এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ১০
মিশু মনি
তিতাস এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ সামনের সাড়িতে বসে থাকা একজনের উপর চোখ আটকে গেলো। কেট উইন্সলেট! প্রথমটায় ভিড়মি খেয়ে যাচ্ছিল তিতাস। নিজের পছন্দের নায়িকা। এখানে, মানে বাংলাদেশে! পরক্ষণেই বুঝতে পারলো এ চোখের ভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। মেয়েটা দেখতে অনেকটাই কেটের মত। তাছাড়া কেট উইন্সলেট এখনও এতটা তরুণী নয়। নিজের এই বোকামির জন্য হাসি পেয়ে গেলো তিতাসের। আপন মনেই হাসছিল। তখন এক ভাই এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘তিতাস মাহমুদ?’
তিতাস হেসে বললো, ‘জ্বি। আপনি নিয়াজ ভাই?’
ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য। মুখ ভরা হাসি। তিতাস হ্যান্ডশেক করে বললো, ‘আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’
– ‘আপনি নয়, জাস্ট তুমি ওকে? তুমি একটু বসো। আরেকজনকে খুঁজতে হবে।’
নিয়াজ ভাইও বাংলাদেশ থেকে ওয়ার্কশপে যাচ্ছে। গত পরশু মেইলে ওনার সাথে পরিচয়। ভালোই হলো, নিজের গল্প করার একজন সাথী পাওয়া গেলো।
কেট উইন্সলেটের দিকে আরেকবার চোখ চলে গেলে দেখতে পেলো মেয়েটা আর সেখানে নেই। উঠে চলে গেছে। তিতাস মাথা দুলিয়ে হাসলো। ফোন বের করে ফেসবুকে একটা সেলফি আপলোড করলো। ক্যাপশনে লিখলো, ‘এয়ারপোর্টে এসেই আজ বড়সড় তব্দা খাইসি। আমার সামনে কেট উইন্সলেট বসা। হার্টবিট লাফিয়ে বত্রিশ ইঞ্চি বড় হয়ে যাচ্ছিল, আরেকবার তাকিয়ে দেখি সে উধাও। জানিনা এ আমার চোখের ভ্রম, নাকি বুড়াতি বয়সের ভিমরতি।’
ক্যাপশনের জন্য প্রচুর হাহা রিয়েক্ট পড়তে লাগলো ওর সেলফিতে। বন্ধুরা হাস্যকর কমেন্টও জুরে দিচ্ছিল। তিতাস একটা একটা করে রিপ্লাই দিচ্ছে আর হাসছে। এমন সময় নিয়াজ ভাইয়ের গলা শোনা গেলো, ‘তিতাস, ইনি হচ্ছেন আমাদের সহযাত্রী। পরিচিত হও’
ফোনের স্ক্রিন থেকে মাথা তুলে সহযাত্রীর দিকে তাকাতেই তিতাসের হার্ট- ব্রেক কষে দাঁড়ালো। সেই কেট উইন্সলেট! হিচকি উঠে যাচ্ছিল ওর। মেয়েটা মিষ্টি হাসি সমেত হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘হ্যালো আই এম ফ্রেরীহা।’
তিতাস হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে নরম হাতের স্পর্শে একবার ঢোক গিলল। বেচারা বুঝতেই পারলো না তার দাঁতগুলো এখনো কেলানোই আছে। ফ্রেরীহা হাসতে হাসতে বললো, ‘আপনি হাসলে ছয়টা দাঁত বের হয়ে থাকে।’
তৎক্ষনাৎ মুখ বন্ধ করে ফেললো তিতাস। পরক্ষণেই আবার হেসে ফেললো। ওর সাথে হাসতে লাগল নিয়াজ ভাই ও ফ্রেরীহা। মেয়েটার নামটা তিতাসের ভালো লেগেছে। আনকমন নাম। নিশ্চয় বিদেশে বড় হয়েছে নয়তো ওর মা অথবা বাপ আমেরিকান। ধবধবে সাদা চামড়া, গাল দুটো লাল টকটকে। চুলগুলোও ছোট ছোট করে ছাঁটা। পিছনে ক্লিপ দিয়ে আটকে রেখেছে। ঠোঁটে টকটকে লাল রঙা লিপস্টিক। যেন ঠোঁট নয়, কৃষ্ণচূড়া ফুল।
তিতাসের পাশের সিটে বসে ফ্রেরীহা নখ পর্যবেক্ষণ করছে। তিতাস জিজ্ঞেস করলো, ‘আর ইউ ব্রিটিশ?’
– ‘নো। আই এম পিওর বেঙ্গলি।’
– ‘তারমানে আমাদের জাতের?’
– ‘এটা কোয়েশ্চেন ছিলো নাকি জোক?’
হেসে উঠলো তিতাস ও ফ্রেরীহা। হাসলে মেয়েটাকে সাধারণ মেয়েদের মতই লাগে। চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়। তখন আর কেটের চেহারার ভাবটা থাকে না। তবুও তিতাসের ভীষণ আগ্রহ জন্মাচ্ছে মেয়েটার সাথে ভাব জমানোর। টুকটাক গল্প, আড্ডা। যেহেতু একইসাথে ওয়ার্কশপে যাচ্ছে, সেহেতু ভাব জমাতেই হবে। সেখানে বাঙালি ছাড়া আর কে আছে গল্প করার?
ফ্রেরীহা বললো, ‘আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য কেউ আসবে?’
– ‘জানি না।’
– ‘না জেনেই বেরিয়ে পড়েছেন কেন?’
– ‘কারণ আমি তো হানিমুনে যাচ্ছি না।’
– ‘ইউ আর সিরিয়াসলি আ জোকার! হা হা হা।’
ফ্রেরীহা শব্দ করে হেসে ফেললো। নিয়াজ ভাই তিতাসের অপরপাশে বসে ফোন গুঁতাচ্ছে। তার প্রেমিকার সাথে আজকে দেখা করে বিদায় নেবার কথা ছিলো। কিন্তু বেচারা ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে ফেলেছে। এখন বেরিয়ে আর লাভ নেই। নিয়াজ ক্ষুব্ধ হয়ে উল্টা পাল্টা মেসেজ পাঠাচ্ছে। আর এদিকে ফ্রেরীহার সাথে গল্পে মেতে উঠেছে তিতাস। মেয়েটা খুবই মিশুক। এমন সুন্দরী মেয়েদের সম্পর্কে তিতাসের ধারণা ছিল তারা খুব কম কথা বলে, খুব কম মেশে। ফ্রেরীহাকে দেখে সেই ধারণা একেবারে বদলে গেলো। ও কথা বলার সময় ওর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
বিমানে উঠে ফ্রেরীহা জানালার পাশের সিটে বসে পড়লো। ইকোনমি ক্লাসের সিট। মাঝখানে বসেছে নিয়াজ ভাই। অগত্যা তিতাসকে বসতে হলো নিয়াজ ভাইয়ের পাশে। ফ্রেরীহার পাশে বসতে না পারার আক্ষেপ হচ্ছিলো ভীষণ। অন্তত সারাটা পথ দুজনে গল্প গুজব করা যেতো। পরক্ষণেই মনে হলো, আমি কি ধীরেধীরে ছেঁচড়া পোলাপাইন হয়ে যাচ্ছি? নাহ, নিজের লেভেল ক্রস করা যাবে না। সে থাক তার মতো।
নিয়াজ ভাই নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো, ‘জানো তিতু, আমার গার্ল এখন আসছে এয়ারপোর্টে। আমার সাথে দেখা করতে। ওরে বললাম শালী এখন প্লেনের পাংখা দ্যাখ।’
– ‘খুবই ভালো বলেছেন। তার উচিৎ ছিল আজকে ভোর থেকেই আপনাকে সময় দেয়া।’
নিয়াজ ভাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘রাইট। ওকে বলেছিলাম আজ রাতে আমার বাসায় থাকো। আমার ব্যাগ গোছাবো, আড্ডা দেবো। শুনবে না। ভালোই হয়েছে কি বলো? এখন আমাকে কল দিলেও পাবে না। টেক্সট দিলেও পাবে না। নতুন নাম্বার ওকে আমি দিচ্ছি না।’
– ‘এটাও খুব ভালো সিদ্ধান্ত।’
– ‘তিতু, আমার সব কথাকে সাপোর্ট করবে না। যেটা খারাপ লাগবে, খারাপ বলবা।’
– ‘ওকে।’
– ‘চলো আমরা প্রসঙ্গ পাল্টাই। গার্ল এর কথা বাদ।’
– ‘আমাকে তিতু ডাকছেন কেন?’
– ‘শর্ট করে ডাকছি। কিউট না? আমার আমার গার্ল এর নাম নাবিলা। আমি ওকে কি ডাকি জানো? “না।’
– ‘না” বলে ডাকেন?’
– ‘ইয়েস। ওকে বলি আমাকে “নি” বলে ডাকবা। ও ডাকেনা। ওর নাকি এসব ভালো লাগে না।’
– ‘না নি- দারুণ হতো কিন্তু।’
নিয়াজ ভাই হাসতে হাসতে বললো, ‘সত্যিই তো। দারুণ হতো। আমি এভাবে ভেবে দেখি নি।’
তিতাস ব্যাগ থেকে চকোলেট বের করে বললো, ‘খাবেন?’
– ‘না।’
তিতাস ফ্রেরীহাকে ডেকে বললো, ‘ডু ইউ ফেভার চকোলেট?’
– ‘ওহ শিওর। থ্যাংকস।’
ফ্রেরীহা ব্যাগ থেকে একগাদা চকোলেট বের করে তিতাসকে দিয়ে বললো ,’প্লিজ?’
তিতাস ফ্রেরীহার চকোলেট গুলো নিয়ে ওর ছোট্ট ব্যাগে ভরে রাখলো। ফ্রেরীহা জিজ্ঞেস করলো, ‘সিট বেল্ট বাঁধেন নি যে?’
– ‘বিমান বালা এসে বেঁধে দিবে।’
– ‘রিয়েলি ইউ আর… হা হা হা।’
ফ্রেরীহা হাসতে একজন বিমানমালাকে ডেকে তিতাসের দিকে মনোযোগ দিতে বললো। মেয়েটা তাহলে দুষ্টুও আছে। বালা যখন বেল্ট বাঁধতে সাহায্য করছিল, ফ্রেরীহা হাসছিল আর মাথা এগিয়ে দেখছিলো।
তিতাস ফ্রেরীহাকে বললো, ‘এটা কিন্তু ফান ছিলো।’
– ‘আই নো ম্যান। বারবার কি ফান করে ওদেরকে ডেকে বলবো আপনার দিকে মনোযোগ দিতে?’
– ‘ইয়েস, ইউ ক্যান। তবে এত আনন্দ আমি নিতে পারবো কি না জানিনা।’
ফ্রেরীহা হেসে ফেললো। এভাবে চলতেই লাগলো দুজনের গল্প। মাঝখানে চিপায় পড়ে গেছে নিয়াজ ভাই। দুজনে বেশ আড্ডায় মেতেছে। নিয়াজ ভাই মাঝখানে থেকেও চাইলে গল্পের মাঝখানে ঢুকতে পারছে না। ওরা নিয়াজকে মাঝে রেখে গল্প চালিয়েই যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে নিয়াজ বললো, ‘ভাই তিতু, হয় তুমি আমার সিটে আসো। নয় ফ্রেরীহা আমার সিটে আসো। দুইজনে আমাকে চিপায় ফেলে গল্প করলে প্লেনের সিট ঠিক থাকলেও আমার মাথার সিট এলোমেলো হয়ে যাবে।’
ফ্রেরীহা ও তিতাস হাসলো নিয়াজের কথায়। কিন্তু দুজনের একজনের মাঝেও জায়গা বদল করার আগ্রহ দেখা গেলো না। যেন নিয়াজকে মাঝখানে রেখে গল্প করতেই তারা বেশি আনন্দ পাচ্ছে। সত্যি কথা হচ্ছে তিতাস সিট বেল্ট লাগাতেও পারে না, খুলতেও পারে না। তাই ওর মাঝে জায়গা বদল করার ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে না। এরপর যখন আবারও ওরা গল্প শুরু করলো, নিয়াজ নিজে থেকে তিতাসের সিট বেল্ট খুলে দিয়ে বললো, ভাই তুই এখানে আয়।
জায়গা বদল করার পর ফ্রেরীহার হাসি যেন আর থামছিলো না। ও তিতাসকে বললো, ‘সো উই আর ফ্রেন্ডস?’
– ‘বলা যায়।’
– ‘বলা যায় মানে? আমাকে কি গল্প করার সাথী হিসেবে ভালো লাগছে না তোমার?’
– ‘অবশ্যই ভালো লাগছে। কিন্তু বন্ধু তো শুধু গল্পেই হয় না। প্রয়োজনেও লাগে।’
– ‘প্রয়োজন?’
– ‘যেমন, বেল্ট খুলে দেয়া, লাগিয়ে দেয়া, উড্ডয়নের সময় আমি ভয় পেলে সাহস দেয়া।’
– ‘হা হা হা। এত ফানি তুমি!’
দুজনের হাসি আর গল্প ক্রমেই জমে উঠছিলো। এদিকে নিয়াজ ভাই একাই এক কোণে বসে, বিমান বালাদের পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া তার কিছুই করার নেই।
চলবে..