#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
মৃদু জলের ছিঁটায় জ্ঞান ফিরলো আদিরার। আদিরার পাশে বসা দু’টো মেয়ে। দু’জনেই উৎকণ্ঠিত হয়ে আদিরার চোখ খোলার আশায় আছে। পিটপিট করে মুদিত আঁখিজোড়া মেলল আদিরা। আদিরাকে চোখ মেলতে দেখে মেয়ে দুটোর থেকে সুমি নামে একজন উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠে,
–যাক আলহামদুলিল্লাহ চোখ মেলেছে। মারসাদকে ডাক দে তো মৌমি।
মৌমি মারসাদকে ডাক দিতে যায়। সুমি আদিরার ওড়না ঠিক করে দেয়। আদিরা কোথায় আছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে তারপর উঠে বসে। মৌমির থেকে খবর জানতে পেরে মারসাদ অডিটোরিয়ামের ভিতরে যেতে নিলে আহনাফ মারসাদের হাত ধরে আটকিয়ে বলে,
–ভিতরে গিয়ে শান্ত হয়ে কথা বলবি। মেয়েটা তোর কারণেই অসুস্থ হয়েছে মনে রাখবি। চল।
মারসাদ মৌন সম্মতি দেয়। ভেতরে গিয়ে মারসাদ সহ আহনাফরা আদিরার সামনে দাঁড়ায়। মারসাদ পকেটে হাত গুঁজে নম্র কন্ঠে বলে,
–এখন ঠিক আছো?
আদিরা মাথা নিচু করে আছে। মারসাদের কথার প্রতিউত্তর সে ঘার এলিয়ে দেয়। মারসাদ কন্ঠের স্বাভাবিকতা রক্ষা করে সুধায়,
–আমার সাথে ডান্সে পার্টিসিপেট করলে সমস্যা কী?
আদিরা জড়োসরো হয়ে বসে আছে। নতমস্তকে আড়চোখে একবার মারসাদকে দেখে নিলো অতঃপর মৌন রইল। কিন্তু মারসাদের অতীব উৎসুক ও অধৈর্য মনভাব কি আর মৌন থাকতে দেয়? আদিরা ভীত স্বরে বলল,
–আমি গ্রাম থেকে এসেছি পড়াশোনার জন্য। আমি নাচ জানি না। জীবনে ভেজাল নামক পরগাছাকে আর যুক্ত করতে চাই না।
মারসাদ ধাতস্থ হলো। একটা বেঞ্চ টেনে বসে খুব শান্ত স্বরে বলে,
–ঝামেলাহীন জীবন হয় না আদিরা। প্রতিটা মানুষের জীবনে বহু চড়াই উৎরাই পার করতে হয়। এরপর সফল হলে সেই সফলতাতে অন্যরকম এক জয়ের আভাস পাওয়া যায়। কারও জীবন ভেজালহীন হয় না। তুমি জড়াতে না চাইলেও সেটা নিজ থেকে জড়িয়ে যাবে।
আদিরা চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। আদিরার পাশে সুমি চুপচাপ আদিরার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছে। মারসাদ উঠে দাঁড়িয়ে কপালে পরে থাকা চুল গুলো নাড়তে নাড়তে বলে,
–তোমাকে আমার সাথে দুই মিনিটের জন্য হলেও ডান্স করতেই হবে। তোমার জন্য আমি সবচেয়ে সহজ ডান্স স্টেপ চুজ করবো। আর এতে হার-জিতের কোনো প্রশ্ন নেই। সো বি রেডি। তোমার ক্লাস সকাল দশটায় তাই না? এখন বাজে নয়টার মতো। আধঘণ্টা প্র্যাকটিস করে তারপর ক্লাসের জন্য বের হবে। দশ মিনিট রেস্ট করো। এরপর বিকেলে আবার কিছুক্ষণ প্র্যাকটিস করবে।
সুমি, মৌমিকে ও রাত্রীকে আদিরার কাছে রেখে মারসাদরা বেরিয়ে যায়। আহনাফ বাহিরে গিয়ে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে মারসাদের মুখোমুখি হয়ে বলে,
–যাক তোর রাগে কন্ট্রোল ছিল। নাছোড়বান্দা তুই যে ওই মেয়ের সাথেই ডান্স করবি সেটা তোর জেদ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আজ যেমন সুন্দর করে বলেছিস তেমনি সুন্দর ব্যাবহার করবি। তাহলে কেউ তোকে ভয় পাবে না আর আমিও একটু শান্তিতে প্রেম করতে পারবো!
শেষের লাইনটা আহনাফ বিড়বিড় করে বলে। আহনাফ কাউকে ভালোবাসে অনেকগুলো বছর ধরে। সেই মেয়েটির সকল বেখেয়ালি মনোভাব সে ভালোবাসে। সকল দুষ্টুমি সে ভালোবাসে। এলোকেশী মেয়েটি তার অর্ধ যুগের প্রেম।
মারসাদের আরেক বন্ধু মৃদুল চিন্তিত স্বরে বলে,
–কিন্তু দোস্ত ওই সামিরা? তোদের ডান্স পার্টিসিপেট নষ্ট করতে আদিরাকে কিছু করবে নাতো? মেয়েটা অনেক সরল। সামিরা আবার কী করবে কে জানে!
রিহান হাই তুলতে তুলতে বলে,
–কী আর করবে! একটু পর মারসাদ বেবি! মারসাদ বেবি! করতে করতে এখানে এসে ঝুলে পরবে। শা*লি চিপকু কাহিকা।
মারসাদ সহ সকলে হেসে উঠে কিন্তু একজন বাদে। বেচারা মুখ দিয়ে নখ কাটছে খুব অস্থিরতার সাথে। মৃদুল ওকে ধা’ক্কা দিলে সে হকচকিয়ে উঠে। মৃদুল মুখ লটকিয়ে বলে,
–কি-রে ভাবুক ভদ্র ছেলে রবিন? এতো সুন্দর করে মুখকে নেইলকাটার বানাতে কে বলছে? নখ গুলোকেও কী সুন্দর ক্যাটরিনা কাইফ শেইপ দিচ্ছিস। তা বলি আপনি কী এই গ্রহে আছেন না-কি চলিয়া গিয়াছেন?
রবিন ভয়ে ভয়ে বলে,
–সাগরর! সামিরা যদি সাগরকে দিয়ে কিছু করায়? মারসাদ তো সেচ্ছায় ভিপির জন্য দাঁড়াবে না। সাগর কিন্তু দাঁড়াবে। আর আশিক ভাইয়ের সাথে সাগরের ভালোই সখ্যতা।
রবিনের ভাবনা অহেতুক নয়। ভিপি আশিকের সাথে সাগর ভালোই ভাব জমাচ্ছে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে (ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে গেলে ভিপির পদ অন্যকাউকে দিতে হয় এটাই জানি)। আর সাগর সামিরাকে পছন্দও করে। আহনাফ ডোন্টকেয়ার মুডে বলে,
–মারসাদের বদলে আমি দাঁড়াবো। মারসাদ একেবারে দাঁড়াবে না এটা বলে নি। মারসাদ শুধু ভিপি হতে চায় না। কিন্তু আমি দাঁড়াবো। সাগর যদি ভিপি হয় তবে মেয়েদের জীবন শেষ করে দিবে। সাইন্সের সকল বিভাগ থেকে আমি দাঁড়াবো। বাকিগুলো থেকে কে দাঁড়াবে জানি না। মারসাদকে সাইন্স গ্রুপ থেকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। এরপরই সে জানায় দেয় সে হবে না। তবে ব্যাপারটা সাগর পর্যন্ত কে নিলো বুঝলাম না। সামিরা নয়তো?
মারসাদ সামনের ছোট দেয়ালের উপর উঠে বসে মুক বাঁকিয়ে বলে,
–উহু। সামিরা এই ব্যাপারে জানে না। আর আশিক ও রাসেল ভাইয়ের বলার কথা না। যেই বলুক আর সাগর জানলেও আমাদের সমস্যা নেই। আশিক ও রাসেল ভাই রাজি হয়েছেন তোকে আমার জায়গায় দিতে। সো চিল। কাল তো আর্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে দ্বিতীয় বর্ষের কয়েকজন ছেলে মেয়ে এসে সাগরের নামে বিচার দিলো। ওরা এখনও জানে না আমি তোকে আমার জায়গা দিবো। তবে ব্যাপার না। আমার বেস্টফ্রেন্ড আমার চেতনার প্রতিচ্ছবি।
পনেরো মিনিট পর মারসাদ অডিটোরিয়ামের ভিতরে যায়। আদিরাকে প্রথমে ডান্স স্টেপ সুমি ও মৌমি দেখায়। খুব সহজ স্টেপ। আদিরাকে এতক্ষণ ওরা বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করিয়েছে। ডান্স স্টেপের জন্য মারসাদ আদিরার হাত ধরলে আদিরা কেঁপে উঠে যা দেখে মারসাদ বাঁকা হাসে। এরপর খুব কম ছুঁয়ে প্র্যাকটিস করে। আদিরা ততোক্ষণ দম আটকে ছিল। প্রতিটা স্টেপে সে চোখ মুখ খিঁচে ছিল। স্টেপ শেষ হওয়ার সাথে সাথে আদিরা অডিটোরিয়াম থেকে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। মারসাদ বাঁকা হেসে জোড়ালো স্বরে আদিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–বিকেলে যদি তোমাকে এখানে না পাই তবে তোমার মেস থেকে তোমাকে তুলে আনবো মেয়ে। মনে রেখো। ভদ্র মেয়ের মতো চলে আসবা।
আদিরা কথাটা শুনলো। তার হৃৎপিন্ড দ্রুত গতিতে চলছে। অডিটোরিয়ামের বাহিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দশটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি। আদিরা ক্লাসেই যায়। লাইব্রেরীতে আর যাওয়া হলো না। ক্লাসে গিয়ে মাঝামাঝি সিটে বসে। হাতে গোনা দশ-বারো জন বাদে সবাই ক্লাসের বাহিরে। ক্লাসের আগে দিয়ে আসবে। আদিরা জানালা দিয়ে অদূরে কড়ই গাছটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কড়ই গাছে সাদা গোলাপির মিশ্রণে ফুলগুলো তার বরাবর ভালো লাগে। ছোটোবেলার বহু স্মৃতি আছে এগুলো নিয়ে। এসব ভাবতে ভাবতেই ক্লাসের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কেউ একজন তার পাশে এসে হড়বড়িয়ে বসে তাকে স্পর্শ করে ডাক দিয়ে বলে,
–হেই তুমি আদিরা? কেমন আছো আদিরা?
আদিরা চমকে তাকালো। ভাবনার ব্যাঘাত ঘটায় চমকে গিয়েছিল। নিজেকে আত্মস্থ করে হাসি মুখে জবাব দেয়,
–আসসালামু আলাইকুম আমি আদিরা। আপনি কে?
মেয়েটা তার স্বভাবসুলভ হাসলো। তারপর আদিরার গাল টেনে বলল,
–তুমি তোমার নামের মতোই কিউট। একদম পিচ্চি পিচ্চি মায়াবি। ফর্সা না হলেও তোমাকে পুতুলের মতো লাগে। উজ্জ্বল বর্ণে চিকচিক করে। তোমাকে আমি আমার ক্যানভাসে আঁকবো। তোমাকে দেখাবো। সোনালি আভা তোমার মুখশ্রীতে।
আদিরা অবাক হয়। এভাবে তার প্রশংসা কেউ করে নি। তার মা বলতো, আদিরাকে নাকি রোদ ও বৃষ্টিতে পরীর মতো লাগে। কিন্তু মায়েদের কাছে তো নিজের সন্তান সবসময় সুন্দর। আদিরা মেয়েটিকে মুচকি হাসি উপহার দেয়। পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে বলে উঠে,
–মাহি, আমাকে একটা এঁকে দিবে? আমার তোমার ছবি গুলো খুব ভালো লাগে।
মাহি খুশি মনে বলে,
–অবশ্যই কেন নয়। তবে আমি কিন্তু আমার ফ্রেন্ড ও ক্লোজ ছাড়া কারওটা আঁকি না। আর সবাইকে ফ্রেন্ড বানাইও না। তবে তোমাদের আমার খুব খুব ভালো লেগেছে। লেটস ফ্রেন্ডস।
ওরা ফ্রেন্ডশিপ করে নেয়। ক্লাসে টিচার আসলে ওরা ক্লাসে মনোযোগ দেয়।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,