এক শহর প্রেম পর্ব-০২

0
1887

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সামনে থাকা বেঞ্চে সজোরে লা থি দিয়ে ফেলে দিলো মারসাদ। অডিটোরিয়ামের উপস্থিত সকলে ভয়ে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে নিজ নিজ স্থানে থেমে যায়। মারসাদ ইশরাকের রাগের পরিসীমা কতোটুকু এটা সকলেরই জানা। এক বছর আগেও এই অডিটোরিয়াম সাক্ষী ছিল তার রাগের। মারসাদ হুংকার ছেড়ে বলে,

–ওই মেয়েটাকে এই মূহুর্তে আমার সামনে দেখতে চাই। ওর এতো বড়ো সাহস যে মারসাদের কথা উপেক্ষা করে! সেলিম যা জুলোজি ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস থেকে খুঁজে নিয়ে আয় ওই মেয়েকে।

মারসাদের চিৎকারে সেলিম বিনা প্রতিউত্তরে বেরিয়ে যায় আদিরাকে খুঁজতে। সেলিম মারসাদের এক ব্যাচ জুনিয়র। মারসাদকে অনেক সম্মান করে। তাছাড়া সেলিমের বাবার কিডনির অপারেশনের টাকা মারসাদ নিজে দিয়েছে। সেলিম অনেক কৃতজ্ঞ মারসাদের প্রতি।
সেলিম বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে অডিটোরিয়ামে সামিরার আগমন ঘটে। সামিরা অট্টহাসি ও হাতে তালি দিতে দিতে অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে। মারসাদ সামিরাকে দেখে দাঁতে দাঁত চিপে হাত মুঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। সামিরা মারসাদের সামনে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্য হাসে তারপর বলে,

–দেখলে তো? মেয়েটা তোমাকে পাত্তাই দিলো না। এখনও সময় আছে মারসাদ বেবি। আমাকে ডান্স পার্টনার বানাও। ওসব সস্তা থা’র্ডক্লাশ মেয়েদের পেছোনে পরে থেকে নিজের পারফরমেন্স নষ্ট করো না। উই বোথ ক্যান বি এ গ্রেট কাপল লাইক বিফোর।

মারসাদ সামিরার দিকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে হিঁসহিসিয়ে বলে,

–নেভার এভার এগেইন। জাস্ট স্টে এওয়ে ফর্ম মি। আমাকে রাগিও না। নিজের লেহাজে থাকো। ভুলে যেও না তোমাকে সহ্য করার কারণ কী!

মারসাদ আরেকটা বেঞ্চ ধা’ক্কা দিয়ে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে যায়। পথিমধ্যে সেলিম ভয়ে ভয়ে জানায়,

–ভাই, পুরো জুলোজি ডিপার্টমেন্ট ফাঁকা। কেউ নেই। মনে হয় মেয়েটা চলে গেছে।

মারসাদ রাগে দেয়ালে ঘু’ষি মারে। মারসাদকে শান্ত করতে পারবে এখন তার বেষ্টফ্রেন্ড আহনাফ ও মারসাদের ছোট বোন মাহি। কিন্তু মাহি এখন চারুকলা ভবনে। সুযোগ পেলেই মাহিরা চারুকলা ভবনে চলে যায় ছবি আঁকতে এবং তখন নিজের ফোন বন্ধ করে রাখে। মাহিও এবার এই ভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হয়েছে জুলোজি ডিপার্টমেন্টে। উপায় না পেয়ে আহনাফকে ডাকতে ফুটবল মাঠে দৌড়ে যায় একজন।

______

আদিরা পায়ে হেঁটে ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে বহুকষ্টে ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট সে এই গলি থেকে ওই গলি খুঁজে বেরিয়েছে। এতো বড়ো বড়ো অট্টালিকার ভীরে ছোট্ট চড়ুইপাখির মতো সে। আদিরা স্টুডেন্টের বাসার ড্রয়িংরুমে বসে আছে। পড়ানোর সময় বিকেল পাঁচটা। আদিরা স্টুডেন্টের মাকে আস্তে করে ডাক দিয়ে বলে,

–আন্টি কিছু মনে করবেন না। আমাকে নামাজের জন্য একটা জায়নামাজ দিবেন? আসলে আমি ভার্সিটি থেকে মেসে গিয়ে নামাজটা পড়ে আসতাম কিন্তু আজ প্রথমবার আসবো আর চিনিও না তাই আরকি..

স্টুডেন্টের মা খুশিমনে আদিরাকে ভেতরের রুমে নিয়ে যায় তারপর নামাজের জায়নামাজ দেয়। আদিরা সেখানে নামাজ আদায় করে নেয়। এরপর আদিরা তার ক্লাস থ্রি তে পড়ুয়া স্টুডেন্টকে পড়ায়। পড়ানো শেষে স্টুডেন্টের মা আদিরাকে বলে,

–তুমি যদি সপ্তাহে চারদিন একটু বেশি সময় নিয়ে পড়াও তবে আমি তোমাকে আরও দেড় হাজার টাকা বাড়িয়ে দিবো। যে তোমাকে ঠিক করে দিয়েছে সে সপ্তাহে তিন দিন ঘরি ধরে এক ঘন্টা পড়াবে বলেছিল। তাই আমি কম করে বেতন বলেছি। জানি একটু বেশিই কম হয়েছে তবে ক্লাস থ্রির বাচ্চার ছয়টা সাবজেক্ট এক ঘন্টায় কভার করা সম্ভব না। তারউপর মাত্র তিন দিন পড়াবে। তুমি যদি সপ্তাহে চার দিন কম করে হলেও দেড় ঘন্টা করে পড়াও তবে আমি তোমাকে চার হাজার টাকা করে দিবো। রাজী তুমি?

আদিরার মনে ইদের চাঁদ দেখার মতো খুশির ঝিলিক। তার জন্য তবে ভালোই হয়। আরেকটা টিউশন জোগাড় করতে পারলে সে বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতে পারবে। যে মেসটাতে থাকে সেখানে এক রুমে ৬ জনের মতো থাকে তাই ভাড়া কম লাগে। আদিরা রাজী হয়ে যায়।

টিউশন শেষে আদিরা মেসে ফিরে ক্লাসের পড়া যেটুকু নোট করতে পেরেছে সেটুকু পড়ে নেয়। বই কেনার টাকা জোগাড় হয় নি এখনও। লাইব্রেরি থেকে এখন নিয়ে নিয়ে পড়তে হবে।

_____পরেরদিন,,
আদিরা ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢোকার পর সামনে রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় মাটিতে বিছিয়ে থাকা রক্তিম ফুলগুলো থেকে একটা কৃষ্ণচূড়া ফুল তুলে নিতে হাঁটু নুইয়ে বসেছে মাত্র তখনি একটা বলিষ্ঠ হাত সেই ফুলটা তুলে নেয়। আদিরা চমকে যায়। মাথা উঁচু করে সামনে গতকালকের ছেলেটাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। ছেলেটা মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে কৃষ্ণচূড়া ফুলটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। আদিরা উঠে দাঁড়িয়ে যায়। তার গতকালকের কথা মনে পরে যায়। ভয়ে ওড়না খিঁচে আছে সে। চলে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াবে তখনই মারসাদও উঠে দাঁড়ায়। তারপর বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,

–পার্পল কুইন দেখছি আজ কৃষ্ণচূড়ার রঙে নিজেকে রাঙিয়েছ! এতো আনন্দ মনে? চলো। আনন্দ আরেকটু বাড়িয়ে তুলি নাচের মাধ্যমে। আনন্দে মানুষ যেমন নাচে তেমনি তুমিও নাচবে। চলো চলো।

আদিরা ঢোক গিলে এক কদম পিছিয়ে যায়। আশেপাশে আর কেউ নেই। আরেকটু দূরে মানুষজন আছে। এমনিতেও একটু জলদি এসেছে লাইব্রেরিতে যাওয়ার জন্য। আদিরাকে পিছিয়ে যেতে দেখে মারসাদ চমৎকার হাসে তারপর শান্ত স্বরে বলে,

–বাহ! এতো ভয় পাও? তাহলে কাল কেনো অডিটোরিয়ামে আসলে না? আমাকে ভয় পেলে তো আমার কথা মানার ছিল। তাই নয় কী?

আদিরা হাত দিয়ে নাকের উপর জমা বিন্দু বিন্দু স্বেদকণা মুছে নেয়। সে আরেক কদম পিছিয়ে যায়। এরপর মারসাদও সামনে এগোয়। এভাবে আর দুয়েক কদম পেছোনোর ফলশ্রুতিতে কৃষ্ণচূড়া গাছের সাথে পিঠ ঠেকে যায় আদিরার। মারসাদ আদিরার থেকে এক হাত দূরত্বে গাছের সাথে নিজের ডান হাত দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে দাঁড়ায়। মারসাদ ঝুঁকে আসে আদিরার দিকে। তার উত্তপ্ত গরম নিঃশ্বাস আদিরার চোখে-মুখে পরছে। আদিরা জড়োসরো হয়ে নিজের ব্যাগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পা তার যেন বরফের ন্যায় জমে গেছে। ছুটে পালানোর মতো সাহস ও শক্তি পাচ্ছে না। মারসাদ আদিরার মুখাবয়বে ভয়ের রেশ দেখে বাঁকা হেসে বলে,

–এতো ভয় পেয়ো না মেয়ে। যাও তোমাকে মাফ করতে পারি একটা শর্তে। যদি তুমি এই মূহুর্তে আমার সাথে চলো। এখন ভেবে নেও কী করবে? আমি তো তোমাকে অপশন দিলাম। হয় এখন আমার সাথে যাবে নয়তো কঠিনতম শাস্তির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো।

আদিরা ভয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে থেমে থেমে বলে,
–কাল আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ভাইয়া। আমি এমনিতেও নাচ জানি না। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। ওই আপুটার সাথে নাহয় নাচুন বা অন্যকারো সাথে। আমাকে ছেড়ে দিন।

মারসাদ এবার আদিরার ডান হাতের কব্জি ধরে খপ করে। আদিরা হতভম্ব হয়ে যায়। আদিরা হাত ছাড়ানোর জন্য অনেক কসরত করছে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মারসাদের ক্রমশ লালাভ ধারণ করা নয়নযুগল দেখে তার কণ্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে গেছে। মারসাদ আদিরাকে টেনে অডিটোরিয়ামের পেছোনের দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পেছোন দিক দিয়ে মানুষ কম থাকে। আদিরা হঠাৎ ভয়ে জ্ঞান হারায়।
মারসাদ যখন টের পেলো আদিরার হাত শিথিল হয়ে আসছে, তৎক্ষণাৎ সে পেছোন মুড়ে যথাসম্ভব আদিরাকে আগলে নেয়।

চলবে ইন শা আল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে