এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৩

0
1788

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৩

রজনির প্রথম প্রহরেই সারা গ্রাম জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এমনিতেই গ্রামে সন্ধ্যার পর তেমন কেউ ঘর থেকে বের হয়না। তারপর আবার শীতের রাত। সবাই এতক্ষনে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘরে বসে আছে। চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। ঝি ঝি পোকারা অন্ধকারে পাল্লা দিয়ে ডেকে উঠছে। আলো জলছে শুধু মজুমদার বাড়িতে। এই বাড়িটা গ্রামের অন্যান্য বাড়ি থেকে আলাদা। অনেক দূর থেকে এই বাড়ির মাথা দেখা যায়। এই বাড়ির ঐতিহ্য হচ্ছে মাটির দো তলা। গ্রামে আরও মাটির দো তলা আছে কিন্তু এই বাড়িটা সাদেকের বাবা নুরুল মজুমদার তার রুচি মতো বানিয়েছেন। দো তলার আকর্ষণীয় নকশাটা বেশ চোখ ধাঁধানো যেটা গ্রামের রাস্তায় ঢুকলেই চোখে পড়ে। নকশার মাঝখানে বড় করে লেখা ‘মজুমদার বাড়ি’। মাটির দো তলার উপরে জানালার পাশে বসলেই পুরো গ্রামটা একবার চোখ বুলান যায়। সেখানে বসেই আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে নাবিল। তার পাশেই বসে আছে মুবিন। দুজনি চুপচাপ শীতের নিস্তব্ধ রাতে ঝি ঝি পোকার ডাক উপভোগ করছে। নাবিল স্নেহর ছোট ফুপু মানে সুমি আর রাজ্জাকের ছেলে।

দুজনি যখন জানালা দিয়ে দৃশ্য উপভগে ব্যস্ত তখনি কানে ঠক ঠক আওয়াজ আসতেই সেদিকে দৃষ্টি ফেরায় তারা। কেউ একজন কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ঠক ঠক শব্দে উপরে উঠছে। উপরে উঠেই এক ঘর পেরিয়ে আর এক ঘরের দরজা মাড়াতেই সুহার পায়ের তালে তালে দোতলা কেঁপে উঠছে। নাবিল সেই বিষয়টাকে খুব উপভোগ করছে। মাটির দোতলা এভাবেই অল্পতেই কেঁপে উঠে কিন্তু আবার ভেঙ্গেও পড়েনা। কি অদ্ভুত! ছোট বেলা থেকে বিদেশে থাকায় গ্রামের এই রূপটা চরম ভাবে মিস করেছে। কিন্তু এখন এখানে এসে মনে হচ্ছে ছেলে বেলার সেই অপূর্ণতা সবটা পুরন করে তবেই শহরে ফিরবে। মুড়ির বাটিটা এগিয়ে দেয় সুহা। মুবিন তার হাত থেকে সেটা নিয়ে নাবিলের সামনে ধরে। মুড়ি দেখে প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে না বলতে পারেনা। তাই হাত বাড়িয়ে এক মুঠো মুড়ি নিয়ে মুখে পুরে দেয়। মুখে দিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায় নাবিল। সামান্য মুড়িও যে এতোটা সুস্বাদু হতে পারে তা না খেলে বুঝতেই পারতোনা। বিরক্ত হয়ে যদি না খেত তাহলে আজ অনেক সুস্বাদু একটা খাবার মিস করে ফেলত। তাই এখন থেকে সে আর কোন কিছুতেই না বলবে না। যা পাবে সবটাই টেস্ট করে দেখবে। বাটির দিকে ভালো করে দেখে নেয় সে। বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক কি কি দিয়ে মুড়িটা মাখান হয়। পেয়াজ, কাঁচা মরিচ, টমেটো ছাড়া তেমন বিশেষ কিছুই চোখে পড়ছে না।

“একটু পরেই চা আনতেছি।” হেসে কথাটা বলেই ফিরে যেতেই সামনে পা বাড়াল সুহা। কিন্তু যেতে পারল না। নাবিলের কথা শুনে থেমে গেলো।
“তোমার নাম কি?” নাবিলের প্রশ্ন শুনে ফিরে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বলল “সুহাসিনি।”

“বাহ! খুব সুন্দর নাম। কিসে পড় তুমি?” প্রশ্ন শেষ করে আবার এক মুঠো মুড়ি নিয়ে মুখে দিলো নাবিল।
“ক্লাস এইটে।” সে ধিরে ধিরে মুখ নাড়াতে নাড়াতে সুহার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বেশ মজা লাগছে মুড়ি মাখাটা। এই সময় যেন এটারই দরকার ছিল। মুড়ি চিবুতে চিবুতে ধির কণ্ঠে বলল “কে মাখছে এই মুড়ি?”

“আপা।” সুহার নির্লিপ্ত উত্তরে নাবিল তার দিকে তাকাল। “তখনের সেই সাদা জামা পরা মেয়েটা তোমার আপু?” নাবিলের শান্ত কণ্ঠের প্রশ্নে সুহা উপরে নিচে মাথা নাড়াল। কিছু একটা ভেবে আবার জিজ্ঞেস করলো “তোমার আপু যেন কিসে পড়ে?”
“এবার উচ্চ মাধ্যমিক দিবে।” সুহা খুব শান্ত ভাবে উত্তর দিলো।

“তোমার আপুর নাম কি?” নাবিলের প্রশ্নটা শেষ হতেই মুবিন চিৎকার করে উঠলো “ও মাগো! ঝাল।” একটা আসত কাঁচা মরিচ চিবিয়ে খেয়েছে। কথাও বলতে পারছে না। এক দৌড়ে নিচে চলে গেলো পানি খেতে। তার যাওয়ার দিকে দুজনি ফিরে তাকাল। সুহা একটু শব্দ করে হেসেও নাবিলের দিকে ফিরে থেমে গেলো। নাবিল সুহার দিকে তাকাল। সে শব্দ করে হাসার জন্য লজ্জা পেয়েছে। তাই একটু ইতস্তত করে বলল “আমি চা আনছি।” ঘুরে সিঁড়ির দিকে যেতেই নাবিল আবার ডাকল।

“সুহা!” সুহা আবার ঘুরে নাবিলের কাছে এলো। প্রশ্নবিধ্য চোখে তাকাল। নাবিল তাকে মাদুরে বসতে ইশারা করলো। বিনা বাক্য ব্যয়ে সে বসে পড়লো। নাবিল একটু অবাক হল। মেয়েটা বেশ ভদ্র। নিজের দৃষ্টি নত রেখেছে। সবুজ রঙের একটা থ্রি পিস পরেছে। ওড়নাটা বড় করে মাথায় টেনে দেয়া। মাথা নুইয়ে নিলে আর মুখ দেখা যায়না। ঠিক এই কারনেই সে তখন স্নেহর মুখটাও ভালো করে দেখতে পায়নি। মুড়ির বাটিটা এগিয়ে দিলো নাবিল।

“খাও।” নাবিলের কণ্ঠ শুনে সুহা চোখ তুলে তাকে দেখে নিলো। দৃষ্টি আবার নামিয়ে সাবলীল ভাবে বলল “নিচে আপার সাথে খাবো।”
নাবিল একটু হেসে বলল “কোথায় বলা আছে আপুর সাথে খেলে ভাইয়ার সাথে খাওয়া যাবে না।” নাবিলের কথা শুনে সুহা তার দিকে তাকাল। হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। এতক্ষন একটা জড়তা থাকলেও নাবিলের মাত্র বলা কথাটা সেটা কিছুটা কাটিয়ে দিয়েছে। সেও যে মুবিনের মতো তার আরেক ভাই সেই বিষয়টা এবার স্পষ্ট। এখন সুহার একটু স্বস্তি লাগছে। সেও একটু হেসে হাত বাড়িয়ে বাটি থেকে মুড়ি নিলো। নাবিল তার সাথে কথোপকথন চালিয়ে গেলো।

“তুমি কি গ্রামের স্কুলে পড়?”
“জি।?”
“আমি কে হই জানো?”
লজ্জা ভাব নিয়ে হ্যা সুচক উত্তর দিলো সুহা। নাবিল একটু হেসে বলল “ বলত কে হই?”
“নাবিল ভাইয়া।” মিন মিনে কণ্ঠে উত্তর দিলো সুহা।
“আমি আসার পর থেকে তোমাদেরকে আমাদের বাসায় যাইতে দেখিনি। জাওনা কেন?”
সুহা নত দৃষ্টিতে বলল “আসলে আপা সব সময় পড়ালেখা করে তো। পড়ালেখার সমস্যা হবে জন্য কোথাও জাইতে চায়না।”

“তোমার আপু সারাক্ষন পড়ে?” সুহা হা সুচক মাথা নাড়ে।

“সুহা চা নিয়ে যা!” নিচ থেকে নরম কোমল কণ্ঠের ডাকে সুহা উঠে দাঁড়ায়। নাবিল জানালা দিয়ে নিচে তাকায়। এই জানালা দিয়ে রান্না ঘরের দরজা অব্দি দেখা যায়। কোমল কণ্ঠের অধিকারিণীকে দেখার উদ্দেশ্যে দৃষ্টি রান্না ঘরের দরজায় রাখলেও ঠিক মতো তেমন দেখতে পেলো না। শুধু সাদা রঙের ওড়না পরিহিত এক অবয়ব দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো। বুঝতে বাকি থাকলো না এই সেই রমনি যার সাথে গ্রামে ঢোকার পথে তার দেখা হয়েছিলো। তবে গ্রামে ঢোকার রাস্তায় তার দেখা পেলেও তখন রোদের তীব্র তেজে তেমন চেহারার দর্শন সম্ভব হয়নি। মুবিন তাকে দেখে চিনে ফেলে। আর সেই ফাকেই স্নেহ নিজেকে আড়াল করে ফেলে। তাই নাবিল আর তাকে দেখতে পায়নি।

নাবিল চোখ ফিরিয়ে নিলো। মুবিন এসে বসলো তার আগের জায়গাতেই। সুহা নিচে চলে গেলো। খানিকবাদেই আবার সে ঠক ঠক আওয়াজে চা নিয়ে ঢুকল। নাবিল তার হাত থেকে কাপ নিয়েই চায়ে চুমুক দিয়ে থেমে গেলো। “নাইচ টি!” চাপা সরে বলল।

“কিছু বললেন ভাইয়া?” সুহা অকপটে জিজ্ঞেস করলো। নাবিল হকচকিয়ে বলল “কে বানাইছে চা?”

“আপা বানাইছে।” নাবিল হাসল। চায়ে চুমুক দিয়ে জানালা দিয়ে নিচে রান্না ঘরের দরজায় তাকিয়ে বলল “তোমার আপু কি রান্না ঘরে?” সুহা মিষ্টি হেসে মাথা নাড়াল। নাবিল তার দিকে তাকাল। “তোমার আপু খুব সুন্দর রান্না করে!” সহাস্যে কথাটা বলল নাবিল। সুহা এমন ভাবে খুশি হল যেন কথাটা তার উদ্দেশ্যেই বলা। একটু হেসে সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে গেলো।

গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকাল সে। বেশ কুয়াশা পড়েছে। অল্প সামনেই ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। চা টাও বেশ লাগছে। মেয়েটার রান্নার হাত খুব ভালো। গ্রামে জন্ম হলেও মজুমদার বাড়ির শহরের সাথে যোগাযোগ ছিল অনেক আগে থেকেই। তার নানা নুরুল মজুমদার ৪ ছেলে মেয়েকেই সর্বোচ্চ শিক্ষিত করেছেন। ছেলেরা নিজেদের জমি আর এই বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই গ্রাম ছেড়ে বাইরে কোথাও যায়নি। কিন্তু দুই মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই বাড়ির মেয়েরা গ্রামে বড় হলেও বেশ স্মার্ট হয়। সব রকম পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তার মা সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি বিদেশে গিয়েও নিজেকে খুব সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। এমনকি এ পর্যন্ত তার কখনও মনে হয়নি যে তার মা গ্রামের মেয়ে।

——————

রাতে খাওয়ার সময় ঘরে সবাই উপস্থিত থাকলেও স্নেহ নেই। সুমি চারিদিকে ভালো করে দেখে নিলো। স্নেহকে কোথাও দেখতে না পেয়ে বলল “স্নেহ খাবেনা? ও কোথায়?”

“শরীর টা ভালো না। মাথা ধরছে। মাথা ধরলে খাইতে চায়না।” লতার চিন্তা দেখে রাজ্জাক বিচলিত হয়ে বলল “ঔষধ খাবেনা? খেলেই তো ঠিক হয়ে যাবে। রাতে এভাবে না খেয়ে থাকলে তো আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে।”

“খাইছে ফুপাজি।” নিচু সরে উত্তর দিলো সুহা। “হঠাৎ মাথা কেন ধরল?” চিন্তিত সরে বলল সুমি।

“আপা আজকে ভেজা চুল খোপা বাধছিল। সারাদিন আর চুল শুকায়নি। চুল ভেজা থাকলে আপার মাথা ধরে।” সুহা বলেই নাবিলের দিকে ডালের বাটি এগিয়ে ধরে বলল “ভাইয়া ডাল দিবো?” নাবিলের সাথে এতটুকু সময়েই সুহার অনেক ভাব হয়েছে। কারন নাবিলের কথা বলার ভঙ্গি দেখে তাকে মুবিনের মতো ভাবতে শুরু করেছে সুহা। যার ফলে তার মধ্যেকার জড়তাটা কাটিয়ে উঠেছে। নাবিলও খুব সহজ করে নিয়েছে বিষয়টাকে।

নাবিল একটু হেসে মাথা নাড়াল। সুহাও হেসে ডাল তুলে দিলো তার প্লেটে। নাবিল মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। খাবার টা বেশ মজা হয়েছে। নাবিলের খাওয়া দেখে সুমি বলল “খাবার কেমন লাগছে বাবা?”

“খুব মজা হইছে।” নাবিল তার মায়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিয়েই প্লেটের দিকে চোখ নামিয়ে আবার বলল “কে রান্না করছে?”

“তোমার বড় মামি।” লতার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল সুমি। নাবিল চোখ তুলে লতার দিকে তাকাল। সে এই প্রশংসা নিতে পারছেনা। সবার সামনে এভাবে প্রশংসা করায় সে একটু লজ্জা পেলো। নাবিল একটু হেসে বলল “তোমার হাতে জাদু আছে মামি। মা অবশ্য সব সময় তোমার এই রান্নার কথা বলতো। আমার তো খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। এখন বুঝতে পারছি কি মিস করছি।”

লতার মনে একটু চাপা কষ্ট নাড়া দিয়ে গেলো। অসহায়ের মতো আবেগি হয়ে বলল “সেই ছোটবেলায় বিদেশ গেছো। তোমারে ভালো মতো আদর করতেও পারি নাই।” থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসি মুখে উতফুল্ল্য হয়ে আবার বলল “এখন পাইছি এত সহজে আর ছাড়বো না। সব আদর পুশাইয়া তারপর জাইতে দিবো।“

লতার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। নাবিল কিছু বলবে তার আগেই তার ছোট মামা সিরাজ বলল “নাবিল বাবা তুমি কি আবার বিদেশ জাইতে চাও নাকি?”

নাবিল কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল “জি মামা। ওখানেই শিফট করার চিন্তা আছে।”
হতাশ হয়ে বলল “ওখানে আমাদের ছাইড়ে থাকতে খারাপ লাগেনা?” নাবিল সিরাজের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললো। একটু ভেবে বলল “লাগে মামা। এই জন্যই তো মাঝে মাঝে দেশে আসবো। তোমাদের সবার সাথে দেখা করতে।”

তাদের এই কথোপকথনের মাঝেই পাশের ঘর থেকে সুহার তীব্র চিতকারের আওয়াজ আসে। “মা তাড়াতাড়ি আসো। আপা………।”

সুহার চিৎকার শুনেই সবাই থেমে যায়। লতা আর কিছু না ভেবেই এক দৌড় দেয় তার মেয়েকে দেখতে।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে