#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩
সাইফের মায়ের সাথে ভেতর ঘরে মিলির কী কথা হলো, সেটা কেউওই জানতে পারলোনা। কিন্তু দীর্ঘ আধঘন্টা পরে যখন ওরা ঘর থেকে বেরুলো তখন শোভা আতংকে অস্থির। মিলি যদি বিয়েতে রাজি না হয়? মিলি একবার না করে দিলে সাইফের মাও রাজি হবেনা বিয়েতে।
শোভা চোখমুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছে। সাইফের মা সোফায় বসলো। মিলি দাঁড়িয়ে রইলো শোভার পাশে। সাইফ মায়ের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু মহিলা কিছু বলছেনা। রমজান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
‘ মিলি বিয়েতে রাজি?’
‘ জি আংকেল।’
মিলির কথায় শোভা অবাক। মেয়েটা এতো সহজে রাজি হয়ে গেলো? কীভাবে সম্ভব! কিন্তু যারপরনাই খুশিও হলো।
রাফু আর তুতুল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। মিলির আঁচল ধরে বললো, ‘তুমি বিয়ে করবে ছোটআম্মু?’
মিলি বললো,
‘ হুম।’
‘ আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?’
মিলি কিছু বললো না।
রাফু বললো,
‘ বিয়ে করে তুমি আমাদের ভুলে যাবে?’
শোভা ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, ‘কখনো না।’
‘ তাহলে বিয়ে করবে কেন?’
‘ সবাইকে করতে হয় বাবা।’
‘ তুমিও করেছো?’
শোভা সবার সামনে থতমত খেয়ে গেলো। মিলি বললো, ‘হুম। মাও বিয়ে করেছে।’
‘ বিয়ে করলে কী বর হয়? সাইফ আংকেল কী তোমার বর হবে?’
‘ হুম।’
‘ তাহলে মায়ের বর কোথায়?’
এবার মিলি আর শোভার দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সাইফের মা বিষয়টা বুঝতে পারলেন। তিনি আগে থেকেই সাইফের কাছে শোভা, মিলির সব কথা শুনেছেন। তাই তিনি এবার উঠে রাফুকে কোলে নিলেন। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ তোমার মায়ের বর হলো তোমার আব্বু। আর তুমি জানো তোমার আব্বু মাকে পছন্দ করেনা। তাইতো আম্মু চলে এসেছে।’
‘ পছন্দ না করলে বিয়ে করেছে কেন?’
‘ সেটা তোমার আব্বু জানে।’
রাফু কোল থেকে নেমে গিয়ে মিলির কাছে দাঁড়ালো। তারপর বললো, ‘তুমি বিয়ে করে নাও ছোটআম্মু। সাইফ আংকেল তোমাকে পছন্দ করে, সে আমার আব্বুর মতো নয়।’
মিলি আলতো হাসলো। শোভার চোখে পানি এসে গেলো। তুতুল চুপচাপ মিলিকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু-ভাইবোন শুধু জানে তাঁদের ছোটআম্মু আর তাঁদের সাথে থাকবেনা। বিয়ে হলে সবাই নাকি বরের বাড়ি চলে যায়।
এদিকে সাইফ দারুণ খুশি। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছেনা মিলির দিকে কীভাবে তাকাবে! কোনোদিন তো বলেওনি যে সে মিলিকে ভালোবাসে। আজ হুট করে মেয়ে দেখতে এসে মা বলছে আজ নাকি ওর বিয়ে। বিয়ের কোনো প্রস্তুতিই তো সে নেয়নি!
যেভাবে ছিলো সেভাবেই রাত আটটার দিকে শোভার বাড়িতে সাইফের বাড়ির কিছু মেহমান এলো। সাথে বিয়ের যাবতীয় তৈজসপত্র, প্রসাধনী। শোভা মিলিকে সাজিয়ে দিলো। শোভার নিজের বিয়েটা হয়েছিল একদম সাদামাটা। সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। সাদ তখন সদ্য চাকুরীতে জয়েন করেছে। নববর্ষ উপলক্ষে সাদ শোভাকে একটা সাদা জামদানী উপহার দিয়েছিলো, সাথে সাদা কাচের চুড়ি। চুলে গুঁজেছিলো বেলী ফুলের সুবাস মোড়ানো সাদা মালা। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপগ্লস। এই সাজেই শোভাকে সেদিন অপ্সরা লাগছিলো। সাদ পরেছিলো ওর সাথে মিলিয়ে সাদা পাঞ্জাবি, ওকেও দারুণ দেখাচ্ছিলো। দুজনেই সেদিন জীবন উলটপালট করা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো পরিবারের কাউকে না জানিয়ে। কাজি অফিসে বিয়ে সারার পর সাদ শোভাকে কথা দিয়েছিলো কখনো ছেড়ে যাবেনা। হাহ, কিন্তু আজ এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও কেউ কারো মুখদর্শন পর্যন্ত করেনি। না করতে চায়! সাদ হয়তো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারে, কিন্তু শোভা পারবেনা। কারণ শোভা বলেছিলো সাদ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ শোভার জীবনে আসবেনা কখনোই। আসেনি, কখনোই দ্বিতীয় মানব শোভার জীবনে আসার পথ পায়নি। শোভা সেই সুযোগ দেয়নি। কী এমন ক্ষতি হবে একলা জীবন কাটালে? কিছুই না। হয়তো বাচ্চাগুলো কাউকে বাবা ডাকার সুযোগ পাবেনা, বাবার ভালোবাসা পাবেনা৷ না পাক, সাদের নোংরা ভালোবাসা কখনোই শোভার সন্তানেরা ডিজার্ভ করেনা।
যাইহোক, শোভা মিলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। লাল শাড়ি, চুড়ি, গয়না সব মিলিয়ে পরী পরী ভাব। মিলি এতকিছু পছন্দ করে না। তাই রেগে বললো, ‘কী করছিস শুভি? আমি তো নিজেকেই চিনতে পারছিনা।’
শোভা বললো, ‘বিয়ের দিন মেয়েরা নিজেদের চিনতে পারবেনা, এটাই স্বাভাবিক।’
‘ তাই বুঝি?’
‘ হুম।’
‘ তোর বিয়েতেও তুই নিজেকে চিনতে পারিসনি?’
‘ নাহ। আমি নিজেকে ঠিকই চিনেছিলাম, কারণ সেদিন আমার সাজগোজ ছিলোনা। যেমন ছিলাম, তেমনই। শুধু চুলে বেলীফুলের মালা গুঁজেছিলাম!’
‘ তো আমাকেও সেভাবেই সাজিয়ে দে।’
‘ না।’
‘ কেন?’
শোভা কঠিন গলায় অদ্ভুতভাবে বললো, ‘ জানিস আমি সেদিন সাদা শাড়ি পরেছিলাম। সাদা শাড়ি
মানে জানিস? বিধবাদের রঙ। সেদিন আমাকে বিধবা বউ লাগছিলো৷ তাইতো দেখলি না, আমার বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো। আমিতো বিধবাদের মতোই বাস করছি। তাই আমি তোকে লাল রঙে সাজাচ্ছি। তোর জীবন রঙিন থাকবে সবসময়। তুই খুব ভালো, তুই সুখ ডিজার্ভ করিস। তুই আজীবন আনন্দে কাটা সাইফ ভাইয়ের সাথে। তুই আমার জন্য যা করেছিস, অন্য কেউ হলে কখনোই করতোনা। তুই ঘর-সংসার নিয়ে সুখে থাক, এছাড়া আমি আর কিছুই চাইনা।’
মিলি শোভার গালে হাত রেখে বললো, ‘কাঁদছিস কেন?’
‘ এমনি। পুরোনো কথা আজ খুব মনে পড়ছে।’
‘ এখনো ভুলতে পারিসনি!’
‘ সব অতীত ভোলা সহজ নয়। আর কিছু কিছু অতীত ভুলে যাওয়ারও নয়। এটাই আমাকে আরও সাহসী হতে সাহায্য করে।’
‘ তুই অনেক বড় হবি শুভি।’
‘ তুইও অনেক ভালো থাকবি।’
রাফু গালে হাত দিয়ে বসেছিলো। মিলিকে এতো সাজগোজ করতে দেখে ওর মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো। মিলি কখনোই সাজেনা, রঙিন কাপড়ও পরেনা। কিন্তু ওকে আজ খুশি হতে দেখে দু-ভাইবোন খুব আনন্দ পেলো। রাফু সাইফকে বর সাজতে দেখে বললো,
‘ আমার ছোটআম্মুকে কষ্ট দিবেনা কিন্তু।’
সাইফ হেসে বললো, ‘আচ্ছা।’
‘ বকবেনা কিন্তু!’
‘ বকবোনা।’
‘ ইনজেকশন দিবেনা। তুমি খুব পচা ডাক্তার, সেবার আমাকে যেভাবে ইনজেকশন দিয়েছিলে ছোটআম্মু আমার কষ্ট দেখে কেঁদে ফেলেছিলো।’
সাইফ বোকার মতো বললো, ‘ইনজেকশন তো অসুস্থ হলে দিতেই হবে।’
‘ না দিবেনা।’
‘ ধরো, তোমার ছোটআম্মুর বেবী হবে! তখন কিন্তু তোমার ছোটআম্মুকে ইনজেকশন নিতেই হবে।’
‘ কেন?’
‘ সুস্থ থাকার জন্য।’
তুতুল মুখটা কালো করে বললো, ‘সব আমার ছোটআম্মুকে কষ্ট দেওয়ার ধান্ধা, তাইনা? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। সবাইকে গিয়ে বলবো।’
রাফু আর তুতুল দৌড়ে দৌড়ে মেহমান সবাইকে গিয়ে এই কথাটা বলছে। বলতে বলতে হঠাৎ মিলির কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
‘ জানো ছোটআম্মু, তোমার বরটা তোমাকে নাকি বেবী হবার সময় ইনজেকশন দিবে।’
শোভা চোখ পাকিয়ে তাকালো। মিলি অবাক হয়ে বলল,
‘ কীহ?’
‘ হুম। তোমাকে গুঁতো দিবে বলেছে।’
‘ বেবীর কথা কে বলেছে?’
‘ সাইফ আংকেল।’
মিলি রেগে কিড়মিড় করে শোভাকে বললো,
‘ দেখলি? এইজন্য আমি পুরুষ জাতটাকে দেখতে পারিনা। এখনো বিয়েই হয়নাই, আর এই হাঁদা ডাক্তার বেবী অবধি আগায় গিয়েছে।’
শোভা মুচকি হেসে বললো,
‘ তো আগাবেনা? বয়স কত দেখছিস?’
‘ হাঁদার বয়স ধুইয়া পানি খাবো! আমার কোনো বাচ্চার দরকার নাই। আমার অলরেডি বাচ্চা আছে, তাও দুইটা।’
শোভা মুখ কালো করে বললো,
‘ এইরকম কথা বলবি না। তোরও কিউট বাচ্চা হবে।’
মিলি গম্ভীর মুখে বসে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে কাজি এলো। মিলি আর সাইফের বিয়েটাও হয়ে গেলো ভালোভাবে। মোনাজাত শেষ করার পর খাওয়াদাওয়া হলো। সাইফের মা অনেক ভালো, নিজেই সব কাজে সালমা বেগমকে সাহায্য করলেন। মিলি রাগী চোখে সাইফের দিকে তাকিয়ে আছে, তার কারণ সাইফ বোকার মতো মিলিকে দেখে ঘামছে। আর সবাই নানা লজ্জ্বাজনক কথা বলছে। আজ রাতটা শোভাদের বাড়িতেই থাকার বন্দোবস্ত করা হলো।
বিয়ের পর্ব নির্বিঘ্নে শেষ হওয়ার পর শোভা নিজের ঘরে গেলো। দরজা আটকে বসে রইলো। মনটা বড্ড কেমন কেমন করছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ঘোলাটে হচ্ছেনা কিছুতেই, সব পরিষ্কার। যেন সেদিনের ঘটনা। মিলিটার একটা গতি করে দিতে পেরে শোভার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে দাঁড়ালো জানালার কাছে। অন্ধকার ঘরটাতে শোভার দীর্ঘশ্বাসের শব্দগুলো ভোঁতা হয়ে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি উঠাচ্ছিলো।
কিছুক্ষণ পর শুরু হলো বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি! অসময়ে দুনিয়া উলটপালট করে ধুলো উড়ানো ঠান্ডা বাতাসে পথঘাট ছেয়ে গেলো।
________
রাস্তার পাশের ভাতের হোটেলটায় দীর্ঘ ছয়ঘন্টা যাবৎ বসে আছে সাদ। সাইফের অপেক্ষা করতে করতে রাত দশটা বেজে গেলো। কিন্তু ডাক্তারের পাত্তা নেই। এর মধ্যেই হোটেল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হলো। সাদ বাইরে এসে দাঁড়ালো। আজ কিছুতেই সাইফকে হাতছাড়া করবেনা সে। নিশ্চিয় কিছু না কিছু সাইফ জানে। হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি। রাস্তায় তো আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না।
কিছু একটা ভেবে সাদ পা বাড়ালো ওই বাড়িটার দিকে, যে বাড়িটাতে সাইফ আছে। দোতলায় উঠে দেখে বাড়ির ভেতর থেকে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। সাদ ভেজা সিক্ত গা নিয়ে পা বাড়ালো। ডোরবেলা বাজাতে লাগলো, কিন্তু বাজ পড়ার প্রচন্ড শব্দে সেই আওয়াজ কারো কানে পৌঁচ্ছাছে না। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি কেন নামলো সাদ বুঝতে পারছেনা। এই অসময়ে বৃষ্টিটা না হলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো!
দীর্ঘ পাঁচ মিনিট পর, যখন বর্ষণ আরো জোরে হচ্ছে তখন কেউ একজন ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো। কিন্তু মানুষটাকে সাদ দেখতে পেলোনা। যেই না সাদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে তখনই বিকট শব্দ করে কারেন্ট চলে গেলো। সাদ চমকে উঠলো সেই শব্দে।
নিজেকে ধাতস্থ করে সাহস নিয়েই সাদ ভেতরে ঢুকলো। মাঝারি আকারের ড্রইংরুমে অন্ধকার চোখে সয়ে নিতে সাদের সময় লাগলো, বেমালুম ভুলে গেলো যে পকেটে সেলফোন আছে। দেখলো একটা ছোট ছেলে সোফার উপর দাঁড়িয়ে আছে। মুখচোখ ভেজা। মোমবাতির হলুদ আলোয় একটা মেয়েকে দেখতে পেলো সাদ। খুব চেনা চেহারা। মেয়েটা শাড়ি পরে আছে, খোঁপা করা চুল। বাচ্চা ছেলেটির মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে মেয়েটি, আর বকবক করছে। সাদ চমকে উঠে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো সেদিকে!
চলবে….ইনশাআল্লাহ!