#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৩০
#সুরাইয়া_নাজিফা
“কিরে সোহা সবাই ভিতরে চলে গেলো তুই ওই গাড়ির পিছনে কি করছিলিস?”
“কিছু না শাড়ীটা মনে হচ্ছিল খুলে যাচ্ছে সেটা ঠিক করছিলাম। ”
তখনই শানও বেরিয়ে এগিয়ে আসছিলো আমাদের দিকে। হঠাৎ আপু মুচকি মুচকি হাসছিলো আর বললো,
“এভাবে হুটহাট শাড়ী খুলে গেলে হবে নিজের বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত ওয়েট কর। ”
আপুর কথা শুনে আমি আশ্চর্য হলাম
“মানে? ”
আপু কোনো কথা না বলে শুধু মিটিমিটি হাসছিলো তখনই শান আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। শানকে দেখে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আপু আবার শানের সাথে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবছে না তো। ভাবতেই লজ্জায় পড়ে গেলাম।
শানকে উদ্দশ্যে করে আপু বললো,
“ভালো আছেন ভাইয়া? ”
“হুম ভালো। ”
কথাটা বলার সময় শান একবার রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো তারপর আবার আপু দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি?”
“হুম আমিও ভালো। আসুন ভিতরে আপনি। ”
তখনি আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
“শুধু ওনাকে বলছিস কেন আমাকে বললি না? ”
“তুই কি এই বাড়ির মেহমান নাকি যে তোকে বলতে হবে আসলে আয় নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাক। ”
বলেই শান আর আপু ভিতরে চলে গেল। আর আমি ওখানেই মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এতো অপমান প্রাণে সয়। কেউ আমার মূল্য বুঝেনা কেন? না বাবার বাড়ির কেউ বুঝে না জামাই বুঝে। যেদিন আমি থাকব না ঐদিন বুঝবে সবাই। নিজের মনে বকবক করতে করতে বাড়ির ভিতরে ধপধপ করে পা ফেলে চলে গেলাম।
★
★
আমি, আপু, আরশ ভাইয়া তিনজনে একপাশে বসে আছি। মা রান্নাঘরে সবার জন্য নাস্তা তৈরী করছে।যদিও আপু অনেকবার উঠে যেতে চাইছিলো কিন্তু আরশ ভাইয়া বারণ করছে যেতে। আমি এদের এসব দেখে মুচকি মুচকি হাসছিলাম। শানসহ বাকিরা অন্যপাশে বসে বসে কথা বলছে।বাড়ির ভিতরে ঢোকার পর শান অনেকবার ইশারা করেছিল উনার পাশে বসার জন্য কিন্তু আমি ইচ্ছা কৃতই উনার পাশে না বসে আরশ ভাইয়ার পাশে বসেছি। সবার কথা বার্তায় মহল বেশ জমে উঠেছে। যদিও মাঝখানে আমি চুপ।উনি সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে বাট কথা বলতে বলতে যে কয়বার আমার চোখের উপর চোখ পড়েছে সেখানে হাসি মিলিয়ে চোখে মুখে রাগ ফুটে উঠেছে। সাথে আমার হাসিটাও মিলিয়ে যাচ্ছে উনার রাগ দেখে। উফ আমার কপালে যে আজ কি আছে আল্লাহ জানে। এতোটা রাগানো হয়তো উচিত হয়নি। এখানে আর বসে থাকতে পারবো না ভয় লাগছে উনার চাহনী দেখে তাই আমি উঠে দাঁড়ালাম।
তখনই আরশ ভাইয়া বলে উঠল,
“কি হলো ভাবীজান কোথায় যাচ্ছো।”
আরশ ভাইয়ার কথা শুনে আপু একটু অবাক হলো। কারণ আপু কখনো ভাইয়াকে ভাবী ডাকতে শুনেনি আমাকে তাই একটু অবাক হবেই স্বাভাবিক। এই আরশ ভাইটাও না যেই কাজটা উনাকে করতে বারণ করব সেটাই উনি আরো বেশী করে করবে। দুপুরে বলেছিলাম না ভাবী না বলতে তাই এখন আরো বেশী করে বলছে যাতে আমি বিরক্ত হই।দুই ভাই একদম এক। আমার পিছনে লাগা ছাড়া এদের আর কাজ নেই।
আমি আরশ ভাইয়ার পাশে বসে বললাম,
“একদম মুখ বন্ধ রাখো নাহলে কিছুক্ষন আগের কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলে তবে বুঝবে মজা করার ফল। ”
আমার এমন শান্ত থ্রেট শুনে আরশ ভাইয়ার মুখ চুপসে গেল।আরশ পড়েছে মহাবিপাকে। কিছুক্ষন আগে বর্না নামে একটা মেয়ের সাথে আরশ কথা বলছিলো। আসলে কথা তো না ফ্লার্ট করছিলো ফোনে রং নম্বর ছিলো তাই ফাজলামি করছিলো।আর ওরই বা কি দোষ ছিল মেয়েটাও তো ওর সাথে তালে তাল মিলাচ্ছিলো।ব্যাস এটাই কিভাবে যে সোহা শুনে নিয়েছে সেই থেকে এভাবেই ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে।
আরশ ভাইয়ার চুপসানো মুখ দেখে আমি শয়তানি একটা হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আপু আমার কানে ফিসফিস করে বললো,
“ব্যাপার কি তোদের বলতো?”
“সেটা তোর বরকেই জিজ্ঞেস কর। ”
বলেই আমি দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম।
রান্নাঘরে মা কাজ করতে ব্যাস্ত তখনই আমি পিছন থেকে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা হেসে বললো,
“এইখানে এলি কেন আবার ওখানেই তো বসতে পারতিস। ”
আমি মাকে ছেড়ে একপাশে দাঁড়িয়ে বললাম,
“না ওখানে ভালো লাগছিল না তোমাকে ছাড়া। কি এতো কাজ করছো বলোতো সবাই ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। ”
মা হেসে বললো,
“এখন তো একটা সংসার সামলাস এখন বুঝিস না একটা সংসারে কতো কাজ থাকে। বাড়ির সবাই আড্ডা দিলেও আমাদের এতো সময় কোথায়। ”
মায়ের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। আসলেই মেয়ে মানুষের জীবনটাই কেমন অদ্ভুত। যে মেয়েটা একসময় নিজের জিনিস গুলোকেই সামলাতে পারতো না তাকে একসময় ঠিকই পুরো একটা সংসার সামলাতে হয়। সবচেয়ে অগোছালো মেয়েটাও একদিন গুছালো হয়। সবসময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মেয়েটাও একদিন নিজের কথা বাদ দিয়ে নিজের সর্বস্ব দিয়ে পরিবারকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা গুলোর উপরেও একদিন অন্যের রাজত্ব মানতে বাধ্য হয় ভালোবেসে। আসলেই মেয়ের অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।যদিও আমার উপরে এতো চাপ আসে না তবে কথা গুলো তো সত্যি। অনেকটা পরিবর্তন তো হয়েছি আগের থেকে সেটা তো বুঝতে পারি।
আমি টেবিলের কাছে গিয়ে জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে মুখে দিলাম হঠাৎ মা বলে উঠল,
“শানের সাথে কি এখনো আগের মতোই ঝগড়া করিস নাকি উন্নতি হয়েছে সম্পর্কে কিছুটা?”
মায়ের কথা শুনে আমার মুখ ফসকে সব পানি গুলো বেরিয়ে গেল। কি বলবো এখন কিছুক্ষন আগেও তো ঝগড়া করে আসলাম। উনার সাথে ঝগড়া তো আমার মনে হয় না এই জন্মে শেষ হবে। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“না ঐ আরকি ঝগড়া করব কেন?এখন তো আমরা দুজনেই খুব ভালো আছি। ”
“ঠিক তো? ”
আমি মাথা জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে বললাম,
“একদম ঠিক। ”
“ঠিক হলেই ভালো বুঝলি তো মেয়েদের স্বামী ভালো না হলে জীবনে কখনো সুখ হয়না। ”
আমি হুট করে বলে উঠলাম,
“সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি অনেক ভাগ্যবতী। শানের মতো মানুষই হয় না। ”
কথাটা বলতেই আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। কার সামনে কি বলে দিলাম। আমার কথা শুনে মা মাথা নিচু করে হাসলেন। হয়তো আমার লজ্জার কারণটা বুঝতে পেরেছে। মা হাফ ছেড়ে বললেন,
“যাক এতোদিনে তোর মুখ থেকে শানের নামে সুনাম তো শুনলাম এতেই খুশি আমি। এখন মনে হচ্ছে সত্যিই ভালো আছিস। আমি জানতাম শান তোকে অনেক ভালো রাখবে। এখন তোর জন্য সব চিন্তা দূর হলো আমার। এখন সব চিন্তা স্মৃতিটার জন্য কি যে হবে মেয়েটার। আর কি কোনো ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে পারবো।”
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি হয়েছে কেউ কিছু বলেছে?”
“কে কি আর বলবে। স্মৃতি যেদিন থেকে পালিয়েছে সেদিন থেকেই তো সবার কথাই শুনতে হচ্ছে এখন সবাইকে বুঝাবো কি করে। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা। ”
আমি মাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম,
“কিছু হবে না মা সমস্যা যখন শুরু হয়েছে তার সমাধানও খুব দ্রুতই হবে ইনশাআল্লাহ। শুদু একটু ধৈর্য ধরো। সবার মুখই বন্ধ হয়ে যাবে। ”
“হুম সেটাই যেনো হয়। ”
মা নাস্তা গুলো ট্রে তে সাজিয়ে দিলেন। তারপর আমি আর মা আস্তে আস্তে সবকিছু এনে উনাদের সামনে পরিবেশন করে দিলাম ।
মা আমাকে বললো,
“সোহা সবাইকে একটু সার্ভ করে দে আমি বাকি কাজগুলো সেরে আসছি। ”
মা চলে গেল।শানের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম সে আমার দিকেই চেয়ে আছে। আমি দ্রুত অন্যদিকে তাকালাম। আমি আপুকে বললাম,
“আপু একটু সার্ভ করে দে তো।”
তখনই আরশ ভাইয়া ফট করে বলে উঠলো,
“কেন তোমার শ্বশুরবাড়ীর লোক সবাই তুমিই না সার্ভ করবে অন্যকে বলছো কেন? ”
আমি আরশ ভাইয়ার দিকে কটমট চোখে তাকালাম আর মনে মনে অকথ্য বাসায় গালি দিলাম কিছু। যখন থেকে বুঝতে পেরেছে শানের থেকে পালানোর চেষ্টা করছি একটা ঝামেলা হয়েছে উনার সাথে তখন থেকে এমনই করছে।ইচ্ছাকৃত বাঘের সামনে ঠেলে দিচ্ছে। এটা নাকি আমার জিজু বদের হাড্ডি। আমি আস্তে আস্তে সবার দিকে সরবতের গ্লাস এগিয়ে দিলাম। যখনই শানকে দিবো তখনই আমার হাত অটোমেটিক কাঁপতে লাগলো।
শান ভ্রু কুচকে বলে উঠল,
“কি ব্যাপার হাত কাঁপছে কেন?এখন তো এটা আমার গায়ে ফেলবে তুমি। ”
আরশ ভাইয়া পেছন থেকে টোন কেঁটে হেসে বললো,
“তাই তো কি হয়ছে ভাবীজান আমরা কি তোমাকে এই প্রথম দেখতে এসেছি নাকি যে তুমি এমন ভাবে ভয় পাচ্ছো। ”
আমি নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলাম।মাথানিচু করে রইলাম।
শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“কি বলিস এসব আরশ সেই তখন থেকে মেয়েটার পিছু লেগে আছিস তুই। ”
“ওহ মা ভাবীর পিছনে দেবর লাগবে না তো কে লাগবে বলো। ”
এদের এসব কথাবার্তার মাঝে শান আমার হাত থেকে সরবতটা নিয়ে নিলো আর কানে ফিসফিস করে বললে,
“তখন আমার দেওয়া শাড়ীটা পড়োনি না এইবার দেখো আমি কি করি। ”
উনার এমন শীতল কথা শুনে ভয় পেলাম। গলায় কিছুটা খুশখুশ করছিলো।আমি টেবিল থেকে দ্রুত একগ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। শান আবার কি করবে কে জানে? আমি গিয়ে আবার আরশ ভাইয়ার পাশে বসে পড়লাম।মাও কিছুক্ষন আগে এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে বাট শান এখনও সরবত ধরে বসে আছে।তাতে আমার কি আমি আমারটা খাচ্ছি। হঠাৎ শান বললো,
“কি ব্যাপার সোহা তোমার হাতে কি হয়েছে? ”
কথাটা বলেই উনি আমার কাছে চলে আসলো। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
“কই কি হয়েছে। ”
শান হাতের দিকে ইশারা করে বললো,
“এই যে হাত থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। ”
আমি হেসে বললাম,
“কই রক্ত না তো টমেটো সস লেগেছে। ”
আমার কথা শুনে আরশ ভাইয়াও হেসে বললো,
“ভাইয়া আজকাল বউকে একটু বেশীই চোখে হারাচ্ছিস মনে হচ্ছে? ”
আরশ ভাইয়ার কথায় সবাই মিটিমিটি হাসছিলো। লজ্জায় কান গরম হয়ে যাচ্ছে আমার শান বিরক্ত হয়েই বললো,
“আরশ কি হচ্ছে এসব বড়রা আছে এখানে? ”
শ্বশুর মশাই হেসে বললো,
“তাতে কি আমরা এখনো বুড়ো হয়ে যায়নি বুঝেছো। ”
শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেসে বললো,
“বাবা তুমিও না। ”
কথাটা বলে আমার পাশ থেকে উঠে যেতে নিবে হুট করে সেন্টার টেবিলের সাথে পা ভেজে উনার হাতে থাকা সরবতের গ্লাসটা উল্টে এসে পড়ল আমার শাড়ীর উপর। আমি পুরা হা হয়ে গেলাম।
“এটা কি করলেন আপনি?”
“আই আ’ম এক্সট্রেমলি স্যরি এক্সচুয়েলি আই কুডন্ট কিপ দ্যা ব্যালেন্স। ”
আমি কটমট চোখে উনার দিকে তাকালাম। আমি বুঝতে পারছিনা উনি যখন সামনের দিকে ছিলেন তখন বাবার গায়ে পড়ার কথা ছিলো উল্টে এসে আমার গায়ে পড়ল কি করে।আমি উনার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
“পা ভাঙা নাকি যে ব্যালেন্স রাখতে পারেন না? ”
আমার কথায় শান শীতল দৃষ্টিতে তাকালো তখনই আমার বাবা বলে উঠলো,
“এটা কেমন ব্যবহার সোহা?শান স্যরি বলছে তো তারপরও এভাবে কথা বলছো কেন?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
“স্যরি বাবা। ”
শ্বাশুড়ী মা বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে যা হয়েছে হয়েছে এইবার গিয়ে চেন্জ করে নে।”
আমি আর কিছু না বলে উপরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা শানের ইচ্ছাকৃত কাজ। কি মনে করে পিছনে তাকালাম তাকাতেই খেয়াল করলাম শান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।আমি রাগি চোখে উনার দিকে তাকালাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ মারল। আমি অবাক হয়ে গেলাম উনার কর্মকান্ডে এতক্ষনে আমি একদম শিউর হয়ে গেছি যে উনি এটা ইচ্ছা করেই করেছে। উনার পছন্দের শাড়ী পড়িনি বলে কি খারাপ। আমি মনে মনে অসংখ্য গালি দিতে লাগলাম শানকে।
রুমে গিয়ে আমার কাবার্ড খুলে একটা নীল রঙের থ্রী-পিছ বের করে নিলাম পড়ব বলে তখনই আপু কোথায় থেকে দৌড়ে এসে বললো,
“সোহা এটা পড়ে নে? ”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“এটা কি?”
“শাড়ী।”
“তুই কোথায় পেলি।”
আপু আমতা আমতা করে বললো,
“আমার শাড়ী নতুন পড়িনি একবারও। উফ এতো প্রশ্ন করিস কেন পড়তে বলেছি পড়লে পর না পরলে নাই। ”
আমি আপুর হাত থেকে শাড়ীটা নিয়ে নিলাম। শাড়ীটা দেখতে অনেক সুন্দর একদম শানের জামার সাথে ম্যাচিং করা কালোর মধ্যে লাল পাড়ের পুরো কাজ করা শাড়ী। আমার পরনের শাড়ী থেকে সরবত সরবত ঘ্রাণ আসছে এটা এখনি চেন্জ করা প্রয়োজন। তাই দ্রুত চলে গেলাম ফ্রেস হতে।
শাড়ীটা পড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম দেখার জন্য যে আমাকে কেমন লাগছে। তখনই পিছন থেকে কেউ বলে উঠল,
“মাশাআল্লাহ একদম পুতুলের মতো লাগছে। শাড়ীটায় এতো মানাবে বুঝিনি। ”
কথাটা শুনে আমি ভয় পেয়ে পিছনে তাকালাম।পিছনে ফিরতেই দেখলাম শান দরজার সাথে হেলান দিয়ে দুই হাত বুকে ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে তাকাতে দেখে আস্তে করে দরজা বন্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো।উনাকে দরজা বন্ধ করতে দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম,
“আপনি এখানে কি করছেন? ”
“এই তো আমার বউকে দেখতে এসেছি।”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
“বাড়িতে সবাই আছে কে কি ভাববে প্লিজ দরজা খুলুন। ”
“এতো ভয় পাচ্ছো কেন আমি কি পর-পুরুষ। যে ইচ্ছা সে আসুক না সমস্যা কি? ”
এরপর আসলে কি বলতে হতো আমি জানি না তাই চুপ করে ছিলাম শান এসে আমার হাত ধরে আমাকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসালো।উনি আমার কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো,
“আজকে তোমাকে আমি আমার পছন্দে সাজাবো। ”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“তাহলে আপনার রাগ পড়ে গেছে? ”
আমার কথা শুনে শান শব্দ করে হাসল
“ভেবেছিলাম তোমার উপর রাগ দেখাবো বাট আমি হেল্পলেস পারলাম না রাগ করে থাকতে । তোমাকে দেখলেই আমার রাগ গুলো কোথায় হাওয়া হয়ে যায় জানি না। ”
আমি উনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। আচ্ছা ভালোই যখন বাসেন তাহলপ স্বীকার করেন না কেন। মন খুলে বলেননা ভালোবাসি?আমার চোখ ছলছল করে উঠল উনি আমায় চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে?”
আমি মাথা নেড়ে কিছু না বললাম উনি হেসে বললেন,
“তাহলে শুরু করি?”
আমি ভীত চাহনীতে তাকিয়ে বললাম,
“কি?”
“সাজানো? ”
আমি আনমনে বললাম,
“ওহ। ”
উনি আমার ঘাড়ে হালকা ঠোঁট ছুয়ে বললো,
“তুমি কি অন্যকিছু ভেবেছিলে? ”
আমি মাথা নিচু করেই বললাম,
“কি ভাববো?”
“এই যে আমি তোমাকে….। ”
উনার বলার ভাব ভঙ্গি শুনে আমি দ্রুত উনার দিকে তাকিয়ে উনার মুখ চেপে ধরলাম,
“প্লিজ যা বলছেন বলবেন না আমি তেমন কিছুই ভাবিনি। ”
আমার কথায় উনি আবারও হেসে উঠলো যেন খুব মজা পেয়েছে।
“সত্যি তুমি না একদম পাগলী একটা মেয়ে সব জিনিসে এতটা হাইপার হয়ে যাও কেন। এইবার দেখি তো আমাকে সাজাতে দেও।”
আমি চোখ পিটপিট করে বললাম,
“আপনি সাজাতেও পারেন?”
উনি হাতের আঙুল দিয়ে দেখালেন,
“একটু একটু।এইবার সাজাতে দেও। ”
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,
“প্লিজ আমার পেত্নী সাজার কোনো ইচ্ছা নাই আমি এমনিতেই ভালো আছি।”
উনি ধমক দিয়ে বললেন,
“একদম এক্সট্রা কথা বলবে না এখনি এখানে চুপচাপ বসো আর চোখ বন্ধ করো নাহলে এরপর যদি আমি কিছু করি তাহলে আমাকে দোষ দিও না। ”
উনার কথা শুনে আমি একদম চুপ হয়ে গেলাম। আর চোখ বন্ধ করলাম। কোনো উপায় নেই। চোখ খুলে নিজেই না নিজেকে দেখে ভয় পেয়ে যাই সেটা ভেবেই ভয় লাগছে।
শান সাজানো শুরু করল। একদম নিজের পছন্দের রাজকন্যার মতো সাজাচ্ছে সোহাকে নিজের ভালোবাসার সবটুকু অনুভুতি দিয়ে। সাজানোর পর কিছুক্ষন নিজেই চুপচাপ দেখতে লাগলো নিজের পরীকে ইচ্ছা করছিলো একবার ঠোঁট ছুয়ে দেবে ঐ লাল টুকটুকে ঠোঁটে কিন্তু না নিজেকে সামলিয়ে নিলো।কারণ এখনও ওর পরী ওকে অনুমতি দেয়নি। আর কারো অনুমতি ছাড়া কাউকে স্পর্শ করাটা উচিত নয় সেটা যতোই অধিকার থাকুক না কেন।
“এইবার চোখ খোলো। ”
শানের কথা শুনে আমি চোখ খুলে উনার দিকে তাকালাম। শান আমার দিকে তাকিয়ে আছে একগালে হাত দিয়ে। উনার তাকানো দেখে আমি নিজের চোখ সরিয়ে নিলাম। শান বললো,
“এইবার আয়নায় তো একবার নিজেকে দেখো। ”
“দেখব বলছেন? ”
শান মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
“না থাক লাগবে না। ”
শান ধমক দিয়ে বললো,
“বললাম না দেখতে দেখো নিজেকে। একটা কথা ভালো ভাবে বললে শোনা যায় না।”
উনার ধমক শুনে আমি মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে আস্তে আস্তে আয়নার দিকে ঘুরে তাকালাম।
তাকাতেই আমি ড্যাবডেবে নজরে আয়নার দিকেই তাকিয়ে থাকলাম। কোনো ছেলে মানুষ এতো সুন্দর করে সাজাতে জানে বুঝতে পারিনি। চোখে গাড়ো করে কাজল, মুখে হালকা মেকাপ, চুল গুলো ছাড়া দিয়ে এলটা বেলী ফুলের মালা লাগানো,ঠোটে টকটকে লাল লিপস্টিক, দুই হাত ভর্তি লাল কালো রঙের চুড়ি আর হালকা জুয়েলারি।
“তো এইবার কি পেত্নীর মতোই লাগছে যে এভাবে দেখছো নিজেকে নিজে?”
শানের কথা শুনে আমি ঘোর থেকে বেরিয়ে আসলাম,
“এতো সুন্দর সাজানো কোথায় শিখলেন? ”
“শিখতে হবে কেন? আমি কি প্রফেশনাল মেকাপম্যান নাকি?”
“তাহলে এতো সুন্দর করে সাজালেন কিভাবে আপনি?”
“নিজের স্বপ্নপরীকে সাজানোর জন্য সাজাতে জানতে হয়না এমনিতেই মনের মাধুরী মিশিয়ে আকিবুকি করলেও সেটা সুন্দর হয়ে যায়। নিজের বউকে নিজের মনের মতো সাজাতে পারি এতোটুকুই জানি আর আমার মনে হয় সব পুরুষেরই জানা উচিত।তাড়াতাড়ি নিচে এসো। ”
কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন আর আমি উনার যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ভালেবাসার কত রং হয় তাই না। কতোভাবে প্রকাশ করা যায় কেউ বলে প্রকাশ করে আর কেউ অনুভুতিতে। আসলে অনুভুতির মাধ্যমটা সর্বোউৎকৃষ্ট। মুখে তো সবাই সবকিছু প্রকাশ করতে পারে কিন্তু অনুভুতির মাধ্যমে কয়জন পারে অন্যের মনের অনুভুতিকে ছুয়ে নিজের কাছে আনতে। ”
.
.
চলবে
#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৩১
#সুরাইয়া_নাজিফা
শান্ত বিকালে সূর্যের লালচে আলোয় ছাদের এককোণে কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে দুটো মানব মানবী।সূর্য অস্ত যাবে যাবে এমন অবস্থা। চারদিকে ফুরফুরে হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে মেয়েটার চুল। ছেলেটা সেই দিকে অপলক চেয়ে রইল। আর মেয়েটা ছেলেটার কাঁধ থেকে হালকা মাথাটা উঁচিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। কারো চোখেরই পলক পড়ছে না যেন কত বছরের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে।চুলগুলো উড়ে এসে বারবার মেয়েটার মুখে পড়ছে বিধায় ছেলেটা আলতো হাতে মেয়েটার চুল গুলো কানের পাশে গুজে দিল।
ঐশী মুচকি হেসে বললো,
“কি দেখছো অমন করে? ”
তিমির খানিকটা হেসে বললো,
“তোমাকে? ”
“কেন আগে দেখোনি নাকি কখনো?”
“দেখেছি তো তবে আগে তো কখনো এতো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি তাই এখন দেখছি মনভরে। ”
ঐশী তিমিরের কাঁধ থেকে মাথা তুলে বললে,
“ভালোবাসো?”
“কি মনে হয়?”
“মনে তো অনেক কিছুই হয় তবে আমি শিউর হতে চাই তাই তো জিজ্ঞেস করলাম। ”
“প্রতিটা মূহূর্ত তোমাকে অনুভব করি, তোমাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা, তোমার হাসি মুখ দেখলে ভালো থাকি, কষ্টে থাকলে নিজে দ্বিগুন কষ্ট পাই এসব যদি ভালোবাসা হয় তাহলে ভালোবাসি। ”
ঐশী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তিমিরের দিকে কি অমায়িক ব্যবহার মানুষটার।এতটা ভালো মানুষ এতো ভালোবাসা কি ডিজার্ভ করত ও বুঝতে পারছে না। হয়তো জীবনে কোনো এক পূন্যের জোরে তিমিরের মতো এমন একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। ঐশীর চোখ ছলছল করে উঠল,
“এই পাগলি এতো চুপ হয়ে গেলে কেন হঠাৎ? ”
“কেন ভালোবাসো এতোটা? ”
হঠাৎ ঐশীর প্রশ্ন শুনে অবাক হলো তিমির পরক্ষনেই হাসি মুখে জবাব দিলো,
“তুৃমি মানুষটাই এমন যাকে ভালো না বেসে থাকাই যায় না তাই ভালোবাসি।
ঐশী অন্যদিকে চেয়ে বললো,
“আচ্ছা আমি তোমার ভালোবাসা ডিজার্ভ করি না তিমির বলো?”
তিমির রাগান্বিত হয়ে বললো,
“এইবার কিন্তু বেশী বেশী হচ্ছে ঐশী। এসব কথা বললে কিন্তু এখন আমি এখান থেকে উঠে চলে যাবো। ”
ঐশী আতকে উঠে বললো,
“এতো রাগ করছো কেন আমার মনে শুধু কিছু প্রশ্ন ছিল তারই উত্তর খুজছি। ”
তিমির ঐশীর পাশে বসে ঐশীর মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
“আমার ভালোবাসা তুমি ছাড়া অন্যকেউ ডিজার্ভ করে না তাই আমি তোমাকে ভালোবাসি। কেন নিজেকে ছোট ভাবছ? ”
ঐশী কিছুক্ষন চুপ করে রইল তারপর আবার বললো,
“তুমি জিজ্ঞেস করবে না আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা? ”
তিমির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“না। ”
ঐশী সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
“কেন?”
“কারণ আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো।যে মানুষটা সারাজীবন নিজেই ভালোবাসা হীনতায় ভুগেছে সে যখন সত্যিকারে ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছে তখন কি কখনো তার ভালোবাসার মায়াজাল ছেড়ে যেতে পারে। এতটুকু তো বিশ্বাস থাকাটা প্রয়োজন দুজন দুজনার মধ্যে। তাই আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তোমার আছে হয়তো আমি তোমাকে এতটা ভরষা এখনো দিতে পারিনি যার ফলে তোমার মনে এই প্রশ্ন গুলো জাগছে। ”
ঐশী ছলছল চোখে বললো,
“এভাবে বলো না তিমির বিশ্বাস করি তো নিজের থেকেও বেশী বিশ্বাস করি তোমাকে।আমার জীবনে এখন যদি কোনো ভরষার, ভালোবাসার জায়গা থাকে সেটা শুধুই তুমি। এটা আমার সন্দেহ না নিজের সাথে নিজের একটা যুদ্ধ যেটা লড়তে লড়তে আমি আজ ক্লান্ত হয়ে গেছি। তুমি তো জানো আমি কতটা একা তাই পাশে কাউকে পেলে ভয় হয় হারাবার। ”
তিমির ঐশীর কপালে একটা চুমু দিয়ে ঐশীর চোখের পানি মুছে দিলো। তারপর ঐশীকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো,
“এখন আর তুমি একা নও আমিও আছি তোমার সাথে বুঝেছো জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে পাশে পাবে কথা দিচ্ছি। ”
ঐশীও তিমিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কখনো না ছাড়ার প্রতিজ্ঞায়।কিছুক্ষন দুজনে ওভাবেই রইল। তারপর ঐশী তিমিরের বুকের উপর থেকে মাথা তুলে কিছুটা ইতস্তত করে বললো,
“তিমির তোমাকে একটা কথা বলার আছে। ”
“বলো না কি বলতে চাও? ”
ঐশী একটু ভীত কন্ঠে বললো,
“ভুল বুঝবে না তো?”
তিমির ঐশীকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
“কখনো না।বলো? ”
ঐশী কিছুক্ষন চুপ করে রইল। বুকের ভিতর ডিপডিপ করছে। যদি কথাটা শুনার পর তিমির ওর পাশে না থাকে যদি ছেড়ে দেয়। তাহলে ও তো বাঁচতে পারবে না। কিন্তু ঐ কথাটা তো লুকাতেও পারবে না তাহলে তিমিরকেই ঠকানো হবে। মনের ভিতর যে বোঝাটা আছে সেটাও যাবে না। আর না জীবনে কখনো শান্তি থাকবে। তাই বলাটাই শ্রেয় মনে করল ঐশী।
তিমির ঐশীকে ইশারায় বললো,
“বলো?”
ঐশী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বললো,
“আমি শানকে ভালোবাসতাম। শানকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখতাম। কি করবো একাকিত্ব জীবনে না ছিল বাবা মা বা আত্মীয়-স্বজনদের ছায়া না ছিল বন্ধু বান্ধব। যার কারণে শানকে পেয়ে ওকেই আকড়ে ধরেছিলাম। শান আমার একা জীবনে প্রথম বন্ধু ছিল। কিন্তু এটা আমার ভুল ছিল যে শানের বন্ধুত্বের হাতকে আমি ভালোবাসার হাত ভেবেছিলাম। ”
কথা গুলো বলার সময় ঐশীর গলা ধরে আসছিলো। ঐশী কথা গুলো চোখ বন্ধ করেই বলছে ওর চোখ থেকে জরজর করে পানি পড়ছে পারবে না তিমিরের চোখে চোখ রেখে এসব বলতে। ঐশী কিছুক্ষন থেমে আবার বলা শুরু করল,
“কিন্তু শান আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে ও শুধুই আমার বন্ধু ছিল ভালোবাসার মানুষ নয়। যদিও শান চাইলেই আমার ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে আমাকে ইউজ করতে পারত তবে সে সেটা না করে আমাকে সত্যির মুখোমুখি হতে সাহায্য করেছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে শানের প্রতি ভিতর থেকে সম্মান বোধ জাগ্রত হয়। কিন্ত যাই হোক না কেন বলে না মানুষ প্রথম ভালোবাসা কখনো ভুলে না হয়তো শান আমাকে ভালোবাসেনি কিন্তু আমি তো শানকে ভালোবেসেছি তাই ভুলতে পারিনি তবে….।”
ঐশীর কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে তিমির বললো,
“তবে তুমি এখন আমাকে ভালোবাসো সেটা তোমার বলার প্রয়োজন নেই আমি বুঝি। তোমার ডিপ্রশনের কারণ শানের থেকে পাওয়া রিজেকশন ছিল সেটাও আমি জানি। তুমি শানকে কতটা ভালোবাসতে সেটা তোমার ডায়েরীর প্রতিটা পাতা বলে আমাকে। তবে সেটা তোমার অতিত ছিল। আর আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে তোমার অতীতকেও ভালোবাসি। তাতে কোনো সাফাইয়ের প্রয়োজন নেই। আর যদি তোমার কথা ধরি তাহলেও এখনি তুমি নিজেই শিকার করেছো তুমি শানকে ভালোবাসতে তারমানে এখন তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি কখনো তোমায় বলব না যে তুমি শানকে পুরোপুরি ভুলে যাও। বরং আমি তোমাকে এতটা ভালোবাসবো যে কংনো তোমার অতিত তোমার মনেই পড়বে না। আমার শর্ত শুধুই একটা জীবনে যতদিন বাঁচবে শুধু আমাকেই ভালোবাসবে। আমিই থাকবো তোমার সাথে আর কিছু না। ”
ঐশী এখনো চোখ বন্ধ করে ছিল। তিমিরের বলা প্রতিটা কথায় কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এতে ওর অপরাধবোধ আরো বাড়ছে।মানুষটা কতটা সহজে বুঝে গেল ওর কথা গুলো।এতটা তো ঐশীও গুছিয়ে বলতে পারত না। এতটা বুঝতে আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি ঐশীকে। তিমির ঐশীর মুখটা নিজের দুইহাতের মধ্যে নিয়ে ঐশীকে স্লো ভয়েসে বললো,
“চোখ খোলো?তাকাও ঐশী আমার দিকে। ”
তিমিরের কথা শুনে ঐশী ধীরে ধীরে নিজের চোখ খুলে তিমিরের চোখের দিকে তাকালো তিমির মিষ্টি করে হেসে বললো,
“এভার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো আমার চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছো?”
ঐশী মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। ”
“ব্যাস তাহলে এসব কথা গুলো আর কখনোই তুলবে না আর না নিজেকে ছোট ভাববে। আমি সব পরিস্থিতিতে তোমার পাশে থেকে তোমায় আগলে রাখব। সবসময় তোমার পাশেই থাকব। ”
তখনই ঐশী হুট করে বলে উঠলো,
“বিয়ে করবে তিমির। ”
তিমির হেসে বললো
“ধুর পাগলি বিয়ে করবো বলেই তো ভালোবাসি। ”
“তাহলে আমাকে বিয়ে করে নেও আজই এখনি পারবে?”
তিমির একটু আশ্চর্যান্বিত,
“এখনই? ”
“হুম কেন পারবে না?তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। আমি তোমাকে হারাতে চাই না তিমির। ”
তিমির একটা লম্বাশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আর ঐশীর হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বললো,
“চলো আমার সাথে।”
ঐশী অবাক হয়ে বললো,
“কোথায়? ”
“কেন তুমিই তো বললে বিয়ে করবে। তো দেরী করে লাভ কি। আর কতকাল একা থাকবো এখন তো বিয়ে করে নেওয়া উচিত তাই না। ”
তিমিরের কথা শুনে ঐশীর মুখে হাসি ফুটল। আজ ওর ও একটা স্বপ্ন পূরণ হবে নিজের একটা সংসার হবে নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে এরচেয়ে বেশী জীবনে আর কি লাগে।
★
★
শান যাওয়ার পরে আমিও রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। নিচে যেতেই আগে আপুর সাথে দেখা,
“আরে বাহ আমার বোনটাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে তো?ওয়াও বেলী ফুলের মালা কে দিলো হুম।রুমে তো ছিল না। ”
আপু চোখের ইশারায় বললো। আমি লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসলাম। আপু আবারও বললো,
“হুম হাসি দেখেই বুঝা যাচ্ছে গিফটটা স্পেশাল কেউ দিয়েছে তাই তো লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেছে। ”
আরশ ভাইয়া আপুকে থামিয়ে বললো,
“আহা স্মৃতি কেন মেয়েটাকে লেগ-পুলিং করছো। ”
আপু আরশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তো কি করব সারাজীবন অন্যেরটাই দেখে যাবো কেউ তো আর আমাকে দেবে না। ”
আরশ ভাইয়া কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
“সিরিয়াসলি কতগুলো চাই তোমার। বেলী ফুলের মালা দিয়ে প্রতিদিন সকালে সাজিয়ে দেবো শুধু বিয়েটা হতে দেও। ”
এদের কথা বার্তা শুনে আমি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম,
“যেকোনো জায়গায় শুরু হয়ে যেও না প্লিজ। আমি আছি এখানে। ”
আরশ ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“হুম দেখতো পাচ্ছি এভার চলো নাহলে সবাই আমাদের তিনজনকে খোঁজার জন্য এখনি হারানো বিজ্ঞপ্তি দিবে। ”
বসার রুমে সবাই বসে বসে টুকটাক কথা বলছে। আমি শুধু বসে বসে ভাবছি আপুদের বিয়ের কথাটা কখন উঠবে। আধোও শান সবাইকে ম্যানেজ করতে পারবে তো। যদিও শানের উপর আমার পুরো ভরষা আছে এর আগেরবার ও শানের জন্যই আপুদের ব্যাপারটা সফটলি মিটে গেছিলো। এবার নিশ্চয়ই মিটে যাবে তারপরও নিজের মনের অস্থিরতা দূর করতে শানকে ফিসফিসিয়ে বললাম,
“বলছি আপুদের বিয়ের ব্যাপারটা কখন বলবেন? ”
শান আমাকে ইশারায় বললো,
“এখনি বাবা বলবেন অপেক্ষা করো। ”
উনার কথা শুনে আমি একটু অবাক হলাম বাবা বলবে মানে?বাবার সাথে উনি এই বিষয়ে কথা বলেছিলেন? তাহলে আমাকে বললো না কেন?উনি এমন কেন কখনো কোনো কাজ আমাকে বলে করে না অদ্ভুত।
কিছুক্ষন পর আমার শ্বশুর মশাই বললেন,
“আচ্ছা আজকে যে জন্য আমাদের এখানে আসা সেটা আগে বলা প্রয়োজন। ”
শ্বাশুড়ী মা উনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। উনার তাকানো দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনিও কিছু জানে না।
শ্বশুর মশাই আবার বললেন,
“আমরা দুইবাবা মিলে ঠিক করেছি আরশ আর স্মৃতির বিয়ে দেবো। ”
কথাটা শুনে সবাই কম বেশী অবাক হলো আমার মা বলে উঠলেন,
“বিয়ে?”
বাবা বললেন,
“হুম বিয়ে, দেখো স্মৃতি আর আরশের পালানো নিয়ে প্রথমত কম ছোট হতে হয়নি দ্বিতীয়ত ওরা যখন ফিরে এলো তখন তো মানুষের কাছে মুখ দেখানোই দায় হয়ে যাচ্ছে। সবাই বলছে মেয়ে মুখ পুড়িয়ে এসেছে। ওরা কেন পালিয়ে ছিল সেটা আমি আর তুমি জানলে সবাই তো বিশ্বাস করছে না। সবাই স্মৃতির চরিত্র নিয়েই কথা বলছে। তাই স্মৃতি আর আরশের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই স্মৃতিকে ওরা ওদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চাইছে।”
বাবার কথা টেনে শ্বশুর মশাই বললেন,
“আর তাছাড়া স্মৃতির তো আমাদের বাড়ির বউ হওয়ার কথা ছিলোই হয়তো শানের তবে এখন যখন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে তাহলে স্মৃতির সাথে আরশের বিয়েটা নাহয় আবার উৎযাপন করা হোউক। ”
দুই মা কিছুক্ষন চুপ থেকে একে অপরের দিকে তাকালো তারপর নিজের মধ্যে কিছু কথা বলে দুজনেই একসাথে হেসে বললো,
“তোমরা তাহলে বিয়ের ব্যবস্থা করো আমাদের কারো কোনো আপত্তি নেই। ”
মায়ের কথা শুনে আমি এতটা খুশি হয়ে গেছিলাম যে খুশির চোটে চিৎকার দিয়ে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম,
“ইয়ে আজকে আমি অনেক অনেক হ্যাপি। এরপর থেকে আমরা দুইবোন একসাথে থাকবো আমি তো জাস্ট ভাবতেই পারছি না। আমাদের দুইবোনকে এখন আর কেউ আলাদা করতে পারবে না। ”
আপুও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমার কথা শুনে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। আমি নিজেই নিজের কাজে লজ্জা পেয়ে চুপচাপ আবার আপুর পাশে বসে গেলাম।
“আচ্ছা স্মৃতি তুই আর আরশ আলাদা করে একে অপরের সাথে কথা বলে নে । তারপর তোদের মতামত জানা। ”
আপু আর আরশ ভাইয়া মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি লাফিয়ে বলে উঠলাম,
“তাহলে আমি নিয়ে যাই দুজনকে।”
আম্মু স্মমতি দিয়ে বললেন
“যা। ”
আমি আপু আর ভাইয়াকে আমাদের রুমে নিয়ে আসলাম দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম দুজনের মুখেই কি অমায়িক হাসি দেখলেও মন জুড়িয়ে যায়।আজ দুজন ভালোবাসার মানুষকে মিলাতে পেরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি কাজ করছে যদিও এর ক্রেডিট সব শানের। একটা স্পেশাল থ্যাংক্স তো বলাই যায়।কি হতে পারে সেটা? আমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।
“আমাদের এতো বছরের সম্পর্কটা আজ সত্যিকারে অর্থে পূর্ণ হলো।এরমধ্যে জীবনে কত চড়াই উৎরাই গেলো। ঝগড়া -ঝামেলা, ভুল বুঝাবুঝিও কম যায় নি তারপরও কখনো কেউ কাউকে ছেড়ে যাইনি। কারণ আমাদের সম্পর্কে ভালোবাসা ছিল সত্যিকারে ভালোবাসা যেটা কখনো আমাদের দূরে যেতে দেয়নি। ”
আরশ ভাইয়া আরেকটু থেমে বললো,
“তোমার মনে আছে স্মৃতি যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয় সেদিন শুধু আমাদের বন্ধুত্ব হয় তারপর একে অপরকে সব শেয়ার করা আস্তে আস্তে ভালোবাসা। আমি ফার্স্টে ভেবেছিলাম তোমাকে কথাটা বলবো কিভাবে? অনেক ভয় পাচ্ছিলাম যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি আসলে সেদিন ভুল ছিলাম সেদিন যদি সাহস নিয়ে না বলতাম তাহলে হয়তো আমাদের পথটাই আলাদা হতো। তাই আমার মনে হয় কেউ যদি কাউকে সত্যিকারে ভালোবাসে সেটা প্রকাশ করা উচিত জানো দেরী না হয়ে যায়।”
এইবার আরশ সোহার সামনে গিয়ে সোহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি জানো সোহা আমার ভাইয়া একজন অমায়িক মানুষ যে মেয়েদের সবসময় সম্মান করেছে। বিচক্ষণতা দিয়ে সব কঠিন এমুহূর্ত গুলো নিকের আয়ত্তে এনেছে। ভাইয়া কখনো জোর-জবরদস্তির সম্পর্কে বিশ্বাসী ছিল না।ভালোবেসে কাছে টানায় বিশ্বাস করতো কারণ কেউ সত্যিকারে ভালোবেসে একবার কাছে আসলে কখনো ছেড়ে যায় না। ভার্সিটিতে কতো মেয়ে ভাইয়ার জন্য পাগল ছিলো।হাত পা কেটে একাকার অবস্থা কিন্তু ভাইয়া কখনো সেসব মেয়েদের দিকে কখনো ফিরেও তাকায়নি। চাইলেই এডভান্টেজ নিতে পারতো কিন্তু সেটাও করেনি। এডভান্টেজ তো দূর কাউকেই নিজের হাতটা ধরার ও সুযোগ কখনো কাউকে দেয়নি। সব ভালোবাসা শুধু নিজের বউয়ের জন্যই তুলে রেখেছে যাতে তার ভালোবাসায় কখনো কম না পড়ে। ”
আরশ ভাইয়র কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম হঠাৎ এসব কথা আমাকে বলছে কেন?কিছু সন্দেহ করেছে নাকি?আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।আরশ ভাইয়া আবার বললো,
“আমি কি বলছি বুঝতে পারছো সোহা।সব বুঝেও অবুঝ থেকো না। নিজের মনে যা আছে সব বলে দেও জীবনে তোমার জন্য ভালো কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছে।বেষ্ট অব লাক। ”
আমি এখনও পলকহীন ভাবে আরশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া একটু হেসে বললো,
“যাইহোক কি বলে যে তোমাদের শুকরিয়া আদায় করব সোহা জানি না। তুমি আর ভাইয়া না থাকলে আজ আমাদের ভালোবাসায় পূর্ণতা হয়তো পেতোই না। থ্যাংক্স আ লট। ”
আমি হালকা হেসে বললাম,
“আমি আসছি তোমরা কথা বলো। ”
কথাটা বলেই আমি বেরিয়ে আসলাম রুম থেকে। বারবার আরশ ভাইয়ার বলা কথা গুলো আমার কানে বাজছে। আমার যে হ্যান্ডসাম বর সত্যিই যদি সময় থাকতে না বলে যদি শানকে হারিয়ে ফেলি। অন্যকেউ শানকে নিয়ে নেয় তখন কি হবে। ভাবতেই আতকে উঠলাম না না এমনটা কখনোই হবে না শানকে আমি ভালোবাসি ওকে হারাতে চাই না। ভালোবাসার কথা সবসময় ছেলেরাই আগে বলবে এটা তো কোনো নিয়ম না মেয়েরাও বলতে পারে আর সেটাই আমি করব।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে আমরা বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু বাহিরে যেতেই শানের কথা শুনে চমকে উঠলাম আমি। শান বাবা, মা, আরশকে আমরা যে গাড়িটা নিয়ে এসেছিলাম সেটাতে পাঠিয়ে দিলো। আর আমাকে যেতে দিলো না সাথে নিজেও দাঁড়িয়ে রইল। আমি রেগে বললাম,
“এটা কি হলো? এখন আমরা যাবো কিসে? ”
“অপেক্ষা করো দেখতেই পাবে। ”
বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শীতে কাপছি আর মশার কামড় খাচ্ছি। এতো রাগ হচ্ছে বলার বাহিরে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করতেই দেখলাম ড্রাইবার আঙ্কেল আরেকটা গাড়ি নিয়ে আসছে। গাড়িটা আমাদের সামনে এসে দাঁড় করিয়ে চাবিটা উনার হাতে দিয়ে দিলো। উনি চাবিটা নিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ আঙ্কেল এতটা হেল্প করার জন্য।”
“কি যে বলো না বাবা এটা তো আমার কাজই।”
“নো আঙ্কেল তারপরও আমার কথায় এতো রাতে এসেছো সেটাও বা কম কিসে। তুমি একটা টেক্সি ধরে চলে যাও। ”
শান উনার হাতে কিছু টাকা দিয়ে আমাকে নিয়ে গাড়ি কাছে এলেন। উনার কর্মকান্ড দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম উনি গাড়িতে উঠো বসে বললেন,
“কি হলো এখনো হা করে তাকিয়ে আছো কেন উঠো। ”
“আমরা তো ঐ গাড়িতেই সবাই মিলে যেতে পারতাম নতুন একটা গাড়ি আনার কি দরকার ছিলো। ”
“বলবো আগে গাড়িতে উঠে বসো লেইট হচ্ছে। ”
আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।
“বলুন না ওদের সাথে না গিয়ে আলাদা কেন যাচ্ছি? ”
শান মুচকি হেসে বললো,
“কারণ আমরা বাড়িতে যাচ্ছি না। ”
উনার কথা শুনে আমি আশ্চর্য্য হলাম বাড়িতে যাচ্ছি না মানে? তাহলে এতো রাতে কোথায় যাচ্ছি আমারা?
.
.
চলবে