#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
স্মৃতি রোমন্থনে নামলো ফাবিহা। মনে তখন হাজারো প্রজাপতি ডানা ঝাপটে চলেছে। বিনা বাধায়, বিনা চাওয়ায় আকাঙ্ক্ষিত পুরুষটি তার হতে যাচ্ছে। পছন্দ মনে সদ্য প্রেম জন্ম দিয়েছে। তারপরই জীবনে শাবাব নামক বখা*টের আগমন। সবকিছুই কেমন হুট করে, অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে যাচ্ছে। তারপর একের পর এক সেই বখা*টের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। শুরু হলো বখা*টের নানাভাবে হেনস্তা। চুপ না থেকে পাল্টা জবাব দিয়েছে। যতবার তাকে হেয় করার চেষ্টা করেছে, ততবারই সে পাল্টা আক্র*মণ করেছে।
এরপরই এলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়। দুজনের জীবন জুড়ে গেল এক সুতায়। বিয়ের দুদিন পরই অস্বাভাবিকভাবে সেই বখা*টে শান্ত হয়ে গেল। এক কথায় মেনে গেল তার কথা। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তার প্রতি নমনীয় হয়ে এসেছে।
আজ মন খানিকটা নয়, পুরোপুরি গলতে চাইছে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল, “যে অনুতপ্ত, সে কি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়?”
নিজের এতখানি পরিবর্তনের পেছনে সম্পূর্ণ হাত হুরাইনের। যদি না হুরাইন তাকে বোঝাতো, তবে শাবাবকে ক্ষমা করার চিন্তাটাও মাথায় আসতো না। আসলেই কি ক্ষমা করা যায়? ক্ষমা পাওয়ার মত কী করেছে সে? আড়াল থেকে তাকে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করেছে বলেই কি ক্ষমা করতে হবে?
মাথা ঝিমঝিম করছে।
★★★
সুরাইয়ার করুণ দশা। একদিকে অসুস্থ স্বামী অন্যদিকে অসুস্থ ছেলে। সবদিক সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছেলে ম*র*তে বসেছে। কার জন্য? নিজের ডি*ভো*র্সি বউয়ের জন্য। ভাবতেই শরীর আর মন জুড়ে তাচ্ছিল্য আসছে। আবারও বোন এসে ওনার সংসার সামলাচ্ছে। তিনি ছেলের কাছে হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন।
“মা।”
অস্পষ্ট, রুগ্ন স্বর শুনে পিছু ফিরলেন সুরাইয়া। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠছে। কাঁ*টা*ছে*ড়া যুক্ত মলিন চেহারা। রাজপুত্তেরের মত দ্বীপ্ত, নিটোল চেহারা হারিয়ে গিয়েছে মুখে জায়গা করে নিয়েছে ফ্যাকাশে ভাব। রক্তশূণ্য শুষ্ক ঠোঁট জোড়া। সুরাইয়ার সারাদিন কান্না পায়। একটাই তো সন্তান দিলেন আল্লাহ। তাহলে তার জীবনে কেন এত এত বি*প*দ, খা*রা*প মানুষের দেখা?
কান্না গিলে জিজ্ঞেস করলেন,“ব্যথা করছে আব্বা?”
“তুমি খেয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“আর কেউ এসেছে?”
“সবাই এসে দেখে চলে যাচ্ছে। রাতে তোর জেঠু আসবেন।”
“বাবা কেমন আছে?”
“ভালো থাকে কী করে? তুই ভালো থাকতে দিচ্ছিস কোথায়? কী দরকার ছিল ওই মেয়ের জন্য মা*রা*মা*রি করতে যাওয়ার?”
শাবাব কোনো জবাব দিচ্ছে না। সে মায়ের কথা সিরিয়াসভাবে নিচ্ছে না। সুরাইয়া দাপুটে, তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,“সত্যি করে বল তো, তুই কি এখন আবার ওই মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখছিস? একবার ছেড়ে দিয়ে আবার সম্পর্কে জড়াচ্ছিস। বলছি তোদের এই খেলা কবে শেষ হবে?”
শাবাব বলল,“ডি*ভো*র্স হলে আবার সম্পর্ক রাখে কীভাবে?”
“সবই পারা যায়। কত মানুষকে দেখলাম আগে ডি*ভো*র্স দিয়ে দেয়। পরে হুজুরের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে আবার ফিরিয়ে এনে সংসার করে। খবরদার তুই যদি এমন নাটক শুরু করিস, তাহলে লু*লা বাপ-ছেলে দুটোকে রেখে আমি নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
শাবাব আলতো হেসে বলল,
“পারবে আমাকে আর বাবাকে রেখে যেতে?”
সুরাইয়া ছেলের হাসিমাখা মুখে তাকিয়েই থেমে গেলেন। তারপর আবারও তেতে উঠে বললেন,“তুই তাহলে ওই মেয়েকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছিস?”
শাবাব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“তুমি চিন্তা কোরো না মা। ও কখনোই আসবে না।”
“আসবে না তোকে কে বলেছে? কালই তো ফরহাদের সাথে এখানে এসেছে। এত বড়ো অভিনেত্রী। চোখে পানি নিয়ে দেখিয়ে গেল আমার ছেলের জন্য তার কলিজা ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। নাটকবাজ মেয়ে। সাথে তুই আজকাল নাটক করা শিখেছিস আমার সাথে।”
শাবাব বিস্মিত হলো ফাবিহার আগমনের কথা শুনে। প্রবল আগ্রহী স্বরে শুধালো, “ফাবিহা এখানে এসেছে?”
সুরাইয়া ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও সূচালো চোখে তাকালেন।
“তুই এত ব্যাকুল হচ্ছিস কেন?”
শাবাব দমে না গিয়ে ফের বলল,“ও যখন এসেছে, তখন আমাকে জাগাওনি কেন?”
সুরাইয়ার চোখ কথা বলছে। এই মুহূর্তে ছেলেকে যেন গিলে ফেলবেন।
ফাবিহা আজ আবার হাসপাতালে এলো শাবাবকে দেখতে। শাবাব মায়ের সাথেই কথা বলছিল। তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি টের পেয়ে দুজনই দরজার দিকে তাকালো। ফাবিহা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। সুরাইয়া কিছু বলতে যাবেন, শাবাব৷ মায়ের হাত চেপে ধরে চোখের ইশারায় অনুনয় করল “প্লিজ মা!”
মুখে ফাবিহাকে বলল,“দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।”
ফাবিহা ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে সুরাইয়ার দিকে। পা বাড়াতেই সুরাইয়ার ধমকে আগের জায়গায় চলে গেল।
“এ্যাই মেয়ে, আর এক পাও এগোবে না তুমি। আমার ছেলের মাথা তো তুমি খেয়েই রেখেছো। তুমি যেভাবে নাচাচ্ছো, সেও সেভাবেই নাচছে। আমি তোমাকে আর কোনো সুযোগ দেব না।”
শাবাব মাকে বলল,“মা প্লিজ থামো!”
সুরাইয়া ছেলেকে ঝাড়ি দিলেন।
“কেন? বিবির জন্য পরান জ্বলে যাচ্ছে? মায়ের জন্য জ্বলছে না?”
“ওর কোনো দোষ নেই মা। সব দোষ আমার। এতদিন যা যা ঘটেছে, সব আমার কারণে ঘটেছে। ও কী বলতে এসেছে, সেটা আগে শুনি!”
সুরাইয়া ছেলের পাশ থেকে উঠে বেরিয়ে গেলেন হনহন পায়ে। শাবাব ফাবিহাকে ডাকলো,“মায়ের কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দুঃখিত! তুমি ভেতরে এসো।”
ফাবিহা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে শাবাবের পাশে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছো?”
শাবাব মৃদু হেসে বলল,“ভালো।”
“কেন গিয়েছ সুমনের সাথে ঝা*মে*লা*য় জড়াতে?”
ফাবিহার প্রশ্ন সরাসরি এড়িয়ে গিয়ে শাবাব জিজ্ঞেস করল,“তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে? বাসার সবাই ভালো?”
ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছো। কেন গিয়েছিলে সুমনের কাছে?”
“আমার ওর সাথে ব্যক্তিগত ঝা*মে*লা আছে। সেটা মেটাতেই গিয়েছি। তুমি হঠাৎ আমাকে দেখতে এলে যে?”
ফাবিহা শক্ত হয়ে বলল,“আমি এখানে থাকতে আসিনি। আমার জন্য কেন ঝা*মে*লা*য় জড়ালে সেটাই জানতে এসেছি। আমার জন্য কেউ নিজের ক্ষতি করুক সেটা আমি চাই না।”
“আমি তোমার জন্য ঝামেলায় জড়াইনি। বলেছিতো আমার ব্যক্তিগত ঝা*মে*লা আছে সুমনের সাথে।”
“ফরহাদ আমায় মিথ্যা বলল?”
ফাবিহার তীর্যক চাহনি। শাবাব বলল,
“ফরহাদ কী বলল না বলল এসব তোমায় বিশ্বাস করতে হবে? পৃথিবীতে মানুষের কাজের অভাব পড়েছে যে তোমার জন্য ঝা*মে*লা*য় জড়াতে যাব?”
ফাবিহা শাবাবকে আগাগোড়া একবার স্ক্যান করে নিলো। সেই ভাঙা ডানহাত মৃদু চেপে ধরতেই মৃদু চিৎকারে আর্তনাদ করে উঠলো শাবাব।
“এ্যাই কী করছো? প্রথমবার রাতে আমার ভাঙা হাতে পিঠ দিয়ে শুয়েছো, এখন আবার আমার হাত গুঁড়ো করে ফেলছো।”
ফাবিহা শাবাবের চোখে চোখ রেখে বলল,“ব্যথা লাগে?”
শাবাবের নাক ফুলে উঠেছে রাগে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“না খুব আরাম পাচ্ছি। আরো জোরে চেপে ধরো ইডিয়ট!”
ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“সত্যটা বলো শাবাব।”
“হ্যাঁ আমি তোমার জন্য ঝা*মে*লা*য় জড়িয়েছি। কারণ সুমন তোমার পেছনে পড়ার কারণ হিসেবে আমি দায়ী।”
হাত ছেড়ে দিল ফাবিহা। হালকা ভাবেই হাত ধরেছিল। দ্বিতীয়বার আ*ঘা*ত পাওয়া জায়গা মৃদু চাপ দিলেও ব্যথা পাওয়া স্বাভাবিক। এবার স্বাভাবিক গলায় বলল,“সুমন তোমার কারণে আমার পেছনে পড়ে থাকেনি। তাই নিজেকে দায়ী করে চালাকি করার চেষ্টা করবে না।”
শাবাব হাতের দিকে তাকিয়ে রইল বেদনাদায়ক দৃষ্টিতে। ফাবিহা বলল,“তেমন কিছু হয়নি হাতের। আসছি আমি।”
ফাবিহা পা বাড়াতেই শাবাব বলে ফেললো,“তুমি নাকি কাল আমার জন্য কেঁদেছ? এতো দরদ?”
ফাবিহা ঘাড় বাঁকা করে পিছে ফিরে বলল,“কে বলেছে তোমায় এসব ফাউল কথা?”
শাবাব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,“বিয়ে করছো না কেন?”
ফাবিহা বলল,“তুমি কেন করছো না?”
“জীবনে আর কতবার বিয়ে করবো? একবার তো করলাম। খায়েশ মিটে গিয়েছে।”
“ওটা বিয়ে ছিল না।”
“যদি তোমার কোনো বান্ধবী সিঙ্গেল থাকে তাহলে বোলো।”
ফাবিহা হতাশ হলো।
“তুমি কখনো ভালো হবে না।”
শাবাব এবার সিরিয়াস হয়ে বলল,“আবারো অনুরোধ করছি। যদি কখনো পারো, আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
“আমি বোধহয় তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আবার দ্বিগুণ ঘৃ*ণা করি। আই হেইট ইউ ইনফিনিটি।”
“ক্ষমা করে আবার কেন ঘৃ*ণা করো?”
“তোমার মেয়ে সঙ্গ দূর হয়নি। অনুতপ্ত ভেবে ক্ষমা করেছি। কিন্তু তুমি ভালো হওনি।”
শাবাবের মেজাজ খা*রা*প হলো।
“তুমি কী চাইছো বলো তো? বলছো বিয়ে করে নিতে। আর বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজলেই দোষ?”
“পাত্রী খুঁজলে দোষ না। দোষ তোমার নজরে। এক্স ওয়াইফ এর ফ্রেন্ডের দিকে নজর দাও।”
“আশ্চর্য! তাকে তো আমার বিয়ে করা জায়েজ। আর তুমিই তো বললে ওটা কোন বিয়ে ছিল না। তাহলে সে আমার এক্স ওয়াইফের ফ্রেন্ড কীভাবে হয়?”
ফাবিহা ফোঁস করে বলল,“শাবাব তুমি কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলছো।”
শাবাব মলিন হেসে বলল,“আমি তো তোমার সামনে যাইনি ফাবিহা। তুমি নিজেই এসেছো। আজ আমি বলছি, প্লিজ তুমি আর আমার সামনে এসো না!”
ফাবিহা থমকে গেল। এতদিন সে শাবাবকে নিজের সামনে আসতে বারণ করতো, আর আজ শাবাব তাকে বারণ করছে। সে প্রশ্ন করে ফেললো,“আমি আসলে কি তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ, আমি আবারও বে*য়া*দ*ব, অ*স*ভ্য হয়ে যা কিছু করে ফেলতে পারি। হয়তো তোমায় আটকেও ফেলতে পারি! তাই নিজের কথা ভেবেই তুমি আর এসো না।”
শাবাবের কথা কীসের ইঙ্গিত দিলো ফাবিহার বুঝতে কষ্ট হয়নি। সে বলল,“আমি আসছি।”
ফাবিহা আবারও পা বাড়ায়। দরজা পর্যন্ত গিয়ে শুনতে পায়।
“তুমি প্লিজ আর কখনোই আমার সামনে এসো না। আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি তোমার প্রতি।”
ফাবিহা না ঘুরেই চলে গেল। রাগ উঠে গেল শাবাবের। এভাবে ফাবিহার কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ না করলেও পারতো।
★★★
শাবাব বাড়ি এসেছে এক সপ্তাহ। সুরাইয়া দুজনকে নিয়ে বড়ো বি*প*দে আছেন। তুলি ছোটো একটা মেয়ে। সে রান্নাবান্নার কাজে সাহায্য করে।
স্ক্রিনে ফাবিহার নম্বর দেখে অবাক হলো শাবাব। রিসিভ করে চুপ করে রইল। ওপাশেও নিরবতা।
শাবাবের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ফাবিহা ডাকলো,
“শাবাব? আছো?”
“হুম, বলো।”
“আমার বিয়ে হচ্ছে শীঘ্রই। তোমার নিমন্ত্রণ রইল।”
থমকে গেল শাবাব৷ রুদ্ধশ্বাসে বলল,“কংগ্রাচুলেশনস।”
“পাত্রকে তুমি চেন। আমার ফ্রেন্ড সানির কাজিন। তোমার ফ্রেন্ডেরও কাজিন সে। তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে!”
শাবাব সাথে সাথে কল কেটে ফোন দূরে ছুঁড়ে মা*র*লো। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে লাইটার অন করলো বাম হাতে। পরপর কয়েকটা সিগারেটের ধোঁয়া পুরো রুম প্রায় অন্ধকার করে ফেলেছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
★★★
বাড়িতে একা মন টিকছে না। ফাবিহা খালার বাড়ি চলে এলো। হুরাইন তাকে পেয়ে খুশিই হয়েছে। নতুন বিয়ের জন্য অগ্রিম অভিনন্দন জানালো। কিন্তু ফাবিহা খুশি দেখাচ্ছে না। তাই হুরাইন জিজ্ঞেস করল,“আপনি কি বিয়েতে খুশি নন আপু?”
ফাবিহা ইতস্তত করে বলল,“আমি দ্বিধায় আছি। বিয়েতে মন সায় দিচ্ছে না।”
“বিয়ে হতে তো এখনো দেরি। ততদিনে মন ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়ই?”
“জানি না।”
“আপনি কি আগের বিয়ে নিয়ে কোনো ভয় পাচ্ছেন?”
“না।”
“তবে কীসের পিছুটান? কোনোভাবে কি আপনি আপনার আগের স্বামীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন? দেখুন, এখনো সময় আছে।”
ফাবিহা বলল,“না না। কোনো দুর্বলতা নেই। আমি বিয়ে করবো।”
“আপনি না বললে কিন্তু সবসময় সবাই মনের কথা বুঝবে না। তাই কী নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সেটা বললে ভালো হয়।”
“কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি না।”
হুরাইন আর জোরাজোরি করলো না। বিকেলে ফাবিহা নিজ থেকেই হুরাইনের কাছে গেল। চিন্তিত সুরে বলল,“আমি যতবার বিয়ের কথা ভাবি, ততবার শাবাবের কথা মনে হয়। এমন নয় যে ওকে আমি ভালোবাসি। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।”
হুরাইন হাতে তসবিহ পড়ছে। কথা বলছে না। রাতে সাজেদার সাথে সে আলাপ করলো ফাবিহাকে নিয়ে।
“আম্মা আমার মনে হয় ফাবিহা আপু আর ওনার স্বামীর ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখা উচিত। কথায় যতটুকু আমি ধারণা করেছি, দু’জনের মনেই কিছু না কিছু আছে। তাই আমার মনে হয় আরেকবার সবার সাথে কথা বলে ওনাদের এক করার ব্যবস্থা করলে ভালো হবে। আপনি খালার সাথে কথা বলে দেখুন।”
“তোমার খালা শাশুড়ি ওই ছেলের কথা শুনতেই পারে না। কোনো লাভ হবে না।”
“ আচ্ছা বুঝিয়ে বলেই দেখুন না। ওনারা স্বামী-স্ত্রী দুজন ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। ফাবিহা আপু ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। তাই সবাই মিলে একটা চেষ্টা দেওয়া উচিত।”
“আচ্ছা আমি কাল কথা বলব ওর মা-বাবার সাথে। তুমি এখন ঘুমাতে যাও।”
#চলবে……
#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
“তোকে একটা কথা বলতে চাই। রাগ করিস না।”
“কী কথা?”
সাজেদা বললেন,“কথাটা ফাবিহাকে নিয়ে। তুই আগেই রাগ করিস না। ওর বাবা আছে পাশে?”
“আছে। কী কথা? বলো।”
“স্পিকার অন কর।”
“করেছি।”
“ফাবিহাকে যে বিয়ে দিচ্ছিস, ওর মতামত নিয়েছিস?”
“ও তো আমাদের উপর সব বিয়ের আগেই ছেড়ে দিয়েছে। তাছাড়া এতদিন পর একটা ভালো সমন্ধ পেয়েছি। ও অমত করবে কেন?”
“তুই কি জিজ্ঞেস করেছিস ওকে?”
“আশ্চর্য! জিজ্ঞেস করার কী আছে? অমত থাকলে তো ও নিজেই বলতো।”
“আমার মনে হয় ওর আগের সম্পর্কের কথা একবার ভেবে দেখা উচিত।”
“আগের সম্পর্ক কী ভেবে দেখবো?”
এবার কথা বললেন আতাউর রহমান।
“আপনি কী বলতে চাইছেন আপা? বুঝিয়ে বলুন।”
“ফাবিহার আগের সংসারের কথা বলছি। দুজনে সম্পর্কে ফিরতে চায় কি না জিজ্ঞেস করে নতুন সম্পর্কে এগোনো উচিত বলে আমি মনে করি।”
ফাবিহার মা বললেন,“আপা তোমার মাথা খা*রা*প হয়ে গিয়েছে। কী বলতে কী বলছো বুঝতে পারছ না।”
আতাউর রহমান বললেন,“আপা তারা একসাথে থাকবে না বলেই তো নিজেদের মত করে সিদ্ধান্ত নিলো। ডি*ভো*র্স ও হয়ে গেলো। তাহলে এখন কোন হিসেবে এসব বলছেন আপনি?”
“ডি*ভো*র্স হলেও ফেরার নাকি উপায় আছে, তাসিনের বউ বলল। আর তোমাদের মেয়ের গতিবিধি লক্ষ করেই ও আমাকে তোমাদের সাথে কথা বলতে বলেছে।”
“ফাবিহা কি বউমার কাছে আগের সংসারে ফিরে যেতে চায়, এমন কিছু বলেছে?”
“না। তবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই বিয়েতে তার মত নেই, জামাইয়ের কথাও আকারে-ইঙ্গিতে বুঝাচ্ছে।”
ফাবিহার মা বললেন,“তোমার ছেলের বউয়ের মাথা খা*রা*প। একবার আমার মেয়ের জীবন ন*ষ্ট করেছে। ভাবছে তাসিনকে ফুসলিয়ে যদি আবার আমার মেয়েকে তাসিনের গলায় ঝুলিয়ে দেই। সেজন্যই আমার মেয়ের ক্ষ*তি চাইছে।”
“তুই ভুল ভাবছিস। যেখানে তোর মেয়ের বিয়েই হয়ে যাবে অন্য কোথাও, সেখানে ওর এসব ভাবনা আসবে কেন? আমি চিনি ওকে। আমার বউমা খা*রা*প না।”
ফাবিহার মা বিলাপ করে বলছেন,“তুমি তো জানো না আপা। ওই মেয়ে তোমার ব্রেনওয়াশ করে ফেলেছে। দেখো গিয়ে তা*বি*জ ক*ব*জ করে তোমায় বশ করে ফেলেছে। নইলে আমার বোন কীভাবে পাল্টে যায়?”
সাজেদা বিরক্ত হয়ে বললেন,“এখন মনে হচ্ছে তোরই মাথা খা*রা*প হয়েছে। মেয়ে তোর, যা ইচ্ছা তুই কর।”
বিক্ষিপ্ত মেজাজে কল কেটেে দিয়ে বসে রইলেন তিনি।
আতাউর রহমান কিছু ভাবছেন। ফাবিহার মা বললেন,“কী ভাবছো তুমি?”
আতাউর রহমান চিন্তিত গলায় বললেন,“তুমি ফাবিহাকে বাড়িতে আসতে বলো।”
মায়ের ফোন পেয়ে ফাবিহা খালার বাড়ি থেকে চলে এলো। রাতেই বাবা তাকে ডাকলেন।
“বাবা ডেকেছ?”
আতাউর রহমান মেয়েকে চেয়ার দেখিয়ে বললেন,“হ্যাঁ বোস।”
ফাবিহা বসল।
“তোর যে বিয়ের কথা চলছে। এতে তোর মত আছে?”
ফাবিহা অস্বস্তি নিয়ে বলল,“হঠাৎ এসব কথা কেন বাবা?”
“না, জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন আছে।”
ফাবিহা মাথানিচু করে আছে। আতাউর রহমান বললেন,“তোর মত না থাকলে আমরা না করে দেব। তবে কেন মত নেই, সেটা বলতে হবে।”
ফাবিহা ফ্লোরের দিকেই তাকিয়ে রইল। পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খোঁচাচ্ছে। আতাউর রহমনা সবটা সূক্ষ্ম চোখে পরখ করে জিজ্ঞেস করলেন,“শাবাবের সংসারে ফিরে যেতে চাস?”
ফাবিহা এবার চমকে উঠে বাবার দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল। আতাউর রহমান বললেন,“কী চাস, স্পষ্ট করে বল।”
ফাবিহা অস্থির হয়ে বলল,“আমি কিছু জানি না।”
ধমকে উঠলেন আতাউর রহমান।
“জানি না বললে তো হচ্ছে না। কী চাস বল।”
“আমি এখন বিয়ে করতে চাই না বাবা।”
“কেন বিয়ে করতে চাস না? তোর সব সমস্যা সমাধানের এখন একটাই রাস্তা। তাহলে কেন সেই রাস্তা বেছে নিচ্ছিস না?”
ফাবিহা নিরুত্তর। আতাউর রহমান বললেন,“তোর ভাবগতি ভিন্ন কথা বলছে। যদি শাবাবের কাছে ফিরে যেতে চাস, তাহলে আগে এত নাটক করলি কেন? কেন জোরজবরদস্তি করে তা*লা*ক নিলি?”
ফাবিহা একটাও শব্দ উচ্চারণ করল না। আতাউর রহমান তীব্র রাগে চেয়ারে লা*থি দিয়ে উঠে গেলেন।
ফিরোজ আলমকে বাড়ি আনার পর একবার দেখে এসেছেন তাকে। আজ মেয়ের উপর রাগ থেকেই কল দিলেন। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করলেন,“কেমন আছেন?”
“ভালো আর থাকি কীভাবে? ছেলে হাসপাতাল থেকে ঘুরে এলো, আমিও ঘরে অসুস্থ। আপনার কী অবস্থা?”
“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। শাবাবের আবার কী হলো?”
ফিরোজ আলম অবাক হয়ে বললেন,“আপনি জানেন না? আপনার মেয়ে বলেনি?”
আতাউর রহমান যেন তারচেয়ে বেশি অবাক হলেন।
“কী বলবে?”
“এখন আবার তারা দুজন নতুন নাটক শুরু করেছে। ফাবিহাকে বিরক্ত করায় সুমনের সাথে মা*রা*মা*রি করে আবার হাত ভেঙে এসেছে। আপনার মেয়েও হাসপাতালে আসাযাওয়া করছে।”
“কীহ্?”
“আপনি তো দেখছি কিছুই জানেন না।”
আতাউর রহমান রাগ চেপে বললেন,“আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করবেন সে কী চায়? আমার মেয়ে কী চায়, তা আংশিক ধরতে পেরেছি আমি।”
“কী চায়, সেটা জিজ্ঞেস করতে হবে না। এমনিতেই বুঝা যাচ্ছে। প্রথম থেকেই শাবাবের ভাবগতি এমন ছিল, ও ত*লা*ক দিতে চায়নি।”
“তবুও দুজনকে সামনাসামনি বসিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত। কবে বন্ধ হবে তাদের সার্কাস? আর যদি এভাবেই চলতে থাকে, তো দুজনকে বের করে দেওয়া উচিত হবে। দূরে গিয়ে রংতামাশা করুক।
মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি। এতদিন সে কিছু বলেনি। আজ বলছে বিয়ে করবে না এখন।”
★★★
শাবাবকে সুরাইয়া আর ফিরোজ আলম বাঘের মত ধরলেন।
“এত নাটকের মানে কী? আর কী শান্তিতে থাকতে দিবি না আমাদের? ফাবিহা আর তোর মাঝে কী চলছে?”
“কী চলবে?”
“কিছু না চললে ওর বাবা আমাকে কল দিয়েছে কেন? সে কেন বিয়ে করতে চাইছে না?”
“আমি জানি না।”
সুরাইয়া বললেন,“সত্যি করে বল। আমাদের ধোঁয়াশার মধ্যে রাখবি না।”
“ও কেন বিয়ে করতে চাইছে না সেটা আমি কীভাবে জানবো?”
“তুই জানিস না?”
শাবাবের শক্ত জবাব “না।”
সুরাইয়া বললেন,“ঠিক আছে। আমি তোরজন্য মেয়ে দেখছি। বিয়ে করে নে।”
“আমি এখন বিয়ে করব না।”
চেঁচিয়ে উঠলেন সুরাইয়া।
“তোদের মধ্যে কিছু চলছে না, তুই বিয়েও করবি না। তাহলে চাইছিসটা কী?”
শাবাব কোনো প্রকার সংকোচ না করে দৃঢ় স্বরে বলল,“ও কেন বিয়ে করতে চাইছে না আমি জানি না। আর আমি যেদিন ওকে ভুলতে পারবো সেদিন অন্য কাউকে বিয়ে করবো। তার আগে নয়।”
কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে শাবাব গটগট পায়ে বেরিয়ে যেতে নিলো। দরজায় আসতেই ফিরোজ আলম হুঙ্কার ছাড়লেন,“তাহলে ছেড়েছিলি কেন?”
“ও চেয়েছে, তাই। আমি আগে যা করেছি, এরপরে আর জোরজবরদস্তিতে কিছু হোক তা চাইনি।”
বলেই চলে গেল সে। সুরাইয়া ধপ করে বসলেন। ফিরোজ আলম ফোন করলেন আতাউর রহমানকে। জানালেন শাবাবের ব্যাপারে। তারপর আতাউর রহমান বললেন,“আমি একটা প্রস্তাব রাখতে চাই।”
“আপনি কী বলবেন, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা করলেই কি সমাধান পাওয়া যাবে? এরপর যদি আবারও তারা উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নেয়? তখন দায়ভার কে নেবে?”
“তখন আর তাদের ব্যাপার আমরা জানি না। এখন তারা যা চাইছে, সেটাই হচ্ছে। পরবর্তীতে আবার একসাথে থাকতে চাইবে না বললে তো হবে না। দুজনকে দিয়ে কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করিয়ে নেওয়া হবে।”
“এখন আপনি-আমি বললে তো হবে না। এভাবে এক হওয়ার বিধান কী? আগে একজন বিজ্ঞ আলেমের সাথে কথা বলতে হবে।”
“আমার ভায়রাভাই এর বেয়াই আছেন। ওনার সাথে আগে কথা বলে দেখি।”
“ঠিক আছে।”
★★★
তাসিনের বাবাকে নিয়ে হুরাইনের বাবার কাছে গেলেন আতাউর রহমান। সবটা শোনার পর তিনি বললেন,“উপায় আছে একটা।”
“কী?”
“নতুন করে বিয়ে কিরে নিলেই তারা সংসার করতে পারবে।
আপনার বর্ণনামতে তা*লা*ক আপনার মেয়ের পক্ষ থেকে। অর্থাৎ স্বামীর মুখ থেকে তিনি তা*লা*কে*র স্বীকারোক্তি আদায় করিয়ে নিয়েছেন। এটাকে বলা হয় খুলা। যখন স্বামী স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতেন, তখন তাকে বলে তা*লা*ক। এখন যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে খুলা। যদি দুজনে চান যে তারা একসাথে আবারও সংসার করবেন, তাহলে দ্বিতীয়বার মোহর দিয়ে বিয়ে করতে হবে।”
তাসিনের বাবা বললেন,“কিন্তু বউমা যে বলল তা*লা*ক।”
জনাব আজাদ বললেন,“আপনারা আসবেন সে আমাকে জানিয়েছে। এবং বিস্তারিত ঘটনাও বলেছে। সে তা*লা*কে*র কথা এবং দ্বিতীয়বার ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিল আপনাদের মেয়ের বর্ণনা থেকেই। আপনাদের মা বারবার তা*লা*ক হয়েছে বলেছিল; কিন্তু সেটা কীভাবে ওটা তো বলেনি। তাছাড়া ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলার কারণেই আপনাদের মেয়ে দ্বিতীয়বার সংসার নিয়ে ভেবেছে। মুখ খুলেছে। আর কখনো ফিরতে পারবে না বললে সে কখনোই মনের কথা মুখে আনতো না। ভাবতো চিরতরে বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে তাদের। আমাদের দেশে অসংখ্য দম্পতি আছেন, রাগের মাথায়, কোনোপ্রকার বুঝাপড়া না করেই খুলা কিংবা তা*লা*ক দিয়ে ফেলেন। পরে আমাদের কাছে ছুটে আসেন দুজনে এক হওয়ার জন্য। যদি সুযোগ থাকে, তবে তাঁরা এক হতে পারেন। কেউ যদি তিন তা*লা*ক দিয়ে ফেলেন, তাহলে আমাদের সাধ্য নেই তাদের এক করার। তখন তারা একে অপরের জন্য হা*রা*ম হয়ে যান।”
“আজ তবে উঠি।” বলে আতাউর রহমান উঠে পড়লেন। তাসিনের বাবাও বেয়াইকে বিদায় দিয়ে বের হলেন। সবটা পরিষ্কার, হুরাইনের কারণেই ফাবিহার মন পরিবর্তন হয়েছে। আতাউর রহমান এতে খুশি না কি বেজার বুঝা যাচ্ছে না।
★★★
ফিরোজ আলম শাবাবকে বললেন,“তৈরি হয়ে নে।”
“কেন বাবা?”
“তোর মায়ের সাথে যাবে বিয়ে করতে।”
বিস্মিত হয়ে বলল,“কীহ্!”
“ফাবিহাকে বিয়ে করবি। ওর বাবা সব ব্যবস্থা করেছেন। আর বিয়ের আগে অবশ্য একটা পেপার সাইন করতে হবে। দ্বিতীয়বার ছাড়াছাড়ি হলে দুজনকেই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, হা*জ*ত*বা*সও হতে পারে।”
“তুমি কীসব বলছ বাবা?”
“তোকে তৈরি হতে বলেছি। যদি শর্তে রাজি থাকিস তাহলে তৈরি হয়ে আয়। নয়তো আমি ফাবিহার বাবাকে না করে দিচ্ছি।”
শাবাব নিজের ঘরে এলো ত্রস্ত পায়ে। ফোন হাতে নিয়ে পরপর ফাবিহাকে কল দিয়ে গেল। ও ফোন তুলছে না। এতে মেজাজ আরো খা*রা*প হচ্ছে। পঞ্চমবারে ফোন তুললো ফাবিহা। শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“ফোন তুলতে এতক্ষণ লাগে?
কী শুরু করেছ তুমি? কী বলছে বাবা?”
ফাবিহা শান্ত গলায় বলল,“কী বলেছে?”
“তোমাকে”
একটু থেমে আবার বলল“ তোমাকে বিয়ে করতে বলছে। এটা কী সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
শাবাব দমে এলো। রুদ্ধশ্বাসে বলল,“তুমি কিছু বলোনি?”
“না।”
“কিন্তু কেন?”
“বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমিও মেনে নিয়েছি।”
“জোরজবরদস্তি সম্পর্ক তোমাকে মেনে নিতে হবে না। তুমি তোমার বাবাকে না করে দাও।”
“না করার দরকার নেই।”
শাবাব সন্দিহান গলায় বলল,“আজ তোমার গলা এত শান্ত লাগছে কেন?”
“আমি বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছি শাবাব। এটাই তোমার জন্য সুযোগ। এরপর আর এমন সুযোগ পাবে না।”
ফাবিহা কল কেটে দিল। শাবাব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ফাবিহার অভিব্যক্তি সে বুঝতে পারছে না। বাবার উপর জেদ করে না কি মন থেকে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছে বুঝা যাচ্ছে না। সে আবার গেল বাবার ঘরে।
“বাবা ফাবিহার মত নিয়েছো তোমরা?”
“ওর মতিগতি লক্ষ করেই ওর বাবা আমাকে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। এজন্যই ও নতুন সম্বন্ধে না করে দিয়েছে। বলেছে বিয়ে করবে না।”
শাবাবের দ্বিধা কাটলো। সে খুশি হবে কিনা বুঝতে পারছে না।
ফাবিহা চুপচাপ বসে রইলো। তার হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে তড়িৎ গতিতে। সে নিজের দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার আগেই বাবা সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিয়েছেন। কড়া কয়েকটা হু*ম*কি*ও দিয়েছেন। তাই বিয়েতে সে মত দিয়ে দিয়েছে। তার একটা দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার উপর সবটা ঝুলে আছে। তাই সবাইকে ঝুলিয়ে না রেখে হ্যাঁ বলে দিল।
শাবাব মা, জেঠা-জেঠী, খালা নিয়ে ফাবিহার বাড়ি আসলো। তার অস্বস্তি হচ্ছে। ফাবিহার মা থমথমে হয়ে আছেন। একইরকম শাবাবের মাও। বিয়েটা হচ্ছে কেবল ফিরোজ আলম আর আতাউর রহমানের কারণে।
নাস্তা পর্ব শেষে বিয়ে পড়ানোর পালা এলো।
হুরাইন ফাবিহাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল,“মাশাআল্লাহ।”
ফাবিহা হুট করে হুরাইনকে জড়িয়ে ধরলো।
“আমি জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী? অনিশ্চয়তার মাঝে আবারও পা বাড়াচ্ছি। দোয়া করিও আমার জন্য।”
“ইনশাআল্লাহ খুব ভালো সংসার হবে আপনার। আপনার কী মনে হচ্ছে না আপনার স্বামী পরিবর্তন হয়েছে?”
“আমার ভয় হচ্ছে ও যদি পরে আবার আগের মত আচরণ করে?”
“আপনি আছেন কী করতে? তাঁকে পিটিয়ে মানুষ বানিয়ে নেবেন। আবার সত্যি সত্যি পে*টা*বে*ন না কিন্তু। ওটা হলো কৌশলের পে*টা।”
বলেই হেসে ফেললো হুরাইন। ফাবিহাও হেসে ফেললো।
শাবাব ভাঙা হাত নিয়ে কাচুমাচু করে বসে আছে। কাজি নতুন করে দেনমোহর ধরে বিয়ে পড়াচ্ছেন। পাশের ঘরেই ফাবিহা। তাকে কবুল বলতে বলা হলো। সময় চলে যাচ্ছে, ফাবিহার মুখ দিয়ে কবুল বের হচ্ছে না। শাবাব অশান্ত হয়ে পড়লো। তারমানে আবারও জোরজবরদস্তি হচ্ছে। সে বলল “ও বলতে না চাইলে বলার দরকার..
শাবাবের কথা সম্পন্ন না হতেই ফাবিহা তিন কবুল বলে ফেললো। এবার শাবাবের পালা। সেও বলে ফেললো কবুল। আবারও দুজনের জীবন একসাথে জুড়ে গেল।
হুরাইন ফাবিহাকে বলল,“আল্লাহ আপনাদের বিবাহিত জীবনে কল্যাণকর করুন। ছোটো হয়ে একটা কথা বলি। সবসময় দুজনই উত্তেজিত আচরণ করবেন না। একজন রেগে থাকলে অন্যজন চুপ থাকবেন। এরপর মাথা ঠাণ্ডা হলে দুজনে ব্যাপারটা নিয়ে বুঝাপড়া করুন। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না, যাতে পস্তাতে হতে পারে। এবার আপনারা এক হতে পেরেছেন বলে ভাববেন না বারবার সুযোগ পাবেন।”
খাওয়াদাওয়া শেষ করে সুরাইয়া পুত্রবধূ নিয়ে বাড়ি যাবেন। ফাবিহার মা এখনো আতঙ্কে আছেন। মেয়ের না কিছু হয়ে যায়। শাবাবের ভালো কোনো আচরণ এখন পর্যন্ত ওনার নজরে পড়েনি। তাই তিনি ভরসা করতে পারছেন না। কেবল স্বামীর কথার উপর কথা খাটাতে পারেননি বলেই মেয়েকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। ফাবিহা জড়িয়ে ধরে তিনি হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ফাবিহাও মাকে ধরে কাঁদছে। আতাউর রহমান কাঁদলেন না। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,“সবসময় মাথা ঠাণ্ডা রাখবে। দ্বিতীয়বার যেন কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। তোমাদের ভেতরকার সমস্যা তোমরা মিটিয়ে ফেলবে।”
শাবাবকে বললেন,“তোমার উপর ভরসা রাখার জায়গাটা রেখো। অন্যথায় সাইন তো করেছো। কী লেখা আছে, তা নিশ্চয়ই পড়েছো।”
শাবাব মাথানিচু করে বলল,“আমি আমার বাবার, আপনার সবার ভরসা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।”
গাড়িতে সবাই একত্রে উঠলো। শাবাব আর ফাবিহার মাঝে কথা হলো না। শাবাবের বাড়ি যাওয়ার পর সকলে মিলে দুজনকে আবারও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খাইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিল।
দুজনেই চুপ। ফাবিহা তার জায়গায় শুয়ে পড়েছে। শাবাব গলা ঝেড়ে সেও পাশে শুয়ে পড়লো। খানিকক্ষণ পর বলল,“তোমার সমস্যা হলে বলিও।”
ফাবিহা বলল,“সমস্যা হলে কী করবে?”
“কিছু না।”
ভ্রু কুঁচকে গেল ফাবিহার।
“তাহলে জিজ্ঞেস করার কী প্রয়োজন ছিল?”
“যদি সমস্যা হয়, তবে মানিয়ে নেব।”
এরপর দুজনই চুপ। পরক্ষণেই কম্বল নিয়ে টানাটানি। দুজন দুদিক ফিরে খাটের দুই মাথায় শুয়েছে বিধায় কম্বল টা*ন পড়ছে। শাবাব টা*ন*ছে একদিকে, ফাবিহা টা*ন*ছে অন্যদিকে।
শাবাব এবার পুরো কম্বল ছেড়ে দিল। ফাবিহার দখলে সব কম্বল।
সোজা হয়ে চোখ বুজে আছে শাবাব। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে। ফাবিহার কাছে সবটুকু কম্বল, অথচ সে ঘুমায়নি। ধীরে ধীরে পাশ ফিরলো। বুকে দুহাত ভাঁজ করে রেখেছে শাবাব। আস্তে করে তার গায়ে কম্বল তুলে দিয়ে মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে নিলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শাবাবের চোখ, সরু নাক, পুরো মুখের আদল দেখছে। যদি না তাসিনকে সে পছন্দ করতো আর শাবাবের চরিত্র সম্পর্কে না জানতো, তবে কি সে শাবাবের প্রেমে পড়তো না? নিজের মনকে প্রশ্ন করে জবাব পেয়ে গেল। কোনো বাঁধা না থাকলে নিশ্চয়ই সে শাবাবের জালে পা দিয়ে ফেলতো।
হঠাৎ ঝট করে চোখের পাতা খুলে ফেললো শাবাব। ফাবিহা এক ঝটকায় দূরে সরে গেল। আবারও কম্বল সরে গেল শাবাবের শরীর থেকে।
শাবাব বলল,“আমার ঠাণ্ডা লাগছে ফাবিহা।”
ফাবিহা নড়চড় করলো না। তাই শাবাবই আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে গায়ে কম্বল জড়িয়ে নিলো।
সকালে ফাবিহার আগে ঘুম ভাঙলো। সে সময় দেখলো। ফজরের সময় এখনো আছে। তাই দেরি না করে উঠতে গিয়ে আঁচল টা*ন দিলো। শাবাবের পিঠের নিচে পড়ে আছে। সে টা*না*টা*নি করছে। হয়রান হয়ে শাবাবের হাতে মৃদু ধা*ক্কা দিয়ে বলল,“শাবাব, শাবাব আমার আঁচল ছাড়ো।”
“হুম?” শাবাব ঘুমঘুম কণ্ঠে জবাব দিল।
ফাবিহা বলল,“আমার আঁচল ছাড়ো।”
“আমি তোমার আঁচল ধরিনি।”
ফাবিহা শাবাবের নাক চেপে ধরলো। শ্বাস নিতে না পেরে শাবাব ধড়ফড়িয়ে উঠলো। আঁচল ছাড়া পেয়ে চলে গেল ফাবিহা। শাবাব হতভম্ব হয়ে বসে রইল।
নাস্তা করতে বসে শাবাবের কাজিন বলল“ওমা ভাবির চুল দেখি শুকনো।”
শাবাব বিষম খেল। তার দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিল ওর জেঠাতো ভাই। ভাগ্যিস বড়োরা কেউ নেই এখানে। মিফতাহকে ওর ভাই ধমক দিল।
“তোর এতকিছুর কী দরকার?”
ফাবিহা লজ্জায় মাথানিচু করে আছে। শাবাব তাকিয়ে দেখল ফাবিহার চোখেমুখে আজ রাগ নেই। তার লজ্জায় আলুথালু গালের দিকে তাকিয়ে ঘোর নিয়ে তাকিয়ে রইল।
#চলবে…..