এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-১৮+১৯

0
142

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১৮

‘কক্সবাজার সেন্ট্রাল হসপিটালের’ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। ঘড়িতে দুপুর দু’টোর কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। আদ্রিতার কাজ শেষ হয়েছে আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে সে অপেক্ষা করছে তার গাড়ি আর ড্রাইভারের। আদ্রিতা খানিকটা বিরক্ত নিয়ে ফোন করলো সোহেলকে। রিং হতেই সোহেল ফোন তুললো। খানিকটা ঘাবড়ানো নিয়ে বললো,“আপনার কি কাজ শেষ হয়ে গেছে ম্যাডাম?”

আদ্রিতা নিজেকে ধাতস্থ করলো। রাগটা দমিয়ে রেখে বললো,“তুমি কোথায় সোহেল? আমি আধঘন্টা যাবৎ অপেক্ষা করছি। আমার কাজ আধ ঘন্টা আগেই শেষ হয়ে গেছে।”

সোহেল থরথর করে বললো,“ম্যাডাম একটু অপেক্ষা করুন। আসলে রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকায় আটকে পড়েছি।”

আদ্রিতা নিজেকে সামলালো। কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই পিছন থেকে উঁচু লম্বাটে টাইপের একজন লোক এসে দাঁড়ালো। গলা খাগাড়ি বললো,“আপনি ডক্টর আদ্রিতা তো?”

আদ্রিতা তক্ষৎনাৎ পিছন ঘুরে চাইলো। অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটিকে দেখতে পেয়ে বললো,“জি। আমি ডক্টর আদ্রিতা।”

লোকটি খানিকটা এগিয়ে এসে বললো,“আপনার সাথে কিছু কথা ছিল ম্যাডাম।”

আদ্রিতা কানের ফোনটা দেখলো। সোহেল তখনও লাইনে। আদ্রিতা সোহেলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তাড়াতাড়ি আসো সোহেল। আমি অপেক্ষা করছি কিন্তু।”

আদ্রিতার কথা শুনে সোহেলও থরথর করে বললো,
“আসছি ম্যাডাম।”

ফোন কাটলো আদ্রিতা এগিয়ে এসে সামনের লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“জি বলুন। কি বলবেন?”
“আসলে ম্যাডাম আমার বাবার বিষয়ে কিছু কথা ছিল। ওনার একটা রোগ হয়েছে।”
“ওহ। কি হয়েছে ওনার?”
“জি ক্যান্সার।”
—-
দুপুরের কড়া রোদ্দুরে আচ্ছন্ন চারপাশ। আদ্রিতা হাঁটছে। বিরক্তিতে তার মস্তিষ্ক এলেমেলো। ঘড়িতে প্রায় তিনটে ছাড়িয়ে চারটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। অথচ সোহেলের গাড়ি নিয়ে এখনো আসার নামগন্ধ নেই। একস্থানে কারণ ছাড়া কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় তাই আদ্রিতা হাঁটছে যদি হাঁটতে হাঁটতে সোহেলের দেখা পাওয়া যায়। আদ্রিতা একটু অধৈর্য্যশীল মানুষ। একস্থানে কারণ ছাড়া বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। তাই হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এগিয়েছে। চারপাশ প্রায় নির্জীব। সবাই হয়তো লান্স সেরে ঘুমাতে ব্যস্ত। আদ্রিতা চারপাশ দেখছে আর হাঁটছে। আচমকাই পায়ের সাথে কিছু বাজতেই হোঁচট খেল আদ্রিতা। ব্যাথায় আহ্ জাতীয় শব্দ বের হলো আপনাআপনি। সে নিচে বসে পড়লো। একটা বড়সড় লোহা তার জুতোর ভিতর দিয়ে পুরো ঢুকে গিয়েছে। আদ্রিতা দ্রুত টান দিয়ে লোহাটা বের করলো। সঙ্গে সঙ্গে কলকলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসলো পা দিয়ে। আদ্রিতা যথাসম্ভব নিজেকে সামলে ব্যাথাটা হজম করলো। আশেপাশে তেমন কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। আদ্রিতা একটু জায়গা বুঝে একটা গাছের নিচে বসলো। ব্যাগ থেকে স্যাভলন, ব্যান্ডেজ বের করলো। আদ্রিতা সবসময়ই ছোটখাটো ডাক্তারি সরঞ্জাম ব্যাগে নিয়ে ঘোরে। আদ্রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে নিজের ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করতে লাগলো।’
.
ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে ফারিশ। নিরিবিলি শান্ত এক রাস্তা পেরোচ্ছে। মনটা এবার বেশ স্বাভাবিক। আশা রাখে ওই ডাক্তার ম্যাডামের সাথে তার আর দেখা হবে না। কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই রাস্তায় আদ্রিতাকে দেখে চরম অবাক হয়ে বিষম খায় ফারিশ। বিস্মিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“যখনই ভাবি দেখা হবে না তখনই কোথা থেকে উদয় হয় এই মেয়েটা কে জানে?’

ফারিশ নিজেকে সামলালো এই মেয়েটার ধারে কাছেও ঘেঁষতে চায় না। ফারিশ আদ্রিতাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলে যেতে লাগলো নিজ গন্তব্যের দিকে। হঠাৎই লুকিং গ্লাসে দেখতে পেল আদ্রিতার পা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে ব্রেক কষলো ফারিশ। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আচমকা। ফারিশ আটপাঁচ কিছু না ভেবেই দ্রুত এগিয়ে গেল আদ্রিতার দিকে।’

এদিকে,
আদ্রিতা একরাশ বিরক্ত নিয়ে তুলোতে স্যাভলন লাগিয়ে ক্ষত স্থানে লাগাতেই কলিজা সমেত বুঝি কেঁপে উঠলো ব্যাথায়। দ্রুত নিচু হয়ে ফুঁ দিতে লাগলো পায়ে। সঙ্গে বললো,“পায়ে আঘাত পাওয়ার আর সময় পেলি না। আজই লাগতে হলো। ইস! কি যন্ত্রণা হচ্ছে। ফালতু লোহা। যে শালায় রেখেছিস না তোর কপালে বউ নাই। আবার বউ থাকলেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিবো দেখিস। অভদ্র মানুষজন। রাস্তাঘাটে লোহা ফেলে রাখিস। ও মা কি পরিমান জ্বলছে।”

বলেই জোরে জোরে ফুঁ দিতে লাগলো আদ্রিতা। কারো কণ্ঠ শোনা গেল তখন। কেউ বললো,“আমি কি একটু সাহায্য করবো আপনার?”

আদ্রিতা চমকে উঠলো। কণ্ঠটা চেনা। আদ্রিতা দ্রুত চাইলো। সামনেই ফারিশকে দেখে দারুণ অবাক হয়ে বললো,“মিস্টার বখাটে আপনি এখানে?”

ফারিশ কথাটা গায়ে না মেখে দ্বিধাহীন বসলো আদ্রিতার সামনে। আদ্রিতার হাত থেকে স্যাভলন তুলা নিয়ে বললো,
“কি করে হলো?”

আদ্রিতা জবাব দিলো না। উল্টো প্রশ্ন করলো,
“আপনি এখানে কি করছেন?”

ফারিশ বিরক্ত ভরা চাহনি নিয়ে বললো,“আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দিন।”

আদ্রিতা দমে গেল। মাথা নিচু করে বললো,
“পায়ে লোহা বিঁধেছিল।”

ফারিশ আবার চাইলো আদ্রিতার দিকে। গম্ভীর এক চাহনি। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কিভাবে বিঁধলো?”
“হাঁটতে গিয়ে।”
“চোখে কি দেখতে পান না?”
“পাই তো।”
“তাহলে কি করে ঘটলো?”
“অসাবধনতা।”
“চোখে দেখতে না পাওয়ার প্রথম অজুহাত।”
“অজুহাত কিসের আমি মটেও কানা নই।”
“কতটা কানা নন তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
“আমি ইচ্ছে করে করি নি কিন্তু।”

ফারিশ কিছু বললো না। সে সাবধানতার সাথে ক্ষত পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিলো। চোখে মুখে অশেষ বিরক্তির ছোঁয়া। সে বললো,
“যাচ্ছিলেন কোথায়?”
“ঢাকা ফিরছিলাম।”

ফারিশ অবাক স্বরে বললো,“হেঁটে হেঁটে।”
আদ্রিতার চোখে মুখে হতাশ। সে বললো,
“হেঁটে হেঁটে ঢাকা যাওয়া সম্ভব।”
“আপনি যে পাগল তাতে অসম্ভবের কিছু দেখি না।”
“দেখুন আপনি কিন্তু আমায় আবার অপমান করছেন।”
“সত্যি করেছি আমি ধরতে কেন পারছি না।”

আদ্রিতা রাগে ক্ষোভে চুপ হয়ে গেল। ফারিশ হাসলো। মনে মনে বললো,
“আপনি হুটহাট রাগবেন না ডাক্তার ম্যাডাম, আপনার রাগ দেখলে আমার নিজেকে কেমন মাতাল মাতাল লাগে।”

কথাটা মনে মনে ভাবলেও মুখে আর বলা হলো না। আদ্রিতা তুমুল বেগে রাগ নিয়ে সোহেলকে কল করলো। ফারিশ তার পানে তাকিয়ে। সোহেল ফোন তুলতেই ক্ষিপ্ত মেজাজে বললো আদ্রিতা,
“তুমি কি আজ আসবে সোহেল? নাকি আমি একা একাই চলে যাবো।”

সোহেলের চোখে মুখে বিস্ময়। সে নরম হলো। ভীতু স্বরে বললো,“আমায় ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম। আমার ভুল হয়ে গেছে। কথাটা আপনায় আগেই বলা উচিত ছিল কিন্তু বলি নি ভেবেছিলাম পারবো কিন্তু রাস্তায় জ্যাম থাকায় পারি নি ম্যাডাম। আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দিন।”

সোহেলের কথা শুনে আদ্রিতার চোখ মুখ কেমন একটা হয়ে গেল। সে চিন্তিত স্বরে বললো,
“কি হয়েছে সোহেল? বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?”

সোহেল গাড়ি থামিয়ে নীরবে বললো,
“সবাই ঠিক আছে ম্যাডাম। আসলে হয়েছে কি এতদিন বন্ধ থাকার কারণে সকালে দেরিতে ঘুমানোর একটা অভ্যাস হয়ে গেছিল। কাল আচমকা আপনার কল আসায় আমি বুঝতে পারি নি। রাতে এলার্ম দিয়েই ঘুমিয়েছিল কিন্তু আমার ঘুম ভাঙে ন’টায়। আমি তখনই বেরিয়ে পড়ি ভেবেছিলাম রাস্তায় জ্যাম থাকবে না দ্রুত স্পিড বারিয়ে চলে আসবো। কিন্তু রাস্তায় আমি আটকা পড়ি। আমার সন্ধ্যা হয়ে যাবে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। আমি কি করবো বুঝচ্ছি না ম্যাডাম?”

আদ্রিতা চুপ করে রইলো। কিছু ভাবলো। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“তোমায় আর আসতে হবে না সোহেল আমি এখান থেকেই বাসে টাসে করে চলে আসবো। তুমি বরং ব্যাক করো।”

সোহেল অপরাধীস্বরে বললো,
“আমায় ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম। আমি বুঝতে পারি নি।”
“ইট’স ওকে। আর ক্ষমার চাওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি ব্যাক করো।”
“আচ্ছা ম্যাডাম।”

ফোন কেটে গেল। আদ্রিতা চুপচাপ বসে। কি করবে ভাবছে। ফারিশ প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে?”
“আমার গাড়ি আসবে না।”
“কেন?”
“লেট হবে অনেক।”
“আপনি কি এখানে একা এসেছিলেন?”
“না বন্ধুদের সাথে।”
“তাহলে তারা কোথায়?”

আদ্রিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুরু থেকেই বললো আবার,
“আসলে বন্ধুদের সাথে দু’দিনের ট্যুরে এসেছিলাম। কিন্তু এখানের একটা হসপিটালে আমার কাজ পড়ে যাওয়ায় আমি থেকে যাই। ওরা কাল রাতে চলে যায়। আমার গাড়িটাকে আসতে বলেছিলাম কিন্তু রাস্তায় জ্যাম পড়ায় ড্রাইভার আটকা পড়ে। ওর এখানে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাই ওকে আসতে বারণ করেছি ভাবছি বাসেটাসে চলে যাবো।”

ফারিশ মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ওহ আচ্ছা বুঝেছি বুঝেছি।”
“জি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমায় সাহায্য করার জন্য। তবে এবার আমায় যেতে হবে।”

কথাটা বলে নিচে পড়ে থাকা সরঞ্জামগুলো উঠিয়ে আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আদ্রিতা। পায়ে যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু কি করার তাকে তো যেতেই হবে। আদ্রিতা ফারিশকে ছাড়িয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে যেতে যাবে তার আগেই তার হাত ধরে বসলো ফারিশ। আদ্রিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। জিজ্ঞেসাসূচক চাইলো ফারিশের পানে। ফারিশ উল্টোদিকে ঘুরেই বললো,“বাসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই আমার সাথে চলুন। আমিও ঢাকায় যাচ্ছি।”

আদ্রিতা অবাক হলো। দ্বিধাহীন স্বরে বললো,
“আপনার অসুবিধা হবে না?”

ফারিশ ঘুরে তাকালো। আদ্রিতার চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে শুধালো,
“আপনার পায়ের যন্ত্রণার চেয়ে কম।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১৯

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে প্রকৃতি জুড়ে। থমথমে চারপাশ। সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে গাড়ি জুড়ে। ফারিশ চুপচাপ ড্রাইভ করছে। পাশেই আদ্রিতা বসা। ফারিশ এক ঘন্টার মতো হবে গাড়ি চালাচ্ছে। আদ্রিতার পায়ে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। গাড়ির সব জানালা বন্ধ। শীত লাগছে খানিকটা। আদ্রিতা অনেকক্ষণ পর বললো,
“সামনে কোনো টংয়ের দোকান পেলে দাঁড়াবেন তো চা খাবো।”

ফারিশ সে কথার উত্তর দিলো না। উল্টো বললো,“আপনার কি খিদে পেয়েছে?”

আদ্রিতার দ্বিধাহীন উত্তর,
“খানিকটা।”
“ওহ।”
“তবে ভাতের খিদে নয়।”

ফারিশ বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“মানে?”
“মানেটা হলো চায়ের খিদে।”

ফারিশ তার কপাল চুলকে বললো,
“দুপুরে খেয়েছিলেন?”
“হুম অল্পস্বল্প।”

ফারিশ আর কিছু বললো না। তার কল আসলো। ফারিশ কানে ব্লুটুথ দিলো। বললো,
“বলো আদিব।”
“আপনি কি বেরিয়ে পড়েছেন ভাই?”
“হুম এক ঘন্টা হবে বেরিয়েছি। কিছু কি বলবে?”

আদিব দোনামনা করলো। কিছু বলতে চাইছে ঠিকই তবে এখন বলবে কি না ভাবছে। ফারিশ বুঝি আদিবের দ্বিধাটা বুঝলো। সে বললো,
“কি হয়েছে আদিব?”
“আসলে ভাই,
“দ্বিধা না করে সরাসরি বলো কি হয়েছে?”
“ভাই বাড়িতে পুলিশ এসেছিল।”

সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে ব্রেক কষলো ফারিশ। আদ্রিতা চমকে উঠলো ফারিমের এহেন কান্ডে। হতভম্ব হয়ে তাকালো ফারিশের দিকে। কিছু বলার আগেই ফারিশ নিজের ঠোঁটের আঙুল দিয়ে বুঝালো চুপ থাকতে। আদ্রিতা চুপ থাকলো। ফারিশ গাড়ি থেকে নামলো কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বললো,
“কেন এসেছিল আদিব?”
“জানা নেই ভাই। আপনার খোঁজ নিলো শুধু। বললাম কক্সবাজার আছে ওমনি চলে গেল।”
“বাড়ি সার্চ করেছিল নাকি।”
“না ভাই তেমন কিছু করে নি। আর করলেও তো কিছু পেত না বাড়িতে তো কিছু থাকে না।”
“তা ঠিক কিন্তু এলো কেন?”
“জানি না ভাই আপনাকে দেখা করতে বলেছে।”

ফারিশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্ত করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“তুমি ঘাবড়িও না আদিব আমি এসে দেখছি।”
“আচ্ছা ভাই। সাবধানে আসবেন।”
“ঠিক আছে তুমি চিন্তা নিও না। খেয়ে দেয়ে নিশ্চিতে ঘুমাও। ওখানে কার্যক্রম সব ঠিক আছে তো?”
“হুম আছে ভাই।”
“আচ্ছা।”

ফোন কাটলো ফারিশ। তবে ভাবনায় পড়লো একটু। পুলিশ কেন আসবে তাকে খুঁজতে!’
.
ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত আদ্রিতা। তার বন্ধুরা লাগাতার মেসেজ দিচ্ছে সে কোথায়? গাড়ি পৌঁছেছে কি না? কখন আসবে? ইত্যাদি ইত্যাদি। আদ্রিতা ছোট্ট করে লিখেছে হা পৌঁছেছে আমি ফিরছি। ব্যস সঙ্গে সঙ্গে সবার মেসেজ যাক ওকে, সাবধানে আসিস। আদ্রিতা মিষ্টি হাসলো। ফোন রেখে চোখ রাখলো ফারিশের দিকে। লোকটাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। আদ্রিতা আওয়াজ করলো। উচ্চস্বরে বললো,
“আমরা কি যাবো মিস্টার বখাটে?”

ফারিশের টনক নড়লো সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল তার সাথে আদ্রিতাও আছে। ফারিশ দ্রুত গিয়ে গাড়িতে বসলো। আর ভাবলো না বিষয়টা অতোটা গুরুতরও কিছু না। ফারিশ আবার গাড়ি ড্রাইভিং করা শুরু করলো। আদ্রিতা তার পানে তাকিয়ে। কিছুক্ষণের নীরবতা ছাড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
“কিছু কি হয়েছে? আপনায় চিন্তিত লাগছে।”

ফারিশ নিরুত্তর। আদ্রিতা আবারও প্রশ্ন করলো,
“বলবেন না।”
“আপনাকে বলা প্রয়োজন মনে করছি না।”

আদ্রিতা আর কিছু বললো না। এ কথার পিঠে আর কোনো কথাই থাকতে পারে না। তবে মনে মনে দুটো গালি দিল। আদ্রিতা মুখ ফুলিয়ে বসে। তার ফোন বাজলো। মা কল করেছে। মায়ের নাম্বার দেখলেই বিরক্তিতে চোখমুখ আরো শক্ত হয়ে আসে আদ্রিতার। রোজ ফোন করে একই প্রশ্ন করে,“কবে আসবি? আরাফাতকে কবে আসতে বলবো?”

আদ্রিতা খানিকটা বিরক্ত নিয়েই ফোনটা তুলে বললো,
“কি হয়েছে মা?”

অপরপ্রান্তে থাকা আদ্রিতার মা বললো,
“রেগে যাচ্ছিস কেন?”
“রাগবো না তো কি করবো একই প্রশ্ন বার বার কেন করো। আমি ফিরলে তো বাড়িতেই ফিরবো।”
“তোর তো আজ আসার কথা?”

আদ্রিতা তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। চোখ বন্ধ করে বললো,
“আমি আসছি মা। আমি গাড়িতে আছি এখন। কালকে সকালে বা রাতেই মধ্যেই আসছি।”

আদ্রিতার মা খুশি হলেন। উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“তাহলে কাল বিকেলেই আরাফাতকে আসতে বলি?”

রাগে মাথা গজগজ করে উঠলো আদ্রিতার। যাও মাথা শান্ত রেখেছিল তাও গেল। সে ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বললো,“কালকেই আসতে বলতে হবে তোমার। বিয়ে যখন করবো বলেছি তখন তো করবোই এত তাড়ার কি আছে। আজ আর ফোন দিবে না। রাখছি।”

মায়ের কিছু বলার আর অপেক্ষা করলো না আদ্রিতা। কল কাটলো। রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে বলতে লাগলো,“এই মা এত বাড়াবাড়ি কেন করছে। সারাদিন জার্নি করে বাড়ি ফিরে কালকেই দেখা করতে হবে ওই আরাফাতের সাথে। যত্তসব উল্টোপাল্টা কাহিনি। ইঞ্জিনিয়ার বলে কি এত তাড়াহুড়ো করতে হবে?”

রাগে ফুঁসতে লাগলো আদ্রিতা। সে এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিল তার পাশে ফারিশ নামের এক যুবক আছে। আদ্রিতার রাগের মাঝেই গাড়িতে জোরে ব্রেক কষলো ফারিশ। সঙ্গে সঙ্গে হুস আসলো আদ্রিতার। সে চাইলো ফারিশের দিকে। ফারিশ ডানদিকটা দেখালো। আলোকিত একটা টংয়ের দোকান। ফারিশ বললো,“টংয়ের দোকান চলুন যাই।”

ফারিশ বের হলো। আদ্রিতা ঠায় বসে। ফারিশ গাড়ির দরজা খুললো। আদ্রিতাও ধীরে ধীরে বের হলো। ফারিশ এগিয়ে এসে বললো,
“পারবেন?”

আদ্রিতা চাইলো ফারিশের দিকে। শীতল স্বরে বললো,“আমার হাতটা একটু ধরুন ঠিক পারবো।”

আদ্রিতার কাজে ফারিশ ভড়কালো। প্রশ্ন করলো,
“আমি ধরবো?”
“হুম ধরুন।”

ফারিশ দ্বিধাহীন ধরলো। এর আগেও সে দু’বার হাত ধরেছিল আদ্রিতার। কিন্তু সম্মতিতে ধরছে বলে তার কেমন লাগছে! আবার সেই অজানা অনুভূতিদানা বাজছে। পাঁচ সেকেন্ডের রাস্তায় আদ্রিতা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সময় নিলো দু’মিনিট। ফারিশ অধৈর্য্যশীল মানুষ তবুও ধৈর্য্য রাখলো আজ। আদ্রিতাকে বসালো টংয়ের দোকানের সামনে থাকা ছোট্ট বেঞ্চে। ফারিশ প্রশ্ন করলো,
“কি খাবেন?”
“এক কাপ দুধ চা আর টোস্ট বিস্কুট।”

ফারিশ তাই চাইলো। দোকানীও তাদের বসতে বলে বানাতে শুরু করলো। ফারিশ বসলো আদ্রিতার সামনের বেঞ্চে। মিনিট চার যেতেই চা আর বিস্কুট দিলো দোকানী। তারা খেল। কিছু ছেলেপেলে হেঁটে যেতে যেতে বললো,“বউ নিয়ে টংয়ের দোকানে চা খাচ্ছে বাহ ব্যাপারটা কিন্তু দারুণ।”

কথাটা ফারিশ আদ্রিতা দুজনেই শুনলো। ফারিশ এখানে কোনো ঝামেলা চায় না। তাই চুপচাপ কথাগুলো হজম করে নিলো। আদ্রিতা মৃদু হাসলো। যেটা চোখ এড়ায় নি ফারিশের।’

পনের মিনিটের মতো সময় পার হলো। ফারিশ চায়ের বিল দিতে গেলে আদ্রিতা অর্ধেক দিতে চাইলো। ফারিশ বারণ করতে বললো,“প্রয়োজন নেই।”

আদ্রিতা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পায়ের জন্য বড্ড পীড়া হচ্ছে তার। ফারিশ আচমকাই কোলে তুলে নিলো আদ্রিতাকে। ফারিশের কাজে আদ্রিতা ঘাবড়ে গিয়ে ফারিশের শার্টের হাতা খামচে ধরলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,“কি করছেন?”

ফারিশ জবাব দিলো না। দ্রুত গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে আদ্রিতার চোখে চোখ রেখে বললো,“কিছুই না।”

তব্দা খেয়ে বসে রইলো আদ্রিতা। আর কিছু বলতেই পারলো না। অথচ বলার মতো অনেককিছু ছিল।”

ফারিশ গাড়ি চালাতে শুরু করলো আবার। তার মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই। যেন একটা মেয়েকে কোলে তুলে নেয়া কোনো বিশেষ ব্যাপারই না।’

ধীরে ধীরে সময় গড়ালো। শীত যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে। আদ্রিতা তার ব্যাগ থেকে চাদরটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ফারিশের গায়ে তখনও শুধু শার্ট জড়ানো। হঠাৎ ফারিশ প্রশ্ন করলো,
“আরাফাত কে?”

আদ্রিতা থতমত খেল। আশেপাশে তাকিয়ে বললো,“আমায় বলছেন?”
ফারিশ বিরক্ত হলো। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“এখানে আপনি ছাড়া আর কি কেউ আছে?”

আদ্রিতা কিছু সময় চুপ থেকে বললো,
“তাও ঠিক।”
“তাহলে বলুন আরাফাত কে?”
“আপনায় বলা প্রয়োজন মনে করছি না।”

ফারিশ বিনিময়ে কিছু বললো না। আচানক হেঁসে উঠলো। শব্দ করে হাসলো। অদ্ভুত সুন্দর দেখালো সেই হাসি। আদ্রিতা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো ফারিশের হাসির পানে। ছেলেটা হাসলে এত চমৎকার কেন দেখায় কে জানে! আদ্রিতা আনমনা বলে উঠল,
“এখানের হাসার মতো কি কিছু ছিল?”
“সত্যি কি কিছুই ছিল না। আমার কেন যেন মনে হলো এখানে হাসার মতো অনেক কিছুই ছিল।”

আদ্রিতা আর কিছু বললো না। সে পর্যবেক্ষণ করতে রাখলো ফারিশকে। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের এই পুরুষটির সাথে তার কতবার দেখা হয়েছে। গোনা হয় নি তবে হিসেব করলে অনেকবারই হয়েছে। যা কাঙ্ক্ষিতের চেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতই বেশি। ছেলেটার চোখের পাশে থাকা কাটা দাগটা অদ্ভুত সুন্দর দেখতে। গায়ের গঠন। উচ্চতা, কথার ধরন, রাগ সব মিলিয়ে পারফেক্ট এক সুদর্শন যুবক। আদ্রিতার কাছে ফর্সা ছেলেদের চেয়ে শ্যামবর্নের পুরুষদের বেশি সুন্দর লাগে। তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে আশরাফ। যেমন ফর্সা তেমন শারীরিক গঠন। অথচ আদ্রিতা কখনোই আকৃষ্ট হয় নি তাতে, মৃদুল রনিও যথেষ্ট সুদর্শন। তাদেরকেও বন্ধু ব্যাতিত অন্য কোনো নজরে কখনো দেখে নি আদ্রিতা। ছোট বেলা থেকেই পুরুষ মানুষদের ওপর আদ্রিতার আকৃষ্টতা কম। কিন্তু এই প্রথম যেন ফারিশের ওপর সে আকৃষ্ট হয়েছে তাও দারুণভাবে।”

আদ্রিতার টনক নড়লো এগুলো কি ভাবছে! ছিঃ! আদ্রিতা চোখ সরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে চাইলো। তার লজ্জা লাগছে হঠাৎ। ভাগ্যিস ফারিশ বুঝতে পারে নি সে তাকে দেখছিল। এ দেখা তো যেনতেন দেখা নয়। গভীরভাবে দেখা।

আদ্রিতা চোখ বুঝে নিলো। একটু ঘুমানোর দরকার। মিনিট পনের পার হতেই আদ্রিতা ঘুমিয়ে পড়লো। এতক্ষণ পর ফারিশ তার পানে চাইলো। মৃদু এক স্বরে আওড়ালো,
“হৃদয় বুঝি ধীরে ধীরে প্রেমারোগে আসক্ত হচ্ছে ডাক্তার ম্যাডাম। আপনিও মরছেন, আমিও মরছি অথচ প্রকাশ করতে দুজনেই নারাজ।”

ফারিশ চুপ হয়ে গেল। ভাবনাগুলো বিষাক্ত লাগছে। কথাগুলো তার চেয়েও তেঁতো। ফারিশ ডাইভিংয়ে নজর দেয়ার চেষ্টা চালালো। মনে মনে বলে উঠলো আবার,“যে প্রেম প্রকৃতির বুকে শোভা পায় না তাকে কি আধও প্রেম বলে?”

#চলবে…..

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে