এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-২২+২৩

0
149

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২২

পর পর দু’কাপ কফি খাওয়া শেষ আদ্রিতার। অথচ আরাফাতের এখনও আসার নামগন্ধ নেই। আদ্রিতা চরম বিরক্ত এতে। আদ্রিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আধঘন্টার মধ্যে না আসলে সে চলে যাবে। এমন ইরেসপন্সিবেল একটা ছেলেকে কি করে তার মামা পছন্দ করলো কে জানে। ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে আদ্রিতার। আদ্রিতা তৃতীয়বারের কফির কাপে চুমুক দিলো। আশপাশ দেখলো। আচমকা বুকের মধ্যে ধক ধক করে উঠলো। কেউ বুঝি আসছে। যার সাথে আদ্রিতার সাক্ষাৎ নেই এক সপ্তাহ হবে। কিন্তু কি করে আসবে! ফারিশের কি এখানে আসার কথা! না তো। আদ্রিতা তাকিয়ে রইলো কফিশপের দরজার দিকে। সে যত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ততই যেন ধীরে ধীরে অস্থিরতা বাড়ছে। সেকেন্ডের কাটা হড়হড় করে ছুটছে। আদ্রিতা তার দৃষ্টি কফিশপের দরজার দিকে নিবদ্ধ রেখেই কফির কাপে চুমুক দিলো আবার। একটা ছেলের পায়ের পদধ্বনি শোনা গেল বুঝি। আদ্রিতা তার বুকে হাত দিলো। সত্যি কি সে এসেছে। সময় যত এগোচ্ছে ততই যেন আদ্রিতার আগ্রহ, অনুভূতি, অস্থিরতা তড়তড় করে বাড়ছে। কফিশপের দরজা খুললো কেউ। আদ্রিতা দেখলো। কালো কোট-প্যান্ট পরিধিত এক যুবক। আদ্রিতা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিজের ফোনটা দেখলো। ছেলেটা আরাফাত। আদ্রিতার মনটা ভেঙে গেল। ফারিশ তো এলো না তাহলে এমন অস্থির লাগলো কেন আদ্রিতার। আরাফাত এগিয়ে আসতে লাগলো। আদ্রিতা তার দৃষ্টি সরালো। যার কারণে সে দেখতে পেলো না আরাফাত ঢোকার পরেই দরজা খুলে ঢুকলো প্রথমে আদিব এরপরে কালো মাস্ক আর হুডি পরিধিত ফারিশ।

আরাফাত মৃদু হেসে আদ্রিতার মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। বললো,
“হাই আমি আরাফাত।”

আদ্রিতা কোনোরকমের হেসে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম। আমি আদ্রিতা।”

শুরুতেই খানিকটা লজ্জা পেল আরাফাত। সালামটা তার দেয়া উচিত ছিল। আরাফাত লজ্জিত স্বরেই বললো,
“ওলাইকুম আসসালাম। আমি খুব দুঃখিত এতটা দেরি করার জন্য আসলে অফিসে একটু কাজ ছিল তাই আর কি।”
“ইট’স ওকে।”

কথাটা মুখে বললেও ভিতরে ভিতরে বললো,“তোর যখন এতই কাজ ছিল তাহলে আজ আসতে বললি কেন। খাটাশ বেডা।”

মিষ্টি হাসলো আদ্রিতা। ভিতরের কথা ভিতরের রয়ে গেল। আরাফাত বললো,
“কিভাবে কি শুরু করবো বুঝচ্ছি না। সত্যি বলতে আপনার যখন ছবি দেখেছিলাম তখনই আপনায় ভালো লেগেছিল। সামনাসামনি আপনি আরো সুন্দর দেখতে।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। মুখের ওপর হঠাৎ কেউ প্রশংসা করলে সে বেশ বিভ্রান্ত অনুভব করে। আরাফাত ওয়েটার ডাকলো। কফি অর্ডার করলো। আদ্রিতা খেতে থাকায় তার জন্য আর দেয় নি। আরাফাত প্রশ্ন করলো,
“তা আপনি কিসের ডক্টর যেন?”
“জি। সার্জারীর। মোটামুটি সব ধরনের সার্জারীই আমি করে থাকি।”
“ওহ আচ্ছা। নিশ্চয়ই সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন?”
“তা একটু থাকি। আপনি ইঞ্জিনিয়ার তো?”
“জি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।”

ওয়েটার কফি নিয়ে আসলো। আরাফাত কফির কাপে চুমুক দিলো আর টুকিটাকি প্রশ্ন বললো। আদ্রিতাও বিনয়ের সাথে প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলো।
—-
আদ্রিতার থেকেই খানিকটা দূরে মুখে মাস্ক, মাথায় হুডির টুপি মাথায় দিয়ে বসে আছে ফারিশ। তার সামনেই আদিব বসা। আদিব বললো,“কফি কি অর্ডার করবো ভাই?”

ফারিশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“করো। আর কফিশপের মালিককে বলো আমি এসেছি আধঘন্টার মধ্যে যেন কফিশপ খালি করে।”
“ঠিক আছে।”

আদিব উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎই তার নজর গেল আদ্রিতার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অবাক হয়ে বসে পড়লো নিজের চেয়ারে। ফারিশের নির্বিকার চাহনি। সে বললো,“কি হয়েছে?”

আদিব হতভম্ব স্বরে বললো,“ভাই আদ্রিতা ম্যাডামও এখানে আছে?”

ফারিশের মাঝে কোনো ভাবাক্রান্ত দেখা গেল না। তার তড়িৎ উত্তর আসলো,“তো। আর তাছাড়া আদ্রিতা ম্যাডামও বা কে?”

আদিব যেন আরেক দফা অবাক হলো এতে। যে মেয়ের সাথে ফারিশ ভাইয়ের এতবার সাক্ষাৎ তাকেই ভাই চিনতে পারছে না। আদিবের ভাবনার মাঝে ফারিশ আবার প্রশ্ন করলো,“কি হলো কথা বলছো কেন? আদ্রিতা কে?”

আদিব বিলম্বিত হলো। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে বললো,“ডাক্তার ম্যাডাম ভাই।”

ফারিশ যেন দারুণভাবে চমকালো। ফাইনালি সে জানলো ডাক্তার ম্যাডামের নাম আদ্রিতা। ফারিশ ঘুরে তাকালো। তার সম্মুখেই এক টেবিল পরে আদ্রিতা বসা। কারো সাথে কথা বলছে। ফারিশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আদিবের দিকে ঘুরলো। আদিব প্রশ্ন করলো,“এবার কি করবো ভাই?”

ফারিশ সময় নিলো না বেশি। তড়িৎ জবাব দিলো,“ সব ক্যান্সেল করো। জব্বার হোসেনকে কল করে বলো এবারের ডিল আমার অফিসে হবে। আজকেই রাত আটটায় হবে।”

আদিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আচ্ছা ভাই। আর গাড়ির মাল?”
“ওগুলো নিয়ে তুমি অফিসে চলে যাও। আমার এখানে কিছু কাজ আছে। আর হা এখানকার সিসিটিভি,,

পুরোটা বলা লাগলো না ফারিশের। আদিব মৃদু হেঁসে বললো,“বুঝতে পেরেছি। ভাই ভাবি কি পাবো এবার?”

ফারিশ তড়িৎ জবাব দিল না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মৃদু হেঁসে বললো,“দেখি।”

আদিব হাসলো। তার খুশি লাগছে। আদিব মিনিট চার কফিশপে থেকে কিছু কাজ সেরে আদ্রিতার অগোচরে বেরিয়ে গেল। কিছু ইশারা করে গেল ফারিশকে। ফারিশ ইশারা বুঝতেই তার মুখের মাস্ক খুলে পকেটে পুড়লো। মাথায় দেয়া টুপিটা সরিয়ে চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করলো। জায়গা পাল্টে বসলো আদিব বসা চেয়ারে। সেখান থেকে সরাসরি আদ্রিতাকে দেখা যায়। ফারিশ বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বসলো। মেন্যুকার্ড দেখলো একটু। এরপর উচ্চস্বরে আওয়াজ করে বললো,“ওয়েটার।”

আচমকাই ফারিশের কণ্ঠের মতো কারো কণ্ঠ ঠেকতেই আঁতকে উঠলো আদ্রিতা। তড়িৎ চাইলো সামনে। সঙ্গে সঙ্গে ব্রাউন কালার হুডি পরিধিত ফারিশকে বসা দেখতে পেয়ে আপনাআপনি হাসি ফুটে উঠলো আদ্রিতার। তার মানে তখনকার অনুভূতি ভূয়া ছিল না।’

ওয়েটার ফারিশের কাছে এসেই জিজ্ঞেস করলো,
“কি খাবেন স্যার?”

ফারিশ বেশ মনোযোগ দিয়ে মেন্যুকার্ড দেখলো। আশেপাশ কোথাও দেখলো না। ভাবখানা এমন সে আদ্রিতাকে দেখে নি। ফারিশ খালি খালি কতক্ষণ মেন্যুকার্ড দেখে বললো,
“এক কাপ ব্লাক কফি।”
“ওকে স্যার।”

ওয়েটার চলে গেল। ফারিশ চুপচাপ বসে মোবাইলে হাত দিলো। ফারিশ এতক্ষণ পর আন্দাজ করতে পারলো কফিশপে ঢোকার সময় তার এমন অস্থির লাগছিল কেন!’

রাগে গজগজ করছে আদ্রিতা। এই মুহূর্তে তার একমাত্র রাগের কারণ হলো ওই সামনে ভাব নিয়ে বসে থাকা ফারিশ। কারণ ফারিশ তাকে এখনো দেখে নি। ভাবখানা এমন যেন এতবড় কফিশপে সে ছাড়া আর কেউ নেই। আদ্রিতার রাগ লাগছে ছেলেটা তাকে দেখছে না কেন! আদ্রিতার মতে কোনো মানুষের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কোনো না ভাবে দেখতে থাকা মানুষটি আঁচ পেয়ে যায় কেউ তাকে দেখছে। বিষয়টায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি পারদর্শী হয়। তারা বেশিভাগ সময়ই ভীড়ের মধ্যেও বুঝতে পারে কোন ছেলে তাকে দেখছে। আদ্রিতা ফারিশকে দেখার পর থেকেই তার দিকে তাকানো। অথচ ফারিশের হুস নেই। রাগে আদ্রিতার মেজাজ বিগড়াচ্ছে। আরাফাত শেষ কফিকাপে চুমুক দিয়ে বললো,“অনেক তো কথা হলো এবার বলুন আপনার আমাকে কেমন লাগলো?”

আদ্রিতার তড়িৎ উত্তর,“ভালো না।”
আরাফাত তব্দা খেল খানিকটা। নিজেকে সামলে বললো,“জি।”

আদ্রিতার হুস আসলো। এতক্ষণ পর মনে পড়লো সে এতক্ষণ বসে কারো কথা শুনছিল। আদ্রিতা তড়িঘড়ি করে বললো,“আমি খুব দুঃখিত।”

আরাফাত বললো,“বিয়েতে কি হ্যাঁ বলা যায় এখন?”

আদ্রিতা সরাসরি তাকালো আরাফাতের দিকে। তড়তড় করে বলে উঠল,“না। আসলে আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। ও এখানেই কফিশপে আছে। আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে দেখা করাতে পারি। ওই যে আমাদের সামনে বসা ছেলেটি।”

আরাফাত পুরো কথা শুনেই পিছন ঘুরে চাইলো। ফারিশকে দেখলো। আদ্রিতা দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড রাগ করেছে। আরাফাতও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আদ্রিতা আটপাঁচ কিছু না ভেবেই ফারিশের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। রাগী রাগী কণ্ঠে বললো,“এই যে মিস্টার বখাটে।”

ফারিশ এতক্ষণ পর কফির কাপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আদ্রিতার দিকে তাকালো। অবাক হয়ে বললো,“আপ…

পুরো কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই আদ্রিতা ফারিশের কাছাকাছি গিয়ে হাত ধরে আরাফাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,“উনি আমার বয়ফ্রেন্ড আরাফাত। খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করছি।”

ফারিশের কাঁশি উঠলো আদ্রিতার কথা শুনে। এই মেয়ে বলে কি! আরাফাত কি বলবে বুঝতে পারছে না! কতক্ষণ হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থেকে নিজের হাত এগিয়ে দিল ফারিশের দিকে। বললো,“শুভ কামনা আপনাদের জন্য।”

ফারিশ হাত মেলালেও মুখে কিছু বললো না। তার কথা বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে। আদ্রিতা এবার ফারিশের থেকে সরে এসে বললো,“প্লিজ মাকে এগুলো বলবেন না। বলবেন আপনার আমাকে পছন্দ হয় নি। আসলে আমি চাচ্ছি আর এক মাস পর মাকে এগুলো জানাতে। বয়ফ্রেন্ডের বিষয়টা আপনায় আগে জানানোরই ইচ্ছে ছিল কিন্তু মায়ের জন্য বলতে পারি নি।”

আরাফাত মৃদু হাসলো। বললো,“আচ্ছা সমস্যা নেই। ভালো থাকবেন। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।”

আদ্রিতাও মিষ্টি হেঁসে বললো,“আমারও।”
আরাফাত আর দাঁড়ালো না চলে গেল। তার মনে হচ্ছে তার থেকে ফারিশকেই আদ্রিতার সাথে বেশি মানিয়েছে। আরাফাত কফিশপ থেকে বের হতেই আদ্রিতা রাগী রাগী চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসলো ফারিশের দিকে। ফারিশ তখনও চুপচাপ বসা। আদ্রিতা বললো,“কফিশপে আসলে যে একটু আশেপাশে তাকাতে হয় জানতেন না।”

ফারিশ সরাসরি তাকালো আদ্রিতার দিকে। জবাবে বললো,“সত্যি তাকাতে হয় জানতাম না তো।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফারিশ বললো,“আমরা কি সত্যি বিয়ে করছি?”

আদ্রিতা থতমত খেল প্রশ্নে। তখন রাগের বসে কি সব বলে দিয়েছে। ভাবতেই এখন লজ্জা লাগছে। ফারিশ আবার বললো,“উত্তর কিন্তু পেলাম না।”

আদ্রিতা নিচু হলো। ফারিশের চোখে চোখ রেখে বললো,“আপনি বলেছিলেন আপনি আমার চোখে যা দেখেন তা যদি সত্যি হয় তবে আমাদের রোজ সাক্ষাৎ হবে। অথচ গত সাতদিন যাবৎ আমাদের সাক্ষাৎ নেই। এতে প্রমাণ কি হয় ফারিশ আমার চোখের ভাষার সত্যিটা পড়তে পারে নি।”

আদ্রিতা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আর কিছু বলতে পারছে না। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। আদ্রিতা যেতে নিলো। ফারিশ উঠলো। আদ্রিতার হাত টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আদ্রিতা চোখ বন্ধ করলো এতে। ফারিশ তার কানের কাছে নিজের ঠোঁটখানা নিয়ে ফিস ফিস করে বলে উঠল,
“ফারিশের প্রেমের রাজ্যে আপনাকে স্বাগতম ডাক্তার ম্যাডাম।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৩

আকাশ জুড়ে মেঘ নেমেছে। শীতের আভাস নামছে দারুণ। মাগরিবের আযান শেষ হলো কিছু সময় পেরিয়েছে। সন্ধ্যা হয়েছে প্রায়। চারপাশ লালচে দেখাচ্ছে। জনসমূহ থেকে খানিক দূরে নিরিবিলি এক পরিবেশ। পাখিরা ছুটছে সূদুরে। ফারিশ আদ্রিতা বসে আছে একটা আলোহীন ল্যামপোস্টের নিচে। নীরব দুজনেই। কথা নেই কারো মুখে। তারা কফিশপ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রায় মিনিট পনের হবে। ফারিশ তার হুডির টুপি আর মাস্ক দুটোই পড়ে নিয়েছে। আদ্রিতা অনেক দ্বন্দ্ব হাটিয়ে নীরব স্বরে শুধালো,“আমরা কি এখন থেকে রিলেশনে আছি?”

ফারিশের দ্রুত জবাব,“না।”
আদ্রিতা বেশ অবাক হয়ে বললো,“তবে?”
ফারিশ কিছু বলে না চুপ করে রয়। অনেকক্ষণ পর আকাশ পানে তাকিয়ে বলে,“গত সাতদিন আপনার সাথে সাক্ষাৎ না করে আমি ভেবেছিলাম আমি বোধহয় আপনায় ভুলে যেতে পারবো। কিন্তু হলো না। আপনি হতে দিলেন না। আপনার সাথে দেখা না হওয়ায় গত সাতদিন আমার নিজেকে বড্ড এলেমেলো লেগেছে। আমাকে এতটা এলেমেলো না বানালেও কিন্তু পারতেন ডাক্তার ম্যাডাম।”

ফারিশ থামতেই আদ্রিতা বলে উঠল,“আর আপনি যে আমায় পাগল বানাচ্ছেন তার বেলা। আপনি জানেন গত সাতদিন আমি কতটা অস্থিরতায় ছিলাম। আমি রোজ আপনার জন্য আমার রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অপেক্ষা করতাম। আমার মন বলতো, আপনি আসবেন। অথচ আপনি আসতেন না। কতটা নিরাশ ছিলাম জানেন। কালকে তো মা ভাত রান্না করতে বলেছিল। আমি চুলায় পানি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি চাল দিতে আর মনে নেই।”

আদ্রিতার শেষের কথা শুনে ফারিশ হেঁসে উঠলো। খানিকটা শব্দও হলো সেই হাসিতে। আদ্রিতা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“একদম হাসবেন না তো আপনার হাসিতে আমার বড্ড অসহ্য লাগে।”

ফারিশ তার হাসি থামালো ঠিকই। তবে শীতল স্বরে আওড়ালো,
“আর আপনার অসহ্যকেই যে আমার দারুণ লাগে।”

আদ্রিতার মুগ্ধনীয় আঁখি। গলায় দৃঢ়তার ছোঁয়া। লোকটা এত সুন্দর করে কথা কেন বলে। কে জানে! আদ্রিতা মৃদু স্বরে বললো,
“আপনি এত সুন্দর করে কথা কেন বলেন ফারিশ?”
“আপনাকে পাগল বানানোর জন্য।”
“হয়ে তো গেছি কবেই।”
“আমি তো দেখি না।”
“আপনার চোখ আছে?”
“নেই।”
“আছে তো না থাকার মতো।”

ফারিশ মৃদু হাসলো। আদ্রিতা চোখ রাঙিয়ে বললো,
“আবার হাসছেন?”
“আমার দারুণ লাগছে।”

আচমকাই আদ্রিতাদের ল্যামপোস্টায় লাইট জ্বলে উঠলো। খানিকটা চমকে উঠলো আদ্রিতা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলালো । ফারিশ বললো,
“আমি কিন্তু ভালোবাসতে জানি না ডাক্তার ম্যাডাম।”
“সমস্যা নেই আমি শিখিয়ে নিবো।”
“আমার বাবা, মা, ভাই, বোন কেউ নেই।”
“তাতে কি আমার তো আছে।”
“আপনি বিপাকে পড়বেন।”
“আপনি সঙ্গে থাকলে সব বিপাক আমি ঘুচিয়ে নিবো।”
“আমার বারে বারে মনে হয় আপনি আমার সাথে ভালো থাকবেন না।”
“একবার রাখতে তো শিখুন ভালো থাকা আমি বুঝে নিবো।”

ফারিশ আর কিছু বলে না। চুপ করে রয়। তার বড্ড ছন্নছাড়া লাগছে। বিষাক্ত প্রেম তাকে বড্ড ভাবাচ্ছে। ফারিশ জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। আদ্রিতার হঠাৎ মনে পড়লো ফারিশের পিঠে থাকা সেই ক্ষতের কথা। এতবারের দেখা হওয়াতেও সে একবারও জিজ্ঞেস করে নি পিঠের যন্ত্রণা কি কমেছিল। আদ্রিতা এ কথা ভুলে কি করে গেল। আদ্রিতা দ্রুত প্রশ্ন করলো,“আপনার পিঠের ক্ষতটা কি কমেছিল? সেলাই কি কেটেছিলেন?”

ফারিশ দৃষ্টি রাখলো আদ্রিতার চোখের দিকে। মেয়েটাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ফারিশ বললো,
“হুম সেরেছে।”
“সেলাই কাটা হয়েছিল?”
“হুম আদিব কিছুদিন আগে একজন ডক্টর এনেছিল।”
“যাক ভালো।”

আবারও নীরবতা ভর করলো দুজনের মাঝে। একটু একটু করে সময় গড়ালো। সন্ধ্যা সরিয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগলো। আদ্রিতা অনেকক্ষণ পর বললো,
“আমরা কি সারাদিন এখানেই বসে থাকবো?”
“তুমি বললে আমি তাও করতে রাজি।”

আদ্রিতা বুঝি খুশি হলো। ফারিশ তাকে আবার তুমি করে বলেছে। সেদিনের তুমিটার চেয়েও আজকের তুমিটা যেন তাকে অন্যরকম অনুভূতি দিচ্ছে। আদ্রিতা মৃদু হাসলো। সাহস জুগিয়ে ফারিশের হাতখানা ধরলো। ফারিশের নিষ্পলক চাহনি। আদ্রিতা বললো,“আপনার মুখের তুমি ডাক আমায় বড্ড আনন্দ দেয়। আমায় তুমি করেই ডাকবেন।”

ফারিশের তখনই উত্তর আসে,“আর আপনার ভালো লাগা আমায় যে বড্ড পীড়া দেয় ডাক্তার ম্যাডাম।”
—-
রান্নাঘরে কাজ করছে আদ্রিতার মা। রাগে ফুঁসছেন তিনি। রাগটা হলো আরাফাতের ওপর। তার নাকি আদ্রিতাকে ভালো লাগে নি। কথাটা শোনার পর থেকেই আদ্রিতার মায়ের মেজাজ চরম খারাপ। ভালো যখন লাগে নি আগেই বলতো, ছবি দেখে কেন বলেছিল ভালো লেগেছে। খামোখা মেয়েটা তার পায়ে ব্যাথা নিয়ে ছেলেটার সাথে দেখা করতে গেল। বাড়ির কলিংবেল বাজার শব্দ আসলো তখনই। রাফিন নিজের পড়ার টেবিলে বসে বই পড়ছিল। আদ্রিতার মা আওয়াজ করে বললেন,“রাফিন দরজাটা খোল তো। তোর আপু এসেছে বুঝি।”

রাফিন উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত গিয়ে দরজা খুললো। সত্যিই অাদ্রিতা এসেছে। আদ্রিতা আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলো। রাফিন বললো,“আরাফাত ভাইকে তোর কেমন লাগলো আপু?”

আদ্রিতার জবাব,“মোটামুটি।”
রাফিন দরজা আঁটকে বোনের পিছু পিছু গেল। বললো,
“জানিস আপা আরাফাত ভাই বলেছে সে নাকি এখন বিয়ে করবে না।”
“ভালো তো। সত্যি বলতে আমিও এই বিয়েটা করতে চাচ্ছিলাম না।”

আদ্রিতার মা এগিয়ে এলেন। তড়তড় করে বললেন,“একদম ঠিক চেয়েছিলি আরাফাতকে আমারও ভালো লাগে নি। আমি তোর জন্য অন্য পাত্র দেখবো।”

আদ্রিতা কিছু বললো না চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। শীত করছে।”
—-
রাত ১১ঃ০০টা। নিজের কাজ সেরে বাড়ির বেলকনিতে বসে আছে ফারিশ। হাতে জলন্ত সিগারেটের ধুঁয়া উড়ছে। ফারিশ এখনও খায় নি। জাস্ট ধরিয়ে হাতে নিয়ে বসে আছে। তার নিজেকে বড্ড বিষণ্ণ লাগছে। আদিব পাশে এসে বসলো। বললো,“ভাই আপনি ঠিক আছেন তো?”

ফারিশ খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো। হাতের সিগারেটটায় এক টান দিয়ে বললো,
“আমি কি ভুল করেছি আদিব?”
“কিসের ভুল ভাই।”
“আমার জীবনে কোনো মেয়েমানুষ আনা কি ঠিক হলো আদিব।”
“কেন হবে না। পৃথিবীতে সব পুরুষের জীবনেই মেয়েমানুষ আসে ভাই।”

ফারিশ আদিবের দিকে তাকালো। হেঁসে হেঁসে বললো,
“তার মানে তোমার জীবনেও কোনো মেয়েমানুষ এসেছে আদিব।”

আদিব লজ্জা পেয়ে গেল। এ কথা আশা করে নি সে। ফারিশ বললো,“কে সে? নাম বল তোমাদের বিয়ে পড়িয়ে দেই।”

আদিব থতমত খেল। দোনামনা করলো কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাও অনেক ভেবে জবাব দিলো,“আপনি না করলে আমি কেমনে করি ভাই।”

ফারিশ সিগারেটে পর পর দু’বার টান দিয়ে বললো,“আচ্ছা বিয়েটা না হয় পরে দেখছি। মেয়েটাকে কে? নাম কি? তা তো বলো।”

আদিব লজ্জা মাখা মুখশ্রী নিয়ে বললো,
“নাম বললে আপনি হাসবেন ভাই।”
“কেন নাম সুন্দর নয়। ”
“তা না। নাম সুন্দর। কিন্তু?”
“কিন্তু কি?”

আদিব অনেকক্ষণ ভেবে বললো,“মেয়েটা ডাক্তার ম্যাডামের বন্ধু ভাই। নাম চাঁদনী।”

সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়কর চাহনী দিলো ফারিশ। আদিবের মাথা নোয়ানো। আচমকাই ফারিশ হেঁসে উঠলো। উচ্চ শব্দের সেই হাসি। আদিব বললো,“বলেছিলাম না ভাই আপনি হাসবেন।”

ফারিশ তার হাসি থামিয়ে বললো,“খারাপ না কিন্তু। প্রপোজ কবে করছো বলো?”

আদিব অবাক হয়ে বললো,
“এসব কি বলছেন ভাই। ওসব প্রপোজ ফ্রপোজ আমার ধারা সম্ভব নয়।”
“কিসের সম্ভব নয়! তুমি কালই মেয়েটাকে প্রপোজ করতে যাবে আদিব। ভাবি কি তোমার একার চাই আমার চাই না।”

আদিব এ কথার পিঠে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার লজ্জা লাগছে। মেয়েটাকে কি করে ফারিশ ভাইয়ের ভাবি বানাবে। মেয়েটা যদি রাজি না হয় তখন। আদিব বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মিনমিনিয়ে বললো,
“আমি নিজের রুমে যাই ভাই। আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন।”
“ঠিক আছে যাও।”

আদিব চলে গেল। ফারিশ পর পর কয়েকটা সিগারেটে সুখটান দিয়ে শেষ করলো। এরপর মদের গ্লাসে চুমুক দিলো। তার চোখ লাল হয়ে গেছে। প্রকৃতির বুক বেয়ে উপচে আসছে শীতল হাওয়া। ফারিশের শরীর কাঁপছে। তাও উঠছে না। হঠাৎই ফারিশ আধভেজা চোখে ওই আকাশ পানে তাকালো। রক্তলাল আঁখি নিয়ে আদুুরে স্বরে আওয়ালো,
“ওহে প্রকৃতি, তুমি তো জানতে ফারিশের বুকে প্রেম এক নিষিদ্ধ অধ্যায়। অথচ তুমি সেই প্রেমে ডুবিয়েই মারতে চাইছো আমায়। কাজটা কি ঠিক করছো?”

আকাশটা মৃদু বর্জপাতে কেঁপে উঠলো হঠাৎ। মৃদু শব্দে বইতে লাগলো বাতাস। তারা বুঝি জানান দিচ্ছিল কিছুর। ফারিশের প্রশ্নে উত্তরে বোধহয় বলছিল,
“ওহে নিঃস্ব পথিক, তুমি হয়তো বুঝচ্ছো না তোমার নিষিদ্ধ শহরে প্রেমই হবে এক শুদ্ধ প্রতীক।”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে