#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৪১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
হুরাইনের শরীর খা*রা*প যাচ্ছে। সাজেদা একটু পরপর কাজের ফাঁকে গিয়ে দেখে আসছেন তাকে। প্রেগন্যান্সির প্রথমদিকে শরীর ভালো ছিল। যত দিন যাচ্ছে, ততই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ঠিকমত ইবাদত করতে পারছে না। যতটুকু শক্তি থাকে সে চেষ্টা করে সময়টা আল্লাহর কাজে ব্যয় করতে। এটা হয়তো তার পরীক্ষা। এই সময় আল্লাহকে বেশি বেশি না ডেকে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে শুয়ে থাকে মানুষ। হুরাইন প্রতিনিয়ত মোনাজাতে আল্লাহর কাছে চায়,সে যেন আল্লাহর ইবাদত করার মত শক্তি পায়।
সারাক্ষণ শুয়ে-বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। সে উঠে এলো শাশুড়ির কাছে। চোখমুখ ভাসা ভাসা। চুলের অবস্থা খা*রা*প। সাজেদা বললেন,“চুলের এই অবস্থা কেন? আসো আমার সামনে।”
তেলের বোতল নিয়ে বসলেন তিনি। হুরাইন বলল,“আমি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি, তাইনা আম্মা? আমার কাজ করে আপনাকে খাওয়ানোর কথা, আর সেখানে আপনি কাজ করছেন।”
সাজেদা তেল দিয়ে দিতে দিতে বললেন,“যখন তাসিন পেটে ছিল, তখন দুনিয়ার সব কাজ করতে হয়েছে আমাকে। এমন না যে একা সংসার ছিল। যৌথ পরিবার ছিল। তবুও জায়েরা ভাগের কাজ রেখে দিত। কাজ নিয়ে ঠে*লা*ঠে*লি হত। যৌথ পরিবারে মানুষ বেশি, কাজও বেশি। খাবার তৈরি করতে হত বেশি, ধোয়ামোছার কাজ বেশি। সকালে সবাই এক নাস্তা খেত না। যার যে নাস্তা খেতে মন চাইতো, সে বলে দিত। সবার জন্য আলাদা আলাদা নাস্তা বানাতে হত। মাথা ঘোরানোর জন্য উঠতে পারতাম না। কেউ কারো দুঃখ বুঝতো না। আমি অসুস্থ হলে যে তারা একটু সাহায্য করবে, সেটা করতো না। তাই তাদের দেখাদেখি আমিও এমন করতাম। তারা অসুস্থ হলেও তাদের কাজ ফেলে রাখতাম। এ নিয়ে সংসারে মনকষাকষি শুরু হলো। আমি তখন শক্ত হয়ে গেলাম। তোমার শশুরকে বললাম আমি আলাদা খেতে চাই। তারপর সংসার ভাগ হয়ে গেল। তোমার দাদা-দাদি সব ছেলেদের ঘরে কিছুদিন ভাগ করে করে খেতেন। পরে যখন তোমার দেবর পেটে এলো, তখন আমার তাসিনও একটু একটু মাকে সাহায্য করতো। কাউকে দেখলেই সে লজ্জা পেয়ে যেত। আমার বোন এসে অসুস্থতার সময়টা আমার কাছে ছিল। এই সময়ের কষ্ট আমি বুঝি। তাই আমি চাই না আমার শক্তি থাকার পরও আমার মত কষ্ট আমার মেয়ে বা আমার ছেলের বউ করুক।”
হুরাইন মুচকি হেসে বলল,“শক্তি থাকতে নাতি-নাতনি বড়ো করে দিয়ে যান।”
“আমি কি পালতে জানি না? আমার ছেলেমেয়েগুলো কি বাতাসে বড়ো হয়েছে? খাওয়ার সময় ছাড়া আমার নাতি-নাতনির তোমাকে প্রয়োজন হবে না।”
হুরাইন চাপা হেসে বলল,“তাহলে তো আমি বড়ো বাঁচা বেঁচে যাব।”
সাজেদা সুন্দর করে তেল দিয়ে চুলে বেনি করে দিলেন।
ঘুমানোর আগে তাসিন বিছানা ঠিক করে নেয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার বিছানা গুছিয়ে ফেলে। এখন নিজের কাজ নিজেই করে। আগে তার সবকিছু হুরাইন গুছিয়ে রাখতো। জামাকাপড় আয়রন করে রাখত। এখন হুরাইনকে করতে দেয় না। বরং নিজে হুরাইনের কাজ করার চেষ্টা করে। অফিস থেকে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল সে। চোখটাও লেগে এসেছে। হুরাইন অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে কপালে ঠোঁট স্পর্শ করল। চোখ খুলে ফেললো তাসিন। হুরাইনের ভ্রু কুঁচকে গেল। ভেবেছিল তাসিনের ঘুম এসে পড়েছে। তাসিন চমৎকার করে হাসলো। শোয়া অবস্থাতেই হুরাইনের একহাত টে*নে নিয়ে হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
হুরাইন বলল,“আপনি ঘুমাননি?”
“ঘুমালে তো বউয়ের চুমু মিস করে যেতাম।”
হুরাইন হাসল। তাসিন বলল,“আমাকে নিয়ে এখন আর অভিযোগ করো না কেন?”
“করি তো। মনে মনে অভিযোগ করি।”
তাসিন আঁতকে উঠে বলল,“কোনো অভিযোগ থাকলে চট করে বলে ফেলবে। মনে পুষে রাখলে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ে। কী অভিযোগ, বলো?”
“আপাতত অভিযোগ নেই। তবে মাঝেমাঝে খুব রাগ হয় আমার।”
“কখন রাগ হয়?”
“যখন আমাকে বাবার বাড়ি যেতে দেন না, তখন।”
হুরাইন গাল ফোলাল। তাসিন হেসে ওর গাল টে*নে দিয়ে বলল,“তোমার গাল দুটো নাদুসনুদুস হয়ে গিয়েছে।”
হুরাইন আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,“দেখতে কি খা*রা*প লাগে?”
“আমার বউকে সবরকমেই দেখতে ভালোলাগে।”
হুরাইন মনে মনে খুশি হয়ে কানের পিঠে চুল গুঁজে বলল,“দেখতে খা*রা*প লাগলেও আমাকেই দেখতে হবে।”
“আমি কি একবারও অন্যদিকে চোখ দেওয়ার কথা বলেছি? তুমি ইদানীং বাচ্চাদের মত আচরণ করছো। সমস্যা নেই, মা বলেছে এই সময় মেয়েদের মন কতরকম হয়ে থাকে।”
★★★
“তুলি তোর ভাবি কোথায়?”
“ভাবি তো রান্নাঘরে আছে, ভাইজান।”
শাবাব ফিসফিস করে আবার জিজ্ঞেস করল,“তোর খালাম্মা আছে ওখানে?”
“না।”
“আচ্ছা।”
শাবাব রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ফাবিহা কোমরে ওড়না বেঁধে কাজ করছে। শাবাব গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,“শাড়ি পরতে পারো না?”
“জামা পরলে কী সমস্যা?”
“সমস্যা তো আছেই। আমি ঠিকমতো কিছু দেখতে পারি না।”
ফাবিহার কান গরম হয়ে এলো। সে পাতিল তাক করে বলল,“আর বেশি কথা বললে পাতিল মে*রে কপাল আলু করে ফেলবো। কী পা*প করেছিলাম আমি, যার জন্য আমার কপালে জন্মের অ*স*ভ্য এসে জুটেছে।”
শাবাব এবার রান্নাঘরে ঢুকে গিয়ে ফাবিহাকে ঝাপটে ধরে দুই-তিনটা চুমু খেয়ে নিলো। ফাবিহা তুলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, দাঁতে দাঁত চেপে নিচু স্বরে বলল,“তোমার কি লজ্জা-শরম কোনোদিনই হবে না?”
শাবাব ওর কথা শুনে তুলিকে বলল,“তুলি তুই একটু যা তো। তোর সামনে তোর ভাবির নাকি লজ্জা লাগে। তুই গেলে ও আর লজ্জা পাবে না।”
“শাবাব!”
ফাবিহা চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে হুঙ্কার ছাড়লো।
শাবাব তুলিকে বলল,“ওহ্ আমি ভুল ছিলাম। তোর ভাবি লজ্জা পাবে না। তুই দাঁড়িয়ে থাক। আমি তোর ভাবিকে চুমু দিচ্ছি।”
কথা শেষ করেই ফাবিহার দিকে তাকাল। হাতে খুন্তি দেখে মেকি হেসে বলল,“আমি যাচ্ছি, তোমরা রান্না করো।”
শাবাব চলে যেতেই তুলি মিটিমিটি হাসছে। ফাবিহা সূঁচালো চোখে তাকিয়ে বলল,“তুই হাসছিস কেন?”
তুলি লজ্জায় মুখ ঢেকে বলল,“আমারও আপনের মত বিয়া করবার মন চায় ভাবি।”
ফাবিহার চোখ চড়কগাছ। বিস্মিত গলায় বলল,
“এ্যাই তোর বয়স কত, যে বিয়ের কথা বলিস?”
“আমি কি ছোডো আছি?”
ফাবিহা বলল,“আমাদের বাড়ির পাশে এক লোক আছে। যার তোর চেয়ে বড়ো চার-পাঁচটা ছেলে-মেয়ে আছে। বউ মা*রা গিয়েছে, তাই বেচারা বিয়ের জন্য তোর মতই পাত্রী খুঁজছে। তুই রাজি থাকলে কথা বলতে পারি। তবে ওই লোকের মাথায় চুল নেই, বড়ো ভুঁড়ি আছে।”
তুলি আতঙ্কিত গলায় বলল,“না আমি ওই লোকেরে বিয়া করুম না।”
ফাবিহা বলল,“দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বললে তুই চাস আর না চাস, ওই লোকের সাথেই তোকে বিয়ে দিয়ে দেব।”
শাবাবের হাত এখন ঠিক আছে। সুমনের ব্যাপারে তাকে বের হতে হয়েছে। ওর পরিবার বৈঠক ডেকেছে। শাবাব নিজের দিক ক্লিয়ার করেছে। দ্বিতীয়বার তার বউকে যদি হয়*রানি হতে হয়, তবে পরেরবার আর জী*বি*ত ছেড়ে দেবে না সুমনকে। ওখানে কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে তারপর ঝামেলা মিটমাট করে বাড়ি ফিরেছে।
ফাবিহা বই পড়ছে বসে বসে। শাবাব বলল,“কী এত সারাদিন বই পড়ো? চোখের সামনে আমাকে দেখেও কি তোমার পড়তে ইচ্ছে করে না? আগে আমাকে পড়ে দেখো।”
“ডিস্টার্ব কোরো না শাবাব। তোমাকে আমার পড়া আছে।”
শাবাব বই টে*নে সরিয়ে দিল। ওর হাঁটুর নিচে হাত দিয়ে পাঁজা কোল করে বলল,“আমাকে না পড়লে বেশি বেশি ডিস্টার্ব করবো।”
“তুমি খুব..
“অ*স*ভ্য। জানি আমি এটাই বলবে।”
ফাবিহাকে থামিয়ে বলল শাবাব।
ফাবিহা চুপ করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। শাবাব বলল,“আমাকে ভালোবাসলে তোমার ক্ষ*তি কী? তোমার বাপের সম্পত্তি ধরে টা*না*টা*নি করবো?”
“তুমি বলেছিলে না আমাকে বিদেশ চলে যেতে? আমি বিদেশ চলে যাব। ব্যবস্থা করো।”
“যাবে তো। আমি নিয়ে যাবো তোমায়।”
“আমি একা যাব। আর আসবো না।”
“সেটা চাইলেও তুমি যেতে পারবে না। এই অফার আমি তোমাকে আগে দিয়েছি। তুমি তখন গ্রহণ না করে ভু*ল করেছো। এখন তুমি না চাইলেও আমার কাছে তোমাকে থাকতে হবে। আমি খুব খা*রা*প লোক।”
“তো? তোমাকে আমি ভয় পাই না।”
ফাবিহাকে বসিয়ে দিয়ে শাবাব বলল,“জানি। তোমার কলিজা খুব বড়ো। আমাদের বেবি হলে তাদের তোমার মত প্রশিক্ষণ দেবে। কীভাবে কলিজা বড়ো করা যায়।”
ফাবিহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই শাবাব বলল,“এভাবে তাকাচ্ছ কেন? এরজন্য আমি তোমায় বেতন দেব। তখন তুমি ওদের মা না হয়ে, হয়ে যাবে টিচার।”
“আমি বুঝি না শাবাব, তোমার মাথায় এসব ফা*ল*তু চিন্তাভাবনা আসে কোথা থেকে?”
“ভালোবাসা আসে যেখান থেকে, ঠিক সেখান থেকেই।”
“এত যে ভালোবাসো ভালোবাসো বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলছো, আমি ম*রে গেলে তো ঠিকই পরদিন আরেকটা বিয়ে করে নিয়ে আসবে।”
শাবাবের দু’চোখ বিচরণ করছে ফাবিহার মুখে। সে চোখে হেসে বলল,“তুমি কি জেলাস?”
“আমি জেলাস না। তুমি যা ইচ্ছে করো। তাতে আমার কী?”
“তাহলে আমাকে অনুমতি দাও আরেকটা বিয়ে করার। পরে কেন এখনই করে ফেলি। তখন তুমি ম*রে গেলেও শোক পালন করতে হবে না। অন্য বউ তো থাকবেই।”
ফাবিহা বালিশ দিয়ে এলোপাতাড়ি মা*র*তে লাগলো শাবাবকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,“একটা নয়, একশোটা বিয়ে করো।”
“সর্ব*নাশ! এতগুলো বিয়ের অনুমতি দিও না। এতজনের খরচ ওঠাবো কী করে? তাছাড়া কোনদিন কোন বউয়ের ঘরে থাকবো, সেটা নিয়েই তো আমাকে টু*ক*রো, টু*ক*রো হতে হবে।”
ফাবিহা একদম কথা বলল না। কেবল ফোঁসফোঁস করছে। শাবাব ঠোঁট টিপে হাসতে পারলো না। সে উচ্চস্বরে হাসছে। তা দেখে ফাবিহার আরো রাগ বেড়ে গেল।
#চলবে……
#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৪২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
কপালের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে শাবাব। চোখ বন্ধ। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবুও ফাবিহা সন্দেহের বশে শাবাবের চোখের উপর হাত নেড়েচেড়ে দেখল সত্যি ঘুমিয়েছে কিনা। শাবাবের কোনো নড়চড় নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পেরেই ফাবিহা চুপিচুপি ওর ফোন হাতে নিলো। কয়েকদিন ধরে লক্ষ করে শাবাবের ফোনের লক আয়ত্ত করে নিয়েছে। ফোন হাতে নিয়েও আরেকবার তাকাল শাবাবের দিকে। শাবাব আগের মতই আছে। ফাবিহা ফোনের লক খুলে পাশ ফিরে গেল। মেসেঞ্জারে ঢুকলো প্রথমে। ঘাঁটাঘাঁটি করেও কিছু পেল না। নতুন কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে কিনা? কিছু না পেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো। এক এক করে সব চেইক দিয়েও কোনো অপরিচিত মেয়ের সাথে আলাপ দেখলো না। স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো ফাবিহা। প্রশান্তি আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে ফোন রাখতে পাশ ফিরে জোরেশোরে এক চিৎকার দিলো। শাবাব কনুইয়ে ভর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুকে থুতু দিয়ে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“না ঘুমিয়ে কুমিরের মত তাকিয়ে আছো কেন?”
“চো*র ধরার জন্য।”
শাবাব শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল।
ফাবিহা বড়ো গলা করে বলল,“কীসের চো*র? নিজের সেইফটির জন্য আমি তোমার ফোন চেইক দিতেই পারি।”
“কিছু পেয়েছ?”
“তুমি হয়তো ডিলিট দিয়ে দিয়েছ।”
শাবাব বলল,“আচ্ছা এক সপ্তাহ তুমি ফোনটা রেখে দাও নিজের কাছে।”
“তুমি তাদের না করে দেবে, এক সপ্তাহ যেন তোমাকে কল, মেসেজ না করে। আমি কি বুঝি না?”
শাবাব মলিন হাসলো। দরজায় টো*কা পড়লো। সুরাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,“কী হয়েছে শাবাব? বউ চিৎকার দিল কেন?”
শাবাব বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দিল। বলল,“ও খা*রা*প স্বপ্ন দেখেছে।”
“ওহ্, রাতে দোয়া পড়ে ঘুমাতে বলবি। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম কী না কী হলো। দরজা আটকিয়ে দে। আমি যাচ্ছি।”
সুরাইয়া চলে যেতেই শাবাব দরজা আটকে শুয়ে পড়লো। ফাবিহার দিকে না তাকিয়ে চোখ বুজে নিলো। ফাবিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকেও যখন শাবাবের সাড়া পেল না। তখন উশখুশ করল। শাবাব ঠিক হচ্ছে। সে আগে যে শাবাবকে চিনতো, এই শাবাব তারচেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যত জানছো, ততই মনে হচ্ছে সে এতদিন ভুল শাবাবকে চিনতো। তার উচিত হয়নি এভাবে শাবাবকে বলা। প্রতিরাতে শাবাব তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। প্রথমদিকে তার এভাবে ঘুমাতে সমস্যা হলেও এখন যেন অভ্যাসে পরিণত হলো। ফাবিহা মৃদু স্বরে ডাকলো,“শাবাব।”
শাবাব তার দিকে না তাকিয়েই বলল,“বলো।”
“আমার ঘুম আসছে না।”
“কেন?”
“ঠাণ্ডা লাগছে।”
“এখন আর শীতকাল নেই।”
ফাবিহা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেই শাবাবের শরীরের সাথে লেগে শুলো। দুই হাত আর পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো শাবাবকে। তারপর তলিয়ে গেল ঘুরের রাজ্যে। শাবাব ঘুমাতে পারলো না। সময় গেলেও ফাবিহার মন থেকে সন্দেহ সরে না। অস্বস্তি হয় তার। আজ আর ফাবিহাকে ধরলো না সে। ফাবিহাকে সরিয়েও দিল না। অনেক রাত পর্যন্ত জাগতে জাগতে ঘুমিয়ে পড়লো।
★★★
সময় সন্নিকটে। গতরাত থেকে হালকা হালকা ব্যথা শুরু হয়েছে হুরাইনের। সাজেদা এক প্রকার জেগেই ছিলেন। তাসিনও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেনি। হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললেও হুরাইন রাজি হলো না। যদি খুব প্রয়োজন পড়ে যায় তবেই সে হাসপাতালে যাবে। সকালে তাসিনকে জোর করে ঠে*লে*ঠু*লে অফিসে পাঠাল সে। সাজেদাও বললেন,“তুই যা। প্রয়োজন হলে তোকে কল দেব। তোর বাবাও বাড়ি আছেন।”
খবর শুনে হুরাইনের মা চলে এলেন। দুপুরের আগেই এক চমৎকার খবর শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ছুটলো তাসিন। তার ঘর আলোকিত করতে পৃথিবীতে এলো এক কন্যা সন্তান। বাবা হওয়ার পর হয়তো আনন্দে পুরুষ মানুষ আরো শত বছর বাঁচতে চায়। এখনো মেয়ের মুখ দেখেনি তাসিন। তবুও তার বুক ভার করা অনুভূতি হচ্ছে আনন্দে। আনন্দে কারো বুক ভারী হয়? কেন এমন হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। কোনোমতে বাড়ি এসে দেখল তার শশুর তার বাবার সাথে হাসতে হাসতে মিষ্টি নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকছেন। তাসিন ছুটে শশুরের আগে ঘরে ঢুকলো। তার আগে কিছুতেই শশুরের কোলে তার মেয়েকে নিতে দেবে না। সাজেদা নাতনি কোলে নিয়েছিলেন। তাসিন মায়ের সামনে এসেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। খুঁটে খুঁটে দেখছে ছোট্ট একটি প্রাণ, ছোটো ছোটো হাত-পা, একটু বোঁচা নাক, টকটকে ঠোঁট, পিটপিট করে তাকিয়ে হাত খাওয়ার চেষ্টা করছে। সাজেদা নাতনিকে তাসিনের কোলে দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন,“তোর মত হয়েছে।”
তাসিন এই কথা শোনার পর খুশিতে আত্মহারা। কিন্তু মেয়েকে কোলে নিতো তার ভয় হচ্ছে। এত ছোট্ট বাবু। তার হাতের ফাঁক দিয়ে না পড়ে যায়। সে ভেতরে ভেতরে কেমন কাঁপছে। ঘরে শশুর আর বাবার কথা শুনেই সে ঝট করে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। মেয়ের ছোট্ট মুখে চুমু খেয়ে বলল,“আয়েশা। আমার আয়েশা।”
তাসিনের চোখমুখের খুশি যেন সরছেই না। তাসিনের বাবা বললেন,“এদিকে দে। ওর নানাভাই আজান দিয়ে দিক।”
তাসিন একবার শশুরের দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বলল,“আমি আজান দেওয়া রপ্ত করেছি। তাই আমার মেয়ের কানে আমিই আজান দেব।”
জনাব আজাদ কিছুই বললেন না। তাসিন যে কেন এসব করছে, তিনি খুব ভালো করেই জানেন। তাসিন মেয়ের কানে আজান দিয়ে সাজেদার কোলে আয়েশাকে দিয়ে হুরাইনের কাছে গেল।
আয়েশাকে তার দাদা-নানা এক এক করে কোলে নিলেন।
হুরাইন সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। তার পাশে বসে আস্তে আস্তে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেল। হুরাইন মৃদু স্বরে বলল,“এখন তো আপনার মেয়েকে পেয়ে গিয়েছেন। আমিও আমার বাবার সাথে চলে যাব।”
তাসিন আলতো করে ওর গাল ছুঁয়ে দিয়ে বলল,“মেয়ে এবং মেয়ের মা দুজনই আমার। তাদের বাড়ি তারা থাকবে।”
“মেয়ের নাম কী রেখেছ?”
“আয়েশা।”
হুরাইন ডাকল,“আয়েশার বাবা।”
তাসিন প্রশান্তির হাসি হেসে জবাব দিল,“বলুন আয়েশার আম্মা।”
★★
রাতে হুরাইনের সাথে তার মা ঘুমালো। আয়েশা একটু পরই কান্না করে। চোখে রাজ্যের ঘুম হুরাইনের। চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে। যত জ্বালা নানির। নাতনির সাথে তিনিও জেগে রইলেন। সারারাত জেগে থেকে নানি-নাতনি তিনটায় ঘুমাল। নানি আবার ফজর হতেই উঠে পড়লেন। মা হলে যতটা না জাগতে হয়, নানি-দাদি হলে তারচেয়ে বেশি জেগে থাকতে হয়। তাসিন ফজর পড়ে এসে একবার নিজের ঘরে উঁকি দিল। হুরাইনের মা এখনো জায়নামাজে বসে জিকির করছেন।
আয়েশা আর হুরাইন মা -মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের একটি বোধহয় এটি! তাসিন প্রাণভরে দেখল তাদের।
আয়েশার আগমনের খবর শুনে নিশি, ফাবিহা দুজনই এলো। আগে -পরে এলেও দেখা হয়ে গেল দুজনের। সবাই আয়েশাকে পেয়ে হুরাইনকে ভুলেই বসেছে। সে গাল ফুলিয়ে বলল,“আমাকে এখন আর কারো লাগবে না।”
নিশি চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলছে ভাতিজিকে। সেও আল্লাহর কাছে একটা সন্তান চেয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সুখবর পায়নি। ফাবিহা মুচকি হেসে বলল,“লাগবে, তোমাকে এখন সবচেয়ে বেশি লাগবে এই ছোট্ট বুড়ীটির।”
আজ আবার সবাই বলাবলি করছে, “বাবু দেখতে তার বাবার মত।”
তাসিন খেতে বসেও আনন্দে খেতে পারছে না। তাসিনের বাবা বললেন,“আগে বড়ো হতে দাও। চেহারা এক এক বার এক এক রকম লাগে।”
এবার যেন তেতে উঠলো তাসিন।
“আরেকরকম হতে যাবে কোন? দেখো মিলিয়ে। আমার মত চোখ, নাক, হাত-পায়ের আঙ্গুল, নখ সবকিছু।”
তাসিনের বাবা বললেন,“ঠোঁট দুটো ওর দাদির মত। এখন দাদির মত বে*ঝা*ই*ল্লা মানুষ না হলেই হয়।”
সাজেদা আবার স্বামীর সাথে একদফা ঝগড়া করে ক্ষান্ত হলেন। মেয়ে হওয়ার খুশিতে তাসিন অফিসেও যাচ্ছে না। ফাবিহা মুগ্ধ হয়ে তাসিনকে দেখছে। তাসিন ভাই কী ভীষণ খুশি! শাবাব কেমন খুশি হবে? তার কি বাচ্চা পছন্দ? কখনো জানা হয়নি ওর।
শাবাব নিতে এলো ফাবিহাকে। আয়েশাকে কোলেও নিলো। আয়েশা শাবাবের আঙ্গুল মুঠো করে ধরে ছেড়ে দিল। ছোটো বাচ্চা কতরকম করে। কিন্তু শাবাব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আয়েশার দিকে। একবার হেসে হেসে বলেও ফেলল,“এই পরীর বাচ্চাটা আমায় দিয়ে দিন।”
তাসিন সাথে সাথে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে নিল। বলল,“হাজারটা কথা বলুন ভাই, এই কথা বলবেন না।”
তাসিনের কাণ্ডে সবাই হেসে ফেলল। নিশি থেকে গেল। ফাবিহা শাবাবের সাথে বাড়ির পথে হাঁটলো। সে নিশিকেও লক্ষ করেছে। নিশির মাঝেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিয়ের আগে হলে সে শাবাবের সামনে আসত। দুলাভাই বলে বলে হাজার দুষ্টুমি করত। অথচ সে আজ সম্পূর্ণ পর্দার আড়ালে রইল। সে আফসোস করে। হুরাইনের পাঠানো কিছু বই পড়ে বুঝতে পারলো সে পা*পে*র সাগরে সাঁতার কাটছে। ফিরে আসার মত পরিবেশ নেই। নিশির মত ধার্মিক পরিবারে বিয়ে হলে সে বোধহয় খুব সহজেই পরিবর্তন হতে পারত। এখন হয়তো সব মেনে চলা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
অথচ চেষ্টা করলে কিছুই অসম্ভব নয়। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হলেও শাবাবের বাড়িতে পর্দা মেনে চলা তার জন্য সহজ। দেবর নেই, বাইরের কোনো পুরুষ নেই। হুরাইন যদি নিজের পর্দা, ইমান ধরে রাখতে পারে, তবে সে কেন পারবে না?
শাবাব লহু স্বরে বলল,“আমাদের ঘরে একটা আয়েশা কবে আসবে?”
ফাবিহা একটু অবাক হলো। সাথে লজ্জাও পেল। কেশে উঠে বলল,“তোমার কি আর কোনো কাজ নেই?”
শাবাব বিষন্ন স্বরে শুধালো,“তুমি কি আমার সাথে থাকতে চাইছো না বলে বাচ্চা নিতে চাইছ না?”
ফাবিহা বিস্মিত হয়ে বলল,“তোমায় এসব কে বলল?”
“কেউ বলেনি। আমার মাঝেমাঝে মনে হয়।”
ফাবিহা বলল,“একটা কিছু চাইব। দেবে?”
“আমার সাধ্যের মাঝে যা চাও, আমি দেব।”
“আমায় পর্দা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? সাথে তোমার ইমান পরিষ্কার করবে। আমি জানি তুমি এখনো সিগারেট পুরোপুরি ছাড়তে পারোনি। মাঝেমাঝে বাইরে থেকে খেয়ে আসো। যতই ব্রাশ করে আসো না কেন, তোমার শরীরে সিগারেটের গন্ধ লেগে থাকে। ছাড়তে পারবে সব?”
শাবাব স্থির হয়ে কেবল তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,“তুমি পর্দা করতে চাইলে আমি সবরকম ব্যবস্থা করে দেব।”
“আরো যেগুলোর কথা বললাম। নিজের সবকিছু তো সবসময় পরিষ্কার খোঁজো। কখনো ইমান পরিষ্কার আছে কিনা খোঁজ নিয়েছ?”
শাবাব ভাবলো যখন বি*প*দ আসে, দুঃখ-কষ্ট আসে, তখন কেবল আল্লাহকে মনে পড়ে। অন্য সময় বিন্দুমাত্র ভয় কাজ করে না। নামাজ পড়তে তার আলসেমি লাগে। তার ইমান ঠিক নেই। মরিচা ধরে গিয়েছে। সময় থাকতে ঘষামাজা করা উচিত। ক্ষণিকের জন্য মোটিভেট হল শাবাব৷ এরপরই সব ভুলে গেল। তার সবকিছু চলছে আগের নিয়মে। ফাবিহা যুদ্ধে নেমেছে। পুরোপুরি দ্বীন মানতে না পারলেও যতটুকু পারা যায় সে মেনে চলবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর পর্দা এ দুটো জিনিস পালন করা তার জন্য সহজ। সে আবারও আগের মত হুরাইনের সাথে যোগাযোগ রাখা শুরু করল।
আয়েশার জন্য রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারে না হুরাইন। মেয়ের কান্নায় তাসিনেরও ঘুম ভেঙে যায়। হুরাইন বিরক্তিকর গলায় বলল,“কে যেন বলেছে আমাকে আর লাগবে না। নিজের মেয়ে নিজে একাই পালতে পারবে। এখন বসে থাকুক মেয়ে নিয়ে। আমার মাথাব্যথা করছে।”
তাসিন বিছানা ছেড়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরজুড়ে পায়চারি করছে। হাঁটলেই শান্ত হয়ে যায় আয়েশা। একটু বসলে আবার কাঁদে। হুরাইন সুযোগ পেয়ে চোখ বুজে ফেলেছে। ঘন্টাখানেক এভাবে যাওয়ার পরও আয়েশা ঘুমাচ্ছে না। তাকে নিয়ে বসতেই পারছে না। তাসিন বেচারা লুক দিয়ে বলল,“এবার বাবাকে একটু ঘুমাতে দাও নারে মা।”
আয়েশা হাত-পা নাড়াচ্ছে।
#চলবে….