#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব
ভার্সিটির মাঠে আনমনে বসে কিছু ভাবছিল আদিরা। হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠস্বরে ভড়কে গেলো।
“হেই মিস পার্পল কুইন! ডু ইউ ওয়ান্না ডান্স উইথ মি?”
ঘার ঘুরিয়ে পেছোন ফেরতে চাইলো আদিরা। সচরাচর এমন ধরনের কথা তাকে কেউ বলে নি তাই পরখ করতে চাইলো। তাছাড়া সেই পার্পল রঙের ড্রেস পড়েছে। ভয়ে বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে তার। সে শুনেছিল, ভার্সিটিতে নাকি র্যাগ হয় আর তখন নাকি সিনিয়ররা নাম ধরে না ডেকে বিভিন্ন নিকনেম নিজেরা দিয়ে তারপর ডাকে। আদিরা সহজ সরল ঝুট-ঝামেলাহীন চলতে পছন্দ করে। আজ চৌদ্দদিন হলো সে এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ক্লাস করছে। আদিরা পেছোন ফেরে একদল ছেলে-মেয়েকে দেখে সন্দিহান হয়ে রইল। তৎক্ষণাৎ আবারও সেই সম্মোহন করা কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো,
–কী হলো? কোথায় হারালে? জবাব দেও।
থতমত খেয়ে যায় আদিরা। তার কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো সূক্ষ্ম ঘামের রেখা। ওড়নার কোণা দিয়ে অতি সন্তর্পণে তা মুছে নেয়। আদিরা আমতা আমতা করে বলে,
–না মানে আমি…
আদিরাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে বাঁকা হাসে কণ্ঠস্বরের অধিকারী ছেলেটি। হাসির কারণে সামনের আঁকাবাঁকা গজ দাঁত সুস্পষ্ট। এবার ছেলেটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলে-মেয়ের মধ্যে একটা মেয়ে এসে ছেলেটির বাম বাহু জড়িয়ে ধরে আদিরার দিকে মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠে,
–এসব মেয়ের পেছোনে সময় নষ্ট করো না মারসাদ বেবি। আমি আছি তো তোমার ডান্স পার্টনার হতে। লেটস গো।
মেয়েটা মারসাদকে টেনে নিয়ে যেতে নিলে মারসাদ আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
–দেখ সামিরা, আমি সময় নষ্ট করছি নাকি করছি না সেটা আমি বুঝে নিবো। আর পরশুদিন আমি কার সাথে ডান্স করবো সেটা আমি ডিসাইড করবো। ইউ বেটার কিপ সাট।
সামিরার ফর্সা মুখশ্রী রাগে ও অপমানে রক্তিম হয়ে উঠে। সামিরা সেখান থেকে রাগে গটগট করে চলে যায়। আদিরা নিরব দর্শকের মতো সবটাই দেখলো। সামিরা নামক মেয়েটি চলে যাওয়ার পর একটি ছেলে এসে এসে মারসাদের কাঁধে হাত রেখে বলে,
–সামিরাকে রাগিয়ে ভালো করিস নি। সামিরা কী কী করতে পারে তা তোরও ধারণা আছে খানিকটা। ও ওর বাবাকে…
ছেলেটিকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে মারসাদ ডোন্টকেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
–মারসাদ সামিরার রাগ বা কাজকে ভয় পায় না। আমার যা মনে হবে তাই করবো। তোর ভালো না লাগলে যেতে পারিস। তাও সামিরার হয়ে কথা বলতে আসবি না।
ছেলেটি হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মারসাদ আবারও আদিরাকে বলে,
–তোমাকে আমার সাথে ডান্স করতেই হবে মিস পার্পল কুইন। বি প্রিপেয়ার।
আদিরা নিজের স্বরনালীতে খানিকটা জোর এনে ভয়ে ভয়ে বলে,
–আমি নাচতে পারি না ভাইয়া। প্লিজ ভাইয়া আমার দ্বারা কোনো ভুল হলে মাফ করে দিন। আমি আর কখনও এমন ভুল করবো না কথা দিচ্ছি আমি।
মারসাদ সন্দিহান কন্ঠে বলে,
–কিন্তু তুমি কী ভুল করেছো?
মারসাদের সাথে থাকা ছেলেমেয়েরা হেসে উঠে। আরেকটা মেয়ে বলে,
–এটা স্কুল কলেজ না। বুঝেছো? ভার্সিটিতে র্যাগ হয়। আমরা তো তোমাকে র্যাগ দিচ্ছি বলতে খুব কম। আর এই অফার সবাই লুফে নেয় জানো! হ্যান্ডসাম ড্যাশিং বয় মারসাদ ইশরাক সবাইকে নিজের ডান্স পার্টনার বানায় না। যে মেয়েটাকে রেগে চলে যেতে দেখলে সে এতোদিন মারসাদের ডান্স পার্টনার হতো। এবার মারসাদ চাইছে না সামিরার সাথে ডান্স করতে। আগেরবারও মারসাদ এজন্য ডান্সে পার্টিসিপেট করেনি।
আঁখিপল্লব নোনাজলে ভারী হয়ে আসছে আদিরার। মিনতি করে বলে,
–প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। আমি ঢাকা শহরে নতুন। পড়ালেখার জন্য বাড়ি থেকে বহু বাঁধা পেরিয়ে এসেছি। দয়া করে আমাকে কারও চোখের বিষ বানাবেন না। আমার এখানে থাকা মুশকিল করে তুলবেন না।
মারসাদ নিজের দু’হাত মুঠোবদ্ধ করে ফেলে চোখেমুখে রক্তিম রাগের আভাস।
–তোমার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে না। ভালো ভাবে বলার পর যখন শোনোনি তাই তোমাকে ডান্স করতেই হবে। ক্লাস শেষে অডিটোরিয়ামে চলে আসবে বিকেল চারটায়। মাইন্ড মাই ওয়ার্ড মিস পার্পল কুইন!
মারসাদ পকেটে হাত গুঁজে স্থান ত্যাগ করে। ওর পিছু পিছু বাকিরাও যায় কিন্তু একটা মেয়ে থেমে গিয়ে আদিরার কাছে এসে নরম স্বরে বলে,
–তোমার সামিরাকে ভয় পেতে হবে না। সামিরার অতো ক্ষমতা নেই যে সে মারসাদের পাখিকে ছুঁবে!
মেয়েটি চলে গেলে আদিরা ধপ করে নরম ঘাসের চাদরে আচ্ছাদিত মাঠে বসে পরে। মেয়েটি কী বলে গেলো তাতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো ভীত হয়ে আছে সামনে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে তার ভয়ে। আদিরা গ্রাম থেকে এসেছে। ওর বাবা নিজের মুদির দোকান করে দিন চালায় আর মা গৃহিণী ও কিছু হাতের কাজ করে। স্কুল-কলেজের উপবৃত্তি ও নিজের হাতের কাজ বিক্রি করে পড়ালেখার খরচ চালাতো। ভার্সিটির ভর্তি ফি টাও তার মা অর্ধেকটা ধার-দেনা করে এনে দিয়েছে। এক মাসের মধ্যে সে টাকা পরিশোধ করতে হবে।
আদিরার পুরো নাম, “আদিরা আদওয়া”। বাবা-মায়ের বড়ো মেয়ে। ছোট একটা ভাই আছো ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চায় নি কিন্তু তার কলেজের শিক্ষকরা নিজেরাই আদিরার রেজাল্ট দেখে ঢাকার দুটো ভার্সিটিতে ফর্ম ফিলাপ করে দিয়েছে। যাতায়াত খরচটাও দিয়েছে। ভর্তির টাকাও দিতে চেয়েছিল কিন্তু আদারা নেয় নি। তারা আদিরাকে পড়ালেখা ছাড়াও অনেক সহোযোগিতা করেছে যার ঋণ আদারা কখনোই পরিশোধ করতে পারবে না।
ব্যাগে থাকা ফোনের রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাঙে আদারার। ফোনটা বের করে দেখে তার মা ফোন করেছে। আজ তার লেখাপড়া করার পেছোনে মূল যে মানুষটির অবদান বেশি সে হলো তার মা। মেয়েকে যেখানে সবাই বোঝা ভাবে সেখানে তিনি মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেন।
–আসসালামু আলাইকুম মা। কেমন আছো?
–ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুই কেমন আছিস মা? কালকে ফোন করতে পারি নি ফোনে চার্জ ও টাকা ছিল নারে। তুই খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করছিস তো? ওখানে সমস্যা হচ্ছে না তো?
আদিরার মন প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। মায়ের ডাক সন্তানের মনে জমা ভয়-ভীতি এক চুটকিতেই দূর করে দেয়। আদিরা আদুরে কন্ঠে বলে,
–হ্যাঁ মা। তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে ফোন করে না পেয়ে খুব চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওখানে আবার কোনো ঝামেলা হলো কি-না! তুমি কেমন আছো? আর বাবা ও ভাই কেমন আছে?
আদিরার মা মেয়েকে জানাতে চায় না যে ওর ছোট ভাইটার জ্বরে খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল। তাহলে আদিরা দূরে থেকেই খামাখা চিন্তা করবে। উনি মলিন কন্ঠে বলেন,
–সব ঠিক আছে মা। তুই মন দিয়ে পড়াশোনা কর। তোকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। রাখি। তোর বাবা চলে আসবে একটু পরে দুপুরের খাবার খেতে। রান্না বসিয়ে আসছি।
আদিরাও তার মাকে বিদায় জানিয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। ভার্সিটির শেষে আজ একটা টিউশন করাতে যাবে তাই আগে আগে যাবে একটু। মেসে তার রুমমেট এক আপু তাকে একটা কম টাকার টিউশন খুঁজে দিয়েছেন। মাসে আড়াই হাজার দিবে বলেছে। ওই আপুর জন্য এটা কমই তাই তিনি আদিরাকে দিয়ে দিয়েছেন।
ভার্সিটির শেষে আদিরা টিউশন করাতে চলে যায়। সে বেমালুম মারসাদের কথা ভুলে বসেছে।
চলবে ইন শা আল্লাহ,
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল।
চলবে।