এক শহর ভালোবাসা পর্ব-৮+৯

0
4060

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৮
#সুরাইয়া_নাজিফা

“জাস্ট স্টপ ঐশী তোমার সাথে আমার কখনো এমন সম্পর্ক ছিলোই না যে আমি তোমার হয়ে থাকব। কিছু বলছি না বলে যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছো। ”

শান ঐশীকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিল। শানের ব্যবহারে ঐশী ভাবলেশহীন ভাবে শানের দিকে তাকিয়ে আছে।

“শান তুমি এটা কিভাবে বলছো? শান তুমিই তো বলেছিলে তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবে। সবসময় আমার কেয়ার করতে। তাহলে এখন কেন দূরে সরে যাচ্ছো। ”

ঐশী শানের দিকে এক পা বারাতেই শান ঐশীকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল।

“লিসেন দূরে থাকো আমার থেকে। এই পৃথিবীতে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক ছাড়াও আরো একটা সম্পর্ক আছে ঐশী সেটা হলো বন্ধুত্ব।আর বন্ধু হয়ে বন্ধুর পাশে থাকব বলেছি তাতে দোষের কি আছে? ”

ঐশী কান্না করতে করতে বললো,
“কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি শান।খুব ভালোবাসি। ”

শান কঠোর গলায় বললো,
“সেটা তোমার সমস্যা ঐশী। তবে তোমার সাথে আমার বিজন্যাস ডিল আর বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই। ”

ঐশী অস্ফুট স্বরে বললো শুধু বিজন্যাস ডিল? কথাটা বলতেই ঐশী ছলছল চোখে শানের দিকে তাকালো। ঐশীও ভেবেছিল শান ওকে ভালোবাসে। কারণ শানের ব্যবহারে কখনো এমন মনেই হয়নি যে আমি শুধুই ফ্রেন্ড নাহলে হয়তো আমিই ভুল ভেবেছি?এতো বড় ভুল। ঐশী আর ওখানে দাঁড়াতে পারল না দৌড়ে বেরিয়ে গেল কান্না করতে করতে।

শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে গিয়ে বসল। শান নিজেও বুঝতে পারেনি যে ঐশী ওর এই ভালো ব্যবহারকে ভালেবাসা মনে করবে। ঐশী হলো শানের বিজন্যাস পার্টনার। খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে। যেমন রূপবতী তেমন গুণবতী। এজন্য শানের ভালো লাগতো। একটা কাজ একবারের বেশী ওকে কখনো বলা লাগতো না। চট করে বুঝে যেতো। ঐশী আর শান মিলে বেশ কয়েকটা ডিল খুব সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করেছিল। আস্তে আস্তে শানের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় ঐশীর। যদিও শানের আরেকটা মোটিভ ছিল সেটা হলো বিজন্যাস। কারণ ঐশীদের বিজন্যাসের সাথে শানের বিজন্যাস এক হলে সেখানে আরো বেশী প্রফিট হবে। এজন্য ঐশীকে শান তার বিজন্যাস পার্টনার বানিয়ে নেয়। কিন্তু ঐশীর সাথে থাকতে থাকতে শান বুঝতে পারে যে ঐশী ওর ওপর দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। দিনদিন ঐশীর ব্যবহার, পছন্দ, পরিবর্তন হচ্ছিল। তাই শান ঐশীর থেকে দূরত্ব বারাতে থাকে এমনকি কথাও বলে না ঠিক করে। শান ভেবেছিল ঐশী যেহেতু ওকে এখনো এই বিষয়ে কিছু বলেনি তাই আগেই যদি ও ঐশীকে আকারে-ইঙ্গিতে বুঝায় যে ও ঐশীকে পছন্দ করে না তাহলে হয়তো ও নিজেকে সামলে নেবে কারণ ঐশী একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে। বাট ঐশীকে এতবার বুঝানোর পরেও ঐশী বুঝেনি। উল্টো যে কথা এতদিন জানায়নি সেটাও জানিয়ে দিল। শান আর ভাবতে পারছে না। শানের কারণে কখনো কেউ কষ্ট পাবে সেটা শান সহ্যে করতে পারেনা। সেখানে ঐশী তো ওর ভালো বন্ধু। কিভাবে সহ্যে করবে ঐশীর কষ্ট। তারপরে আরো একটা বিষয় বেশ ভাবাচ্ছে সেটা হলো ঐশীর সাথে এই ঝামেলাটা নিয়ে ওর বিজন্যাসের উপর কোনো প্রভাব পড়বে না তো।ঐশী যদি বর্তমানে যে ডিলটা চলছে সেটা ক্যান্সেল করে দেয় তাহলে কত যে লোকশান হবে সেটা শান খুব ভালে বুঝতে পারছে। কিন্তু শুধু অনুমানের ভিত্তিতে কিছু বলা যাবে না দেখা যাক ঐশীর ডিসিশন কি হয়। তারপর নাহয় ভাবা যাবে।



বিকালে শান অনেক তাড়াতাড়ি চলে এসেছে অফিস থেকে। আজকে সকালেই সোহাকে নিয়ে অনেক প্লান করেই এসেছে বাড়ি থেকে।মনটাও ভালো ছিল।কিন্তু সকাল থেকে যা যা হলো তাতে আর ভালো থাকার জো আছে তারপরও যদি সোহার সাথে কিছুটা সময় কাঁটিয়ে ভালো থাকা যায় সেটাই অনেক শানের কাছে।

বাড়ির ভিতরে আসতেই শান দেখতে পেল সোহার বাবা মা বসে আছে। শান গিয়ে সোহার বাবাকে সালাম করল।সোহার বাবা বললো,

“কি ব্যাপার ইয়াংম্যান আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে?”
“এই অফিসে আজকে প্রথমদিন ছিল তো তাই আঙ্কেল।বাট আপনি এই সময় বাসায়? ”
“তুমি যেই কারণে বাসায় আমিও সেই কারণে। ”

শান একটু আশ্চর্য হলো। শান কেন বাসায় এসেছে সেটা উনি জানল কেমনে,

“আরে কি ভাবছ আজকে সোহা এসেছে সকালে তো আর বলে আসোনি তাই দেখা হয়নি। মেয়েকে দেখার জন্য মন কেমন করছিলো তাই চলে এলাম।তাই তুমি যাই বলো না কেন তুমিও যে সেইম কারণে এসেছো সেটাও আমি বুঝতে পারছি। ”

শ্বশুরের কথা শুনে শান একটু হাসল। শান আগে থেকেই জানত যে সোহার বাবা রাগি হলেও অনেক রসিক টাইপের মানুষ।বিশেষ করে শানের সাথে উনার আগে থেকেই অনেক ভালো সম্পর্ক। তাই বলে মেয়ের জামাইকেও ছাড়বে না সেটা বুঝতে পারেনি। শানের খুবই লজ্জা লাগছে শ্বশুরের সামনে এই পরিস্থিতিতে পরতে। সোহার বাবা আবার বলে উঠল,

“আরে ইয়াংম্যান এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমরাও এই বয়সটা পার করে এসেছি তো আমরা জানি।”

সোহার আম্মু চিৎকার করে বললো,
“উফ কি বলছো এসব। সম্পর্কের মাথা খেয়েছো নাকি?মেয়ের জামাইয়ের সাথে কিভাবে কথা বলছো?”
“কি বললাম আমি তো শানকে টিপস দিচ্ছিলাম যে বিয়ের পর কিভাবে সুখে থাকতে হয়। আর শান তুমি যেই পথে চলছো সেটা একদমই রাইট রাস্তা। এভাবেই চলতে থাকো তোমাকে দিয়েই হবে ইয়াংম্যান। ”
সোহার মা টোন কেটেই বললো,
“আহা নিজে যেন কতো সংসারের খেয়াল রাখে সে আবার অন্যজনকে টিপস দিচ্ছে।”
“কি মিথ্যা কথা বলো তোমরা মেয়েরা।সংসারের জন্যই তো এতো কষ্ট করছি। দেখেছো তো ইয়াংম্যান এটাকেই বউ বলে। জীবনে যাই করোনা কেন কোনো নাম হবে না তাই বি কেয়ারফুল। ”

এই নিয়ে সোহার বাবা মায়ের মধ্যে খুনসুটি বেজে গেছে। শানের খুব হাসি পাচ্ছে তাদের কথা শুনে। কিন্তু শ্বশুর শ্বাশুড়ী বিধায় হাসতেও পারছে না।তবে শান আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এক নজর সোহাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে মন। এদিকে শ্বশুর শ্বাশুড়ীর এই মিষ্টি ঝগড়াটাও মিশ করতে মন চাইছে না শানের। তাদেরকে দেখলেই বুঝা যায় যে বিয়ের এতো বছরেও তাদের ভালেবাসা ঠিক আগের মতোই আছে এতটুকুও কমেনি।

শান একবার ভাবছে জিজ্ঞেস করবে সোহা কোথায়? কিন্তু পরমূহূর্তেই লজ্জা লাগছে। যতোই আগে থেকে পরিচিত থাকুক। হুট করে কিভাবে বলবে যে আপনাদের মেয়ে কোথায়?

শান একবার আশেপাশে দেখে নিল। না মহারাণী কোথাও নেই। তাহলে কি রুমে?উফ এই মেয়েটাও সারাদিন রুমে কি করে কে জানে।আয় নিচে এসে সবার সাথে কথা বল তা না। শানকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে সোহার মা বললো,

“আচ্ছা শান তুই অনেকক্ষন হলো এসেছিস এখানে না বসে উপরে গিয়ে রেস্ট নে। সোহাও উপরে আছে। ”

শান তো এতক্ষন এই কথাটারই অপেক্ষা করছিল। শানের শ্বাশুড়ী মায়ের পা ধরে এখন সালাম করতে ইচ্ছা করছে এতো সহজে ওর মনের কথাটা বুঝে যাবে ভাবতে পারেনি।কিন্তু বলা মাত্রই উঠে গেল আবার কি মনে করবে তাই শান বললো,

“না সমস্যা নাই আমি ঠিক আছি। ”

তখনি সোহার বাবা টোন কেঁটে বললো,
“আরে যাও যাও। এত ফর্মালিটির দরকার নাই। সুযোগ যখন পেয়েছো ছাড়াটা ঠিক নয়। ”

শানের হাত আপনাতেই কপালে চলে গেল।শুধু চাপড়ানো বাকি।শান বেশ বুঝতে পারল এখানে বসে থাকলে বাকি যেটুকু প্রেস্টিজ আছে সেটাও পান্ঞ্চার করে ছাড়বে শ্রদ্ধেয় শ্বশুরমশাই। তাই শান এদিক ওদিক না তাকিয়ে দ্রুত উঠে উপরে চলে গেলো।



ঐশী ফুল স্পীডে গাড়ি চালিয়ে একটা ব্রিজের উপর এসে গাড়ি থামালো। চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি বিসর্জন করে যাচ্ছে। কোনো ভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করতেই পারছে না। আজকে কত খুশি ছিল ও। মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল যে আজকে দেশে ফিরেই একসাথে দুটো খুশির খবর দিবে একটা হলো ডিল কম্প্লিট হওয়ার খুশি যার জন্য ঐশী দেশের বাহিরে গিয়েছিল আর দ্বিতীয়টা শানকে ওর মনের কথা বলে দিবে। অনেকবার ফোন করেছিল ঐশী যাতে শান এয়ারপোর্ট থেকে ওকে রিসিভড করতে আসে বাট না শানের কোনো খবরই ছিল না। ঐশীর তখনই ভয় লাগতে শুরু করল যে শান ঠিক আছে তো। ও তাড়াতাড়ি করে নিজের বাসায় যায়। আর সেখানে গিয়েই ওর বাবার কাছে জানতে পারে যে শান বিয়ে করে নিয়েছে। এই খবরটা শুনার পর ঐশীর সব খুশি মাটিতে মিশে গেল। পরক্ষনে যখন শুনল যে এই মেয়েটা সে নয় যার সাথে বিয়ের কথা হয়েছিল তখন এক পলকের জন্য কোথাও মনে আশার আলো জেগেছিল যে হয়তো শানকে বললে শান ওকে মেনে নেবে। বাট ও ভুল ছিল। কেউ যদি ভাগ্যেই না থাকে তাকে কখনোই নিজের জোরে ভাগ্যের লিখন বানানো যায় না। কথা গুলো মনে করেই ঐশী হুহু করে আবার কেঁদে উঠল। ঐশী অনেক শক্ত একটা মেয়ে। যেকোনো বিষয় সহজেই মেনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আজকের বিষয়টা যেন মন কিছুতে মানতেই পারছে না। এখন বুঝতে পারছে,

” কাউকে এতটাও ভালোবাসা ঠিক নয় যে তাকে না পেলে নিজের জীবনটা মূল্যহীন মনে হয়।”

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে ঐশী এখানে এসেছে। যখন এসেছিল তখন সূর্যের প্রখর রোদ ছিল। আর এখন তেজটা কমে কিছুটা হেলে গিয়েছে। ফুরফুর করে বাতাস আসছে চারদিক থেকে। মাঝে মাঝে পাশ থেকে দুই একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। সবাই সবার মতো ব্যস্ত। ঐশী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দূর আকাশে সূর্যের দিকে তাকিয়ে। শান এখন ঐশীর কাছে ঠিক ঐ আকাশটার মতো যাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় অনেক কাছে। আরেকটু গেলেই ছুতে পারবে আকাশটা। কিন্তু যতোই কাছে যাবে ততোই দূরত্বটা বাড়তে থাকবে আর ছোঁয়ার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যাবে।

আজকের এই কষ্টের জন্য ঐশী কখনো শানকে দোষ দিবে না। কারণ ভুলটা ওর ছিল। শান কখনোই এমন কিছু বলেনি বা করেনি যাতে মনে হয় শান ওকে ভালোবাসে। নেহাত শান অনেক ভালো মানুষ তাই সবসময় ওর খেয়াল রেখেছে, ওর একাকিত্বের সঙ্গী হয়েছে,ওকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, ওর পাশে থেকেছে আর ও এইসবকেই ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছে। ঐশী ভাবত ও একটা বুদ্ধিমতী মেয়ে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওর মতো স্টুপিড পৃথিবীতে একটাও নেই যে কারো ভালো ব্যাবহারকে, ভালো মানুষিকে ও ভালোবাসা ভেবেছে। যেহেতু ভুলটা ওর তাই ভুলের মাশুলটা তো ওকেই গুনতে হবে। ভেবেই ঐশী ব্রিজের দিকে আরেকটু ঝুকে গেল। নিচে বয়ে চলেছে নদীর ধারা। যেখান থেকে পড়লেই সাথে সাথে নদীর স্রোতটা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে চিরতরে। ঐশী একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেখানে।

“এই মেয়ে ব্রিজের এতটা কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছো কেন?আরেকটু ঝুঁকলেই তো পড়ে যাবে। জীবনের মায়া নেই নাকি? ”

কথাটা শুনেই ঐশী অবাক হয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। ওর সামনে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স হয়তো সাতাশ বা আটাশ হবে। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং। গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। একটা অফ-হোয়াট শার্ট, একটা ব্লু জিন্স প্যান্ট, পায়ে কেটস। হাতে ঘড়ি। চোখে সানগ্লাস। গলায় একটা লকেটে একটা অক্ষর টাইপের কিছু রয়েছে যেটা বুঝা যাচ্ছে না ভালো করে। দেখে উচ্চবংশীয়ই মনে হয়। বাট ঐশী চিনে বলে মনে হচ্ছে না।ইনফেক্ট কখনো দেখেছে বলেও মনে হয় না। তাহলে ছেলেটা কি কথা গুলো ওকেই বলেছে নাকি অন্যকাউকে। ঐশী একবার নিজের আশেপাশে দেখে নিলো। ছেলেটা তখনই বলে উঠল,

“এই যে ম্যাডাম এদিক ওদিক কি দেখছেন কথাটা আমি আপনাকেই বলেছি। ”

ঐশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তারপর হাত দিয়ে নিজের দিকে ইঙ্গিত করে বললো,

“আমাকে বলছিলেন?”
“আপনি ছাড়া তো এখানে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে সুইসাইড করতে এসেছে তাহলে কথাটা আপনাকেই বলেছি। ”
ঐশী আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বললো,
“সুইসাইড করতে এসেছি মানে?”

“মানে আপনার চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই প্রেমে ছেঁকা খেয়েছেন তাই চলে এসেছেন সুইসাইড করতে। আপনাদের এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের আমি মাঝে মাঝে বুঝতেই পারি না। একটু কিছু হলেই সুইসাইডের রাস্তা বেঁচে নেন কেন?নিজের ভিতরে লড়ে বেঁচে থাকার সামর্থ্য নেই নাকি? সবসময় কেন অন্যের জন্য বাঁচতে হবে? নিজের জন্য কি বাঁচা যায় না। একবার নিজের বাবা মায়ের কথাটা তো চিন্তা করতেন। আপনি না থাকলে তাদের উপর কি প্রভাব পড়বে বুঝেন সেসব। বয়ফ্রেন্ড কি বলেছে কি বলে নাই চলে এলো মরার জন্য।আপনি মরলে না যা ক্ষতি হওয়ার আপনারই হবে অন্যের কিছুই হবে না। অদ্ভুত মানুষ সব। ”

এতক্ষনে ঐশী লোকটার কথা শুনে রেগে আগুন হয়েছে। একে তো নিজের মনে নিজেই কাহিনী বানিয়ে নিয়েছে। তার উপর এক্সট্রা জ্ঞান দিচ্ছে। আর ঐশীর পছন্দ নয় যে কেউ ওকে জ্ঞান দিক। ঐশী লোকটার দিকে তেড়ে গিয়ে বললো,

“আপনার কাছে কেউ জ্ঞান নিতে চেয়েছে যে দিচ্ছেন। অদ্ভুত মানুষ তো আপনি কোথায় চিনি না জানি না চলে এসেছেন গায়ে পড়ে কথা বলতে। আমি সুইসাইড করি না জাহান্নামে যাই সেটা আমার ব্যাপার আপনার কি?আপনাকে কে ডেকেছে।পাগল একটা। ”

“পাগল মানে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? আপনি সুইসাইড করতেন আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম সেটা ভালে হতো বলছেন?

ঐশীর মাথাটা এমনিতেও গরম হয়ে আছে আর এই ছেলেটার কথা শুনে আরো বিরক্ত লাগছে। ঐশী বুঝে গেল এই পাগলের সাথে কথা বলা মানে নিজের মাথায় নিজে বারি মারা।তাই ঐশী হনহন করে গাড়িতে গিয়ে বসল আর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলেও গেল। ঐশীর ব্যবহারে ছেলেটা হা করে তাকিয়ে থাকল।কারো ভালো করতে গেলেও যে এতো কথা শুনতে হয় জানা ছিল না তার।কোথায় ও মোটিভেশনাল ভাষণ দিয়ে ওকে সুইসাইডের হাত থেকে বাঁচালো ওকে একটা ধন্যবাদ দিবে তা না করে খারাপ ব্যবহার করলো। ছেলেটা রেগে বললো,

“ধ্যাত আর কারো হেল্পই করবো না জীবনে।দিন দিন মানুষ গুলা সব অকৃতজ্ঞ হয়ে যাচ্ছে।”



শান রুমে এসে দেখল সোহা মুখের উপর একটা বই দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। সম্ভবত বইটা পড়তে পড়তেই ঘুমিয়েছে। ভাবতেই শানের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। মেয়েটা এমনিতে শুধু হাতে পায়েই বড় হয়েছে কিন্তু মনটা একদম সেরকমই রয়ে গেছে যেদিন শান সোহাকে প্রথম দেখেছিল। ছোট্ট একটা পুতুলের মতো বাচ্চা মেয়েকে।এতোটা ভয় পেয়েছিল মেয়েটা সেদিন যে ভাবলেই এখনো হাসি পায়।

শান সোহার কাছে গিয়ে সোহার মুখের উপর থেকে বইটা সরালো। নিমাই ভট্টাচার্যের “মেমসাহেব” উপন্যাসটা পড়ছে।

“এই বাচ্চা মেয়েটা নাকি প্রেমের উপন্যাস পড়ছে ভাবা যায়।যে প্রেমের প ও বুঝে না সে এসব উপন্যাস পড়ছে। ”

শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বইটা পাশে রেখে দিলো। সোহার পাশে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে এক গালে হাত রেখে সোহাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে সারা বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিছু চুল মুখে এসে পড়েছে। শান আলতো হাতে চুল গুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিলো। অদ্ভুত সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে সারা মুখ জুড়ে। শান আস্তে করে ওর এক আঙ্গুল দিয়ে সোহার ঠোঁটে স্লাইড করতেই সোহা একটু নড়ে চড়ে উঠল। শান তাড়াতাড়ি করে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। উফ কারো ঘুমন্ত চেহারায়ও এতো মায়া থাকে,এতো মিষ্টি লাগে সোহা তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। মনে হয় সারাজীবন দেখেই যায় দেখার ঘোর না কাঁটে।

হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখল বড্ড দেরী হয়ে গেছে। ওদের এখনি বেরোতে হবে নাহলে এমনিতে দেরী হয়েছে সেখানে গিয়ে ফিরতে ফিরতে আরো লেইট হয়ে যাবে। তাই শান সোহাকে ডাকতে থাকলো,

“এই সোহা উঠো। সোহা উঠো না প্লিজ।এই মেয়ে। ”
শান সোহার গালে হাত রেখে ডাকতে লাগল। তখনই সোহা ঘুমের মধ্যেই বলে উঠল,

“উফ মা যাও তো ভালো লাগছে না ঘুমাবো।”

“আরে আমি তোমার মা না তোমার বর উঠো তাড়াতাড়ি আমাদের বেরোতে হবে।”

“দূর নিজেরটা নিজে যাও না মা আমাকে কেন বিরক্ত করছ।এমনিতেও ঐ বাড়িতে রাক্ষস একটার জন্য ঘুমাতে পারিনা শান্তিতে। এখন তুমিও বিরক্ত করছ। ”

কথাটা শুনেই শানের প্রচন্ড রাগ হলো হোয়াট আমি রাক্ষস?আমিন এমন কি করেছি তোমার সাথে? বাট রাক্ষস কেমন হয় এখন তুমি বুঝবে। কথাটা বলেই সোহাকে কোলে তুলে ওয়াসরুমে নিয়ে শাওয়ারটা অন করে দিলো।

হঠাৎ ঠান্ডা পানির ছোঁয়া লাগায় আমি এক চিৎকার মেরে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম এটা আমার ওয়াসরুম।কিন্তু আমি তো আমার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম তাহলে ওয়াশরুমে এলাম কি করে। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি পুরা বাক রুদ্ধ হয়ে গেলাম।কিছুক্ষন পর আমার ঘোর কাঁটতেই দেখতে পেলাম শান আমার সামনে দাঁড়িয়ে । আমি উনার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম,

“আমি ওয়াসরুমে এলাম কি করে? আর আপনিই বা এখানে কেন? আপনি করেছেন না এটা? ”

শান নিজের দুই পকেটে হাত দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ করেছি। কি যেন বলছিলে আমি রাক্ষস তাই না। আমার জন্য তুমি ঘুমাতে পারো না। আমি তোমাকে ডিসটার্ভ করি তাই তো। ”

আমি নিজের মনেই বললাম,
“হায় হায় এই সত্যি কথা গুলা আমি আবার কখন বললাম। নাকি উনি নিজেই মন গড়া কাহিনী বানাচ্ছে। ”

আমি একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
“কই আমি?কখন বলেছি এসব। মিথ্যা বলছেন কেন আমি?”

“আমি মিথ্যা বলছি। এই মাত্র তুমি বলেছো সব ঘুমের ঘোরে। ভালোই হয়েছে ঘুমের মধ্যে ছিলে নাহলে তো আমার সম্পর্কে তোমার এই মহান ধারণা গুলো জানতেও পারতাম না আমি। আজকে হচ্ছে তোমার। ”
শান আমার দিকে এগিয়ে আসল আর আমি আমার চোখ বন্ধ করে নিলাম।
.

চলবে

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৯
#সুরাইয়া_নাজিফা

“প্লিজ প্লিজ মাফ করে দিন আমি আর কখনো বলবোনা।তবুও আমার থেকে দূরে থাকুন।”
শান আমার কাছে এসে দেওয়ালে একহাত রেখে আমার দিকে একটু ঝুঁকে বললো,
“আর যদি দূরে না থাকি তাহলে?”
“তাহলে আমি চিৎকার করে সবাইকে ডাকব। ”
শানের খুব ভালো লাগছিল সোহার এমন বোকা বোকা কথা। শান মজা করেই বললো,
“আচ্ছা। তো সবাইকে ডেকে কি বলবে তুমি ?আমাকেও বলো আমিও একটু শুনি। ”

শান আমার কাছে এসে দাঁড়াতেই আমি আবার চোখ বন্ধ করে নিলাম। নিজের হাত দিয়ে পানির ট্যাপটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। আমার খুব ভয় লাগছিলো তাই চিৎকার করেই বললাম,

“আপনি এখন আমার সাথে উল্টা-পাল্টা কিছু করলে আমি সেটা সবাইকে বলে দিবো। ”
শান চোখ গুলো স্বাভাবিকের থেকেও কয়েকগুন বড় হয়ে গেল। শানের গলায় বিষ্ময় নিয়ে বললো,
“মানে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা হবে সেটা তুমি সবাইকে বলে দিবে?”

আমি মুখে কিছু না বলে দুই তিনবার মাথাটা জোরে জোরে ঝাকালাম ফলস্বরূপ দেওয়ালে ঠাস করে মাথাটা লেগে গেল। আমি মাথায় হাত দিয়ে “উফ “বলে উঠলাম আর মাথাটা হাত দিয়ে ঢলতে লাগলাম।

শান আমার কাছ থেকে দু’পা পিছনে সরে গেল। শানের মুখের কথা হারিয়ে গেছে। জীবনে এমন একটা মেয়ের প্রেমে পড়ল যে ওকে কখনো বুঝলোই না। শান খুব ভালো করে জানে এই মেয়ের কোনো বিশ্বাস নেই চিৎকার দিলেও দিতে পারে। শান এখনও ওদের প্রথম দেখার কথা ভুলেনি। সেদিন শান শুধু ওর হাত ধরেছিলাম আর ও সেখান থেকে বেরিয়ে সবাইকে বলেছিল আমি নাকি ওকে জড়িয়ে ধরে রুমে আটকে রেখেছি। কি একটা লজ্জাজনক অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। আরশ তো টোন কেটে প্রায় বলেই দিয়েছিল,

“দূর ভাইয়া তোর থেকে এটা আশা করিনি। এত তাড়াহুড়ার কি ছিলো। একটু কৌশলে আয়ত্বে আনতে পারতিস।বাচ্চা মেয়ে তো বুঝতে একটু সময় লাগবে। ”

যদিও আরশকে বকা ঝকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেছিল।সামান্য একটা বিষয়ে ছোট ভাইয়ের কাছেও মজার পাত্র হয়ে গেছিল। আর সেটা নিয়েই এরপর থেকে লেগ পুলিং করতে শুরু করলো আরশ। ভাগ্যিস কথাটা সেদিন কেউ অতটা আমলে নেয়নি। তবে তিনদিন পর্যন্ত শান কারো সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনি। এখনও মনে পড়লে শিউরে উঠে শান।এখন যদিও বউ হয়। কিন্তু তারপরও এখন কিছু করলে যদি চিৎকার করে সবাইকে জড় করে তাহলে আর মুখ দেখানো যাবে না। সবাই কি বলবে স্বামী হয়ে বউকে একটু টাচ করেছে কি করেনি তাই সে চিৎকার করেছে আল্লাহ। যেটুকু সম্মান বাকি আছে সেটা নিয়েও টানাটানি লেগে যাবে। এরচেয়ে যেমন আছে তেমন থাকুক। শান নিজের চোখ মুখ খিঁচে বললো,

“ইউ আর জাস্ট টু মাচ। ছাগল জানি একটা। ”

আমি শানের কথা শুনে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি ছাগল? তাহলে তুই কি ব্যাটা খচ্চর। উফ আমার এতো সাধের ঘুমটা নষ্ট করে দিলো। এমনিতেও ঐ বাড়িতে এই ভয়ে ঘুমাতে পারিনা কখন কি করে। যতই ভালো মানুষ হোক। যতই গার্লফ্রেন্ড থাকুক। পুরুষ মানুষের মনতো যেকোনো সময় বদলাতে পারে। কিন্তু এখানে যখন সুযোগ পেলাম তাই ভাবলাম যতটুকু ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। তা না দেখো এখানে এসেও সেই জোর জবরদস্তি শুরু হয়ে গেল। কোন কুক্ষণে যে এই উল্লুকটাকে বিয়ে করেছিলাম এখন বুঝো ঠেলা।

“মনে মনে গালি না দিয়ে সরাসরি বলো। এমনিতেও তোমার থেকে এর বেশী আর কি বা আশা করা যায়। ”

আমি আশ্চর্য হলাম বুঝিনা সবসময় উনি কি করে বুঝে আমি কিছু বললে।আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম,
“আমি আপনাকে কিছু বলি নি। ”
“হুম জানি আমি তুমি কি বলতে পারো আর না পারো। ”

কথায় কথায় শানের চোখ সোহার উপর পড়তেই শানের চোখ আটকে গেল। পানিতে ভেজার কারণে সোহার শরীরের বেশ কিছুটা অংশ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যেটা এতক্ষন খেয়াল করেনি। শানের মনে হলো ওর কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি করে চোখ সরিয়ে নিলো সোহার থেকে। আর গম্ভীর গলায় বললো,

“তাড়াতাড়ি জামা কাপড় চেন্জ করে নেও ঠান্ডা লেগে যাবে। ”

হঠাৎ শান আমার দিকে না ফিরে অন্যদিকে ফিরে কথা বলাতে আমার বিরক্ত লাগল। আজব তো কথা বলছে আমার সাথে আর ফিরে আছে দেওয়ালের দিকে এমন কথা বলে লাভ কি? আমি শানের সামনে গিয়ে দুই হাত বুকে বেঁধে বললাম,

“বলি কথাটা কি আপনি দেওয়ালকে বলছিলেন। বাপরে আপনি তো দেখি “দেয়ালেরও কান আছে ” এই প্রবাদ বাক্যটা সত্যি করে দিলেন। ”

“মাথামোটা আমি দেওয়ালকে বলবো কেন? তোমাকেই বলেছি। এইবার সামনে থেকে দূর হও আর গিয়ে চেন্জ করো। ”

শানের কথাটা শুনে অপমানিত বোধ হলো। অদ্ভুত এভাবে অন্যদিকে ফিরে কথা বলছে কেন? আমাকে কি দেখার মতো না নাকি? আমি রেগে বললাম,

“হবো না দূর। আপনি কি করবেন।মুখ ফেরাচ্ছেন কেন। ফেস টু ফেস কথা বলুন। ”
শান এইবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বললো,
“আচ্ছা এখন যদি তোমার সাথে কিছু খারাপ হয় তার দোষ কিন্তু তুমি আমাকে দিও না। পরে বলোনা আপনি আমার সাথে এটা কেন করলেন? দোষ কিন্তু তোমারই। তুমি বারবার আমার সামনে আসছ। ”
আমি উনার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে বললাম,
“মানে? কি বলেন এসব। ”
উনার কন্ঠে বিরক্তি ফুটে উঠল,
“নিজের দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখো স্টুপিড নিজেই বুঝে যাবে। ”

উনার কথা শুনে আমি নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আমার জান যায় যায় অবস্থা। আল্লাহ এতক্ষন আমি এইভাবে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছি উনি আমাকে এভাবে দেখেছে। আমার ওড়নাটা কই গেলো। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে উনার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।শান এভার টোন কেটেই আমাকে বললো,

“কি হলো এখন কেন নিজেকে আড়াল করছো। এসো না আমার সামনে দাঁড়াও। মুখোমুখি কথা বলি। ”

শান আমার দিকে ফিরতেই আমি আবার দৌড়ে ওনার পিছনে চলে গেলাম নিজেকে আড়াল করতে আর কান্না জড়িতো কন্ঠে বললাম,
“আসলে আমি দুঃখিত খেয়াল ছিল না। এভাবে বলবেন না প্লিজ। ”
“কোন জিনিসে খেয়াল থাকে তোমার। যাই হোক এখন চেন্জ করে নেও আমি বাহিরে যাচ্ছি। ”

শান এক পা এগোতেই আমি পিছন থেকে ডেকে বললাম,
“শুনুন আমার একটা জামা দিয়ে যান। আপনিতো পানিতে চুবিয়ে দিলেন এখন চেন্জ করবো কিভাবে। ”

শান কথাটা শুনে পিছনে না ফিরেই বললো,
“দাঁড়াও আমি দেখছি। ”

শান যেতেই আমি ওয়াসরুমের দরজা লক করে দিলাম। আর নিজের বুকে হাত দিয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম। ছি সব সময় নিজের কিছু বোকামির কারণেই নিজের লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরতে হয়। বাট আমারও বা দোষটা কোথায় উনি নিজেই তো আমাকে পানির মধ্যে এনে ফেলে দিলেন। উনি যদি এই কাজটা না করতেন তাহলে আমাকেও এই লজ্জায় পরতে হতো না। ধ্যাত ভালো লাগে না।

কিছুক্ষন পর শান দরজায় নক করলো। আমি দরজারা খুলে দিলাম। শান আমার জন্য একটা শাড়ী নিয়ে ফিরে এলো। আমি অবাক হয়ে বললাম,

“আপনি শাড়ী পেলেন কোথায়? আমি তো বিয়ের আগে খুব একটা শাড়ী পরতাম না আর পড়লেও আম্মুর শাড়ী পড়তাম।আর এই শাড়ী দেখে মনে হয়না আম্মুর শাড়ী তবে কই পাইছেন। ”

“এতো এক্সট্রা কথা বলার দরকারটা কি আমি বুঝি না। কোথায় পেয়েছি সেটা জেনে তেমার কোন লাভ আছে। নিজের পছন্দের মতো জিনিস পাচ্ছো যখন সেটা নিয়েই খুশি থাকো না। ”

কথাটা বলেই উনি শাড়ীটা আমার হাতে দিয়ে ধুম করে দরজাটা আটকে দিয়ে চলে গেলেন। আমি পুরা তাজ্জাব হয়ে গেলাম,

“অদ্ভুত তাই বলে যে যা দিবে সেটাই পড়ে নেবো না জেনে যে জিনিসটা কোথা থেকে এসেছে? ”



আমি ড্রেস চেন্জ করে কিছুক্ষন ওয়াসরুমেই বসে থাকলাম। সামনে যাবো কি যাবো না সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু ওয়াসরুমেও বা কতক্ষণ যেতে তো হবেই। সারাক্ষণ তো আর এখানে থাকতে পারবো না। তখনই দরজায় জোরে জোরে ধাক্কানোর আওয়াজ হলো। হঠাৎ আওয়াজে আমি ভয় পেয়ে গেলাম।কিন্তু দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আরো দ্বিগুন হলো। আজব তো শ্বশুরবাড়ী বেড়াতে এসেও যে কেউ দানবের মতো আচরণ করে জানা ছিলো না তো। যা শুরু করেছে এখন যদি দরজা না খুলি নির্ঘাত দরজা ধাক্কতে ধাক্কাতেই ভেঙ্গে ফেলবে। আমি দ্রুত গিয়ে দরজা খুলতে খুলতেই চিৎকার করে বললাম,

“কি সমস্যা কি আপনার। দরজা ভেঙ্গে ফেলবেন নাকি?দেখলেন তো জামা চেন্জ করতে ঢুকলাম এতো জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন? এভার শান্তিতে কি জামাটাও চেন্জ করতে দিবেন না। ”

“এত সময় লাগে সামান্য চেন্জ করতে।তুমি তো ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করবে। আমি তো ভেবেছি আবার ঘুমিয়ে পড়েছো।”

আমি মনে মনে বললাম,
“হুম আমার জীবনে যতোদিন আপনি আছেন ততোদিন আবার শান্তিতে ঘুমাতে পারবো নাকি। ”

শান আমার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার আবার কোথায় হারিয়ে গেছো?”
আমি মন খারাপ করে বললাম,
“কোথাও না।এখানেই আছি। আমার ভাবনার মাঝেও আপনাকে হানা দিতে হয়। ”
শান বিরক্তির সাথে বললো,
“তোমাকে নিয়ে না আমি আর পারিনা। আচ্ছা তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নেও আমরা বেরোবো। ”
শানের কথায় আমি দ্রুত উনার দিকে ফিরে উনার সামনে গিয়ে বললাম,
“আবার কোথায় যাবো?”
“কেন বাসায় যাবেনা নাকি? ”
“আমি তো আমার বাসায় আছি।”
শান একটু মুচকি হেসে বললো,
“ম্যাডাম আমি তোমার স্বামীর বাড়ির কথা বলছি।আর এখন থেকে ওটাই তোমার আসল বাড়ি।”
আমি উনার কথা শুনে আশ্চর্য হলাম ,
“আসল আর নকল বুঝি না ?এই বাড়িতে আজকেই তো এলাম এরমধ্যেই চলে যাবো নাকি?”
“হুম যাবো। ”
“আমি যাবো না। আপনার যাওয়ার হলে আপনি যেতে পারেন। ”
শান রেগে বললো,
“যাবে না মানে। তুমিও যাবে না তোমার ঘাড় যাবে। এখানে তুমি সারাজীবন থাকতে চাচ্ছো নাকি। ”
আমি মিনতির সুরে বললাম,
“দেখুন সারাজীবন না হলেও কয়েকটা দিন তো আব্বু আম্মুর সাথে থাকতেই পারি। ”

আমার কথা শুনে উনিও নরম গলায় আমার মুখটা নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে বললো,
“আজকের মতো চলো আমার সাথে প্লিজ। এরপর তোমার যখন ইচ্ছা তখন আসবে এখানে ঠিক আছে। ”

আমিও বুঝে গেলাম শান যখন বলেছে তখন আমাকে না নিয়ে উনি যে এক পাও নড়বে না সেটা আমি খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছি। তাই চোখ ছোট ছোট করে বললাম,

“পাক্কা তখন বাঁধা দিবেন না তো।”
“পাক্কা। ”
“প্রমিজ করুন।”
শান হেসে বললো,
“জানো তো তোমার আর পুষ্পর মাঝে কোনো তফাৎ নেই। দুজনেই বাচ্চা।আমার তো মনে হয় পুষ্পর থেকে একটু বেশীই বাচ্চা স্বভাব তোমার মধ্যে আছে। ”
“আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কেন প্রমিজ করুন।”
“ওকে যাও প্রমিজ। এইবার রেডি হয়ে নেও আমরা বেরোবো। অনেক লেইট হয়ে গেছে। ”
তারপর আমি রেডি হয়ে গেলাম।আমরা দুজনেই নিচে নেমে এলাম। আমাদের দেখে আম্মু বললো,
“আর কিছুদিন থেকে গেলেই পারতি শান। এতো তাড়ার কি আছে? ”

শান আম্মুর কাছে গিয়ে সালাম করে বললো,
“মামনি তুমি তো জানো আজকেই ভাইয়া ভাবী চলে গেছে। এখন যদি আমরাও থেকে যাই তারা একা হয়ে পড়বে। আম্মু বারবার বলেছে যেন সোহাকে নিয়ে যাই তাই। তোমরা মন খারাপ করোনা আমরা আবার আসবো। ”

আম্মু মন খারাপ করে বললো,
“আচ্ছা সাবধানে যাস। ”

তারপর শান আব্বু কাছে গেল কথা বলতে এই ফাঁকে আমি আম্মুট কাছে গিয়ে বললাম,
“আম্মু প্লিজ ওনাকে বুঝাও না আমি অন্তত আজকের দিনটা থেকে যাই। আমাকে যেন রেখে যায়। ”

আম্মু আমার দিকপ তাকিয়ে বললেন,
“আমি তো বললাম তোর শ্বাশুড়ী নাকি বলেছে তোকে নিয়ে যেতো তো আর কি করা যাবে। বাদ বাকি তুই থাকতে চাইলে শানের সাথে কথা বলে নে। তোদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার তোরা ভালো বুঝবি। ”

আমার মনে যতোটুকু আশার আলো ছিলো সেটাও ধপ করে নিবে গেল। আরে রাক্ষসটাকে তো আমি কখন থেকেই বলছি আমার কথা শুনলে তো? আর কি করা যাবে। মন খারাপ করে আমি আর শান আব্বু আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা দুজনেই বেরিয়ে পড়লাম।



গাড়িতে আমি চুপচাপ মন খারাপ করে বসে আছি।শান রেডিওটা অন করে একটা গান ছাড়ল “এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো। “আমি একবার আড়চোখে উনার দিকে তাকালাম দেখে মনে হচ্ছে ভালোই মুডে আছে। বাট এতো খুশি হওয়ার কি আছে বুঝলাম না। ধ্যাত সোহা খুশি না হওয়ারই বা কি আছে উল্লুকটা নিজের কথা রেখে তোকে নিয়ে আসতে পেরেছে এর থেকে বড় আনন্দ আর কি আছে উনার কাছে। কথাটা মনে করেই আমি উনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাহিরে তাকালাম।

“মন খারাপ তোমার? ”

হঠাৎ শানের কথা শুনে ওনার দিকে একনজর দেখলাম তারপর আবার বাহিরের দিকে তাকালাম।কিন্তু কিছু বললাম না।

“কি হলো কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি। ”

শানের ধমক শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম।আমি রাগে ফুসতে লাগলাম। পরমুহূর্তেই আমিও দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে বললাম,

“দেখতেই তো পাচ্ছেন মন খারাপ আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে। ”

শান আমার কথা শুনে রাগি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।
“গলার স্বর যেন আর উঁচু না হয়। ”

কথাটা বলেই উনি আবার গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
“হুম আসছে গলার স্বর যেন উঁচু না হয়।ব্যাটা তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোকে দিয়ে কেউ কিছু করালে বুঝতি। ”

আমি ওনাকে ব্যঙ্গ করে মনে মনে কথাটা বলে রেডিওর গানটা শুনতে লাগলাম। কিন্তু কিছুক্ষন পর দেখলাম গাড়িটা আমাদের বাড়ির দিকে না গিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছে। আমি বিচলিত কন্ঠে বললাম,

“একি এটা কোথায় যাচ্ছেন? আমাদের বাসা তো এদিকে না। ”
শান কোনো কথা না বলে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। আমি একটু বিরক্ত হলাম তাই আমি আবার বললাম,
“বলছি কোথায় যাচ্ছি আমরা। কথা বলছেন না কেন? ”

এইবারও শান কোনো রেসপন্স করল না। কি ব্যাপার বোবা হয়ে গেল নাকি কানে কম শুনতে শুরু করল। আমি উনার কানের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বললাম,

“হ্যাঁলো মিষ্টার আরিয়ান আরেফিন শান আমরা কোথায় যাচ্ছি আপনি কি সেটা বলতে পারেন? ”

কথাটা বলতেই শান হুট করে গাড়ি থামিয়ে নিজের কানে হাত দিলো।আর আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে বললো,
“এভাবে চিৎকার করছো কেন? আমাকে কি তোমার বয়ড়া মনে হয়। ”

আমি উনার থেকে সরে এলাম তাও ভালো রেসপন্স করেছে আমি বিরবির করে বললাম,
“আপনার ব্যবহার দেখে একটু সময়ের জন্য আমার সেটাই মনে হয়েছিল। এজন্যই তো পরীক্ষা করে নিলাম। ”
তবে মুখে বললাম,
“কানে শুনলে এতক্ষন যাবত ডাকছি সাড়া দিচ্ছেন না কেন? ”
“কারণ আমি সাড়া দিতে প্রয়োজন মনে করছি না। ”
“আজব আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন সেটা আমি জানতে চাইবো না? ”
শান রেগে বললো,
“তোমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে নিয়ে গিয়ে মেরে দিবো তাই নিয়ে যাচ্ছি এইবার চুপচাপ বসে থাকো আর কোনো কথা নয়।বেশী কথা বললে এখানেই শুভ কাজটা সেড়ে ফেলবো মাইন্ড ইট। ”

উনার কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম
সত্যি সত্যি মেরে দিবে না তো। দিলে দিতেও পারে এতোদিনের শত্রুতা সেটার প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ কেন কেউ ছাড়বে। আমার এখন কান্না পাচ্ছে। আল্লাহ কেন যে তখন উনার সাথে বের হলাম। এখন আবার কি হবে?

ঠিক তখনই শান গাড়িতে ব্রেক কসল। আমি একবার বাহিরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আর দেখতেই আমি পুরা অবাক হয়ে গেলাম।একবার বাহিরে তাকাচ্ছি আবার একবার উনার দিকে। উনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে উঠলেন।

“হঠাৎ এখানে কেন?”
শান নিজের হাসি থামিয়ে বললো,
“কেন তোমার সমুদ্র ভালো লাগে না? ”
আমি চোখে মুখে খুশি নিয়ে বললাম,
“অনেক ভালো লাগে। ইনফেক্ট সমুদ্র তো আমার সব থেকে প্রিয় জায়গা। বাট ব কিছুক্ষন আগে আপনার কথা শুনে তো আমি মনে করেছি আপনি আমাকে সত্যি সত্যি মেরে দেবেন। ”

কথাটা বলেই এমন একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম যেন কোনো বড় বিপদ থেকে বেঁচেছি। আমার কথা শুনে শান অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

“মানে তুমি সত্যি সত্যি ভেবেছিলে আমি তোমাকে মেরে ফেলবো?”
আমি অপরাধীর মতো মুখ করে বললাম,
“হুুম।”
আমার কথা শুনে শান বিরক্তি নিয়ে বললো,
“এক কাজ করো তুমি না আমার মাথায় একটা বারি মেরে দেও তাহলে যদি তোমার মন থেকে আমার সম্পর্কে এই নেগেটিভ ধারণা গুলো কিছুটা হলেও দূর হয়। ”

আমি মাথা নিচু করে বললাম,
“স্যরি। ”
“হুম উদ্ধার করেছো এভার নামো। ”

শান বলতেই আমি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বাহিরে চলে আসলাম। প্রচুর মানুষ মানুষের জন্য ভালো করে উপর থেকে দাঁড়িয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে চারপাশ থেকে ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। সমুদ্রের বাতাসে আমার চুলগুলো খোলা থাকায় সব এলোমেলো হয়ে গেছে। কিছু চুল উড়ে এসে বারবার শানের মুখের উপর পড়ছে কিন্তু আমার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।

সোহার মুখে এতো খুশি দেখে শানের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। সোহার লম্বা ঘন কালো চুল গুলো যতবার শানকে স্পর্শ করছে শানের মনে তখনই অনুভুতিরা সাড়া জাগিয়ে যাচ্ছে। সোহার এলোমেলো চুলের মাঝেই যেন হারিয়ে যাচ্ছে বারবার। সোহার শরীরের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হচ্ছে।

“আচ্ছা চলুন না নিচে নামি। ”
আমার কথা শুনে শান থতমত খেয়ে বললো,
“হ্যাঁ। না না কোনো দরকার নেই এখান থেকেই উপভোগ করো। ”
“প্লিজ চলুন না। সমুদ্রের মজা সমুদ্রের কাছে না গিয়ে এতো দূর থেকে কখনো নেওয়া যায় নাকি। ”
শান চোখ পাকিয়ে বললো,
“বললাম না একবার না।”
শানের না শুনে আমি ঠোঁট উল্টালাম।
“দেখুন এখন যদি আপনি আমাকে না যেতে দেন তাহলে কিন্তু আমি হাত পা ছড়িয়ে এখানে কাঁদতে বসব। ”

শান আর না পেরে আমাকে নিয়ে নিচে নেমে গেল। এখন ভাটা পড়েছে। জোয়ার থাকলে পাথরের উপর পর্যন্ত পানি উঠে। আর সবাই উপর থেকে দেখে। পাথর গুলো পিছলা অনেক তারপরেও অনেক কষ্ট করে নামলাম। শান ও অনেক হেল্প করেছে। ওনার হাত ধরেই নেমেছি।

সূর্য প্রায় অস্ত যাবে লাল বর্ণ ধারণ করবে আর সমুদ্রের নিচে হারিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে সমুদ্রের ঢেউ এসে লাগছে আমার পায়ে। তাই আমি জুতাটা খুলে ফেললাম।
আমি জুতা খুলতেই শান চিৎকার করে বললো,

“কি হলো জুতা খুললে কেন? ”
“সমুদ্রের পানি পায়ে না লাগলে কোনো মজা আছে। আপনিও খুলুন ভালো লাগবে।”
“না থাক আমার লাগবে না। ”
“প্লিজ খুলনই না আমার সাথে না হয় দুই পা এভাবেই হাটুন। কি হাটবেন তো?”

আমার কথাটা শুনেই শান নিজের শু জুতাটা খুলে দিলো। আর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

“শুধু দুই পা না সারাজীবন এভাবেই তোমার পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতেও আমার কোনো আপত্তি নেই । ”
.
.
চলবে

বিঃদ্রঃ রিচেক দেওয়া হয়নি। বানান ভুল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে