এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৪
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
তোহাকে নিয়ে মিলি আর সুবর্ণা পার্লারে গিয়েছিলো। বিয়ের আগে বউকে নিয়মিত পার্লারে না গেলে নাকি মেকআপে সুন্দর লাগবে না। আর তোহা তো আগে থেকে পার্লারে যায়নি। এখন যদি বিয়ের আগের একটা দিনও না যায় তাহলে বিয়ের কনেকে দেখে লোকজন হাসবে। দেখতে লাগবে বিচ্ছিরি। আর বাসর ঘরে ঢুকে যদি রাজিব দেখে তোহার মুখের সব মেকআপ নষ্ট হয়ে আছে তখন সেও মজা নিবে। এসব হাবিজাবি বুঝিয়েই সুবর্ণা তোহাকে রাজি করিয়েছিলো পার্লারে যেতে। ফেসিয়াল, ভ্রু প্লাগ করে দুটো মেয়ে ঠিক করে এলো তাকে বিয়ের দিন আর গায়ে হলুদের দিন বাসায় গিয়ে সাজিয়ে আসার জন্য। পার্লার থেকে তাদের নিয়ে আসতে গেলো মোহন। বড় রাস্তা থেকে যখন বাসার গলিটা দিয়ে ঢুকছিলো গাড়ি তখন তোহার চোখ যায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলের দিকে। তোহা উৎকণ্ঠা হয়ে বলে,
– ‘ গাড়িটা একটু থামাও তো মোহন ভাইয়া।’
মিলি ভ্রু কু্ঁচকে জানতে চায়,
– ‘ কোথায় যাবে ? ‘
– ‘আমার একটু কাজ আছে। চলেই তো এসেছি। তোমরা যাও আমি দু মিনিটে আসছি। ‘
মিলি আর কিছু জানতে চায় না। মোহন গাড়ি থামায়। তোহা নেমে যাবার পর তারা চলে যায় বাসায়। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে দিপু। তোহাকে দেখতে পেয়েই সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এক হাতে নিজের চশমা ঠিক করতে থাকে। তোহা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– ‘ হাতে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে ? ‘
দিপু চোখ নামিয়ে নেয়। পিচ ঢালা রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে,
– ‘ হ্যাঁ। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি। ‘
– ‘ কোথাও যাচ্ছেন ?’
– ‘ হুম। হোস্টেলে যাচ্ছি। সেখানে থাকবো কিছুদিন। ‘
তোহা অবাক হয়ে বললো,
– ‘ ওমা! আপনি না বাসায় থেকে ক্লাস করতেন ? তাহলে হোস্টেল কেনো ? ‘
– ‘ হোস্টেলে সিট রাখা আছে আমার। মাঝে মাঝেই গিয়ে থাকতাম। এখন আবার যাচ্ছি।’
তোহার মনটা কেনো যেনো খারাপ হলো। সে একটু মিইয়ে গিয়ে বললো,
– ‘ আমার বিয়েতে থাকবেন না ? ভাইয়া তো বলেছিলো আপনাকে থাকতে। ‘
দিপুকে একটু অন্যরকম দেখালো। তার চোখ মুখ শুকনা। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সে বরাবরের মতো চশমা ঠিক করতে লাগলো।
– ‘ আসলে আমার এক্সাম আছে তো। চাইলেও মিস দেয়া যাবে না। যাওয়াটা জরুরি। ‘ বলেই একটা রিক্সা পেতেই সেটাতে উঠে পরলো দিপু। বললো,
– ‘ আসি তাহলে। শুভ কামনা আপনার জন্য।’
রিক্সা চলে গেলো। তোহা তাকিয়ে আছে রিক্সা ছুটে যাওয়ার দিকে। তার মনটা হঠাৎ করেই কেনো যেনো খারাপ হয়ে গেলো। দিপু ছেলেটা কি তার থেকে পালিয়ে গেলো ? তোহার মনে হলো পরীক্ষার কথাটা নেহাতই একটা অজুহাত। দিপু থাকতে চাচ্ছে না তার বিয়েতে। কিন্তু কেনো ? আর তারই বা খারাপ লাগছে কেনো এই মুহূর্তে ?
পুরো বাড়ি লাইটিং করা হয়েছে। ড্রইং রুমের দরজার উপর ঝোলানো হয়েছে গাদা গুলের মালা। এক পাশে সাজানো হয়েছে স্টেজ। গায়ে হলুদ মেখে সেখানে বসে আছে তোহা। তার হাতে, গলায়, মাথায় ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। কাঁচা হলুদ আর কলা পাতা রঙের শাড়ি পরে মাথায় হালকা ঘোমটা টেনে দিয়ে রেখেছে সে। দেখতে বেশ লাগছে। মিলি আর সুবর্ণা তোহার মতোই শাড়ি পরেছে। শুধু তাদের সাজটা আলাদা। ছেলেরা পরেছে সবুজ পাঞ্জাবী। মায়া তোহার পাশেই একটা হলুদ স্কাট পরে বসে আছে। আশে পাশের বাসার সকলকে দাওয়াত করা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ এসেছে তোহাকে হলুদ দিতে। মুরুব্বী কিছু মহিলা তোহার গালে, হাতে হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছে।
সৌরভ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরের অন্ধকারের মাঝেও আজ সব কিছু জ্বল জ্বল করছে। চারপাশ মুখরিত হয়ে আছে হাজারো ফুলের সৌরভে। মানুষের কোলাহলে আর গানের মিষ্টি সুরে বাড়িটা মেতে উঠেছে বিয়ের উৎসবে। ছায়া থাকলে খুব মজা করতো। মিষ্টি করে সাজতো। সৌরভও নিশ্চই ছায়ার পিছন পিছন ঘুর ঘুর করতো তখন। ছায়ার কথা মনে হতেই মনের মাঝে মেঘের আস্তরন পরে গেলো। তবে মেঘটাকে ভারী হয়ে আসতে দিলো না সে। তোহার গায়ে হলুদ আজ। তার আদরের ছোট বোনটা নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে যাবে। খুব সুখী হবে সে। এসব ভেবেই মনকে শান্ত করে ফেললো সৌরভ।
পেছন থেকে কেউ একজন দুহাত বাড়িয়ে সৌরভের গালে আলতো করে হলুদ লাগিয়ে দিলো। তারপর খিল খিল করে হাসতে লাগলো। সৌরভ পেছন ফিরে দেখলো মিলি। তবে এটা কি মিলি ? নাকি ছায়া ? মিলিকে একদম ছায়ার মতো লাগছে। চুল গুলো খোপা করে রাখায় আর ভারী সাজে দুবোনের মাঝে পার্থক্য খুঁজে বের করা খুব কঠিন হয়ে পরেছে। কাছের মানুষ না হলে বাহিরের যে কেউ আজ ভাবতো এটা ছায়া। সৌরভ হালকা হাসলো। হলুদ মাখা গালে তার হাসিটা দেখে মিলির ভেতরে কেমন একটা কাঁপন সৃষ্টি হলো। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো ভেতরটা। এমনটা আগে হতো না। সে সব সময় সৌরভকে শ্রদ্ধা করতো। সৌরভের আচরণ, তার কর্তব্যবোধ সব কিছু ভালো লাগতো মিলির। তবে কখনো অন্য কিছু কল্পনাতেও ছিলো না সৌরভকে নিয়ে তার মনে। অথচ আমেনা বেগম সেদিন মিলির সাথে সৌরভের বিয়ের কথা বলাতে মিলি হুট করেই রাজি হয়ে গেলো। কেনো রাজি হয়েছে সেটা সে নিজেও জানে না। কোন এক অদ্ভুত কারণে তার ভেতরের সত্ত্বাটা চাইছিলো যেনো সৌরভকে। আর তারপর থেকেই এই হুটহাট অন্যরকম ভালো লাগা। অন্যরকম শিহরণ অনুভব করতে পারছে মিলি।
– ‘কিছু বলবে ?’
সৌরভের কথায় ঘোর ভাঙলো মিলির। সে মুচকি হেসে দু’পাশে মাথা নাড়ালো। তারপর দৌড়ে চলে গেলো নিচে। মিলির এই উদ্ভট কান্ডের কিছুই বুঝতে পারলো না সৌরভ।
স্টেজে বরের জন্য রাখা আসনে বসে আছে রাজিব। তার পড়নে সাদা শেরোয়ানি। মাথায় খয়েরি রঙের পাগড়ি । রাজিবের পাশে বসা মোহন, সৌরভ আর বিয়ের কাজী। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তোহা আর রাজিবের কিছু বন্ধুদের দল। একটু পর উপর থেকে নেমে আসতে লাগলো তোহাকে নিয়ে মিলি আর সুবর্ণা। তাদের পাশে সাদা গাউন পরে সিঁড়ি ধরে ধরে নামছে মায়া। তোহার পড়নে খয়েরি রঙের বেনারসি। গলায়, হাতে, কানে ভারী গহনা। বিয়ের কনে হলেও হালকা একটা সাজ দেয়া হয়েছে তোহাকে। গয়নার জন্য এই অল্প সাজটাই ফুটে উঠেছে খুব করে। ড্রইং রুমের সকলের দৃষ্টি তখন এই নব বধূর দিকে। রাজিব মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো তোহাকে। আর তখন তোহার পাশে দাঁড়ানো মিলির চোখ জোড়া খুঁজে নিলো সৌরভকে। সে আজ সাদার মাঝে ছাই রঙা সুতার কাজের একটা পাঞ্জাবী পরেছে। মিলি সৌরভের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই তোহাকে নিয়ে এগিয়ে এলো। বরের পাশে বসানো হলো কনেকে। সকলে বর কনের সাথে এসে কথা বলছে। রাজিবের কিছু বন্ধু তোহার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। সুবর্ণা আর মায়াও তাদের সাথে জোগ দিয়ে ছবি তুলছে। মিলিকে যখন বলা হলো পাশে দাঁড়াতে তখন মিলি হালকা হাসলো। ক্যামেরা ম্যান ছেলেটাকে কানে কানে কিছু একটা বলে তার সাথে নিয়ে গেলো। সৌরভ তখন পাশেই একটা ছেলের সাথে কথা বলছিলো। মিলি হঠাৎ গিয়ে সৌরভের হাতটা ধরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে এক গাল হেসে ক্যামেরা ম্যানকে বললো,
– ‘ আমাদের একটা ছবি তুলুন তো। ‘
আকস্মিক ঘটনায় সৌরভ কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকালো মিলির মুখের দিকে। মিলির হাত জোড়া তার একটা হাত আকড়ে ধরে আছে। সে অবস্থায়ই ক্যামেরা ম্যান চটাচট কয়েকটা ছবি ক্লিক করে নিলো। সৌরভ কিছু বলতে যাবে সে সুযোগ পেলো না। তার আগেই আবার মিলি ছুটে পালালো।
তোহা আর রাজিব পাশাপাশি বসে থাকলেও কোন কথা বলতে পারছিলো না। সকলেই তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রাজিব তোহার কানের কাছে মুখ নিয়ে হালকা স্বরে বললো,
– ‘ কখন যে বউটাকে একটু একা পাবো! মুখটাই তো দেখতে পাচ্ছি না ভালো করে। এই মানুষ গুলোকে রেখে চলো দৌড়ে পালাই।’
রাজিবের কথায় তোহা ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। সৌরভ এসে তখন বসলো পাশে। নরম গলায় বললো,
– ‘ কাজী সাহেব। বিয়ে পড়ানো শুরু করুন। ‘
সাথে সাথেই অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে গুলো গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে পরলো স্টেজটার চারপাশে। সকলে উৎসুক হয়ে বিয়ে পড়ানো দেখছে। তোহার তখন বেশ লজ্জা লাগছিলো। সেই সাথে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছিলো ভেতরটায়। সে মুখ নিচু করে কাজী সাহেবের থেকে এগিয়ে দেয়া রেজিস্ট্রি পেপারটায় সাইন করলো।
চলবে….