এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১২
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
কি সাহায্যের জন্য ছায়া তুহিনের সাথে দেখা করেছে জানতে চাইলে তুহিন বলে,
– ‘ ছায়া প্রেগন্যান্ট ছিলো আপনি তো জানতেন। ‘
সৌরভের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। ছায়া চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। তাদের প্রথম সন্তান আসতে চলেছিলো পৃথিবীতে। সৌরভ যেদিন প্রথম জানলো ছায়া মা হবে সেদিন যে সে কী খুশি হয়েছিলো ! ছায়াকে নিয়ে বাহিরে খেতে গিয়েছিলো। সিনেমা দেখেছে। সারাদিন ঘুরেছে ওরা। সৌরভ সব সময় বলতো ছায়ার মতোই মিষ্টি একটা মেয়ে চাই তার। ছায়া সে কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যেতো। সন্তানকে নিয়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা চলতো রাত ভোর। কিন্তু সবই এখন ধোঁয়াশা। সৌরভ একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললো,
– ‘ হুম। ‘
– ‘ কিন্তু ছায়া বাচ্চাটি এখনই চায়নি। সে তার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতো সব সময়। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারতো না। যেমন তার বাবার কথায় বিয়ে করে ফেলে প্রতিবাদ করতে পারেনি, অফিসে নাকি তার কোন এক বস ডিস্টার্ব করতো তাকে। সেটারও প্রতিবাদ করতে পারেনি। নিরবে সরে গেছে অফিস থেকে। তেমনই আপনাদের বাচ্চা যাতে এখন না হয়, ক্যারিয়ার গোছাতে চায় সে সেটাও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। সে এই সব নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছিলো। এমনকি নিজের সন্তানকেও সে নষ্ট করে ফেলতে চাচ্ছিলো। সে কারণেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলো। কোন ভাবে এবর্শন করতে চাচ্ছিলো সে। ‘
তুহিনের কথায় সৌরভ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এসির ঠান্ডায় ও সে ঘামতে শুরু করেছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। চার পাশের সব মিথ্যে মনে হচ্ছে। যে মানুষটার সাথে সে এতোদিন থেকেছে সে কী না তাদের সন্তান কে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো ! কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না সৌরভ। দিপু সৌরভের কাঁধে নিজের একটা হাত রেখে বৃথা সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো। মোহন নিজেও অবাক। তার বোন এতো কিছু ভাবতো যেটা তারা টেরই পায়নি। ফোনের ওপাশ থেকে তুহিন বলতে লাগলো,
– ‘ ছায়াকে আমি তখন বলি, তার চার মাস চলছে। এ অবস্থায় এবর্শন করতে চাইবে না কোন ডাক্তার। তাছাড়া এটা খুব ঝুঁকি হয়ে যাবে। আর আপনি আছেন, তার ফ্যামিলি আছে। সবাইকে সে কি জবাব দিবে ? এতো গুলো মানুষ তো কষ্ট পাবে। তখন তাকে অনেক বুঝাই আমি। তবে ছায়া বুঝেছে বলে মনে হয়নি। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে সে এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছে যে নিজেকে শেষ করতেও পিছুপা হবে না। ‘
সৌরভের চোখে পানি।সে ভেজা, ভরাট কন্ঠে বললো,
– ‘ আপনি বলতে চাচ্ছেন ছায়ার মৃত্যুটা তার নিজের কারণেও হতে পারে ? ডিপ্রেশনে থেকে সে সুইসাইড করেছে ? ‘
– ‘দেখুন আমি তো দেশে নেই। জানি না কী কী হয়েছে সেখানে। তাই কিছু বলতে পারছি না। হতে পারে খুন আবার হতে পারে সুইসাইড। ‘
তুহিনকে থামিয়ে দিয়ে সৌরভ বললো,
– ‘ না। সুইসাইড না। ছায়ার লাশটা বস্তায় করে ব্রিজের নিচে পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারনা হত্যার পর তাকে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। ‘
তুহিন কথা বাড়ালো না। সে টপিক চেঞ্জ করে বললো,
– ‘ যাই হোক। পুলিশ কি কোন সন্ধান পেলো ? ‘
– ‘ না। আচ্ছা আমি রাখছি। কোন প্রয়োজন পরলে আবারো ফোন করবো। ‘ আনমনা হয়ে কথাটি বললো সৌরভ।
– ‘ হ্যাঁ অবশ্যই। যে কোন প্রয়োজনে বলবেন। আমি সব রকম সাহায্য করবো এ বিষয়ে। ‘
তুহিনের কথা আর শুনার প্রয়োজন মনে করলো না সৌরভ। সে চট করে ফোন কেটে দিলো। ভালো লাগছিলো না ছেলেটার কথা শুনতে। ছায়ার প্রতি যে তার অধীর আগ্রহ তা কথা শুনেই বুঝতে পেরেছে । এই মুহূর্তে আবারো সব ঘোলা হয়ে গেলো। এই হত্যাকান্ডের কোন কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না সে। নিজেকে কূল হারা নাবিকের মতো মনে হচ্ছে। যে গহীন সমুদ্রে ভেসে আছে অথচ তীরের সন্ধান পাচ্ছে না।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মিলি ঠিক করেছে এবারে ঢাকায় একটা চাকরী খুঁজবে। আমেনা বেগম অবশ্য এতে আপত্তি করেছেন। তিনি মেয়েকে বলে দিয়েছেন, এসব চাকরী বাকরীর কোন দরকার নেই। পড়াশুনার জন্য এতোদিন বিয়ে করতে চায়নি মেয়ে। সেই সাথে পেয়েছে ভাইয়ের সাপোর্ট। আশকারা পেয়ে মাথায় উঠেছিলো। মেয়ে মানুষের চাকরী করে কী হবে। মেয়ে মানুষ হবে সংসারী। তবে এখন মেয়ের পড়াশুনা শেষ। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট কবে না কবে দিবে সেই আশায় তিনি থাকবেন না। তিনি মেয়ের বিয়ে দিবেন। এ নিয়ে মায়ের সাথে মিলির শুরু হয়েছে তান্ডব কান্ড। সে এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না। বিয়ে নিয়ে কোন কিছু ভাবতে চায় না সে। আগে ক্যারিয়ার গুছাবে তারপর বিয়ে। তবে আমেনা বেগমকে বুঝায় কে ? মোহন ঢাকা থেকে বাড়ি যাবার পরই তিনি ছেলেকে ডেকে এনেছেন নিজের রুমে। ডেকেছেন মিলিকেও।
মোহন আর মিলি মায়ের সামনে চুপটি করে বসে আছে। আমেনা বেগম বললেন,
– ‘তোমার বোনের কাহিনী শুনছো ? তিনি নাকি এখন বিয়ে করবে না। এতো দিন পড়াশুনার অজুহাত দিছে এখন দিতেছে চাকরীর অজুহাত। তার নাকি ক্যারিয়ার লাগবে আগে! ‘
মায়ের কথা শুনে মোহন বোনের মুখের দিকে তাকালো। মিলি গাল ফুলিয়ে রেখেছে। মোহন গম্ভীর ভাবে বললো,
– ‘ মিলি যা চাইছে তাই হবে মা। ‘
ছেলের কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন আমেনা বেগম। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
– ‘ বলি তোমরা যা বলবা তাই হবে নাকি ? আমার পেট থেকে তোমরা হইছো ? নাকি তোমাদের পেট থেকে আমি হইছি ? ‘
মা যে বেশ রেগে গেছে এটা তার কথা শুনেই বুঝতে পেলো মিলি। সে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো। নিচু স্বরে বললো,
– ‘থাক ভাইয়া। আমি জব করবো না। ‘
মোহন ধমকে উঠে গলা চড়িয়ে বললো,
– ‘ থাম তুই। তুই ক্যারিয়ার গুছাতে চাস এটা ভালো সিদ্ধান্ত। ছায়ার মতো ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে সংসার নষ্ট করার থেকে আগে ক্যারিয়ার গুছিয়ে তার পর বিয়ে করাই ভালো। অন্তত মনের ইচ্ছা পূরণ হোক তোর। আগে জব কর। নিজেকে গুছিয়ে নে তারপর বিয়ে হবে। ‘
কথা শেষ করে মোহন মায়ের দিকে তাকালো। আমেনা বেগম আর মিলি দুজনই চুপ হয়ে গেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন মোহনের রাগটা এখন কোথায়। ছায়া মুখ ফুটে যে কথা বলেনি মিলি তা বলেছে। এবারে মিলি যেন ছায়ার মত অভিমান পুষে না রাখে সেটাই চায় মোহন। তার বোন সুখে থাকুক।
তোহা ফোনে রাজিবের সাথে কথা বলছিলো। মায়া এসে মিলির রুমে পড়তে বসেছে। মিলি তাকে পড়াচ্ছে। আজ কাল মায়া তার মায়ের থেকে ফুপির সাথেই থাকে বেশি সময়। মায়াকে স্কুলে ভর্তি করা হবে। সেজন্যই মিলি তাকে প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ের পড়াশুনা করিয়ে যাচ্ছে। তোহা কথা শেষ করে এসে বসলো মিলির পাশে। তার মুখটা বেশ হাসিখুশি। মিলি খুঁচিয়ে বললো,
– ‘ কী ব্যাপার ? কেমন চলছে প্রেম ? ‘
তোহা হেসে বললো,
– ‘ ধুর আপু। কি যে বলো! ‘
তোহা মিলির থেকে ছোট হলেও তাদের বন্ডিংটা বেশ ভালো। বন্ধুর মতো একে অপরের সাথে মিশে থাকে। তাছাড়া ছায়া যেমন প্রয়োজন ছাড়া বেশি কথা বলতো না মিলি তেমনটা না। মিলি একটু বেশিই মিশুক। তার সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়।
– ‘আচ্ছা আপু , তোমার তো আজ পরীক্ষা শেষ হলো। এখন কি করবে ভেবেছো ? ‘
তোহার কথায় মিলি অদ্ভুত হাসলো। বললো,
– ‘ ভাবছি তোমাদের সাথে চলে যাবো। ‘
তোহা ভ্যাবলার মতো তাকালো মিলির দিকে। বুঝতে পারলো না কিছু। মিলি হেসে বললো,
– ‘ মানে ঢাকায় যাবো। একটা ভালো চাকরী খুঁজে সেটা করবো। ‘
– ‘ সত্যিইইই …? তুমি ঢাকায় থাকলে তো অবশ্যই আমাদের সাথে থাকবে। থাকতেই হবে। উফফ তারপর কত মজা করবো আমরা। ‘ খুশিতে তোহার চোখ চিকচিক করছে। সে মিলির গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘ আমরা কবে যাবো ? ‘
– ‘ এতো তাড়া কেনো ? যাবো তো। ‘
– ‘ উহু তুমি আমার সাথেই চলে যাবে ঢাকা। একা বাসায় ভালো লাগে না। তোমরাও যাবে আমার সাথে। ‘ মিলি গাল ফুলিয়ে আবদার করলো।
মায়া বই থেকে মুখ তুলে বললো,
– ‘ আমি যাবো না ? ‘
– ‘ তুমিও যাবে তো। ‘ মায়ার গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো তোহা।
চলবে…