এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-২৪+২৫

0
153

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৪

প্রকৃতি তখন সূর্যের দাপতে। কনকনে শীতের আভাস ছাড়িয়ে সূর্য উঠেছে ধরণী জুড়ে। ফারিশ ঘুমিয়ে আছে বেলকনিতে। কাল রাতে এখানেই ম’দ সিগারেট খেয়েসেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। গায়ে তার মোটা কম্বল জড়ানো। কম্বলটা আদিব দিয়ে গেছে। কাল আদিব ঘুমানোর আগে আরো একবার ফারিশের রুমে আসে। এসে দেখে ফারিশ বেলকনিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। শীতে গায়ের পশম গেছে দাঁড়িয়ে অথচ তাও ফারিশ রুমে এসে বিছানায় শোয় নি। আদিব একবার ভেবেছিল ফারিশকে ডাকবে কিন্তু পরে আর ডাকার সাহস হয় নি। তাই বাধ্য হয়ে রুমে থাকা মোটা কম্বলটা এনে জড়িয়ে দেয় ফারিশের গায়ে। ফারিশও হঠাৎ শীতল ছোঁয়ার ভিড়ে গরম উষ্ণতা পেয়ে কম্বল ঝাপটে ধরে ঘুমিয়ে থাকে। আদিব বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে তাকে ফারিশের ঘুমন্ত মুখের দিকে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে নিজেও জানে না। পরে হুস আসতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় নিজের রুমে। যাওয়ার পথে একটা কথাই ঘুরপাক খায় মাথায়“এ জীবন যেন বড্ড দুঃখ দেয়”।’

ফারিশের ঘুম ভাঙলো আরো আধঘন্টা পর। শীতের সকালে তীব্র রোদ্দুরের ছোঁয়া গায়ে মাখতেই যেন আরো বেশি সতেজ হলো শরীর। এক মিষ্টি গন্ধ যেন নাকে বিদে তখন। ফারিশ চোখ খুলে চাইলো। হাই তুলে আশপাশ দেখলো। সেকেন্ড পনের আশপাশ চোখ বুলাতেই বুজলো সে বেলকনিতে শুয়ে আছে। গায়ে জড়িয়ে থাকা মোটা চাঁদরটা দেখলো। ফারিশ বুঝলো এটা আদিবেরই কাজ। ফারিশ আস্তে আস্তে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ঘাড় পিঠ খানিকটা ব্যথা করছে। ফারিশের পিঠের ক্ষত এখনো বুঝি পুরোপুরি সাড়ে নি। এখনও মাঝে মাঝে লম্বা আকৃতির দাগটায় চিনচিনে ব্যথা হয়। কিন্তু ফারিশ বরাবরই তা উপেক্ষা করে। তার মতে ফারিশ আঘাত পায় না, তাদের ব্যথা হয় না, যন্ত্রণা উপলব্ধি করে না। অথচ গত সাতদিন যাবৎ ডাক্তার ম্যাডামকে দেখতে না পাওয়ার শূন্যতায় যে যন্ত্রণা হয়েছিল ফারিশের তা সহ্যনীয় ছিল না। ফারিশ নীরবে জোরে নিশ্বাস ফেললো। ফারিশ বুঝলো, পৃথিবীতে ভালোবাসার উপর কোনো নিয়ম চলে না। এটা একদম অনিয়ম ব্যাপার স্যাপার। যেটা হুট করে আসে আর সহজে যেতে চায় না। ফারিশ মেনে নিয়েছে। আপাতত সে চায় তার জীবনে কেউ একজন থাকুক যাকে ভালোবাসা যায়, বুকে জড়িয়ে ধরে যত্নে রাখা যায়, ক্লান্তিতে কোলে মাথা দিয়ে দু’দন্ড শোয়া যায়। মন খুলে অনেককিছু বলা যায়। ফারিশের মনে হয় সেই কেউ একটা বুঝি আদ্রিতাই। ফারিশের নাকে আবারও সেই সুগন্ধটা এলো। এবার যেন আরো বেশি করে গন্ধটা নাকে লাগছে। ফারিশ অনেকক্ষণ গন্ধটা সুকে বুঝতে পারলো এটা কোনো খাবারের গন্ধ। তবে কি আদিব রান্না করছে। ফারিশ সকালের সোনালী রোদ্দুরটা গায়ে মেখেই উঠে দাঁড়ালো। বেশ ফুড়ফুড়ে লাগছে নিজেকে। ফারিশ নিচে লেপ্টে থাকা কম্বলটাও হাতে নিলো। গিয়ে রাখলো বিছানায়। তারপর এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে।’

যা ভেবেছিল তাই আদিব সকাল সকাল মুরগী পোলাও রান্না করছে। ফারিশ তার বাম পাশের ঘড়িটা দেখলো। এখনকার সময়কে সকাল বলা চলে না। বেলা প্রায় বারো’টা ছাড়িয়ে। এত বেলা হয়ে গেছে অথচ তার মনে হচ্ছে এখনও সকাল চলছে। ফারিশ রান্নাঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়েই বললো,
“আদিব,

আদিব মুরগী বাজছিল। হঠাৎই ফারিশের কণ্ঠ শুনে পিছনে তাকালো। এক ঝলক ফারিশকে দেখে বললো,“জি ভাই। আপনার ঘুম ভেঙেছে?”

ফারিশ আরো দু’পা রান্না ঘরে দিলো। বললো,
“হুম। এগুলো কি করছো তুমি?”
“রান্না ভাই। মুরগীর রোস্ট আর পোলাও।”
“তা তো দেখছি কিন্তু হঠাৎ তুমি রাঁধতে গেলে কেন?”
“এমনি ভাই। রোজ রোজ হোটেলের খাবার ভালো লাগছিল না তাই একটু রান্না করছি।”

ফারিশ কি বলবে বুঝছে না। এ বিষয়টা নতুন না। আদিব প্রায়শই এমন হঠাৎ হঠাৎ রান্নাবান্না করে। ফারিশ আর ভাবলো না। আদিবের রান্নার হাত সুন্দর। যা রাঁধে সবই সুস্বাদু আর মজাদার হয়। ফারিশ দাঁড়ালো না আর। যাওয়ার পথে বললো,
“ঠিক আছে রান্না করো আমি গোসল সেরে আসছি।”
“আচ্ছা ভাই।”

ফারিশ চলে গেল। আদিব রান্নায় মন দিলো।’
—–
হসপিটালে নিজ চেম্বারে বসে আছে আদ্রিতা। মিটমিটিয়ে হাসছে সে। আর তাকে ঘিরে বসে আছে আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। লাঞ্চ টাইম চলছে। আজ সবাই মিলে ঠিক করলো লাঞ্চটা আদ্রিতার চেম্বারে বসে খাবে। তাই চেম্বারের মেজেটা খুব সুন্দর ভাবে মোছা হয়েছে। সাদা টাইসটা চকচক করছে মেজেটা। কিন্তু তাও কোথাও গিয়ে নড়েবড়ে লাগছে। মৃদুল কিছুটা কপাল কুঁচকে বললো,“নিজটা যতই চকচকে হোক এখানে বসে খেতে ইচ্ছে করছে না চল সবাই মিলে ছাঁদে যাই।”

মৃদুলের কথা শুনে আশরাফ বললো,“এখন ছাঁদে যেতে নিলে লাঞ্চ করার সময় থাকবে না। তাই নিচে না বসতে চাইলে চেয়ার পেতেই বসি না সবাই।”

আশরাফের কথায় যুক্তি আছে। তাই কেউ আর বেশি কথা না বলে চেম্বারের টেবিলে গোল হয়ে বসে খেতে শুরু করলো। আদ্রিতার মাঝে কোনো ভাবাক্রান্ত নেই। সে নীরব। চুপচাপ। বিষয়টায় তার বন্ধুমহলরা বেশ চিন্তিত। কারণ আদ্রিতা কখনোই এতটা চুপচাপ থাকে না। তারা শুনেছে আদ্রিতাকে নাকি কোন ছেলে দেখতে এসেছিল। তাও রেস্টুরেন্টে। কিন্তু আদ্রিতা বিয়ে করবে না এমনটা নাকি বলে দিলেছে। মৃদুল বুঝে না এখনও বিয়ে না করলে আর কবে করবে। মৃদুল আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“আদু,

আদ্রিতা তড়িৎ চমকে ঘুরে তাকালো মৃদুলের দিকে। বললো,“হুম বল,

রনি বললো,“কি হয়েছে তোর?”
রনির কথায় চরম চমকান চমকালো আদ্রিতা। ভড়কানো গলায় বললো,
“কি হবে?”
“তোর হাবভাব ঠিক লাগছে না।”(চাঁদনী)
“আমারও কেমন যেন লাগছে।” (মুনমুন)

আশরাফও বেশ ভাবলো বিষয়টায়। তারও কেমন ঠেকছে যেন আদ্রিতার হাবভাব। আশরাফ মুখে এক লোকমা খাবার নিয়ে তা চিবোতে চিবোতে বললো,“সত্যি কি তোর কিছু হয়েছে আদু?”

বন্ধুদের একে পর এক প্রশ্নে হতমত খাচ্ছে আদ্রিতা। সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ তার বন্ধুমহলের হলোটা কি?” আদ্রিতা বেশ হতভম্ব স্বরে বললো,“আমি সত্যি বুঝচ্ছি না তোরা কি বুঝাতে চাচ্ছিস?”

মৃদুলের সোজা কথা,“প্রেমেট্রেমে পড়েছিস বোইন?”

সঙ্গে সঙ্গে যেন আরো ঘোর চমকান চমকালো আদ্রিতা। চোখ বড় বড় করে বললো,
“এসব কি বলছিস তুই?”
“বিয়েটা করলি না ক্যান।”(রনি)
“আরাফাতের আমাকে পছন্দ হয় নি তাইলে বিয়ে কিভাবে করবো।”

কথাটা ঠিক হজম হতে চাইলো না কারোই। তবুও জোরজবরদস্তি করে কথাটা হজম করে নিলো। এবার আদ্রিতা বললো,“তোরা বিয়ে করছিস না কেন?”

মৃদুল বেশ ভাব নিয়ে বললো,“আগামী পরশু তোগো ভাবিরে দেখতে যাইতাছি। পছন্দ হইলেই বিয়া পাক্কা।”

মৃদুলের হাবভাবে সবাই বেশ হাসলো। রনি মুনমুনের দিকে তাকিয়ে বললো,“মুন চল না আমরাও বিয়েটা করে ফেলি।”

মুনমুন নাকমুখ কুঁচকালেও বললো,“বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিস একবারও। খালি বিয়ে বিয়ে করিস।”

সঙ্গে সঙ্গে পুরো বন্ধুমহল যেন মুনমুনের পানে চাইলো। কি বললো মেয়েটা। তাহলে কি রনিকে বিয়ে করতে সম্মতি জানালো মুনমুন। বন্ধুমহলের হাবভাবে বিষম খেল মুনমুন। তড়িৎ চোখ মুখে লাজুক ভাব এনে বললো,“তোরা এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন?”

আচমকাই হুল্লোড় করে উঠলো সবাই। মুনমুন বিস্মিত। রনি বললো,“কালই তবে যাচ্ছি তোর বাড়ি মুন।”

মৃদুল তো চেঁচিয়ে বললো,“উড়ে মামা ফাইনালি বান্ধুবীর বিয়া খামু।”

মুনমুন মুখে শিখার না করলেও তারা জানতো মুনমুন রনিকে পছন্দ করে। রনির পাশে কোনো অচেনা মেয়েমানুষদের সহ্য করে না। এর আগে যতবার রনি তাকে বিয়ের কথা বলেছে ততবারই তার উত্তর ছিল “তোকে বিয়ে করবে কেডা?” কিন্তু আজকের উত্তরটা ছিল ভিন্ন। তাই সবাই ভেবেই নিয়েছে ফাইনালি তাদের বান্ধুবী, বন্ধুকে বিয়ে করতে রাজি।”

মুনমুন তব্দা খেল সবার উল্লাস দেখে। নিজেও হেঁসে ফেললো হঠাৎ। রনি ভিড়ে মাঝে এগিয়ে এলো মুনমুনের দিকে। বললো,“সত্যি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবো তোর বাড়ি?”

মুনমুন আর না করলো না। সে লাজুক হেঁসে বললো,“আয়।”

মুনমুনের কথা শুনে আচমকাই রনি মুনমুনকে জড়িয়ে ধরলো। হতভম্ব বন্ধুমহল। পরমুহূর্তেই সবাই সবার চোখ বন্ধ করে হেঁসে হেঁসে বললো,“আমরা কিন্তু কিছু দেখি নি।”

হাসে রনি। লজ্জায় মিইয়ে যায় মুনমুন।’
হাসি তামাশার মাঝে হঠাৎ একটা মেসেজ আসে আদ্রিতার। সে দেখে। কিছু ভাবে। কল করে একজন মেডিকেলের স্যারকে। বলে,
“স্যার আমার তিনঘন্টার জন্য একটু ছুটি চাই। বিষয়টা ইমারজেন্সি।”
—–
বাড়ির ছাঁদে বিশাল টেবিল বসানো। মাথার উপর গোল আকৃতির ছাতা। সঙ্গে গোল টেবিলটার চারপাশে চারটে চেয়ার বাঁধানো। আদিব টেবিলে খুশি মনে খাবার বারছে। পোলাও, রোস্ট, ছালাত,ড্রিংক হিসেবে কোক দিয়ে জায়গাটা সাজাচ্ছে আদিব। আজ একটা বিশেষ দিন যার জন্যই আদিবের এত আয়োজন। ফারিশ ছাঁদে প্রবেশ করলো তখন। আদিবের কান্ডকারখানা তার মাথায় ঢুকছে না ঠিক। ফারিশ আদিবের কাছাকাছি এসেই বললো,“এগুলো কি করছো আদিব?”

আদিব মিষ্টি হাসলো। সাজানো শেষ তার। আদিব খুব উৎসাহ নিয়ে বললো,“শুভ জন্মদিন ভাই।”

সঙ্গে সঙ্গে অবাক হলো ফারিশ। চমকালো দারুণ। এতক্ষণে বুঝলো আদিবের এত তোড়জোড় কিসের। ফারিশ বললো,“তুমিও না আদিব।”

ফারিশ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আদিবকে। বললো,
“এই ভুল তারিখ কেন সেলিব্রেট করো আদিব।”
“দিনটা আমার খুব প্রিয় ভাই।”

ফারিশ কিছু বলে না। একগাল হেঁসে বলে,
“চলো খাই।”

আদিব গেল না। শক্ত কণ্ঠে বললো,“আমি খাবো না ভাই।”

ফারিশ অবাক স্বরে বললো,“কেন?”
সেই মুহূর্তেই ছাঁদে ছুটে আসলো আদ্রিতা। বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,“শুভ জন্মদিন মিস্টার বখাটে।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৫

বেশ বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে ফারিশ আদ্রিতার দিকে। এই মুহূর্তে কোনোভাবেই আদ্রিতার উপস্থিতি আশা করে নি সে। ফারিশ বার কয়েক পলক ফেললো সত্যি দেখছে নাকি। আদ্রিতা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে প্রতিনিয়ত। তার বুক কাঁপছে। এভাবে আচমকা, দৌড়ে ছাঁদে ছুটে আসতে তার খুব কষ্ট হয়েছে কিন্তু ফাইনালি আসতে তো পারলো। আদ্রিতা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতেই খুঁড়িয়ে হেঁটে এগিয়ে আসতে লাগলো ফারিশের দিকে। ফারিশের ঘোর তখনও কাটে নি। আদিব ফারিশের কাঁধে হাত রাখলো। মৃদু হেসে বললো,“সময়টা আপনার ভালো কাটুক ভাই।”

আদিব চলে গেল। ফারিশ তার কথাটা শুনতে পেয়েও জবাবে কিছু বলতে পারলো না। তার মানে এটাও আদিবের কাজ। আদিব যাওয়ার পথে আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেঁসে এতটুকু বলে শুধু,“থ্যাংক ইউ।”

বিনিময়ে মৃদু হাসে আদ্রিতা। আদিব ছাঁদ থেকে বেরিয়ে গেল। তবে শুধু ছাঁদ নয় সে বাড়ি থেকেই বেরিয়ে গেল। আদ্রিতা ফারিশের দিকে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। শীতল স্বরে বললো,
“অবাকটা কি খুব হয়েছেন?”

ফারিশের হুস আসে। তাও থতমত খেয়ে বলে,“খুবের চেয়েও বেশি।”

মৃদু হাসে আদ্রিতা। নিজের হাত ঘড়িটার টাইমটা দেখে বলে,“আমার কাছে খুব বেশি সময় নেই। আসুন খাওয়া দাওয়া শুরু করি।”

ফারিশ নিস্তব্ধ পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। ফারিশের হাত ধরে আদ্রিতা। বসিয়ে দিলো চেয়ারে। ফারিশের নির্বিকার চাহনি তখন। আদ্রিতা নিজ চেয়ারে বসে বলে,“আজ আপনার জন্মদিন আমায় আগে বলেন নি কেন?”

ফারিশ স্বাভাবিক হলো। সরু চোখে আদ্রিতার পানে তাকিয়ে বললো,
“আগে বললে কি হতো?”
“আপনার জন্য গিফট নিয়ে আসতাম।”

ফারিশ আচমকা হেঁসে ওঠে। বলে,
“জন্মদিনে গিফটও দিতে হয় জানতাম না তো।”

আদ্রিতা বেশ অবাক হয়। বলে,
“এ কেমন কথা। জন্মদিনে গিফটই তো আসল।”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,
“না গিফট আসল নয়। আপনি যে এসেছেন এটাই আসল।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফারিশ আদ্রিতার প্লেটে পোলাও, মুরগীর রোস্ট দিলো। বললো,“এগুলো সব আদিব রান্না করেছে খেয়ে দেখুন তো।”

আদ্রিতা যেন এবার আরো অবাক হলো। আদিব রান্না করেছে। বিষয়টা দারুণ তো। আদ্রিতা ফারিশের প্লেটে খাবার দিলো। উৎসাহ নিয়ে বললো,
“আপনার জন্মদিন আপনি আগে খান।”

ফারিশ খাবার নাড়াতে নাড়াতে বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“সত্যি বলতে আজ আমার জন্মদিন নয়।”

আদ্রিতা যেন বিস্মিত হলো। চোখ মুখের ভঙ্গি গেল পাল্টে। এই ফারিশ বলে কি! আদ্রিতা বিস্মিত কণ্ঠেই বললো,“মানে।”

ফারিশ পোলাও মুখে দিলো। চোখ বুজে বললো,“উম্ দারুণ হয়েছে। এই ছেলেটার রান্নার হাত এত সুন্দর কেন কে জানে!”

আদ্রিতাও মুখে পোলাও দিল। খেতে সত্যি দারুণ হয়েছে। আদ্রিতা বিচলিত কন্ঠে বললো,“মানেটার উত্তর কিন্তু দিলেন না।”

ফারিশের চোখমুখ বেশ শান্ত। হাবভাবও স্বাভাবিক। সে বললো,“আসলে আমার জন্মদিন কবে এটা আমি নিজেও জানি না। আমার বাবা মা কে তাও জানি না। আজকের এই দিনটায় আমার সাথে আদিবের প্রথম দেখা হয়েছিল। বয়স তখন বড়জোর পাঁচবছর হবে। ছেলেটা এইদিনটাকে আমার জন্মদিন ভেবে সেলিব্রেট করে। ওর নাকি এই দিনটা খুব প্রিয়। আর কিছু না।”

আদ্রিতা যেন মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। এই আদিব ফারিশকে কতটা ভালোবাসে তা যেন আজকের দিনটাই জলজ্যান্ত প্রমাণ। চাঁদনীর সাথে আদিবের মিলটা হলে বেশ হবে। চাঁদনী নিশ্চয়ই খুব সুখী হবে। আদ্রিতার ভাবনার মাঝেই ফারিশ বললো,
“ঘৃণা আসলো কি আমার উপর?”

তড়িৎ চমকে উঠলো আদ্রিতা। কথার অর্থ না বুঝে বললো,
“হঠাৎ ঘৃণা আসবে কেন?”
“কেন আবার আমার বাবা মা কে বা কারা জানা যে নেই।”
“এসবে আমার ঘৃণা আসার কোনো কারণ দেখি না।”
“সত্যি কি দেখছেন না নাকি দেখতে চাইছেন না।”
“আপনি যেটা মনে করেন।”

ফারিশ চুপ করে রইলো। মুরগীর রোস্টটা মুখে চিবোতে চিবোতে বললো,“এক ইমাম ছিলেন রংপুরে তার বাড়ি। তিনি যে মসজিদের ইমাম ছিলেন সেই মসজিদেই কে যেন আমায় রেখে যায়। তারপর উনি লালন পালন করেন। নাম দেন ফারিশ মাহামুদ। সেই থেকেই আমি ফারিশ মাহমুদ।”

আদ্রিতা ফারিশের সব কথাটুকু মন দিয়ে শুনলো। তার মনে কিছু প্রশ্ন জাগলো যেমন রংপুর থাকলে ফারিশ ঢাকা আসলো কি করে, আর সেই ইমামও বা কোথায় আর আদিবের সাথে কিভাবে পরিচয় ফারিশের তাও পাঁচবছর বয়সে। আদ্রিতা প্রশ্নগুলো করার জন্য মুখ খুলতে নিতেই ফারিশ বলে উঠল,“আজ এই পর্যন্তই বাকি কথা অন্য আরেকদিন বলবো।”

আদ্রিতা থেমে গেল। গলায় আসা প্রশ্নগুলো গলাতেই আটকে রইলো। প্রায় আধঘন্টা সময় নিয়ে নিজেদের খাওয়া শেষ করলো আদ্রিতা আর ফারিশ। আদ্রিতার পেট খানিকটা ভরা থাকলেও আদিবের রান্নার স্বাদে খাওয়া যেন থামানোই গেল না।’

সময়টা প্রায় দুপুর সাড়ে তিনটার কাছাকাছি। সূর্যের তীব্র তাপ শূন্যের দিকে। আদ্রিতা ফারিশের সোফা রুমে দাঁড়ানো। তাকে যেতে হবে। পাঁচটায় তার একটা সার্জারীর অপারেশন আছে। দ্রুত হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। আদ্রিতা হাত ঘড়িটা আবার দেখলো। ফারিশ আসলো তখন। গায়ে জড়ানো ব্লাক হুডি। চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ছেলেটা নামছে। আদ্রিতা কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো তার পানে। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে লাজুক হাসলো। ফারিশ দেখলো কিছু বললো না। আদ্রিতা শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
“কোথায় যাবেন?”
“আপনার সাথে।”
“হসপিটাল।”
“হুম।”

আদ্রিতা হাল্কা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে চললো বাহিরে। সে গাড়ি আনে নি কোনো। ফারিশ তার একটা লাল গাড়ি বের করে বললো,“চলুন যাই।”

আদ্রিতা দ্বিধাহীন গেল। ফারিশ গাড়িতে বসলো। আদ্রিতাও বসলো। ফারিশ গাড়ির সিটব্লেট লাগাতে লাগাতে বললো,
“আপনার পায়ের ব্যাথা এখনও কমেনি?”
“কমেছে।”
“তবে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন যে?”
“অল্প স্বল্প আছে এখনো।”

ফারিশ আর কিছু বললো না। আদ্রিতাও চুপ রইলো। গাড়ি চলছিল সূদূরে। চারপাশ কেমন যেন ঠেকছে আদ্রিতার। তারা কি সত্যিই প্রেমিক প্রেমিকা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’
—-
নিজের চেম্বারে বসে আছে চাঁদনী। সামনেই তার পেশেন্ট বসা। পেশেন্টটা হলো আদিব। তার নাকি মুখের ডানদিকের মাড়ির দাঁতে ব্যাথা। অথচ চাঁদনী দেখে তেমন কিছুই পেল না। আবার মনেও হলো না ব্যাথা আছে বলে। চাঁদনীর বুক দুরুদুরু করছে। ছেলেটার আচমকা আগমনে সে কিছুটা থমকে গিয়েছিল। পরে অবশ্য নিজেকে সামলেছে। আদিবের ভাবখানা এমন ছিল ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। যেন চাঁদনীর সাথে তার আগে কখনো দেখা হয় নি। চাঁদনী বললো,
“আপনার দাঁতে কি সত্যি ব্যাথা করছে?”

আদিবের নিষ্পলক চাহনি। অস্থির দু’খানা চোখ। সে বললো,“সত্যি করছে?”

চাঁদনী জোরে নিশ্বাস ফেললো। বললো,
“আমি কিছু ব্যাথার ঔষধ লিখে দিচ্ছি আশা করি খেয়ে নিলেই কমে যাবে।”

আদিবের ছোট্ট করে জবাব,“আচ্ছা।”
—-
রাস্তা জুড়ে নীরবতা। গাছের পাতা মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ নড়ছে। বাতাসের আনাগোনা নেই তেমন। বিকেল ছাড়িয়ে প্রকৃতি নিস্তেজ প্রায়। ফারিশ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। আদ্রিতাও চুপচাপ বসা। কথা বলতে চাইছে ঠিকই কিন্তু কি বলবে বুঝছে না। আদ্রিতা অনেক ভেবে চিন্তে প্রশ্ন করলো,
“আপনি কি নামাজ পড়েন ফারিশ?”

ফারিশের দ্রুত জবাব,“না।”
আদ্রিতার বিস্মিত আঁখিজোড়া আরো বিস্মিত হলো। নীরব স্বরে বললো,
“কেন?”
“তার কাছে আমার অনেক অভিযোগ।”
“তো নামাজ পড়ে জানাচ্ছেন না কেন?”
“পাপী মানুষের কথা কি সে শোনেন?”

আদ্রিতা ভড়কালো। বার কয়েক পলক ফেলে বললো,
“তিনি সবার কথা শোনেন।”
“তবুও আমার মনে হয় আমার মতো পাপী মানুষের কথা শোনেন না।”
“কি পাপ করেছেন আপনি?”
“যার জন্মই বোধহয় পাপ দিয়ে সে আর কি বড় পাপ করবে।”

আদ্রিতা হঠাৎ যেন কি হলো। সে উচ্চস্বরে বললো,
“গাড়ি থামান।”

ফারিশ গাড়ি থামালো। আদ্রিতা ফারিশে দিকে ঘুরলো। হাত দুটো ধরলো। খুব শান্ত স্বরে বললো,“শিশুরা যখন জন্ম নেয় তারা নিষ্পাপ হয়। আপনিও নিষ্পাপ। মানুষ বড় হয়ে পাপী হয়। কিন্তু আমার মন বলে আপনি পাপী নন ভালো মানুষ। আমার ভালো মানুষ।”

আদ্রিতার “আমার ভালো মানুষ” কথাটা বুঝি সোজা ফারিশের বুকে গিয়ে বিঁধলো। যন্ত্রণা দিলো খুব। তার বিতৃষ্ণায় ধরিয়ে রাখা কণ্ঠটা বলতে চাইলো,“আপনার মন ভুল বলে ডাক্তার ম্যাডাম। আমি দারুণ পাপী মানুষ। এক হাতে মানুষ বাঁচাই আরেক হাতে মানুষ মারি।”

ঠোঁটের কথা ঠোঁটে রইলো। বলা হয়ে উঠলো না। ফারিশ জোরে নিশ্বাস নিলো। বুকে ব্যাথা উঠেছে তার। কিন্তু আদ্রিতাকে বুঝতে দিলো না তা। আদ্রিতা বললো,“আপনি আজ থেকে নামাজ আদায় করবেন। মাগরিব দিয়ে শুরু করবেন। বুঝেছেন।”

ফারিশ কিছু বলে না। আদ্রিতা বলে,
“কথা দিন রোজ নামাজ আদায় করবেন?”

ফারিশের বুক দুরুদুরু করছে। কণ্ঠস্বর আঁটকে আসছে প্রায়। আদ্রিতা আবার বললো,
“কি হলো কথা দিন?”

ফারিশ বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,“ঠিক আছে।”
আদ্রিতা খুশি হলো। আচমকা ফারিশকে জড়িয়ে ধরলো। ফারিশ চমকে উঠলো এতে। তার নিশ্বাস বুঝি আঁটকে আসলো। ভাড়ি হলো শরীর। এই প্রথম আদ্রিতা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। ফারিশ কি করবে বুঝচ্ছে না। বুকে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে। অস্থিরতায় চারপাশ যেন কাঁপছে। হৃদয় বার বার জানান দিচ্ছে ‘এবার তুই শেষ ফারিশ,এবার তুই শেষ।’ ফারিশের হাত কাঁপছে তারও কি উচিত আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরা। ফারিশ ধরতে পারলো না। তার হাতখানা আদ্রিতাকে ছুঁতে নারাজ। কেমন অবশ হয়ে আছে। তবুও ফারিশের এই মুহূর্তটা ভালো লাগছে। বলতে ইচ্ছে করছে,“আমায় কখনো ছাড়বেন না ডাক্তার ম্যাডাম। আজীবন ধরে রাখবেন। আমি মানুষটা আপনায় ছাড়তে চাইলেও আপনি কখনো ছাড়বেন না। কখনো না।”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে