এক টুকরো আলো পর্ব-৩৭+৩৮

0
490

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

প্রথমবার ফা*টা*লো মাথা। দ্বিতীয়বার ভাঙা হাত নিয়েই বিয়ে করতে হলো।
আজ জেঠার বাসায় দাওয়াত আছে। সুরাইয়া ফিরোজ আলমকে রেখে যাবেন না। ফাবিহা আর শাবাবের সাথে তুলি যাবে। শাড়ির আঁচল ঠিক করছে ফাবিহা। সিগারেটের উৎকট গন্ধ নাকে ঢুকে গেল। শাবাব বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বাঁ হাতে সিগারেট ফুঁকছে। ঠোঁটজোড়া কালচে দেখাচ্ছে। ফাবিহা সিগারেটের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শাবাব হঠাৎ লক্ষ করল বিষয়টি। ফাবিহার চাহনি দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,“তুমিও সিগারেট খাবে? এসব স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।”

ফাবিহা কড়া স্বরে বলল,“আমি তোমার মত খ*বি*শ নই, যে ছাইপাঁশ খাব। এসব ছাড়তে হবে তোমায়?”

“ছেড়ে দেব, কিন্তু বিনিময়ে কী পাব?”
শাবাবের ভেতরকার অভিসন্ধি আঁচ করতে পেরে চোখ সরু হয়ে এলো ফাবিহার।
“আর কী চাইছ? কী পাওয়া বাকি?”

শাবাব ফাবিহার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,“পেয়েও তো স্বাধীনতা পেলাম না।”

“ভালো হয়ে যাও শাবাব।”

শাবাবের ঠোঁটে তীর্যক হাসি। বলল,“তুমি আমায় সুযোগ দিয়েছো।”

ফাবিহার কিছু বলার পূর্বেই তুলি দরজায় এসে দাঁড়ায়।
“ভাইজান, ভাবি আপনেগো হয় নাই?”

শাবাব বলল,“না, মাত্র তো বিয়ে হলো। বাচ্চাকাচ্চা হতে অন্তত এক বছর তো অপেক্ষা করতেই হবে।”

তুলি লজ্জা পেয়ে মিটিমিটি হাসলো। ফাবিহা ফুঁসে উঠলো।
“শাবাব আমি কিন্তু তোমার মুখ ভেঙে দেব। ছোটোদের সামনে কী বলছ তুমি?”

শাবাব ভ্রু কুঁচকে বলল,“তুলি তুই ছোটো? ওহ্ তাহলে তুই যা। এখন থেকে তোর ভাবিকে গোপনে বলব।”

তুলি লজ্জা লজ্জা মুখ করে ছুটে পালিয়ে গেল। শাবাব বলল,“তুলি চলে গিয়েছে। এবার বলব?”

“যে ভালো হাতটা আছে না? ওটাও এখন ভেঙে ফে*ল*ব।”

এক বস্তা রাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল ফাবিহা। শাবাব আলগোছে হাসলো। এখনও জড়তা কাটেনি ফাবিহার। তবে এই রাগটা উপরি উপরি।
গাড়ি নিয়ে খালার বাড়ি দাওয়াত খেতে গেল। যাওয়ার পর থেকে দুজন এক জায়গায় বসে আছে। তুলি আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে। যোহরের আজান পড়ল। ফাবিহা শাবাবের উদ্দেশ্যে বলল,“নামাজ পড়তে যাও।”

শাবাব নড়েচড়ে বসল। ফাবিহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,“কী হলো?”

শাবাব বলল,“আমার হাতে সমস্যা তো। সুস্থ হলে পড়বো।”

“ভাঙা হাত নিয়ে বিয়ে করতে পেরেছ, খেতে পার, সব পার। আর নামাজ পড়তে পারবে না? তাহলে এক কাজ করো খাওয়া, বাথরুম, গোসল এসবও সুস্থ হলেই করে নিও।”

শাবাব বসা থেকে উঠে ইচ্ছে না থাকার পরও পা বাড়ালো। ফাবিহা তার প্রতিটি কদম মনোযোগ দিয়ে গুনছে। এবার সে-ও নামাজ পড়ে নিলো।
শাবাব অনেকদিন পর আজ আবার মসজিদে প্রবেশ করলো খালুর সাথে।

শরীরে মৃদু শিহরণ বয়ে গেল। জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করে বাড়ি ফিরতেই খালা পুরুষদের একসাথে খাবার খেতে বসিয়ে দিলেন। পরের মেয়েদের সাথে ফাবিহা বসবে।
শাবাব বলল,“ ফাবিহা, তুলি বসে যাও আমাদের সাথে।”

খালা বললেন,“ওরা আমাদের সাথে খাবে। তোরা খেয়ে নে।”

শাবাব খেয়ে উঠে গেল। ফাবিহা খালা শাশুড়ির সাথে পরেই খেয়ে নিলো। বাড়ি আসার পর হুরাইনের কল পেয়ে ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো। সালাম বিনিময় করে বলল, “কেমন আছ?”

“আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? সব ঠিকঠাক চলছে?”

“চলছে। তুমি এখনো আমাকে আপনি করেই ডাকবে? আমি তোমায় প্রথম থেকেই তুমি ডেকে এসেছি।”

হুরাইন মৃদু হেসে বলল,“অনুমতি পেয়ে গিয়েছি। এখন থেকে তুমি বলব।”

কথার মাঝেই শাবাব প্রশ্ন করল,“কার সাথে কথা বলছো?”

“হুরাইন।”

শাবাব বলল,“ওনাকে একটা ধন্যবাদ দিও আমার পক্ষ থেকে।”

হুরাইনকে ধন্যবাদ দিতে হলো না। সে শাবাবের কথা শুনতে পেয়ে মৃদু ঠোঁটে হাসলো। ফাবিহাকে বলল,“আল্লাহর কাছে চাইতে থাকো আপু। যা চাইবে, তাতে যদি তোমার কল্যাণ নিহিত থাকে; সেটা তুমি পাবে। আমি তোমাদের জন্য দোয়া করছি। তোমার দোয়াতেও আমাদের সকলকে রেখো।”

“কী করছো তুমি?”

“বই পড়ছিলাম।”

“আমাকেও কয়েকটা বই সাজেস্ট করো।”

“আমি একটু পরই মেসেজ করে জানাচ্ছি কী কী বই পড়বে।”

“আচ্ছা, নিজের খেয়াল রেখো। বাইরে থেকে এসেছি। পরে কথা বলব।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

হুরাইন ইসলামিক বই পড়ে, সেটা সে জানে। বইয়ের নাম সাজেস্ট করার কথা হুট করে আবেগ থেকেই বলেছে। একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ইসলামকে জানার উদ্দেশ্যে বলেনি।

রাত্রি গভীর হলো। বেশ রাত করে ঘুমানো শাবাবের অভ্যাস। সে ঘুমন্ত ফাবিহাকে খুব কাছ থেকে দেখছে। তার নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে শাবাবের গলায়। শাবাব ঘুমন্ত ফাবিহার সুযোগ নিলো। নাকের ডগা আর অধর ছুঁয়ে দিল নিজ ওষ্ঠ দ্বারা। নড়েচড়ে উঠলো ফাবিহা। খানিক্ষন বাদে তার ঘুম ছুটে গেল শরীরের উপর ভারী কিছুর স্পর্শ পেয়ে। নিভু নিভু চোখ খুলে শাবাবকে ঘুমন্ত অবস্থায় তার গায়ে হাত দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখলো। এভাবে ঘুমাতে অসুবিধা হয় তার। শাবাবের হাত সরিয়ে দিয়ে আবারও গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল। শাবাব মিটমিট করে হাসছে। আবারও সে হাত রাখলো। কয়েকবার ফাবিহা হাত সরিয়ে দেওয়ার পরও সে বারবার হাত রাখছে। শেষে শাবাবের ইচ্ছাকৃত কাজ বুঝতে পেরে ফাবিহা ওর হাত ধরে সরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে কামড়ে ধরলো।
এবার দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো শাবাব। ফোনের আলো জ্বালিয়ে হাতে বসে থাকা দাঁতের স্পষ্ট চিহ্ন দেখে আঁতকে উঠলো। কয়েকবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় ফাবিহার ঘুম একেবারে হালকা হয়ে গেল। সে না ঘুমালেও চোখ বুজে আছে। মনে মনে পৈশাচিক হাসি হাসছে। শাবাব আর হাত রাখলো না। সটান হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন ফাবিহার শশুর বাড়ি এলো তাসিন। হাতে কয়েকটা বই। এগুলো হুরাইন পাঠিয়েছে। অবাক হলো ফাবিহা। সে গতকাল বইয়ের নাম চেয়েছিল আর হুরাইন বই সহ পাঠিয়ে দিল? তাসিনের আপ্যায়ন চলছিল বেশ। শাবাবের সাথেও কথা হলো। শাবাব কয়েকবার বাঁকা চোখে তাকালো তাসিন আর ফাবিহার দিকে।

ফাবিহা ঘরে ফিরতেই শাবাব বলল,“তোমার তাসিন ভাই দেখছি একেবারে চোখ তুলেই তাকাচ্ছেন না।”

ফাবিহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,“তুমি এসব খেয়াল করছিলে? সবাইকে নিজের মত ভাবো, তাইনা?“

“আশ্চর্য! আমি খা*রা*প কী বললাম? উনি এসেছেন থেকেই মাথানিচু করেছিলেন। সেজন্যই জিজ্ঞেস করেছি।”

ফাবিহা এবার স্বাভাবিক গলায় বলল,“তিনি স্ত্রীর কথা মেনে চলেন। কোনো পরনারীর দিকে তাকান না। সব ধরনের হা*রা*ম কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।”

শাবাব বলল,“এমন শাসন পেলে আমিও সব ছেড়ে দিতে রাজি আছি।”

ফাবিহা চুপ করে আছে। শাবাব জবাবের অপেক্ষায় থেকেও জবাব না পেয়ে বলল,“তুমি কি সম্পর্কের উন্নতি চাও না? না চাইলে কেন বিয়ে করেছো?”

ফাবিহা বলল,“তোমার ধৈর্য এত কম কেন?”

“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেজন্য আমার ধৈর্য কম। এটা স্বাভাবিক নয় কি? নিজের পছন্দের মানুষকে বৈধভাবে পেয়ে কাছাকাছি থেকেও তার মন ছুঁতে না পারা, তাকে ছুঁতে না পারা ব্যক্তির ধৈর্য কম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আমাদের দুজনেরই কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে।”

ফাবিহা গমগমে স্বরে বলল,“তোমাকে তো আমি অপেক্ষা করতে বলিনি। তোমার যা চাই, তা তুমি আদায় করে নাও। সব রকম অধিকারই তোমার আছে।”

শাবাব মৃদু আওয়াজে বলল,“আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে, আমাদের সম্পর্ককে একটা সুযোগ দিতে চাও, সেজন্যই বিয়ে করেছো। আমি আগেও বলেছি জোরজবরদস্তি করতে চাই না আর। মন না টা*ন*লে আবারও কেন জড়ালে? এতদিন সব তো খুব ভালোই চলছিল।”

ফাবিহা কথা বলছে না। আগ বাড়িয়ে শাবাবের কাছ ঘনাতে পারছে না সে। কেমন জড়তা কাজ করে।
শাবাব রাগ করে দরজায় লা*থি দিয়ে বেরিয়ে গেল।
সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লো। রাতের খাবারের সময়ও উঠলো না। ফাবিহা ডাকাডাকি করেও ওকে ওঠাতে পারছে না। পাশে বসে ওর গায়ে হাত রেখে ডাকল।
“শাবাব উঠে খেয়ে নাও।”

শাবাব স্বাভাবিক গলায় বলল, “তোমরা খেয়ে নাও। আমার খিদে নেই।”

ফাবিহা বলল,“খাবার নিয়ে আসবো?”

“বললাম তো তোমরা খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।”
এই বলে শরীর থেকে ফাবিহার হাত সরিয়ে দিল। ফাবিহারও আর ইচ্ছে হলো না খেতে। শরীর কেমন ভার হয়ে আসছে।
শশুর-শাশুড়ি আর তুলিকে খাবার দিয়ে সে এসে শুয়ে পড়লো।

রাতে জ্বর এসে গেল ফাবিহার। ফজরে আর ওঠেনি। ও সহজে অসুস্থ হয় না; একবার অসুস্থ হলে সহজে সেরে ওঠে না।
ফাবিহাকে ডাকতে এলো তুলি। ওর ডাকে শাবাবের ঘুম ভেঙে গেল। সে ফাবিহার দিকে ফিরে ডাকতে গেল।
তুলি আবারও ডাকলো।
“ভাবি ওঠেন। রাইতে না খাইয়া ঘুমাইছেন বইলা খালাম্মা চিল্লাচিল্লি করতাছিল। এখনও ঘুমাইয়া আছেন দেইখা আমারে চিল্লায়ইতাছে।”

শাবাবের টনক নড়লো। ফাবিহা রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে? একবার নরম স্বরে ওকে ডাকলো।
“ফাবিহা।”

ফাবিহা সাড়া দিল না। কয়েকবার ডেকে দেওয়ার পর উঠলো ফাবিহা। ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে চলে গেল। শাবাব শুয়েই রইল। ফাবিহা আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। অসুস্থ লাগছে চোখমুখ। এটা কি ঘুমের কারণে?

সুরাইয়া প্রথমে বকাবকি করলেও পরে ফাবিহার শরীরের উত্তাপ টের পেলেন। তুলিকে বললেন, “ঘরে ঔষধ আছে, নাস্তা করে ঔষধ খেয়ে নিতে বলিস।”

নাস্তা করার ফাঁকে তুলি বলল,“ভাবি ঘরে ওষুধ আছে। খালাম্মা কইছে নাস্তা কইরা জ্বরের ঔষধ খাইতে।”

ফাবিহা মাথা নাড়লো। তার দিকে চোখ তুলে তাকালো শাবাব। তারমানে তার ধারণা ভুল নয়। শাবাব বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ঘরে এসে ফাবিহাকে বসে থাকতে দেখলো। কোনো কথা ছাড়ায় এগিয়ে এসে ফাবিহার কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা চেক করলো। শরীরে বেশ জ্বর।
শাবাব বলল,“চলো ডাক্তারের কাছে যাব।”

“যেতে হবে না। এমনিতেই সেরে যাবে।”

“আমার কথা না শুনলে আমি কিন্তু জোর করতে বাধ্য হবো।”

ফাবিহা বসেই রইলো। শাবাব অকস্মাৎ ওর অধর চেপে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড পরই ছেড়ে দিয়ে ফাবিহার দিকে তাকিয়ে বলল,“চলো।”

ফাবিহা চোখ লুকিয়ে বলল,“আমি যাব না।”

“তাহলে আবার চুমু দেব।”

ফাবিহা জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল,“তোমার ওই সিগারেটে পোড়ানো ঠোঁটে আমায় ছুঁতে এলে তোমার ঠোঁট আমি কু*চি*কু*চি করে ফেলবো।”

শাবাব বলল,“তোমার ছুঁতে পারলে আর সিগারেট ছুঁয়ে দেখবো না। প্রমিস!”

★★★

হুরাইন ফোন করে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেছিল বইগুলো পড়ে জানাতে, কেমন লেগেছে। তাই ইচ্ছে না থাকার পরও একটা বই নিয়ে বসলো ফাবিহা। জ্বরের শরীরে কিছুই ভালোলাগছে না। সুরাইয়া এটা-ওটা বলে বকাবকি করছেন, আবার নিজেই সব কাজ করে ফেলছেন।
শাবাব একটু বের হয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসে। আজ আর বের হলো না। ফাবিহাকে নিয়ে সে বিকেলে ডাক্তারের কাছে যাবে।

ফাবিহা বইয়ের দিকে তাকাতে পারলো না। তিন-চার লাইন পড়ার পরই ওর চোখ জ্বালা বেড়ে গেল। চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। তাই বই রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। শাবাব এসে আবারও কপালে হাত রেখে জ্বর দেখলো। ফাবিহা চোখ খুলে তাকালো।

“চলো ডাক্তারের কাছে।”

এবার শরীর খুব খা*রা*প লাগছে। তাই ফাবিহা আর বাড়াবাড়ি না করে শাবাবের কথায় উঠে পড়লো। বোরকা পরে বের হলো শাবাবের সাথে। সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। শাবাব জিজ্ঞেস করল,“বেশি খা*রা*প লাগছে?”

“হুম।”

“আমি আছি, ডাক্তার ঔষধ দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
বলে ফাবিহার হাত নিজের মুঠোয় নিলো। ডাক্তারের কাছে যেতেই ফাবিহার জ্বর যেন অর্ধেক কমে গেল। ঔষধপত্র নিয়ে বের হয়ে শাবাব জিজ্ঞেস করলো, “কী খাবে?”

“আমি বাসায় যাব।”

#চলবে……..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“ঠান্ডা পানি ধরিস না। তোর শাশুড়ি কিছু বললেও ধরার দরকার নেই।”

ফাবিহা বলল,“কাজ তুলি আর উনিই করেন। আমি টুকটাক এগিয়ে দিয়ে থাকি।”

“শাবাব তোর সাথে খা*রা*প আচরণ করে? শুধু মাকে বলবি।”

“না। কেউই খা*রা*প আচরণ করছে না।”

“তবুও সাবধান থাকিস।”

“আচ্ছা। বাবা কোথায়?”

“বাড়িতে নেই। তোকে দেখতে যাবে বলেছে।”

“কখন?”

“সেটা বলেনি।”

মায়ের সাথে কথা বলার ফাঁকেই তুলি এসে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলল,“ঠাণ্ডার মাঝে এমন বইসা রইছেন ক্যান? ভাইজান চাদর পাঠাইছে।”

ফাবিহা চাদর ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে মায়ের সাথে কথা শেষ করল। তুলিকে জিজ্ঞেস করল,“তোর ভাইজান আমায় কখন দেখল?”

“বাড়িত ঢুকনের সময় দেখল আপনে ছাদে শীতের কাপড় ছাড়া বইসা আছেন।”

“ওহ্।”

“আপনের জ্বর কমছে?”

“এখন একটু কম আছে।”

“তুলি নিচে যা।”
শাবাবের পুরুষালি স্বর শুনে তুলি, ফাবিহা দুজনই পিছু ঘুরে তাকাল। শাবাব এসেছে ছাদে। তুলি ভাইজানের আদেশ পেয়ে দ্রুত নিচে চলে গেল।
শাবাব গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,“এখন জ্বর কেমন?”

“কম আছে।”

“দেখি।” বলে ফাবিহার কপাল, গলা ছুঁয়ে দিল শাবাব। তারপরই পকেটে হাত গুঁজে বলল,“এভাবে ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে জ্বর আবার আসবে। নিচে চলো।”

ফাবিহা কোনো প্রকার সংকোচ না করে তাকিয়ে রইলো শাবাবের পানে। সে ভাবছে শাবাব কি সত্যি মন থেকেই তার জন্য এসব করছে না কি ছলনা? সে বশ্যতা স্বীকার করার পরই নিজের রূপ দেখিয়ে দেবে?
শাবাব দূরত্ব কমিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বলল,“কয়দিন চুলে চিরুনি চালাও না?”

ফাবিহা দৃষ্টির নড়চড় না করেই ক্ষীণ ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,“চুলে চিরুনি না চালালে কি খা*রা*প দেখায়?”

শাবাব চোখ ছোটো করে বলল,“নায়িকা তো লাগে না। ভূতের মত থাকলে ভূতনিই লাগবে। তোমার চোখের নিচও ভূতনির মত কালো হয়ে গিয়েছে।”

“আমাকে ভূতের মত দেখালে সমস্যা তো নেই। তোমার জন্য তো মেয়ের অভাব নেই। আরো তিনটে বিয়ে করলেও কেউ না করবে না।”

“সত্যি?”

ফাবিহা তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করল। শাবাব আলতো হেসে বলল,“একজনের ভালোবাসাই আমার জন্য যথেষ্ট। তার মাঝেই আমি চারজন খুঁজে নেব। কখনো রাগী, কখনো শান্ত, কখনো চঞ্চল আর কখনো আদুরে বিড়াল।”

ফাবিহা হাসলো। তাতে কটাক্ষ ছিল বোধহয়!
“এভাবেই মেয়েদের পটিয়ে নিতে, তাইনা?”

শাবাব শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,“আমি এসব ভুলতে চাই ফাবিহা।”

ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“আমার মনে হচ্ছে আমি অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”

শাবাব ফাবিহার এক কথায় বলে ফেলল,“কোথায় যেতে চাও? তোমার পছন্দের জায়গায় যাব আমরা। সাজেক, কক্সবাজার, যেখানে যেতে চাও বলো।”

“ওসব জায়গায় না। গ্রাম হলে ভালো হয়। আগে ছোটোবেলায় দাদা বাড়ি যেতাম। দাদা-দাদি মা*রা যাওয়ার পর থেকে আর যাওয়া হয় না।”

“আমার দাদার বাড়িতে কেউই নেই। আমরা, জেঠুরা আর ফুফু সবাই শহরে থাকি। নানার বাড়িতে বড়ো মামা আছেন। যাবে ওখানে?”

★★★

রাতের বাসে চড়ার ইচ্ছা থাকলেও শাবাব অপেক্ষা করল ফাবিহার জ্বর আরো কিছুটা কমার। সকালে ঘুম থেকে উঠে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পাচ্ছে না শাবাব। তন্নতন্ন করে বিছানা, ড্রয়ার সব জায়গায় খুঁজে যাচ্ছে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে ফাবিহাকে ডাকল।

“ফাবিহা ঘরে এসো তো।”

ফাবিহা শশুরের কাছ থেকে উঠে ঘরে এসে জিজ্ঞেস করল,“কী হয়েছে?”

“আমার সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পাচ্ছি না।”

ফাবিহা ভাবলেশহীন বলল, “আমি ফেলে দিয়েছি।”

“কীহ্!” মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো শাবাব।

“আবার বলতে হবে? কটন আছে ঘরে। কান পরিষ্কার করে নিও।”

শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“তুমি সিগারেট ফেলেছো কেন?”

“সিগারেট এবং সিগা*রেট*খোর মানুষ দুটোই আমার অপছন্দ। আজ সিগারেট ফেলেছি, কাল মানুষটাকেই জানালা দিয়ে ফে*লে দেব।”

ফাবিহা খুবই শান্ত মেজাজে কথা বলছে। শাবাব ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,“তুমি কত ফে*ল*বে? আমি আবার নিয়ে আসবো।”

“তুমি যতবার নিয়ে আসবে, আমি ততবারই ফে*লে দেব।”

“তুমি আমার যতগুলো সি*গা*রে*ট ফেলবে, আমি গুনে গুনে তোমায় ততোগুলো চুমু খাব।”
বলে ধূর্ততার পরিচয় দিয়ে হাসলো শাবাব।

ফাবিহা কটমট করে তাকাতেই শাবাব তার রাগ আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিতে বলল,“আজ পাঁচটা সি*গা*রে*ট ফেলেছো। চলো এখন থেকেই শুরু করি।”

ফাবিহার দিকে এগিয়ে আসতেই ফাবিহা দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,“একদম এগোবে না তুমি।”

কে শোনে সাবধানের বাণী? শাবাব এগিয়ে এসে চট করে দুটো চুমু খেয়ে সরে গেল। বলল,“বাকি তিনটে তোলা রইল। এ দুটো আগে হজম করে নাও।”

ফাবিহা হাতের কাছে পানির গ্লাস পেল। পানি ছুঁড়ে মা*রা*র আগেই শাবাব খপ করে তার হাত ধরে ফেলে বলল,“বুঝতে পেরেছি, বাকি তিনটে চুমু তোমার এখনই লাগবে। নয়তো তোমার মাথা ঠাণ্ডা হবে না। রাগ কোরো না, তুমি বললে আমি একশো একটা চুমু দিতে রাজি আছি।”
মুখের কথা শেষ করতে না করতেই বু*লে*টে*র গতিতে বাকি তিনটে চুমু দিয়ে গ্লাস টে*নে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ফাবিহা হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার কিছু ফিল হচ্ছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক সে অনুভূতিটা কেমন সেটা ঠাওর করে উঠতে পারলো না।
শাবাব বাইরে থেকে আসার সময় তিন প্যাকেট সিগা*রেট কিনে নিয়ে এসেছে। ফাবিহাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বালিশের পাশে রাখছে। ফাবিহা সিগা*রেট ফেললেই তার উদ্দেশ্য সফল। আসার সময় বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে।
ফাবিহা ভুলেও সিগা*রেট ফেলল না।

দুপুরে খাওয়ার পর জায়গামত সিগা*রেট না পেয়ে শাবাব দুর্বোধ্য হাসলো। ফাবিহার দিকে এগোতে এগোতে বলল,“চলো, গুনে গুনে..

কথা শেষ করার আগেই ফাবিহা হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।
“তেমার সিগা*রেট আমি ফেলিনি। তুলি ফেলেছে।”
বলেই ধূর্ত হাসলো। অতঃপর বলল,“চুমু দেবে না?”

শাবাবের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল। সে ক্ষ্যা*পা স্বরে বলল,“এটা তুমি ইচ্ছে করে করিয়েছ।”

“অবশ্যই। আমি অস্বীকার করছি না।”
ফাবিহার সহজ স্বীকারোক্তি শুনে শাবাব বলল,“আমি একবার সুযোগ পাই, তখন তোমার নিস্তার নেই।”

★★★

ফাবিহার জ্বরের প্রকোপ কমে যাওয়ায় নানা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শাবাব, ফাবিহা। গতরাতের পরিবর্তে আজ রাতে গাড়িতে চড়লো দুজন। বাসে কেউ কেউ ঘুমিয়ে আছে, কেউ বা নিজেদের মত করে ফোনে মগ্ন। ফাবিহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। শাবাব তার চাদর ঠিক করে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। ফোন দেখতেও ভালোলাগছে না। তাই ফাবিহাকে বিরক্ত করল।

“হ্যালো মিস! আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

ফাবিহা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপরই বলল,“নানা শশুর বাড়ি যাচ্ছি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

শাবাব বলল,“আমিও। তবে নানা শশুর বাড়ি না, নানার বাড়িতেই যাচ্ছি।”

“রাতের বাসে কেন যাচ্ছেন?”

“আসলে আমার ওয়াইফ চাচ্ছিল, সেজন্যই। কিন্তু আপনি মেয়ে মানুষ একা একা কেন রাতের বাসে যাচ্ছেন?”

“আমার সাথে একজন বডিগার্ড আছে।”

শাবাব বুঝতে পারলো তার কথাই বলছে। হাজবেন্ড বলতে পারত! সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,“আপনার বডিগার্ড বেশ হ্যান্ডসাম।”

ফাবিহা বলল,“জি, তবে হাত ভাঙা।”

শাবাব আবারও মনঃক্ষুণ্ন হলো। বলল,“হাত তো কিছুদিন পরই ভালো হয়ে যাবে।”

তারপর দুজনই চুপ। শাবাব ফোন বের করে নিজের একটা ছবি বের করে ফাবিহাকে দেখিয়ে বলল,“দেখুন, এটা আমার ছবি।”

ফাবিহা ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,“ওহ্, আমি ভেবেছিলাম কোনো ছিন*তাই*কারীর ছবি।”

শাবাব হতাশ চোখে তাকালো। নিজের আরেকটি ছবি দেখাল। পরপর নিজের কয়েকটা ছবি দেখিয়ে ফাবিহার একটি ছবি দেখিয়ে বলল,“এটা আমার ওয়াইফ।”

এবার মুখ খুললো ফাবিহা।
“সুন্দরী।”

শাবাব সূঁচালো চোখে তাকালো। ফাবিহা ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর নিজের ফোন রের করে তার চৌদ্দগোষ্ঠীর সবার ছবি দেখিয়ে বলছে– এ অমুক, এ তমুক।”

শাবাব বিরক্ত হয়ে বলল,“আপনার হাজবেন্ডের ছবি নেই?”

“না।”

“ফেসবুক একাউন্টে ঢুকলেই তো পাবেন।”

“সে ফেসবুক ব্যবহার করে না।”

“আপনি নাম দিয়ে সার্চ দিলেই পাবেন।”

ফাবিহা বলল,“আমার ফোনে এমবি নেই।”

শাবাব ফাবিহার ফোন টেনে নিয়ে নিজের একটা ছবি তুলে দিয়ে বলল,“এইতো আপনার হাজবেন্ডের ছবি। গুড লুকিং।”

ফাবিহা বলল,“আপনার চোখে ছানি পড়েছে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।”

শাবাব বলল,“ আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি একজন ডাক্তার। প্লিজ আমার চোখ ভালো করে দিন!”

ফাবিহার ঘুম পাচ্ছে। তাই সে আর কথা বলল না। সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নিলো। শাবাব আবার একা হয়ে পড়লো। সে ফাবিহার দিকে তাকিয়ে রইলো।

★★★

নিশি বাবার বাড়ি আসলে যেন বন্দীশালা থেকে মুক্তি পায়। স্বাধীনতা পাওয়া মানুষ ধরাবাঁধা নিয়মে পড়ে গেলে হাঁপিয়ে ওঠে। তার অবস্থাও তেমনি। ফজরের পর জা’য়েদের সাথে মিলে নাস্তা বানাতে হয়। একটু ঘুমানোর সুযোগ নেই। হাজবেন্ড নামাজ, পর্দা এসব ছাড়া আর কোনো চাপ দেয় না। যা প্রয়োজন হয়, যা খেতে চায় নিয়ে আসে। তবুও নিশি এখনো পুরোপুরি মন থেকে সবাইকে গ্রহণ করতে পারেনি।

তাসিনের কাছ থেকে পড়া নিচ্ছে হুরাইন। এখন সে নিজে নিজেই পড়তে পারে। মাঝেমাঝে তাজবিদে ভুল করে। সেগুলোই ঠিক করিয়ে দেয় হুরাইন। পড়ানো শেষ করে তাসিনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো সে। আদুরে গলায় বলল,“একটা কথা বলবো?”

তাসিন বলল,“বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা ছাড়া হাজারটা কথা বলতে পারো।”

হুরাইন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলল,“আমার আব্বুর সাথে আপনার কী শ*ত্রু*তা?”

“সেটা তো আমিও জানি না। কোন শ*ত্রু*তা*র জের ধরে তিনি আমাকে আমার বউ থেকে দূরে রেখেছেন? আমিও সেই শ*ত্রু*তা*র জের ধরে ওনাকে ওনার মেয়ে থেকে দূরে রাখছি।”

“সবার কথা খুব মনে পড়ছে আমার।”

“ভিডিও কল করে দেখে নাও। বিকল্প তো আছেই।”

হুরাইন কিছু বলল না। ঘুমানোর সময় তাসিন ওকে জড়িয়ে ধরতে নিতেই হুরাইন কোলবালিশ দেখিয়ে বলল,“কোলবালিশ জড়িয়ে ধরুন। বিকল্প পদ্ধতি তো আছেই।”

তাসিন আমতা আমতা করে বলল,“আচ্ছা যেও বাপের বাড়ি।”

হুরাইন খুশি হয়ে গেল। ফজরের পর থেকেই তার প্রস্তুতি চললো বাবার বাড়ি যাওয়ার। তাসিন মসজিদ থেকে ঢুলতে ঢুলতে এসে বলল,“দেখোতো হুরাইন, আমার বোধহয় আজ জ্বর আসবে। তুমি বাপের বাড়ি অন্যদিন যেও।”

হুরাইন তাসিনের কপাল চেক করে বলল,“না তো। জ্বর বোধহয় আমি বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর আসবে।”

#চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে