এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ৬
মিশু মনি
.
সবসময় চলে যাওয়া মানে চলে যাওয়া নয়, কখনো কখনো চলে যাওয়া মানে রেখে যাওয়া। কিছু একটা রেখে যাওয়া। যে জিনিসটা কারো মনে সর্বক্ষণ অস্থিরতা জাগিয়ে তুলবে। যে জিনিসটা কখনো কখনো পোড়াবে, ব্যথা দেবে, আনন্দ দেবে। তিতাস চলে গিয়ে সেরকমই কিছু রেখে গেলো রূপসার অন্তরে। যা রূপসার সমস্তকিছুকে এক ঝাপটায় অন্যরকম করে দিলো। যন্ত্রণাকে কাছে টেনে নেয়ার মত একটা সুক্ষ্ম অনুভূতি জাগছিলো রূপসার ভেতরে।
আকাশে মেঘ জড়ো হচ্ছে। ধূসর রঙের মেঘ। কোথা থেকে জড়ো হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ যতদূর চোখ যায়, সবখানে ধুসর রঙে ছেয়ে আছে। বৃষ্টি নামলো বলে। রূপসা একমনে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। বারবার মনে হচ্ছে, যদি ঝুম বৃষ্টি নামে, যদি আচমকা প্রবেশদ্বার খুলে উঠোনে তাকে দেখা যায়, খুব একটা অবাক হবে না রূপসা। বরং মনে হবে, এত দেরি করে কেন এলো? আরো তারাতাড়ি আসার কথা ছিলো না? কিন্তু না, কেউ আসে না। বড় প্রবেশদ্বার শক্তভাবে আটকানো। সামান্য নড়েও না। রূপসা একদৃষ্টে চেয়ে থাকে।
রূপসার এখন গল্পের বই ভালো লাগে না। উপন্যাস পড়তে ইচ্ছে করে। “সোনালী দুঃখ” উপন্যাসটা একবার রাত জেগে পড়েছিল। কি যে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি জাগছিলো মনে। বারবার মনে হচ্ছিল যদি আমার জীবনেও কেউ আসত! আজ মনে হচ্ছে, আমার জীবনে কেউ একজন আসতে চাইছে, কিংবা এসে পড়েছে। কিন্তু সে আর আসে না কেন?
৭
খুব সকালেই মা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। গতকাল বৃষ্টি হয়েছে। আজও হতে পারে। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। ধানগুলো কেটে বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। মা রূপসাকে রান্নাবান্নার দায়িত্ব দিয়ে ক্ষেতে চলে গেলেন। কয়েকজনকে কামলাও নেয়া হয়েছে, তারাও ভাত খাবে। রূপসা ঘুম ঘুম চোখে রান্না করতে লেগে গেলো।
আজ বৃষ্টি হলে টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ ও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ঝন, ঝনঝন, ঝনঝনাৎ.. কেমন করে শব্দ হয়? এসব ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো কে জানে।
সবাই খেতে এসেছে। মা পরিবেশন করছেন। খেয়েদেয়ে আবার চলে গেলো তারা। মা থালায় ভাত নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। কয়েক মুহুর্ত পরেই রূপসার নাম ধরে ডাকতে শোনা গেলো।
রূপসা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো। মা রাগী রাগী গলায় বললেন, কি বালছাল রানছিস? এত কইরা কইলাম মানুষ জন খাবে। ভালো কইরা রান্ধিস। তরকারির মধ্যে নুন, মশলা কিচ্ছু তো হয়ও নাই। সেদ্ধ করতে করতে একেবারে জাউ বানাইয়া ফেলছিস। এগ্লা তোর ভাতার খাবে? মাইয়া মানুষ রান্নাবান্না শিখবে, কাজকাম শিখবে। জীবনেও চুলার পাড়ে আসে না। বিয়ার পরে কি আমারে সাথে নিয়া যাবি? তোর সওয়ামীর সাথে কি আমি শুমু?
রূপসা প্রতিবাদ করে উঠলো, মা। এইসব কি বলতেছো? ছিহ। তুমি না আমার মা? মায়েরা এসব মেয়েরে বলে?
– জ্ঞান দিতে আইসো না তো। পারো না কোনো বালের কাম। বাল গজায় নাই এখনো, বালের জ্ঞান দিতে আসছে আমার।
মা খাবারের প্লেট টেবিলের উপর শব্দ করে রেখে হাত ধুয়ে চলে গেলেন। পানিও খেলেন না। রূপসার কান্না এসে গেলো। কান্না চেপে রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। মা কি কোনোদিনও শোধরাবে না? মুখ ফুটে আর কিছুই বলতে পারলো না। কিন্তু মনেমনে বললো, একবার বিয়ে হইলে আর জীবনেও এই বাড়ির উঠানে পারা দিবো না। আর কোনোদিনো আসবো না এইখানে। কোনোদিনো না।
বিছানায় এসে উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে রূপসা। এই গ্রামের কত মেয়েই তো দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। কত স্বাধীন ওরা! এ বাড়ি ও বাড়ি যেতে পারে, বান্ধবীর বাসায় যায়, বিয়েতে যায়, অনুষ্ঠান দেখতে যায়, পিকনিকে যায়। রূপসা কখনো কোথাও যেতে পারে না। বাবা মা কোথাও যাওয়ার অনুমতি দেন না। এমনকি চাচাতো ভাই বোনের বিয়েতেও রূপসা যেতে পারে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে আর সবার মত হাসাহাসি, হৈ হুল্লোর করতেও বাধা। মা বিশ্রী ভাষায় গালাগাল শুরু করেন। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদেরকে হয়তো এতটা কষ্ট পেতে হয় না। যতটা কষ্ট শুধুমাত্র মায়ের কথার জন্য রূপসাকে পেতে হয়।
মাঝেমাঝে রূপসার ইচ্ছে করে তারাতাড়ি বিয়েটা হয়ে গেলে কিছুটা শান্তি মিলতো। বয়স তো কম হলো না। বিয়ের ব্যাপারেও যেন বাবা মায়ের আগ্রহ নেই। কখনো ঘটক আসে না এ বাড়িতে, কখনো বিয়ের আলাপ হয় না। ঘটক যে একেবারেই আসে না, তাও কিন্তু নয়। বাবা পাত্রের বিবরণ শুনেই ঘটক কে নিষেধ করে দেন। কোনো ছেলেকেই যেন বাবার মনের মত লাগে না। রূপসা ঠিক বুঝতে পারে না বাবা আদৌ ওর বিয়ে দিতে চায় তো? এমনিতে বিয়ের প্রতি আগ্রহ রূপসারও নেই। কিন্তু যখন জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন একদমই এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করে না।
আজ পুরো বাড়ি ফাঁকা। বাবা, মা, চাচী সবাই ধানের কাজে ব্যস্ত। ধান কেটে সেগুলো মাড়াই করতে হবে। রূপসা বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছে। বইয়ের নাম “শবনম”। পড়তে খুবই মজা লাগছিলো। রোমান্টিক উপন্যাস। মনে একটা নতুন রং এনে দিচ্ছে। মন খারাপ ভাবটা নিমেষেই দূর হয়ে যাচ্ছিলো। পড়ার মাঝে বারবার অকারণে তিতাসের নাম মনে আসছিলো। বই বুকের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে রূপসা। সবকিছু এত রঙিন লাগছে কেন!
৮
তিতাস কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। শহুরে বৃষ্টি। শীতল হাওয়ায় কেমন একটা উষ্ণ অনুভূতি জাগছে। এরকম দিনে মনটা বড় উদাস হয়ে যায়।
ছোটমামা বাসায় এসে জানিয়েছে পাত্রী তিতাসের পছন্দ হয় নি। রূপসার কথাটা মামাও কাউকে জানায়নি, তিতাসও জানায়নি। প্রথমদিনেই সব কথা বলে দিলে গুরুজনের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। ধীরেসুস্থে বলা ভালো। আজকে তিতাস মনস্থির করেছে মাকে গিয়ে রূপসার কথাটা বলবে৷ বলে দেয়াটাই ভালো। ওই গ্রামে যাওয়া ছাড়া রূপসার সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই। সবচেয়ে ভালো হয় বাবা মাকে পাঠিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়া।
তিতাস মাকে কথাটা বলার সুযোগই পাচ্ছে না। সন্ধ্যায় রান্নাঘরে গিয়ে দেখে মা রান্নায় ব্যস্ত। ভাবলো রাতে বলবে। কিন্তু ঘরে এসে একটা মেইল দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো তিতাস। বিয়ের ভূতটা এক দৌড়ে মাথা থেকে পালালো।
একটা নামি-দামি কোম্পানি থেকে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের একটা অফার পেয়েছিলো তিতাস। সেটার সময় জানানো হয়েছে। এখন ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে পাড়ি দিতে হবে সুদূর সাউথ আফ্রিকায়। দীর্ঘদিন ধরে এরকম একটা ওয়ার্কশপের অপেক্ষার প্রহর গুণছিলো ও। আজ সেই সুযোগ এসেছে। সেইসাথে ওয়াইল্ড লাইফ কাস্টমাইজড ট্যুরও আছে। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছিলো তিতাসের। ছুটে বাইরে এসে হৈ চৈ করতে করতে বললো, মামা, মামা কই তুমি? আমার ওয়ার্কশপ কনফার্ম । এবার আমি উড়ে উড়ে আফ্রিকার জঙ্গলে রওনা দিবো। উহ হু হু হু…
তিতাসের আনন্দ যেন আর ধরেই না। এই ছেলেটা এমনই। বেশি আনন্দ পেলে একদম বাচ্চা হয়ে যায়। এখনো সেই ছোটবেলার স্বভাবটা যায় নি।
ছোটমামা রাত্রিবেলা তিতাসকে বললো, বিয়েটা তাহলে আপাতত স্কিপ করে যাবি?
– ওহ মামা। বিয়ের জন্য বাকি জীবন তো পড়েই আছে। কিন্তু আমার ওয়ার্কশপটা কিন্তু এবার হাতছাড়া করলে পরবর্তীতে এইরকম সুযোগ নাও পেতে পারি।
– তা ঠিক। তুই যা ভালো মনে করিস। যাওয়ার আগে মেয়েটার সাথে দেখা করে যাবি না?
তিতাস চোখ তুলে মামার দিকে তাকালো। একটা ভালো কথা বলেছে মামা। দেখা করে যাওয়াটাই তো উচিৎ। কিন্তু এখন দেখা করলে যদি বিয়ে করে ফেলতে ইচ্ছে করে? বিষয়টা আরেকবার ভেবে দেখতে হবে।
চলবে..