এক শহর ভালোবাসা পর্ব-২১+২২

0
3609

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_২১
#সুরাইয়া_নাজিফা

“কি হয়েছে আমার পিছন পিছন ঘুরছো কেন একবার বললাম তো রুম থেকে বের হতে।”
আমি মন খারাপ করে বললাম,
“আমাকে দিন আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। ”
“কোনো প্রয়োজন নেই আমারটা আমি করে নিতে পারব। তুমি তোমার কাজ করো। ”

“এতো রাগ করছেন কেন? বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছিলাম। ফিরেও আসতাম বাট মা বললো যে আরেকটু ঘুরাতে। আমি প্রথমে রাজি ছিলাম না। কিন্তু পরবর্তীতে আপনার কাজ কর্ম দেখে কেন জানি আপনাকে জ্বালানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই আমরা শুধু একটু মজাই করছিলাম। আর কিছু না। ”

শান আমার দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তেড়ে আসল আমার দিকে। আমার বাম হাতের বাহু ওনার ডান হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে বললেন,

“অনেক মজা লেগেছে না। এটা মাথায় থাকে না তোমার মজা অন্যের কষ্টের কারণও হতে পারে। আমি এই গিল্টি ফিলিংয়ের জন্য ঘুমাতে পারছিলাম না যে আজকে আমার জন্য তুমি এতোটা কষ্ট পেয়েছো। আর তুমি আমার কষ্টটাকে নিয়ে মজা করছিলে। যাও তুমি তোমার মজা নিয়েই থাকো।আমার সাথে কথা বলাী দরকার নেই যাও। ”

কথাটা বলেই উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিল। ওনার ধাক্কার কারণে আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম। আমার চোখে জল ছলছল করছিলো।শাম আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে সোফায় বসলো। তারপর ফার্স্ট এইড বক্স দিয়ে নিজেই নিজের হাতে তুলা দিয়ে পরিষ্কার করছে নিচের দিকে তাকিয়ে। আমার সাথে একটা কথাও বলছেন না। আমি উনার পাশে বসে এইবার উনার হাত ধরে বললাম,
“দেখি দিন আমাকে।কেন করছেন এমন। স্যরি বলছি তো?”

উনি আমার দিক থেকে হাত সরিয়ে আমার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকালেন,
“আমিও স্যরি বলেছিলাম বাট তুমি মাফ করেছিলে?তাহলে অন্য কারো কাছ থেকে কিভাবে আশা করো? ”

কথাটা বলেই শান আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেলেন। আমার অনেক কান্না আসছিলো।নিজের ঠোঁট চেপে আমি আমার কান্না আটকালাম। নাহয় একটু মজাই করছিলাম তাই বলে এতো রাগ করতে হয়।


শান ছাঁদের এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দুই হাত বুকে ভাজ করে দূর আকাশের দিকে। আকাশের বুকে একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে যেটা মাঝেমাঝে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যাচ্ছে আবার ধরা দিচ্ছে। একরকম লুকোচুরি খেলা। হঠাৎ শানের পাশে একটা গাছের উপর নজর পড়ল।সেখানে দুইটা পাখি বসে কিন্তু কিছুটা দূরে দূরে। এই পাখি গুলো অনেকদিন যাবত এই গাছেই থাকে। মাঝে মাঝে ছাঁদে এলেই শান দেখতো পাখি গুলোকে একটা রোমান্টিক মুডে সবসময় একসাথে বাট আজকে দেখে শান একটু অবাক হলো কারণ পাখি দুটো অনেকটাই দূরে।কিছুক্ষন পর পাশের পাখিটা অন্য পাখির দিকে এগিয়ে গেল আর ডানা দিয়ে তাকে আগলে রাখতে চাইল কিন্তু পাখিটা বারবার ওর ডানার নিচ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল।শান খুব মনযোগ সহকারে দেখছে ওদের আর বেশ বুঝতে পারছে এদের মাঝেও হয়তো মান অভিমান চলছে।

“আমরা যাকে সবসময় যত্ন করে আমাদের বুকের মাঝে আগলে রাখতে চাই তারাই সবসময় আমাদের আগলানোকে অস্বস্তি অনুভব করে দূরে সরে যায়। কখনো আমাদের বুঝতেই পারে না। ”

কথাটা ভাবতেই শানের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। চারদিক ঘেকে কনকনে ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগছে। চট্টগ্রাম শহরেও এবার বেশ ভালোই শীত পড়েছে। শানেরও প্রচুর শীত লাগছে। রুমে গিয়ে একটা চাদর নিয়ে আসলে হয়তো ভালো হতো তাহলে। কিন্তু না এখন অভিমানটা শীতকেও ছাপিয়ে গেছে তাই যাবেনা রুমে। সোহার সাথে এখন কোনো কথা বলতো চায় না শান।

“কি ব্যাপার বেটা এতো ঠান্ডার মধ্যে ছাঁদে দাঁড়িয়ে তাও কোনো গরম কাপড় ছাড়া? ”

কন্ঠটা শুনেই শান নিজের পাশে তাকালো দেখল শানের বাবা দাঁড়িয়ে শান একবার দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
“এমনি ভালো লাগছিলো না তাই দাঁড়িয়ে আছি। তুমি এতো ঠান্ডার মধ্যে কেন ছাঁদে এসেছো। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নেও। ”
ইমতিয়াজ সাহেব কিছুটা ভাব নিয়েই বললো,
“কেন? তুমি কি আমাকে বুড়ো লোক মনে করো নাকি। তুমি যদি এই ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারো আমি পারবো না কেন? এখনো আমি আর তুমি যদি একসাথে হেঁটে যাই সব মেয়েরা আমাকেই দেখবে এখনো এতটা সুদর্শন আছি হুম। ”

বাবার কথা শুনে মন খারাপের মাঝেও মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
“তাই তাহলে তোমার জন্য তো এবার মেয়ে দেখা দরকার। তোমাকে আবার বিয়ে দিয়ে দেই কি বলো?”

ইমতিয়াজ সাথেব আতকে উঠে বললো,
“মাথা খারাপ একজনের জ্বালাই সহ্য করতে পারিনা আবার আরেকটা। আমার মাথায় যেই চুল গুলো দেখছো না একটাও থাকবেনা তাহলে।”

শান হেসে বললো,
“ওহ মা তোমাকে এতো টর্চার করে তাহলে ছেড়ে দেও মাকে। ”

“উহুম এটা বলো না। ওটা আমি চাইলেও পারবো না।সে যেমনই হোক তাকে আমি ভালোবাসি।হয়তো একটু রাগি কিন্তু মনটা অনেক ভালো।মাঝে মাঝে রেগে থাকে আমার রাগ ভাঙায়, ফিরতে দেরী হলে অপেক্ষা করে রাতভর, কোনো ভুল দেখলে সেটা শুধরে দেয়। সে যাই করে তাতে কোথাও না কোথাও আমার জন্য ভালোই থাকে সেটা অস্বীকার করার কোনো পথ নেই। তাই আমার জন্য সেই ভালো। তাকে ছাড়া আর অন্য কাউকে কল্পনা করারও সম্ভব নয়। ”

নিজের বাবাকে মাঝে মাঝে বুঝতে পারেনা শান মায়ের সামনে সবথেকে বেশী বদনাম বাবা করে আর তার পিছনেই সব থেকে প্রসংশাও বাবাই করে। কি অদ্ভুত সম্পর্ক। কথা গুলো শুনে শানের সামনে সোহার মুখটা ভেসে উঠল। আচ্ছা ওর আর সোহার সম্পর্ক কি এমনই। সোহা কি ওর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা আর করবে নাকি ওটুকুতেই আটকে থাকবে?সোহার মনে কি আধোও কোনো অনুভুতি আছে আমার জন্য নাকি সব দেখানো। তখনই ইমতিয়াজ সাহেব আবার বলে উঠল,

“সোহার সাথে অভিমান করেছো?”
শান নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো।অন্যদিকেই তাকিয়ে বললো,
“তোমার কফিটা কে বানিয়ে দিছে মা?
ইমতিয়াজ সাহেব কফির দিকে তাকিয়ে বললো,
“কথা এড়িয়ে যাচ্ছো। ”
শান কিছু না বলে চুপ করে রইল। ইমতিয়াজ সাহেব আবার বললেন,
“মেয়েরা একটু পাগলামি দেখতে পছন্দ করে। তাদের পিছনে নিজের প্রিয় মানুষটাকে ঘুরাতে পছন্দ করে। কারণ তারা দেখতে চায় তাদের জন্য তাদের প্রিয় মানুষটা কি কি করতে পারে। কখনো রাগ না হলেও রাগ করার অভিনয় করে শুধু একটু ভালোবাসা, অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য। তারা দেখতে চায় তাদের জন্য তার ভালোবাসার মানুষটা কতটা পসেসিভ।এটুকুতেই তাদের মুখে হাসি ফুঁটে উঠে। একটা মেয়ে আমাদের জন্য কত কিছু করে তার বিনিময়ে আমরা তো তার জন্য এটুকু করতেই পারি। সোহাও তো তার ব্যতিক্রম নয়। তুমি যতোই পাগলামি করছিলে সেটাই ওর মুখের হাসির কারণ ছিলো তাই সে আরো দেখতে চাইছিল তুমি তার জন্য আর কি কি করতে পারো এটা তো ভুল নয়।কেন বুঝতে পারছো না সোহা তোমাকে ভালোবাসে।”

বাবার কথা শুনে শান এখন উনার দিকে তাকালো। আর আনমনেই বলে উঠল,
“ভালোবাসে? ”
ইমতিয়াজ সাহেব হাসলেন,
“তা নয়তো কি?ভালো না বাসলে যদি এড়াতেই চাইতো তাহলে থুরি না একটা স্পিমল বিষয় নিয়ে তোমাকে আগে পিছে ঘুরাতো। এটুকু বুঝতে পারোনা।”

শানের চোখে মুখে হাসির ঝলক ফুটে উঠল।কিন্তু বিশ্বাস হলো না। ইমতিয়াজ সাহেব বললেন,
“কি রাগ পড়েছে তো? পড়লে এইবার গিয়ে মান অভিমান শেষ করো। বাবা অনেক ঠান্ডা লাগছে আমি আসছি। ”

শানের বাবা চলে গেল। শান আবার একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল। এতো কথা বললো কিন্তু ওর মধ্যে তার কোনো প্রভাব পড়ল বলে মনে হলো না।


শানের জন্য,অনেকক্ষন অপেক্ষা করছি বাট আসার কোনো নামই নাই। অদ্ভুত এই রাতের বেলায় একটা গরম কাপড় না নিয়েই উনি চলে গেলেন ছাঁদে। আমিও যেতে চেয়েছিলাম তখনই দেখলাম বাবা যাচ্ছে তাই আর যাইনি। না জানি বাবার সামনে আবার কি বলে বসে। কিছুক্ষন পরই দেখলাম বাবা আসছে। তাই আমি দরজার আড়ালে চলে গেলাম। ভাবলাম হয়তো বাবার সাথে শানও আসবে। কিন্তু বাবা নেমে চলে গেলেন কিন্তু শানের কোনো খবর নাই। আমি আর অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে ছাঁদে চলে গেলাম।

ছাঁদে গিয়ে দেখলাম উনি ছাঁদে দাঁড়িয়ে।শরীরে কি চামড়া না প্লাষ্টিক। এতো ঠান্ডার মধ্যে কেমনে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে?আমি গিয়ে উনার পিছন থেকে চাঁদরটা গায়ে দিয়ে দিলাম। দিতেই উনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তাকিয়েই কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন,

“তুমি এখানে কেন এসেছো? ”
“কেন ছাঁদে আসা মানা বুঝি?”
“না মানা না। তবে আমার পিছনে কেন এসেছো? দেখতে পাওনি আমি আছি। এখন যাও পরে এসো। ”
“আপনার পিছনে আসিনি তো আমার চেয়েছে তাই আসছি।”

শান আমার দিকে রাগি চোখে তাকালো। আমি ঠোঁট টিপে খানিকটা হাসলাম। শান নিজের গা থেকে চাঁদরটা ফেলে দিয়ে অন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমিও উনার পিছনে গেলাম,

“আচ্ছা আপনি আমার উপর রেগে আছেন তাহলে রাগ আমার উপরে দেখানো উচিত নিজের শরীরকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন?”
“আমি একবারও বলিনি আমি তোমার উপর রেগে আছি? ”
“না বললেও আমি বুঝতে পারি। ”

শান কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না। আমি উনার আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলাম। উনার মুখটা আমার হাত দিয়ে আমার দিকে ফেরালাম।
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
“কেন বিরক্ত করছো আমাকে রুমে যাও। ”

আমি উনার সামনে কান ধরে দুই তিনবার উঠবস করলাম। শান আশ্চর্য হয়ে বললো,
“এসব কি করছো বাচ্চাদের মতো? ”
“কেন মাফ চাইছি? ”
শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো বললো,
“পাগলি। ”

কথাটা বলেই পাশ কেঁটে চলে গেলেন। উনার পিছন পিছন আমিও গেলাম। উনি দ্রুত সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। আমি উনাকে পিছনে ডেকে বললাম,
“শুনুন না। ”

কিন্তু উনি আমার ডাক শুনছিলেন না। হঠাৎ দ্রুত নামতে গিয়ে এক সিড়ি বাঁদ দিয়ে পরের সিড়িতে পা দিতেই আমি পা পিছলে পড়ে যেতেই “আহ ” করে চিৎকার
দিলাম। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো আমি পড়িনি। কারো শক্ত বলিষ্ঠ বাহু আমাকে ধরে নিয়েছে। কারণ আমার হাতের মুঠোয় তার শার্ট খামছে ধরে রেখেছি । আমি আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকাতেই শান রেগে বলে উঠল,
“চোখ নেই সাথে দেখে চলতে পারো না। এখনি পড়ে হাত পা ভাঙত। ”
আমি হেসে বললাম,
“আপনি আছেন তো সামলাতে কিছুই হতো না। ”
কথাটা বলতেই শান আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে আবার নিজের মতো রুমে ডুকে গেল।
“আচ্ছা আমার এতে কেয়ার কটেন তারপরও কেন রাগ করে আছেন। এবার তো রাগ ঝেড়ে ফেলেন। ”
শান আমার কথায় কর্ণপাত না করে বিছানায় বসে বললে,
“লিসেন আমি এখন ঘুমাবো একদম বিরক্ত করবে না। ”

কথাটা বলেই উনি লাইটটা অফ করে শুয়ে পড়ল।আমার কান্না আসছিলো অনেক। আমি আর উপায় না পেয়ে বিছানার একপাশে বসে পড়লাম।


সকালে শান ঘুম থেকে উঠতেই আমি মুচকি একটা হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে।
“আপনার কফি আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। ”

ঘুম থেকে উঠেই সোহার এই মিষ্টি হাসি দেখে মনটা খুশি হয়ে গেল শানের।কিন্তু হঠাৎ শান সোহার এই অবতার দেখে চমকে উঠলো। আজ পর্যন্ত কখনো তো আনলো না আজ হঠাৎ।ওহ এটাও রাগ ভাঙানোর জন্য। শান সোহার কথা না শুনাট ভান করে পাশ কেঁটে চলে গেল। শান উঠে যেতেই আমি বললাম,
“কফিটা খেলেন না। ”
শান গম্ভীর হয়েই বললো,
“খাবো না। ”
“কিন্তু আপনি তো সবসময় কফি খান। ”
“সবসময় খেলেও এখন খাবো না। ”
“কেন? ”
“তোমাকে বলতে বাদ্ধ নই। ”
“তাহলে এটার কি করব এখন? ”
“ডাস্টবিনে ফেলে দেও তাহলেই হয়। ”

কাথাটা বলেই উনি চলে গেলেন।আমার বুক ফেঁটে কান্না আসছিলো এতো কষ্ট করে বানালাম আর উনি।আমি চোখের পানিটা মুছে মনে মনে বললাম,
” ওকে ব্যাপার না আমার নামও সোহা আপনার রাগ কেমনে না ভাঙে সেটাও আমি দেখব। ”

উনি ওয়াসরুমে গেলেন ফ্রেস হতে।আজকে উনি হয়তো আমার সাথে ঝগড়া করতে গিয়ে জামা কাপড় নিতে ভুলো গেছে তাই সেই সুযোগে আমি উনার জামা কাপড় ওয়ালেট, ঘড়ি, রুমাল সবকিছু বের করে বিছানায় সাজিয়ে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

শান নিজের প্রতি নিজেই প্রচন্ড বিরক্ত হলো। কথায় কথায় জামা কাপড়ই আনতে ভুলে গেছে এখন বের হবে কেমনে। যদিও টাওয়াল পড়ে বের হওয়া যায় কিন্তু পড়ে ঐ মেয়ে আবার চিৎকার চেঁচামেচি না শুরু করে।শান আগে পিছে না ভেবে ভাবল একবার দেখে নেওয়া যাক রুমে আছে কিনা। ভেবেই একটা উঁকি মেরে দেখল। দেখতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। শান বেরিয়ে এলো। কিন্তু বিছানার কাছে এসে অবাক হয়ে গেল। বিছানার উপর পর সব প্রয়োজনীয় জিনিস সুন্দর কটে সাজিয়ে রাখা। বুঝতে অসুবিধা হলো না সোহার কাজ। শানের মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠল,

“রাগ করলে এতো সুবিধা পাওয়া যায় জানা ছিলো না তো। ”

কিন্তু শান একটু ইগো দেখিয়ে জামা কাপড় গুলো না পড়ে নিজের পছন্দ মতো একটা পড়ে নিলো। কিছুক্ষন পর রুমে এসে শানকে দেখে প্রচন্ড রাগ হলো,

“এটা কি হলো?আপনার জন্য আমি যেই জামা কাপড় গুলো বের করলাম পড়লেন না কেন?”

“আমার ভালো লাগেনি তাই। ”

“ভালো লাগেনি মানে আপনি এখনি এটা চেন্জ করো ওটা পড়বেন। ”

“আমি একবার বলেছি মানে পড়ব না তখন পড়ব ন। একদম বিরক্ত করবে না। ”

কথাটা বলেই উনি ওনার প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে চলে গেলেন। আমি ওখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।


শান যাওয়ার পর থেকেই আমি গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মনটা একদমই ভালো লাগছে না। সারাদিনই এমন অগেছালোভাবে কেঁটেছে।কিভাবে যে ওনার রাগ কমবে আল্লাহ জানে। তখনই আমার মাথায় একটা আইডিয়া এলো। আচ্ছা শানের কোনো পছন্দের ডিশ বানাই। যেই ভাবা সেই কাজ।

আমি রান্নাঘরে গিয়ে শানের পছন্দের খাবার পায়েস বানাবো ঠিক করলাম। একটু মিষ্টি মুখ করিয়েই নাহয় রাগটা ভাঙাই। কিন্তু কিভাবে রান্না করবো কোনো আইডিয়া নেই।কারণ আম্মু বিয়ের আগে কখনো রান্নাঘরে আসতে দেয়নি। আর বিয়ের পর শ্বাশুড়ী মাও দেয়নি। তাই পড়লাম মহা ঝামেলায়। ইউটিউবটা ওপেন করে পায়েস রান্নার রেসিপিটা দেখে নিলাম আর ওই রকম ভাবেই রান্না করতে থাকলাম। যাক অনেক কষ্টে রান্নাটা শেষ করলাম। এখন বাকি শানের আসার।

সন্ধা ছয়টায় শান বাসায় এলো। শানকে দেখেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শান রুমে গিয়ে চেন্জ করে একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তখনই আমি হাসি মুখে পায়েসের বাটি নিয়ে রুমে ডুকে গেলাম। পায়েসের বাটিটা সামনে এগিয়ে শানকে বললাম,
“খেয়ে দেখুন তো এটার টেস্ট কেমন হয়েছে? ”
শান চোখ মেলে আমাকে একবার দেখে বললো,
“খাবো না নিয়ে যাও। ”
আমি বায়না করে বললাম,
“প্লিজ একটু। ”
শান এইবার রেগে বললো,
“একটা কথা কয়বার বলতে হয় তোমাকে বললাম তো খাবো না নিয়ে যাও।”
ওনার কথা শুনে আমার এখন প্রচুর কান্না পেলো। আমি কান্না করে বললাম,
“কালকে থেকে আপনি এমন করছেন কেন?একটু মজাই তো করেছি এমন কি? তাও ভুল হয়েছে তাই স্যরি বলেছি বাট তাও আপনি আমার কথাটা মানছেন না।এতো এটিটিউড দেখাচ্ছেন কেন? আজকে প্রথম আমি আমার হাত পুরিয়ে আপনার জন্য রান্না করেছি আর আপনি একটু ছুয়েও দেখলেন না। ”

আমার কথাটা শুনেই শান দ্রুত উঠে বসল,
“হাত পুড়েছে মানে কোথায় দেখি?”
“না দেখতে হবে না। দেখে কি করবেন আমি তো আপনার শত্রু। ”
শান রেগে বললো,
“একদম এক্সেস কথা বলবে না হাতটা দেখি। ”
বলেই আমার হাতটা টেনে নিলেন। পায়েস রান্না করতে গিয়ে হালকা ভাঁপে হাতটা একটু লাল হয়ে গেল। শান বক্স থেকে ঔষুধটা বের করে আমার হাতে একটু মলম লাগিয়ে দিলো আর আমাকে বকতে বকতে বললো,
“যে কাজ পারো না সেটা করতে যাও কেন। আর কখনো যেন তোমাকে আমি রান্নাঘরে যেতে না দেখি। ”
আমি কান্না করতে করতে বললাম,
“যাবো। যদি মাফ না করেন তাহলে আমি আপনার কথা শুনবো না। ”
শান আমার চোখের পানি মুছে বললো,
“মাফ করলে খুশি?”
“অনেক খুশি। ”
শান হেসে বললো,
“ওকে যাও মাফ করে দিলাম। ”
“তাহলে একটু আমার রান্না করা পায়েসটা খান। ”
শান পায়েসটা এক চামচ মুখে দিয়ে বসে রইল আমি বললাম,
“কি হলো ভালো হয়নি? ”
“ওয়াও খুব ভালো হয়েছে। এই প্রথম বউয়ের হাতে রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য হলো। আমি তো ভেবেছিলাম কখনো হবেই না কারণ আমার বউ তো কিছুই পারত না। বাট আগে যদি জানতাম রাগ করলে এতো তাড়াতাড়ি রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য হবে তাহলে অনেক আগেই রাগ করতাম। তবে প্রবলেম নাই এখন থেকে মাঝে মাঝে এমন রাগ করব। ”
উনার কথা শুনে আমি আঁতকে উঠলাম,
“না প্লিজ আর রাগ করবেন না। আমি সামলাতে পারবো না। আপনার রাগ অনেক ভয়ংকর। ”
কথাটা বলতেই শান খিলখিলিয়ে হেসে দিল। এতক্ষন পর উনাকে মন খুলে হাসতে দেখে আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।


রকিং চেয়ারে বসে আছে রায়ান। ওর কিছু ভালো লাগছে না। ও কিছুতেই আজকে শানের বলা কথা মেনে মিতে পারছে না। সোহা কিছুতেই অন্যকারো হতে পারে না। রায়ান সোহার ছবির দিকে তাকালো,

“নো সোহা তুমি কিছুতেই অন্যকারো হতে পারোনা তুমি আমার ছিলো আর আমারই থাকবে সেটা যেকোনো মূল্যে।”
.
.
চলবে

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_২২
#সুরাইয়া_নাজিফা

শান অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম। এতো সেজেগুজে যে মানুষ অফিস যায় উনাকে না দেখলে আমি জানতামই না। আসলে অফিসে তো যায় না যায় মেয়েদের পাগল করতে যতোসব।
আমি ওনার কাছে গিয়ে বললাম,
“আজকে কি আপনি ফ্রী আছেন?”

শান মাথা আছড়াতে আছড়াতে বললো,
“হঠাৎ জিজ্ঞেস করছো কেন?”

“আজকে আমার ফ্রেন্ড তানিশার জন্মদিন।বলেছিলাম আপনাকে। ওদের বাসায় পার্টি রেখেছে আমার সাথে আপনাকেও দাওয়াত দিয়েছে তাই বলছিলাম কি যদি আপনি যেতেন। ”
“আগে বললে হয়তো মেনেজ করতে পারতাম এখন সম্ভব না আজকে আমার একটা মিটিং আছে। ”
“ওহ গেলে ভালো লাগতো। আচ্ছা ব্যপার না আমি একা চলে যাবো। ”
শান এইবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কখন যাবে আর কখন ফিরবে?”
“এইতো সন্ধ্যা যাবো আসতে আসতে হয়তো অনেক রাত হবে। ”
“যাওয়ার দরকার নেই।” ”
আমি উনার কথা শুনে চমকে উঠলাম,
“যাবো না মানে?
“এতো রাত অব্দি বাড়ির বাহিরে থাকবে তাও একা একা কোনো প্রয়োজন নেই। বাসায় থাকো। ”
আমি বায়না ধরে বললাম,
“দেখুন আমি না গেলে ও খুব রাগ করবে। আমার বেষ্টফ্রেন্ড এমনটা বলবেন না প্লিজ। ”
আমি শানকে অনেক অনুরোধ করতে থাকলাম। শান কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,
“ওকে ওকে যেও একদম বাচ্চাদের মতো পিছনে পড়ে যাও। ”
ওনার কথা শুনে আমি অনেক খুশি হয়ে গেলাম,
“অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি জানতাম আপনি ঠিক মানবেন। ”
“হুম বাট তুমি আমাকে ঠিকানা দিয়ে যাও আমি তোমাকে নিতে যাবো ঠিক দশটার সময় বাসার নিচে থাকবে ওকে। ”
আমি হেসে বললাম,
“ওকে। ”

তারপর আমি উনাকে তানিশার বাসার ঠিকানাটা দিয়ে দিলাম। উনি অফিসে চলে গেলেন আমি উনাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম।


সন্ধ্যা ছয়টায় আমি রেডি হয়ে নিলাম তানিশার বাসায় যাওয়ার জন্য। আমি তেমন একটা সুন্দর সাজতে পারিনা তাই শ্বাশুড়ী মা সাজিয়ে দিলেন। একটা লাল গাউন পড়লাম, গলায় একটা পেন্ডেন্ট, কানে ছোট একজোড়া এয়ারিং, হাতে ব্রেসলাইট, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হালকা মেকাম, চুলগুলো ছাড়া দিলাম। বেশ আমার সাজ কমপ্লিট।

শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“দেখি একটা কালো টিপ দিয়ে দি কারো নজর না লাগে। ”
মা একটু কালি নিয়ে আমার কানের কাছে হালকা করে ছুয়ে দিলেন।আমি অবাক হয়ে বললাম,
“হঠাৎ আবার এসব কেন? ”
“কেন আবার আমার মেয়েটাকে যে এতো ভালো লাগছে তাই। ”
মায়ের কথায় আমি হাসলাম।
“আচ্ছা মা তুমিও চলো না আমার সাথে। আমার একা একা ভালো লাগছে না। ”
মায়ের কন্ঠে আড়ষ্টতা,
“নারে আমার ঐসব পার্টি ভালো লাগে না। আর কিছুক্ষন পর তোর বাবা আর শান চলে আসবে তাই বাসায় থাকতে হবে। তুই যা। সাবধানে যাবি। ”

আমার আর কি করার কারোই সময় নেই আমার সাথে যাওয়ার।তাই আমাকে অগত্যা একাই যেতে হচ্ছে। যদিও আমারও যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিলনা কিন্তু তানিশাকে কথা দিয়ে ফেলেছি তাই বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে।

তানিশাদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামতেই আমি ভিতরে চলে গেলাম।এখানে আমাদের ক্লাসের সবাই আছে তাই তেমন একটা অসুবিধা হলো না সবাইকে চিনতে। আমি সবার সাথে টুকটাক কথা বলল তানিশাকে খুঁজতে লাগলাম।কিছুক্ষন খোঁজার পরেই তানিশাকে পেয়েও গেলাম। আমাকে দেখতে পেয়েই তানিশা দৌঁড়ে এলো,
“কিরে এতো লেইট করলি। তোর জন্য কতক্ষণ থেকে ওয়েট করছিলাম। ”
“একটু জ্যামে পড়েছিলাম তাই লেইট হলো।যাইহোক শুভ পয়দা দিবস শাকচুন্নি। ”
তানিশার হাতে গিফট ধরিয়ে দিয়ে বললাম। তানিশা বললো,
“ধন্যবাদ দিমুনা কারণ এইটা পাওয়া আমার অধিকার।”

তানিশার কথা শুনে আমি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম এই মেয়েটা কখনো চেন্জ হবে না। তখনই পিছন থেকে কেউ এসে বললো,
“শুভ জন্মদিন দশবাচ্চার মা। এই নে তোর স্পেশাল গিফট। ”

আমরা পিছনে তাকাতেই দেখলাম সৃজন। তানিশা গিফট দিয়ে সৃজনকে একটা বারি মেরে বললো,
“হারামী কে দশবাচ্চার মা। আজকে আমার জন্মদিন অন্তত আজকের দিনে আমার সাঘে সুন্দর করে কথা বল।”
“কি করমু বল তোরে দেখলে আমার সুন্দর কথা বেরই হয়না। ”
হঠাৎ সৃজনের আমার দিকে চোখ পড়তেই বললো,
“হায় হায় এটা কে আমাদের সোহা নাকি? মাশাআল্লাহ একদম লাল পরী লাগতেছে। ”
“হুম একটু বেশী বেশী বলছিস না। ”
“একটুও বেশী না বিশ্বাস না হলে তানিশারে জিজ্ঞেস কর। ”
“থাক জিজ্ঞেস করা লাগবে না বিশ্বাস করলাম।”
সৃজন আমার কানের কাছে এসে চুপিচুপি বললো,
“বাই দ্যা ওয়ে তোর ওই খারুচ বরটা আসে নাই। আমার কথা শুনছে কিনা কে জানে তাহলে তো একদম উগান্ডা পাঠাই দিবো। ঐদিন যে রাগ নিয়া কথা কইল। বাবা রে বাবা এরপর থেকে তো আমার তোর সাথে কথা বলতেই ভয় করে।”

সৃজনের কথা শুনে আমি হাসলাম। ঐদিন মার্কেটের ঐ ঘটনার পরে সৃজনের সাথে আমার যখনই দেখা হয় ডে আমাকে এভবােই টোন কাঁটে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও এখন আর লাগে না। তাই আমিও ওর কথায় শায় দিয়ে বললাম,
“না আসে নাই তোর কপাল ভালো। ”
সৃজন বুকল হাত দিয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলো,
“যাক বাঁচলাম। ”
তানিশা সৃজনের পাশ থেকে আমাকে টেনে নিয়ে এসে বললো,
“ওর কথা বাদ দে তো চল তোর সাথে আমার একটা কাজিনের পরিচয় করাই। ”
“আরে কাকে পরিচয় করাবি লাগবে না। ”

কথাটা শেষ করতে না করতেই তানিশা আমাড কথা অগ্রাহ্য করে ওর কাজিনকে ডাক দিলো। এখন আবার কাকে পরিচয় করাবে বিরক্ত লাগছিলো। আমি মাথা নিচু করে ছিলাম তখনই তানিশা বললো,

“সোহা মিট মাই কাজিন ব্রাদার রায়ান আর রায়ান ভাইয়া এটা হলো সোহা যার কথা তোমাকে সবসময় বলি। ”

রায়ান নামটা শুনেই আমার মনের ভিতরে খটকা লাগলো। আমি দ্রুত কপাল উঠিয়েই চমকে উঠলাম,
“আপনি। ”
রায়ান হেসে বললো,
“হুম আমি। ”

আমি অনেকটা বিষ্ময় নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। উফ গড যেখানে যাই সেখানেই এই লোকটা থাকা কি জরুরী। এখন আবার কি বলে? দূর কিছু বলবে কেন শান তো ঐদিনই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। যদিও ঐদিনের পর রায়ান আমাকে আর বিরক্ত করেনি। আমি নিজের বিষ্ময় নিয়ে বললাম,
“আপনি আমাকে দেখে অবাক হননি এতো চিল কিভাবে আছেন? ”
“না কারণ কালকেই তানিশা আমাকে তোমার ছবি দেখিয়েছিল। আমি তো অপেক্ষায় ছিলাম কখন তোমার সাথে দেখা হবে। ”
ওনার কথাটা শুনেই বিরক্ত বোধ করলাম। তানিশা বললো,
“ওয়াও তোমরা আগে থেকেই দুজন দুজনকে চিনো?”
আমি দাঁতে দাঁত চিপে বললাম,
“হুম দূর্ভাগ্যবসত চিনি। ”
তানিশা টাস্কি খেয়ে বললো,
“এবাবে বললি কেন? ”
তখনই রায়ান হেসে বললো,
ওটা কোনো ব্যাপার না তোর ফ্রেন্ড এমনই নিজের প্রিয় জিনিস গুলোকে এবাবেই আখ্যায়িত করতে পছন্দ করে। ”
আমি বিরবির করে বললাম,
“প্রিয় না ছাই। পাগল লোক একটা। ”

তখনই তানিশাকে তানিশার আম্মু ডাক দিলো তানিশা বললো,
“আচ্ছা তোরা যখন একে অপরকে চিনিসই তাহলে গল্প কর। আমি একটু আসছি। ”

বলেই তানিশা চলে গেল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি সাথে সৃজন আর রায়ান। কিছুক্ষন পর সৃজনকে একজন ডাক দিতেই সৃজন আমাকে বলে চলে গেল। এখন রায়ান আর আমি আছি। রায়ান বারবার আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল যেটা আমার মোটেও ভালো লাগছিলো না।আমি যদি আগে জানতাম এই রায়ান তানিশার কাজিন তাহলে কখনোই আসতাম না। তাই আমি সরে অন্য জায়গায় যেতে নিতেই রায়ান আমার হাত ধরল। আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। রাগে আমার শরীর কাঁপছে আমি তাড়াতাড়ি করে ওনার হাত ঝাটকা মেরে সরিয়ে নিলাম,
“কি হচ্ছে এসব আমার হাত ধরছেন কেন?”
“তুমি এতো রিয়েক্ট করছো কেন? আমি তো জাস্ট তোমাকে থামানোর জন্য ধরেছিলাম।”
আমি কর্কশ কন্ঠে বললাম,
“মুখে বলা যেত না ধরার কি দরকার ছিল? ”
“ওকে স্যরি শান্ত হও এতো হাইপার হচ্ছো কেন? ”

আমি নিজেকে একটু সামলে নিলাম।এখানে আশেপাশে অনেক মানুষ আছে তাই সিনক্রিয়েট করার মানেই হয়না কে কি ভাববে বলা যায় না। তখনই রায়ান আবার বলে উঠল,

“আজকে কিন্তু তোমাকে সত্যি অনেক বিউটিফুল লাগছে। ”
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
“ধন্যবাদ। ”
“তোমার বিবাহিত জীবন নিয়ে তুমি খুশী তো? ”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“মানে?”
তিমির একটু ভঙ্গিমা করে বললো,
“মানে তুমি কি তোমার হাজবেন্ডকে ভালোবাসো? ”
আমি সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
“এসব কি প্রশ্ন করছেন বলুন তো। অবশ্যই শানের সাথে আমি খুশি। খুশি নাহলে নিশ্চয় আমরা একসাথে থাকতাম না। ”

রায়ান ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
“আচ্ছা আমি যে তোমাকে এতোটা ভালোবাসি সেটা কি তুমি কখনো বুঝতে পারোনি না দেখতে পাওনি। আমার থেকে কি শান তোমাকে বেশী ভালোবাসে যে তাকে তুমি যে আসনটা দিলে সেটা আমাকে দিতে পারতেনা। ”

“সব আসন সবার জন্য প্রযোয্য না। ”
“দেখো সোহা তুমি চাইলে এখনো শানকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে পারো আমি তোমাকে আমার হৃদয়ের রাণী করে রাখব।”
আমি রাগান্বিত হয়ে বললাম,
“বন্ধ করুন আপনার এই ফালতু কথা। আমি আমার হাজবেন্ডকে ভালোবাসি আর ওর সাথেই থাকতে চাই মাঝখানে আপনি না আসলে খুশি হবে।”

রায়ান আর কিছু বলবে তার আগে সৃজন চলে আসলো। সৃজনকে দেখে রায়ান আর কিছু না বলে চলে গেল। সৃজন আমাকে দেখে বললো,
“কিরে এভাবে মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?কিছু হয়েছে?তানিশার ভাই কিছু বলেছে?”
আমি সৃজনের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললাম,
“না ঠিক আছে। ”


পার্টিতে এসেছিলাম সন্ধ্যার দিকে এখন প্রায় দশটা বাজে কিছুক্ষন পরই শান চলে আসবে আমাকে নিতে। তাই বসে বসে শানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।বার বার রায়ানের সাথে চোখাচোখি হলেই অস্বস্তি বাড়তে লাগল।যদিও রায়ান আমাদের থেকে কিছুটা দূরেই ছিল। হঠাৎ আমার অনেক পানি পিপাসা পেল আমি পানি খাওয়ার জন্য উঠতে যাবো তখনই তাবিশা বললো,
“কিরে কোথায় যাচ্ছিস?”
“পানি খাবো। ”
“তো যাওয়ার কি দরকার তুই বস আমি পানি নিয়ে আসছি।”
তানিশা গেল পানি আনতে। আমি অপেক্ষা করছিলাম তখনই একটা ওয়েটার এসে বললো,
“ম্যাম জুস? ”
আমার অনেক পানি পিপাসা পেয়েছিল তাই আর আগে পিছে না ভেবে ওয়েটারটার থেকে জুসটা নিয়ে নিলাম। জুসটা খেয়ে বসলাম তখনই তানিশা পানি নিয়ে এলো,
“নে ধর।”
“লাগবে না আমি জুস খেয়েছি। ”
তানিশা অবাক হয়ে বললো,
“তুই না বললি পানি খাবি। ”
সৃজন রেগে বললো,
“ঐ ময়নার মা এতো কথা বলিস কেন একটা খেয়েছে তো। ”

তানিশা আর কিছু না বলে পানির গ্লাসটা পাশে রেখেই বসে পড়ল। আবার পুনরায় সবার সাথে কথা বলতে লাগলাম। হঠাৎ আমার মাথাটা কেন জানি চক্কোর দিয়ে উঠলো। শরীরটা প্রচুর খারাপ লাগছিলো। অশান্তি অনুভব হচ্ছিল। আমি তারপরও কিছুক্ষন বসে ছিলাম। কিন্তু না মাথাটা আরো বেশী পরিমানে ঘুরছিলো। একটু ওয়াশরুমে গিয়ে নাকে মুখে পানি দেওয়াটা জরুরী।

তাই তানিশাকে বললাম,
“তোর রুম কই?”
“কেন?কি হয়েছে?”
“লাগবে।ওয়াশরুমে যাবো।”
“ঐতো সোজা গিয়ে বামদিকে। ”
“আচ্ছা। ”

কথাটা বললই আমও চলে গেলাম। হাঁটতেও প্রচুর কষ্ট হচ্ছিল মনে হয় আমি এখনই মাথা ঘুরিয়ে এখানেই পড়ে যাবো। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছিলাম। তাও কোনো রকম ওয়াসরুমে গিয়ে পানি দিচ্ছিলাম মুখে। কিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না ঠাস করে পড়েগেলাম নিচে তারপর আর কিছু মনে নেই।

রাত দশটা বাজে শানের গাড়ি এসে থামলো তানিশাদের বাড়ির সামনে। শান গাড়ি থেকে নেমে সোহাকে বেশ কয়েকবার কল করল বাট সোহা রিসিভড করলো না। শানের কেমন জানি খটকা লাগলো। শান আর বাহিরে দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত ভিতরে চলে গেল। ভিতরে গিয়ে সোহাকে খুঁজতে লাগলো বাট চোখে পড়ল না। তখনই সৃজনকে দেখতে পেলো। সৃজনের সাথে ঐদিন শপিং মলে দেখা হওয়ায় চিনতে অসুবিা হলো না।

শান গিয়ে বললো,
“সোহা কোথায়? ”
সৃজন বললো,
“ভাইয়া আপনি সোহাকে নিতে এসেছেন বুঝি?”
“হুম। ”
তানিশা অবাক হয়ে বললো,
“আপনি সোহার হাজবেন্ড? ”
“হুম কেন?”
তানিশা হেসে বললো,
“আমি সোহার বেষ্টি। নাইস টু মিস ইউ। ”
“সেম টু ইউ। বাট এখন বলো সোহা কই? ”
“সোহা ওয়াশরুমে গিয়েছে? ”
“কখন?”
“বেশ কিছুক্ষন হলো। ”
শান চিন্তিত হয়ে বললো,
“এখনো আসেনি? ”
“না? ”
“আচ্ছা আমাকে নিয়ে চলো তো? ”
“কি হয়েছে ভাইয়া? ”
“কিছু না নিয়ে চলো আমাকে। ”

তানিশা শানকে চিন্তিত হতে দেখে তাড়াতাড়ি শানকে তানিশার রুমের দিকে নিয়ে গেল।


রায়ান সোহাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বিছানার পাশ গেসে নিচে মেঝেতে বসল। সোহার একহাত নিজের হাতে মুঠোয় নিলো আর ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
“কেন সোহা কেন তুমি আমার সাথে এমনটা করলে। কম তো ভালোবাসিনি তোমাকে। শানের মধ্যে এমন কি দেখলে যেটা আমি তোমাকে দিতে পারতাম না।আজকে তোমার সাথে যেটা হবে সেটার জন্য দায়ী শুধুমাত্র তুমিই দায়ি। অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে বুঝানোর তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি বাট তুমি বুঝলেই না কখনো। আজকের পর নিশ্চয়ই তোমার হাজবেন্ড তোমার মুখটাও দেখবে না সেই ব্যবস্থাই করব। তবে তুমি চিন্তা করো না তোমাকে আমি আমার রাণী করে রাখব প্রমিজ। ”

রুমের সামনে এসে লক ঘুরিয়ে দেখল দরজা খুলছে না। তানিশা অবাক হলো।দুই তিনবার ধাক্কা দিলো বাট খুলছে না। তাহলে কি দরজা ভিতর থেকে লক করা কে করবে সোহা? কিন্তু কেন? তানিশাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শান বললো,

“কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
তানিশা চিন্তিত হয়ে বললো,
“ভাইয়া দরজা ভিতর থেকে লক করা। ”
শান চিৎকার করে বললো,
“মানে?”
শানের চিন্তাটা আরো বাড়লো এতক্ষন ফোন করছে অথচ সোহা ফোনটাও রিসিভড করছে না এখন দরজা বন্ধ নিশ্চয় কোনো ঝামেলা হয়েছে। শান দরজায় নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারল সাথে সৃজনও। দুই তিনবার জোরে জোরে ধাক্কা মারার পরই দরজার লক ভেঙে গেল আর সবাই ভিতরে ডুকে গেল।ভিতরে ডুকেই ওরা তিনজনই শকড হয়ে গেল।

সৃজন সোহার ওড়নাটা একটানে খুলে নিয়েছে আর যখনই নিজের হাত দিয়ে সোহাকে স্পর্শ করতে যাবে তার আগেই শান এসে রায়ানের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। রায়ান চমকে গিয়ে শানের দিকে তাকিয়ে রইল।
“তুই এখানে?”
কথাটা বলতেই শান রায়ানকে টেনে নাক বরাবর একটা ঘুশি দিতেই রায়ান উল্টে পড়লো। শানের রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে। শান রায়ানকে ইচ্ছা মতো লাথি ঘুশি দিতে থাকলো। আর চিৎকার করে বললো,

“কু***বা*** তোর সাহস হলো কি করে আমার কলিজার গায়ে হাত দেওয়ার। তোকে বলেছিলাম না আমার সোহার থেকে দূরে থাকবি। এতো সাহস কোথায় পেলি। যেই হাত দিয়ে আমার সোহাকে স্পর্শ করতে যাচ্ছিলি ঐ হাতটা আমি আজকে ভেঙেই ফেলবো। ”

শান কথা গুলো বলছিল আর রায়ানকে মারছিল। শানের ইচ্ছা হচ্ছে রায়ানকে মেরেই ফেলে। শানের চোখ থেকে আগুনের গোলা ঝরছে। তানিশা আর সৃজন জাস্ট স্পিচলেস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা নিজেরাও বুঝতে পারছেনা এসব কি হচ্ছে। ওরই কাজিন ওর ফ্রেন্ডের সাথে ছিছি ভাবতেও তানিশার শরীর শিউরে উঠছে।যেই ছেলেটাকে ওদের বাড়ির সবাই আদর্শ ভাবে। এতো ভালোবাসে সে এমন বিশ্বাসই করতে পারছেনা তানিশা। তানিশা দ্রুত সোহার কাছে এগিয়ে গেলো। সোহার গায়ে ওড়নাটা ভালো করে দিয়ে দিলো। শান রায়ানকে মারতে মারতে পুরা আধমরা করেই ফেলেছো প্রায়। তখনই দৌঁড়ে গিয়ে সৃজন শানকে ধরল,

“ভাইয়া ছেড়ে দিন এভাবে মারলে মরে যাবে ও। ”
শান রাগি কন্ঠে বললো,
“মরে যাক। ওর সাহস হলো কি করে আমার সোহার ক্ষতি করার। ”
তখনই তানিশা দৌড়ে এলো,
“ভাইয়া ছেড়ে দিন ওকে। বাসায় অনেক মানুষ। এই ঘটনা জানাজানি হলে সোহারই বদনাম হবে সাথে আমাদের ফ্যামিলিরও তাই আপনার কাছে অনুরোধ করছি ভাইয়া। আজকের পর থেকে রায়ান ভাই আর কখনো সোহার আশেপাশেও যাবে না আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। ”

শান একটু শান্ত মাথায় কথাটা ভাবলো। তারপর রায়ানকে আরেকটা লাথি মেরে চলে গেল। রায়ানের পুরো রক্তারক্তি অবস্থা। শান সোহার কাছে গেল পাশে পানির জগ থেকে দুই তিনবার পানির ছিটা দিল বাট নো রেসপন্স।

“সোহা। এই সোহা তাকাও না প্লিজ। ”

শান দুই তিনবার গালে হাত দিয়ে ডাকলো কিন্তু তাও তাকালো না। সৃজন বললো,
“ভাইয়া আমার মনে হয় ও সোহাকে কোনো ঘুমের মেডিসিন টাইপ কিছু দিয়েছে আপনি ওকে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে জান। ”

সৃজনের কথাটা শুনে শান দ্রুত পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো সোহাকে। তানিশা ওদের বাড়ির পিছনের গেইট দিয়ে বের করে দিলো শানকে যাতে কেউ না দেখে। শান যাওয়ার আগে তানিশা আর সৃজনকে বলে গেলো,

“এই কথা যেন সোহা কখনো জানতে না পারে। ”

ওরা চোখের ইশারায় বুঝালো বলবে না।সৃজন গাড়ির দরজা খুলে দিলো শান সোহাকে গাড়ির ভিতরে শুইয়ে দিলো। তারপর গাড়ি ড্রাইভ করে শানের ফার্ম হাউজে চলে গেল কারণ এখন বাসায় নিয়ে গেলে মা বাবাট প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তখন কও বলবে শান? শান শুধু বাসায় ফোন করে বলে দিলো ওরা আসতে পারবে না অনেক রাত হবে তাই ফার্ম হাউজে চলে যাবে কেউ যেনো অপেক্ষা না করে।

শান সোহাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এসে একটা বিছানায় শুইয়ে দিলো। গাড়িতে আসতে আসতে ডাক্তারকে কল করে দিল। কিছুক্ষনের মধ্যে ডাক্তার এসেও গেল। সোহাকে একটু চেকাপ করে ুকটা ইনজেকশন দিয়ে দিল।
“আপনার ওয়াইফের শরীরে অনেক হাই ডোজের ঘুমের ঔষুধ প্রবেশ করানো হয়েছে তাই আজকে আর জ্ঞান ফিরবে না। তবে ভয়ের কিছু নেই কাল সকালে উনি সম্পূর্ন সুস্থা হয়ে যাবে। ”

কথাটা বলেই ডাক্তার চলে গেল। শান দরজাটা আটকে গিয়ে সোহার পাশে বিছানায় বসল। কি নিষ্পাপ, পবিত্র মেয়েটি যাকে কিনা ওই জানোয়ারটা অপবিত্র করতে চেয়েছিল ভাবতেই শানের রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। আজকে আরেকটু দেরী হলেই সব শেষ হয়ে যেতো।শানের চোখে পানি ছলছল করছে। একফোঁটা পানি গড়িয়েও পড়ল সোহার মুখের উপর।শান সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা কিস করলো।আর মনে মনে ভাবল,

” না আজকের মতো আর ভুল আর জীবনে করবো না জান। আর কখনো আমার জানপাখিকে একা কোথাও যেতে দিবোনা। সবসময় ছায়ার মতো সাথে থাকবো যাতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে না পারে এটা প্রমিজ রইলো সুইটহার্ট।”

শান সোহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।সারারাত শান সোহার পাশেই বসে ছিল। সোহাকে এক নজরে দেখতে থাকলো। দেখতে দেখতেই যে কখন সোহার পাশেই ঘুমিয়ে গেল সেটা বুঝতে পারছে না শান।


সকাল চোখ খুলতেই শানকে আমার পাশে শুটিশুটি হয়ে একহাতে আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে একটু শকড হয়ে গেলাম। শান এখানে কি করছে?আমি শোয়া থেকে উঠবো কিন্তু মাথাটা প্রচুর ব্যাথা আর ভার লাগছিলো।আমি এক হাত দিয়ে আমার মাথায় হাত দিলাম। আস্তে আস্তে শানের হাতটা আমার শরীরের উপর থেকে সরিয়ে দিলাম। তারপর উঠে বসলাম। চোখ কচলে একবার চারদিকে তাকালাম আরে এটা কোথায় আমি?এটা তো তানিশার বাড়ি না আর না আমাদের। বাড়ি তাহলে কোথায়। আরেকটু মনোযোগ সহকারে দেখতেই সোহার মনে হলো আরে এটা তো শানদের ফার্ম হাউজ আমরা এখানে কেন? আমার খটকা লাগলো। কালকে রাতে তো আমরা তানিশাদের বাসায় ছিলাম তাহলে এখানে এলাম কখন। আমি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগলাম কালকে জুসটা খাওয়ার পরই আমার শরীর খারাপ লাগছিলো। তারপর ওয়াসরুমে গেলাম আর তারপর? তারপর কি হয়েছিল?অনেক মনে করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই পারলাম না।

শান চোখ না খুলেই হাত বাড়িয়ে দেখল সোহা আছে কিনা? কিন্তু যখন দেখল নেই শান ভয় পেয়ে গেল আর ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠে গেল। উঠেই খেয়াল করল সোহা ওর পাশে বসে মাথায় হাত দিয়ে। শান সোহার কাঁধে হাত দিলো।

আমি মাথায় তুলে তাকালাম। শান আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কি হয়েছে? এখন শরীর কেমন আছে?”
আমি শানের দিকে অবাক হয়ে বললাম,
“শরীরের আবার কি হবে? আআ্ছা আমরা এখানে কেন? আমরা তো কালকল তানিশার বাসায় ছিলাম? আপনি কখন গেলেন? আমার কিছু মনে নেই কেন? ”

শান আমার কথা শুনে খানিকটা হাসল। শানকে হাসতে দেখে বললাম,
“আমি হাসার মতো কি বললাম?”
“না আসলে একসাথে এতো প্রশ্ন করছো তো তাই ভাবছি কোনটা আগে বলবো।”
আমি বিছানা থেকে নেমে গলা উঁচিয়ে বললাম,
“সবটা বলবেন। ”
শান আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“হুম বলবো। তার আগে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নেও ভালো লাগবে। ”
“আগে আপনি বলুন। ”
শান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,
“কালকে হয়তো কিছু ভুলভাল খেয়ে নিয়েছিলে তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে একটু এজন্য মনে নেই। ঐ অবস্থায় তো আর বাসায় যাওয়া যেত না তাই এখানে নিয়ে এলাম এবার খুশি শুনে নিয়েছো। ”

আমি একটু হেসে মাথা নাড়ালাম। শান বললো,
“ওকে এবার গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসো। ”

শানের কথা শুনে আমিও আলে গেলা আমার এখন এমনিতেও একটু ফ্রেস হতে হবে শরীর অনেক খারাপ লাগছে। গোসল করলে যদি ভালো লাগে।বাট পড়বো কি? আমি আবার পিছন ঘুরে তাকালাম,

শান বললো
“আবার কি?”
“আচ্ছা আমি পড়বো কি?কিছুই তো নেই এখানে।”
শান তখন কিছু একটা ভাবল তারপর কাবার্ডের কাছে গিয়ে একটা শাড়ী বের করে নিয়ে এসে আমাকে দিলো,
“নেও এটা চলবে কিনা দেখো।”
“চলবে মানে দৌঁড়াবে বাট আপনি এটা কোথায় পেলেন। ”
“কিনেছিলাম কই পাবো?”
আমি ভ্রু নাচিয়ে বললাম,
“কার জন্য? ”
শান হেসে বললো,
“আমার বউ পাখিটার জন্য এখন যাও গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসো। ”

শানের মুখে বউ ডাকটা শুনে আমার হৃদয়ে একটা সুখের পরশ ছুয়ে গেল আর চোখে মুখে খুচি ফুঁটে উঠলো। আমি লজ্জা পেয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম আর শান আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

আমি ফ্রেস হয়ে এসে দেখি শান মোবাইল টিপতেছে। আমি মাথা মুছতে মুছতে গিয়ে বললাম,
“আমার খুদা লাগছে? কিছু আছে খাওয়ার মতো।”
শান কিছু একটা ভুলে যাওয়ার ভান করে মাথায় হাত দিয়ে বললো,
“ইশ একদমই ভুলল গেছি। আচ্ছা তুমি বসো আমি খাবার অর্ডার করে দিচ্ছি। ”

শান হাতে ফোন নিতেই আমি ফোনটা কেড়ে নিলাম। শান ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার? ”
“খাবার অর্ডার দেওয়ার দরকার নেই আমি খাবার বানিয়ে দিচ্ছি। ”
শান রাগান্বিত হয়ে বললো,
“কোনো দরকার নেই রান্না করার। ঐদিন হাত পুড়িয়ে ছিলে মনে আছে? ”
“আরে কিছুই হবে না। আমি রান্না করব প্লিজ প্লিজ। ”
“ওকে বাট আমি ও রান্না করব তোমার সাথে। ”
আমি টাস্কি খেয়ে বললাম,
“আপনি?”
শান মুচকি হেসে বললো,
“হুম।”
“আপনি রান্না পারেন? ”
“পারিনা তবে তোমার থেকে শিখব।”

আমি হো হো করে হেসে দিলাম। উনিও আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমরা দুজনেই রান্নাঘরে চলে গেলাম।প্রথমে মাছটা কাঁটাকাঁটি করে নিলাম আর উনি নাক মুখ সিটকে রইলেন হঠাৎ বললেন,
“তোমরা মেয়েরা এমন অসম্ভব কাজ গুলো করো কিভাবো বলোতো?সেটা আমরা পারিনা কেন?ঐদিন যো অবস্থা হলো এই কাজটা করতে।”
উনার কথা শুনে আমি খিলখিলিয়ে হেসে দিলাম,
“উত্তর তো আপনি দিয়ে দিলেন আমরা মেয়ে বলেই পারি আর আপনারা ছেলে বলে পারেন না সিম্পল। ”

আমি উনাকে একটা একটা সবজি এগিয়ে দিতে বললাম আর উনি দিচ্ছিলেন। আমি সবজি গুলো কাঁটার জন্য ছুড়ি হাতে নিতেই উনি বললেন,
“আমিও কাঁটবো?আমাকে শিখাও।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“দুটো ছুড়ি তো নেই কিভাবে শিখাবো?”

তখনই উনি আমার হাত ধরে টান দিয়ে উনার কাছে টেনে নিলেন। আর আমাকে পিছন দিল থেকে ঘুরিয়ে উনি আমাকে পিছন দিকে থেকে জড়িয়ে ধরলেন আর আমি যেই হাতে ছুড়ি ধরলাম ঐ হাতের উপর উনার হাত রাখল। আমি শিউরে উঠলাম উনার এহেন কর্মকান্ডে। আমার বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো। শান বললো,
“নেও এইবার শিখাও।”
আমি কাঁপা কন্ঠে বললাম,
“এভাবে কিভবাে শিখাবো। তাহলে তো আপনাকে সামনে আসতে হবে। ”
শান আমার কানে ফিসফিস করে বললো,
“আমি তোমায় জড়িয়ে আছি তো আই মিন হাত ধরে আছি তো তাহলেই হবে।”

আমি বেহায়ার মতো উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর উনি হাসছিলেন। উনার গায়ের স্মেলটা আরো পাগল করা। উফ আমি দিন দিন এতো বেহায়া হয়ে যাচ্ছি কেন কে জানে? তাহলে কি এটা প্রেমে পড়ার লক্ষন।ভাবতেই বুকটা সমান তালে কাঁপতে লাগলো।


সময় স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। সেটা নিজ গতিতে চলতে থাকে। দিনেরপর দিন গিয়ে সেটা মাস হয় এবং মাসের পর মাস গিয়ে হয় বছর। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। কেউ সময়ের তালেমখুজে পায় নিজের আপন মানুষ আর কেউ হারিয়ে ফেলে। এভাবেই আমাদের জীবন চলছে।

আমাট জীবনও ব্যতিক্রম নয়। দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের তিনমাস চলে গেল। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখে,বিপদে- আপদে সবসময় যেমন পাশে ছিলাম তেমনই আছি।এই তিনমাসে আমাদের সম্পর্কের বাধনটা আরো শক্ত হয়েছে। আমরা এখন বিশ্বাস করি একে অপরকে নিজেদের থেকেও বেশী। যেখানে চাইলেও কেউ ফাঁটল রাতে পারবে না। এখন আমরা স্বামী-স্ত্রীর থেকে বেশী খুব ভালো বন্ধু। এমন বন্ধু যার সাথে সব শেয়ার করা যায়। কি অদ্ভুত না একজন আরেকজনকে একডময় সহ্যই করতে পারতাম না আর এখন তাকে ছাড়া জীবনটা যেন শূন্যই লাগে।

এই তিনমাসে আমাদের সম্পর্কের বাঁধনটা আরো শক্ত হলেও নিজের লক্ষ্যটা পূরণ করতে পারিনি। এখনও পর্যন্ত আপু আর আরশ ভাইয়াকে সবার সামনে আনতে পারিনি। না কাউকে জানাতে পেরেছি। শানকেও অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম বলার কিন্তু প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো ঝামেলায়,আর বলা হয়ে উঠেনি। তবে আজকে সাহস করে চলেই এলাম আপুদের সাথে দেখা করতে যেটা এতোদিন চেয়েও পারিনি। আধঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি বাট কারোই আসার কোনো নাম নাই। আমি প্রচুর বিরক্ত হয়ে গেলাম আর মনে মনে দুটোকেই বকতে লাগলাম।হঠাৎ খেয়াল করলাম দুজনেই ভিতরে আসছে। আপু আমাকে দেখেই দৌঁড়ে এলো এসেই জড়িয়ে ধরল,

“কেমন আছিস সোনাকতদিন পর দেখা। ”
আমি কিছুটা অভিমাণ নিয়েই বললাম,
“এতোটা ওয়েট করানোর পর মনে পড়ল আমার কথা। ”
আরশ ভাইয়া বললো,
“আরে না আমাদের কোনো দোঢ নাই গাড়িতেই লেইট করে ফেলছি। যাই হোক স্যরি।”
আমি মুখ গোমড়া করেই বললাম,
“না এতে হবে না। ”
স্মৃতি আপু অবাক হয়ে বললো,
“তাহলে?”
আমি হাত বাড়িয়ে বললাম,
“আমার ঘুশ দেও আগে। ”
আটর ভাইয়া হতাশ হয়ে বললো,
“আল্লাহ আমি তো ভুলেই গেছি এখন? ”
“হুম এখন তো বউ পেয়েছো আমাকে মনে রাখার কি দরকার।”

আমও অন্যদিকে ফিরেই মুখ গোমড়া করে রইলাম তখনই আরশ ভাইয়া পিছন থেকে চারটা চকলেট বের করে আমার সামনে রাখল।আমার চোখে মুখে হাসি ফুটে রইল। আমি দ্রুত ছোঁ মেরে নিয়ে নিলাম,

“উফ এতোদিন কি যে মিস করছি। ”
স্মৃতি আপু হাসল। আমি বললাম,
“কিন্তু চারটা কেন? তুমি তো সবসময় দুইটা আনতে?”

আরশ ভাইয়া বললেন,
“বারে খালি হাতে কি করে আসবো দুটো আমার শালীকার জন্য আর দুটো ভাবী। ”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“না ভাবী বলো না আমি তোমার শালীকাই ঠিক আছি। ”
“উহুম এখন তো না চাইলেও তুমি আমার ভাবীই। আমি অনেক খুশী হয়েছিলাম শুনে যে শান ভাইয়া আর তুমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছো। এটা ভাবলে ভালোই লাগে যে আমরা পালিয়ে ভালোই করেছি। ”
“একদমই ভালো করোনি শুধু শুধু একটা খারুচ, পাগল, বদমেজাজি লোকের সাথে আমাকে বেঁধে দিয়েছো। ”
স্মৃতও আপু আমাকে চোখ দেখিয়ে বললো,
“এমন বলতে আছে উনি তোর স্বামী হয় না। তুই আর কখনো চেন্জ হলি না সেই বাচ্চাই রয়ে গেলি। কোথায় ভাবলাম এসে দেখবো এই তিনমাসে আমাদের সোহা পাক্কা গৃহীনি হয়ে যাবে বাট কোথায় কি? ”
আমি চকলেট খেতে খেতে বললাম,
“ওটা আর পসিবল না এটা তোমাট স্বপ্নই রয়ে যাবে।”

আমার কথা শুনে আপু আর আরশ ভাইয়া একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। আমি বেশ বুঝতে পারলাম এদের ছোট্ট হৃদয়ে কথাটা নিতে পারেনি। আমি টেবিলে একটা বাড়ি মেরে বললাম,

“তোমাদের একে অপরকে দেখা শেষ হলে এইবার কাজের কথায় আসি। ”

ওরা দুজনেই মাথা নাড়ালো,
“তোমরা বিয়ে করেছো?”
আরশ ভাইয়া বললো,
“না সেই সৌভাগ্য হয়নি। ”
আমি একটা স্বাস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
“আল্লাহ বাঁচাইছে এট লিষ্ট এই একটা কাজ ভালো করেছো। ”

ওরা দুজনেই অবাক হয়ে একসাথে বললো,
“কেন?”
আমি এক হাত কপালে রেখে বললাম,
“সবাই তোমাদের উপর কি পরিমান রেগে আছে ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া। ”
কথাটা শুনেই দুজনে হতাশ হয়ে বললো,
“তাহলে এখন কি হবে কেউ কি আমাদের মেনে নিবে না। ”
“হুম নিবে তবে তার আগে তোমাদের যার যার বাসায় ফিরে যেতে হবে আর আমি যেভাবে বলবো সেভাবে করতে হবে তাহলে কিছু হতে পারে। ”

ওরা দুজনই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।

ওদের সাথে আরো কিছু কথা বললাম। হঠাৎ আমি চকলেট মুখে নিয়ে পিছনে ঘুরতেই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেলাম মাথা তুলে উপরে তাকাতেই আমার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।সাথে আপু আর আরশ ভাইয়ার ও একই অবস্থা। আমি অজান্তেই বলে ফেললাম,

“শান। ”
.
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে