দিকে। তারপর ফিক করে আবারো হেসে দিলো। বেশ গম্ভীর গলায় সৌরভ প্রশ্ন করলো,
– ‘ কে তুলেছে এগুলো! ‘
মিলি ঠোঁট চেপে হাসলো।
– ‘ আমি। ‘
– ‘ তুমি ?’ সৌরভ অবাক হলো।
– ‘ হুম। আপনাকে যা সুন্দর লাগছিলো ! তাই তুলে নিয়ে ছিলাম। কিন্তু আপনি ঠিক ভাবে দাঁড়াচ্ছিলেনই না। তাই এমন হয়েছে। ‘
মিলির মুখের হাসিটা প্রশস্ত হলো। সৌরভ কিছু বললো না। গম্ভীর মুখে বসে রইলো মিলির পাশে। বেশ কিছু সময় নিরবে, স্তব্ধতায় কেটে গেলো। মিলি বললো,
– ‘ কাল আপনার অফিস আছে ? ‘
সৌরভ ছোট করে উত্তর দিলো,
– ‘ হুম। ‘
– ‘ ওমা! বোনের বিয়ে আর আপনি ছুটি নেননি ? কাল কিসের অফিস আবার! ‘
– ‘ অযথা ছুটি নিবো কেনো? আজ তো ছুটি নিয়েছিলাম। বিয়ে শেষ। কাল থেকে আবার অফিস করবো। ‘
মিলি সৌরভের উত্তরে বিরক্ত হলো। নাক মুখ খিঁচে বললো,
– ‘ আমি ছুটি নিয়েছি। বিয়ের রেশ কাটটে সময় লাগবে আমার। ‘
এবারে সৌরভ হেসে দিলো।
– ‘ তোমার বিয়ে নাকি! রেশ কিসের আবার ? ‘
– ‘ ওই একই কথা। ‘
সৌরভ আর ঘাটালো না মিলিকে। এই মেয়ের কিছুদিন যাবত হলোটা কী সে বুঝতে পারছে না। কেমন অপরিচিত লাগছে।
বিছানার উপর সকালের মিষ্টি আলো এসে পড়েছে। হালকা হিম বাতাস এসে লাগছে গায়ে। ঠান্ডার প্রকোপ আসতে চলেছে তার আগাম বার্তা জানান দিচ্ছে প্রকৃতি। কিন্তু এখন তো শীতকাল না! তবুও এমন হিম শীতল আবহাওয়া গায়ে কাঁটা লাগিয়ে যাচ্ছে কেনো! আকাশ কিছুটা মেঘলা। আষাঢ় মাস পড়েছে। এখন ঠান্ডা লাগার কারণটা বুঝতে পারলো তোহা। আষাঢ়ের বৃষ্টি নেমে আসার সময় হয়েছে। এখন প্রকৃতি মেতে উঠবে তার প্রিয় খেলায়। যখন তখন হুড়মুড় করে বৃষ্টি ছাপিয়ে নেমে আসবে। ভিজিয়ে দিয়ে যাবে গাছ পালা, রাস্তাঘাট, চারপাশকে। ঠান্ডা হাওয়ার মাঝেও গায়ের উপর কারো উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে তোহা নড়ে উঠলো। রাজিব তার গায়ের উপর লেপ্টে আছে। হালকা হাসলো তোহা। রাতের কথা মনে হতেই সে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলো। এখন উঠবে কী ভাবে! রাজিবের মুখোমুখি হতে হবে। ভাবতেই কেমন লাগছে। তোহা হালকা ধাক্কা দিয়ে রাজিবকে সরাতে নিলেই রাজিবের ঘুমটা ভেঙে গেলো। সে ঘুম জড়ানো অবস্থাতেই তোহার গলায় মুখ গুজে দিলো। তোহা আবারো শিউড়ে উঠলো। রাজিবকে সরানোর বৃথা চেষ্টা করায় কোন লাভ হলো না। রাজিব আবারো তোহার সবটা দখল করে নিলো। আবারো মজে উঠলো ভালেবাসার এক অন্ধকার আদিম খেলায়।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
– ‘এই যে আমাকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবেন ? ‘
মিলির কথায় ঘুরে দাঁড়ালো সৌরভ। অফিস যাবার সময় হয়ে গেছে। এ সময় কথা বলার ইচ্ছে না থাকলেও রাগতে পারলো না সে। নিজের মানুষদের উপর হুট হাট রাগ করা যায় আবার কখনো বিরক্ত হলেও রাগা যায় না। খুব অদ্ভুত নিয়ম কানুন সৃষ্টি করে নিয়েছে মানুষ নিজেরাই। সৌরভ একটা ব্যস্ততা দেখিয়েই বললো,
– ‘ ঘুরতে যাবে ?’
-‘ হু। ‘ উপর নিচ ঘাড় নাড়িয়ে বললো মিলি।
– ‘ কোথায় ?’
– ‘ আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন। তবে এখন না। এখন তো আপনি অফিস যাচ্ছেন। পরে নিয়ে গেলেও চলবে। ‘
পরে নিলেও চলবে তাহলে এখন ডাকলে কেনো! কথাটা বলতে ইচ্ছে করলেও বললো না সৌরভ। এই মুহূর্তে অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে। সে দ্রুত জায়গাটা থেকে প্রস্থান করলো।
সৌরভ বেরিয়ে যেতেই মিলি ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। মায়া ডাইনিং এ বসে নাস্তা করছিলো। মিলি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– ‘ এই মায়া শুন। ‘
মায়া গাল ভর্তি খাবার মুখে নিয়ে তাকালো মিলির দিকে। মিলি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সতর্ক হয়ে বললো,
– ‘ তোর সৌরভ চাচ্চুকে কেমন লাগেরে ? ‘
মায়া এবার খাবার চিবুতে চিবুতে বললো,
– ‘ ভালো। ‘
– ‘ কেমন ভালো? ‘
– ‘ খুব ভালো। ‘
– ‘ আমার সাথে মানাবে ? ‘
মায়া আবারো মিলির মুখের দিকে তাকালো। কী বুঝলো কে জানে। কিছু একটা ভেবে বললো,
– ‘ খুব মানাবে। ‘
মিলির মুখে সাথে সাথে রাজ্যের হাসি ফুটে উঠলো। মায়ার গাল গুলো আলতো করে টিপে দিয়ে বললো,
– ‘ ইশশ। কবে যে হবে উনার সাথে বিয়েটা। ‘
তারপর দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। মায়া কিছুই না বুঝে আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আমেনা বেগম ডাইনিং রুমে আসছিলেন। আড়াল থেকে মেয়ের এমন কথাবার্তা শুনে তিনি তাজ্জব বনে গেলেন! তারপর হুট করে নিজেও মুচকি হাসলেন। মনের মাঝে যেন এক প্রশান্তি ছেয়ে গেলো তার। সৌরভকে তাহলে মিলি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছে। পছন্দ হয়েছে মেয়ের। সৌরভ এবার তাদেরই থাকবে। ছেলে মেয়ে দুটো সুখী হবে খুব। একদিন সব ভুলে ভালো থাকবে ওরা। ভাবতেই মনটা শান্ত হয়ে গেলো আমেনা বেগমের।
চলবে…