এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১০
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
‘ না ভাইয়া আমি তো চিনতে পারলাম না। তাছাড়া আমি শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজে আছি। আপনি বলছেন উনি ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। তবুও নতুন। তাই না চিনারই কথা। ‘ সৌরভের দেয়া ফুটেজে ছায়ার পাশের লোকটিকে দেখে দিপু বললো।
সৌরভ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। লোকটির সন্ধান পাওয়া তার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। ছায়ার মামলাটা কিভাবে যেন ঝুলে আছে। কেউ কিছু করতে পারছে না। সৌরভের মনে হলো এ দেশের পুলিশরা আসলেই কোন কাজের না। একটা মানুষ কিভাবে খুন হলো তার কোন সন্ধান তারা বের করতে পারছে না। অদ্ভুত!
– ‘ তুমি কি কোনভাবে এই লোকটির খোঁজ পেতে পারো ? ‘ বললো সৌরভ। তার মুখে ক্লান্তির ছাপ। চোখে ব্যার্থতার গ্লানি।
সৌরভের অবস্থা দেখে দিপু বললো,
– ‘ আমি চেষ্টা করবো ভাইয়া। ঢাকা মেডিকেলে আমার কিছু ফ্রেন্ড আছে। আমি নিজে গিয়ে খোঁজ নিবো। ‘
– ‘ অনেক ধন্যবাদ ভাই। প্লিজ একটু দেখো তুমি। ‘
– ‘ অবশ্যই ভাইয়া। ‘
তারপর দিপু সৌরভের থেকে ফুটেজটা নিজের ফোনে নিয়ে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে একবার উপরের দিকে তাকালো। নাহ, তোহা নেই আশেপাশে। চোখের চশমাটা ঠিক করে বের হয়ে গেলো দিপু।
সুবর্ণার মা আর ভাই চলে গেছে। সেই সাথে বন্ধ হয়েছে সুবর্ণার কথা বলা। বাড়ির কারো সাথে সে কথা বলছে না। এমনকি নিজের মেয়ের দিকেও তার খেয়াল নেই। গাল ফুলিয়ে সারাক্ষণ নিজের রুমে বসে থাকে। বাড়ির সকলে তার এই ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছে। এক মাত্র ছেলের বউকে এভাবে দেখে আমেনা বেগম হতাশ। কিন্তু মোহন এতে বিরক্ত। সে মায়ের রুমে এসেছিলো। আমেনা বেগম তাকে বলেছে,
– ‘ মিলির সাথে কথা বলে দেখ। বউমার ভাইকে তার পছন্দ হয় কি না। বাড়ির বউ এভাবে থাকলে সংসারে অলক্ষ্মী ঢুকবে তো। ছেলে মেয়ে খুশি থাকলে আমি বাধা দিবো না এ বিয়েতে। ‘
মায়ের কথায় মোহন বিরক্ত হয়ে বলে,
– ‘ সুবর্ণার সাথে তুমিও পাগল হলে ? ওর মন খারাপ না। ও এভাবে নাটক করছে। যাতে করে তোমরা রাজি হয়ে যাও। আমার বোন কি পানি ভাত নাকি! যে, বললেই তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো! থাকুক এভাবে কত দিন থাকতে পারে। মিলির ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেবার আমি নিবো। আর সেটা অবশ্যই মিলির মত থাকলেই নিবো। যার তার সাথে তো আমি আমার বোনের বিয়ে হতে দিবো না। ‘
কথা শেষ করেই মোহন মায়ের রুম থেকে বের হয়ে গেলো। নিজের রুমে ঢুকেই দেখতে পেলো সুবর্ণা বিছানার উপর চুপ করে বসে আছে। তার মুখ গম্ভীর। মায়া টেবিলে বসে আঁকিবুঁকি করছে। মোহন ঝেঁজে উঠে বললো,
– ‘ কী শুরু করেছো তুমি ? কি সমস্যা তোমার।? ‘
মোহনের কন্ঠে চমকে উঠলো সুবর্ণা। হালকা স্বরে বললো,
– ‘ কী শুরু করেছি বুঝো না ? ‘
– ‘ না বুঝি না। কি সমস্যা বলো। ‘
– ‘ তোমার কাছে তোমার বোনই সব। আমার ভাই কি ফেলনা নাকি! তোমাদের জন্য আজ আমার মা ভাই চলে গেলো। ‘ সুবর্ণার কন্ঠ কাঁদো কাঁদো। যেন এখনি কেঁদে দিবে সে। সবই নাটক! বুঝতে পারে মোহন।
– ‘ তোমার ভাই ফেলনা তা তো বলিনি আমি। আর তোমার মা ভাই চলে গেছে তাদের ইচ্ছায়। তাদের কেউ চলে যেতে বলেনি। ‘ গলার স্বর আরো বাড়িয়ে কথাটি বললো মোহন।
– ‘ ঠিক আছে। কোন লাটসাহেবের কাছে তোমার বোনের বিয়ে দাও সেটাও আমি দেখবো। ‘তাচ্ছিল্যের সাথে বলে সুবর্ণা।
মোহনের ম্যাজাজ আরো বিগড়ে যায়। সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়ে চোখ বড় বড় করে তাদের কথা শুনছে। বাবা মায়ের এ দৃশ্য তার কাছে অবাক লাগছে। মোহন হালকা স্বরে মেয়েকে বললো,
– ‘ মায়া। যাও তোমার ফুপির রুমে গিয়ে ঘুমাও আজ। ‘
মায়া বুঝতে পারে বাবা মায়ের মধ্যে কী চলবে এখন। সে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে যায়। রুমের বাহিরে এসে দেখে মিলি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। মায়াকে দেখেই মিলি তার কাছে টেনে নিয়ে আসে। তারপর নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। মোহন আর সুবর্ণা এতো জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে কথা বলছিলো যে অন্য সকলের রুমেই আওয়াজ যাচ্ছে। মিলি সব শুনতে পেয়েছে এতোক্ষণ। তার খারাপ লাগলো এটা ভেবে যে, তার জন্য ভাই আর ভাবির মাঝে ঝগড়া হচ্ছে।
মিলিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো মায়া। মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মিলি বললো,
– ‘ মায়া সোনা। তুই তো আমার সাথেই প্রতিদিন এসে ঘুমাতে পারিস। ‘
– ‘ এখন থেকে তোমার সাথে ঘুমাবো আমি। মা বাবা প্রতিদিন ঝগড়া করে। ভালো লাগে না আমার। ‘ মিলিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে মায়া।
– ‘ প্রতিদিন ঝগড়া করে কে বললো! ‘ মিলি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে।
– ‘ কালও করেছে। আজও করছে। ‘
– ‘ আগে কখনো করেছে? ‘
মায়া আলতো করে মাথা নাড়ায়, ‘ উহু। ‘
– ‘ তোর বাবা মা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসে। কখনো ঝগড়া করে না তো। এখন যেটা করছে এটা ঝগড়া না। বাবার মাথা গরম তো তাই রেগে কথা বলছে। এরকম সবাই করে। তোর দাদা দাদুও করে। এটা ঝগড়া না। বুঝলি ?’
মায়া হালকা করে মাথা নাড়ায়। সে বুঝেছে। মিলিকে ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
– ‘ তবুও তোমার সাথে ঘুমাবো আমি। তুমি সুন্দর করে কথা বলতে পারো। ‘
মায়ার কথায় মিলি হাসে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
দিপুর ফোন আসে পরদিন বিকেলে। সৌরভ ফোন রিসিভ করে বলে,
– ‘ হ্যাঁ দিপু বলো। কোন খোঁজ পেলে ? ‘
– ‘ জি ভাইয়া । আমার এক বন্ধু চিনে উনাকে। তাদের মেডিকেলের সার্জারি বিশেষজ্ঞ। রাশেদুল রহমান তুহিন। ‘
সৌরভ উত্তেজিত হয়ে বলে,
– ‘ হ্যাঁ। তুহিন নাম। মিলি বলেছিলো। ‘
– ‘ তবে ভাইয়া সমস্যা আছে একটা। ‘
– ‘ কী সমস্যা ? ‘
– ‘ উনি দেশে নেই। কিছুদিন আগে মালয়েশিয়া গেছেন। যে ফোন নাম্বারটা ছিলো সেটাও চেঞ্জ। বাহিরে গিয়ে তো দেশের নাম্বার চলবে না। আর সেখানকার কোনো নাম্বার কারো কাছে নেই। ‘
সৌরভ হতাশ হয়ে বলে,
– ‘ তাহলে এখন কী উপায় ? উনার সাথে কথা বলতে না পারলে তো হবে না। ‘
– ‘ উপায় একটা আছে। আমি আমার ফ্রেন্ডকে বলেছি কোন ভাবে লোকটার বাসার ঠিকানা ম্যানেজ করে দিতে। তার বাসায় গিয়ে ফোন নাম্বার পেতে পারি আমরা। ‘ আনন্দের সাথে বলে দিপু। যেন সে বেশ বড় কোন কাজ করতে পেরেছে।
– ‘ ঠিক আছে। বাসার ঠিকানা পাওয়া গেলে সেখানেই যাবো আমরা। ‘
তোহার মন খারাপ। মন খারাপ ভাইয়ের জন্য। পুলিশ মোজাম্মেল শিকদার কে ছেড়ে দিয়েছে। তার পক্ষের উকিল উপর মহলকে ম্যানেজ করে নিয়েছে। এখন তদন্ত চলছে ধীর গতিতে। সৌরভ অফিস বন্ধ দিয়ে বাসায় বসে আছে। বোনের সামনে স্বাভাবিক থাকলেও তার মনের মাঝে যে সুখ নেই সেটা তোহা বুঝতে পারে। তোহাকে এভাবে দেখে সৌরভের কাছেও ভালো লাগছে না। বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে সারাক্ষণ। লাগবেই বা না কেন ! এতো বড় বাড়িতে মাত্র দুজন মানুষ। নিজের লোক বলতে কেউ তো নেই তাদের সাথে থাকার। আমেনা বেগম মাঝে মধ্যে ফোন দিয়ে কান্না কাটি করেন। কষ্ট হয় সৌরভের। মেয়ে হারানোর শোকে মায়ের মন যে ঠিক নেই সৌরভ বুঝে। মানুষ গুলোকে সে সম্মান করে। সব সময় তাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবেসেছে তারা। মানুষ গুলোকে খুশি রাখতে চায় সৌরভ। এই ভালোবাসার দাম দিতে চায় সে। আগলে রাখতে চায় ভালোবাসার মানুষ গুলোকে। ছায়ার মতো আর কেউ তাকে ছেড়ে চলে যাক এটা সে চায় না। নিজের হাজার খারাপ লাগার মাঝেও সে এই মানুষ গুলোর জন্য বাঁচবে, এই মানুষ গুলোর মুখে হাসি ফোটাবে। মন খারাপ নিয়েই সৌরভ বোনের রুমে যায়। তোহার পাশে বসে বলে,
– ‘ তুই না বলেছিলি ঘুরতে যাবি ? যাবি কুমিল্লা ? ‘
তোহা খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে,
– ‘ ভাবির বাসায় ?’
সৌরভ মাথা নাড়ায়। বুঝায়, ‘ হ্যাঁ। ‘
– ‘ কখন যাবো ? ‘
– ‘ কাল। ‘
তোহা আনন্দে আত্মহারা। রাতেই সে গোছগাছ করে নেয়। রাত জেগে কথা বলে রাজিবের সাথে। বাহিরে যেতে চায় শুধু নিজের জন্য না। ভাইকে স্বাভাবিক রাখার জন্য। দুজনের মন ভালো করার জন্য। এ শহরের দম বন্ধ করা প্রকৃতি থেকে একটু স্বস্থির জন্য। পরদিন সকালে তারা রওনা হয় কুমিল্লার উদ্দেশ্যে।
চলবে….