এক টুকরো আলো পর্ব-৩৩+৩৪

0
455

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সময়ে সাথে সাথে হুরাইনের শরীরের পরিবর্তনগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। শরীর অনেকটাই মুটিয়ে গিয়েছে। সবসময় ওড়না দিয়ে পেট পর্যন্ত ঢেকে রাখে। একটু বসে থাকলেই পা ফোলা দিয়ে ওঠে। পা ঘন্টাখানেক আগেও ঠিক ছিল। কিছু সময়ের ব্যবধানে এতটা ফোলায় বিচলিত হলো তাসিন। উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল,“পা এমন হলো কীভাবে? দেখি।”

হুরাইন বলল,“এমন আরো হয়েছে। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার ফল।”

“এভাবে একটানা দাঁড়িয়ে থাকবে না।”

“আচ্ছা।”
বলে তাসিনের দিকে তাকিয়ে ফের বলল,“আপনি চিকিৎসক হলেন কবে?”

তাসিন ভ্রু কুঁচকে বলল,“চিকিৎসক হলাম মানে?”

“এই যে, এভাবে চলবে, ওভাবে চলবে। একটু পর পর খাবে, পানি পান করবে, ভারী জিনিস ধরবে না।”

তাসিন নিরব রইলো। হুরাইনের কথা কানে না তুলে নিজের শার্ট আয়রন করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। হুরাইন বলল,“আমি করে দিচ্ছি।”

তাসিনের কাজে মনোযোগী গম্ভীর স্বর,“একেবারে সুস্থ হলে তখন করে দিও। এখন আমি করি।”

“আচ্ছা আপনার ফোনটা দিন। আমি মায়ের সাথে কথা বলবো।”

“তোমার ফোন কোথায়?”

“ওটা রান্নাঘরে ফেলে এসেছি।”

তাসিন নিজের ফোন বাড়িয়ে দিলো হুরাইনের দিকে। হুরাইন মায়ের সাথে কথা বলে দেখলো তাসিন ঘরে নেই। তাই সে ইউটিউবে ঢুকলো। ওয়াজ সার্চ দেওয়ার জন্য সার্চ লিস্টে গিয়ে সার্চ লিস্ট দেখে সে আচমকা হেসে উঠলো। ঠোঁট চেপে হাসছে। সার্চ লিস্টে “প্রেগ্ন্যাসি সময়ে করণীয় কী? প্রেগন্যান্সিতে কী কী খাবার খেতে হয়? প্রেগন্যান্সিতে কীভাবে চলাফেরা করা উচিত?” দেখে তার হাসি থামবার নয়।
তাসিন ঘরে ঢুকলো কিছু খাবার নিয়ে। হুরাইনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তাকে হাসতে দেখে কৌতুহলী স্বরে বলল,“কী দেখে হাসছো?”

হুরাইন ফোনের স্ক্রিন তাক করলো তাসিনের দিকে। থতমত খেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে ফোন নিয়ে নিলো তাসিন।
“তোমাকে কে বলেছে আমার ফোন ঘাটতে? এই নাও তোমার ফোন।”

হুরাইন বলল,“এজন্যই তো বলি নতুন নতুন চিকিৎসক এলো কোথা থেকে?”

তাসিন বলল,“দুনিয়াতে কি তুমি একাই প্রেগন্যান্ট?”

হুরাইন রগঢ় করে বলল,“তো এসব নিজের জন্য সার্চ করেছেন? আপনি তাহলে প্রেগন্যান্ট?”

অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো তাসিন। হতাশার সুরে বলল,
“তোমায় শান্তশিষ্ট মেয়ে ভেবেছিলাম। বিয়ের পরই বুঝেছি কতটা ব*দে*র হাড্ডি তুমি।”

হুরাইন মিছেমিছি রাগ করে বলল,“আমি যখন ভালো না, তখন এখানে থেকে কী করবো? বাপের বাড়ি চলে যাব।”

তাসিন বলল,“জামাকাপড় সব গুছিয়ে দেব?”

এবার চোখ পাকিয়ে তাকালো হুরাইন।
“আমি রাগ করেছি। কোথায় আপনি রাগ ভাঙাবেন। তা না করে আমাকে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন?”

তাসিন না বুঝার ভান করে বলল,“ওহ তুমি রাগ করেছো? দেখেছো, তোমার চেহারা দেখে আমি বুঝতেই পারনি। ভেবেছি তুমি হাসতে হাসতে বাপের বাড়ি যেতে চাচ্ছো।”

হুরাইন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাসিন আবারও বলল,“তোমার বাবা খুব ধূর্ত মানুষ। আমাকে তাঁর মেয়ের সাথে ঠিক করে দেখা করতে দেয়নি। আমিও আমার বাচ্চাকে ওনার সাথে দেখা করতে দেব না। তাই বাপের বাড়ি যেতে হলে আমার বাচ্চাকে দিয়ে তারপর যাবে। নিয়ে যাক তোমার বাবা তাঁর মেয়েকে।”

হুরাইন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“একেবারে খুব বড়াই করছেন? আপনি আপনার বাচ্চাকে না দেখতে দিলে আমার কী? আমার বাবা আমার বাচ্চাকে দেখবেন।”

তাসিন বলল,“তোমার আবার কী? এটা আমার বাচ্চা।”

হুরাইন ভেংচি কেটে বলল,“বড়ো গলায় একা নিজের বাচ্চা বলে লাফাচ্ছেন। নিজের পেটে রেখে বড়ো করার তো মুরোদ নেই।”

তাসিন বলল,“এই একটা দুর্বলতাই তো পেয়েছো। নয়তো তোমাকে আর তোমার বাবাকে পাত্তা দিতাম না আমি।”

“মনে হচ্ছে আপনার পাত্তা পাওয়ার জন্য আমরা বাবা-মেয়ে কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলেছি!”

“সেটাই তো বাকি রেখেছো।”

হুরাইন ফুঁসে উঠে বলল,“বেশি কথা বললে একদম আম্মাকে বলব বাড়িতে ঢুকতে না দিতে।”

তাসিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“ক্ষমতা যেখানে নারীর হাতে, সেখানে অযথা তর্ক করে এনার্জি খরচ করার কোনো মানেই হয় না। নারী নিজের কথা উপরে রাখার চেষ্টা করবেই।”

★★★

“আজ শাবাব ভাইকে দেখলাম একটা মেয়ের সাথে। নতুন গার্লফ্রেন্ড মনে হয়। খুব হাসিখুশি দেখলাম।”

“তাতে আমার কী? ওর কথা আমাকে বলছিস কেন? আমি ওর কথা আগেও শুনতে চাইনি, এখনো চাই না।”
রাগী সুরে বলল ফাবিহা।

রিপা বলল,“আমিও তো সেটাই বলি। শাবাব তো এখন আর নেই। এভাবে নিজেকে বন্দী করে রাখার মানে কী? চিল কর, আনন্দ কর নিজের লাইফে। কে কী বলল, না বলল তাতে তুই পাত্তা দিবি কেন? সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিতে পারলেই জীবন উপভোগ করতে পারবি। ওদের কথায় পাত্তা দিলে তুই জীবনেও সুখী হতে পারবি না।”

“সমাজকে পাত্তা দিতে না চাইলেও, তাঁদের কথায় অজান্তেই আ*ঘা*ত পেয়ে যাই। আমি নিজের সম্পর্কে কিছু শুনতে পারি না, এটা তোরা জানিস।”

“শোন, এসব বা*লে*র সমাজের গোষ্ঠী মা*রি। আমাকে দেখ্, ওদের দু’পয়সার পাত্তা দিচ্ছি না। তুই আজকে চলে আয়। সানির বার্থডে পার্টির পর আজ সবাই আমরা ওখানেই থাকবো রাতে। এভাবে একা থেকে নিজেকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলিস না।”

ফাবিহা বলল,“না পার্টিতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার।”

“তুই তোর বাকি দুই বান্ধবীর মত বিহেভ করছিস। ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে আসতে কী সমস্যা? আমিও তো যাচ্ছি। তোরা তিনজন ছাড়া বাকি সবাই আসছে। তুইও আয়।”

“না।”

“থাক তুই এভাবে। ম*র*গা। শাবাব ফূর্তি করুক। আর তুই বিরহে দিন কাটা। দিন দিন ফকিন্নি মার্কা চেহারা বানাচ্ছিস। মনে তো হচ্ছে তোর আর শাবাবের জনম জনমের প্রেম ভেঙে গিয়েছে।”
রিপা কল কেটে দিলো।

ফাবিহার মেজাজ খা*রা*প হয়ে আছে। নিজের উপরই প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে সে। সে এতদিন ভেবেছিল শাবাব হয়তো সত্যিই ভালো হতে চাইছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া দুজনের মধ্যকার ঘটনা রোমন্থন করে খানিকটা দয়া হলো। সংসার না করলেও ভেবেছিল মন থেকে ক্ষমা করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু না সে কীভাবে এত বড়ো ভুল করতে পারলো? কু*কু*রে*র লেজ কখনো সোজা হয় না। শাবাবও ভালো হবে না।
তার কাছে ক্ষমা চেয়ে আগের মতই মেয়ে নিয়ে ঘুরছে। এতে কি তার অপ*মান হচ্ছে না?
অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো পার্টিতে যাবে। সত্যিই তো এভাবে নিজেকে বন্দী করে ক্ষতি ছাড়া কী লাভ হচ্ছে?

সন্ধ্যায় বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। মাকে বলেই বেরিয়েছে সে। তাকে পার্টিতে দেখে রিপা হাসিমুখে এগিয়ে এলো।
“আমি জানতাম তুই আসবি। গুড গার্লের মত কাজ করেছিস। শোন্ , সানির চাচাতো ভাই তোকে খুব পছন্দ করে। মা*ল*টা*ও হেব্বি। চান্স দিয়ে দেখ। চাইলে ডিরেক্ট বিয়ে করে ফেলতে পারিস।”

ফাবিহা বিরক্ত হয়ে বলল,“ভালোলাগছে না রিপা। তোর ইচ্ছে হলে তুই গিয়ে ঝুলে পড়। কারণ তুই আর শাবাব দুটোই সেইম ক্যাটাগরির।”

রিপা বিদ্রুপ করে বলল,“খুব সতীসাবিত্রী বলেই তো তোর লাইফে এত ঝামেলা। শাবাবের সাথে দুই-তিন মাস প্রেম করতি। ব্যাস, সমস্যা শেষ।”

ফাবিহা জেদ করে পার্টিতে তো এলো। কিন্তু তার দুই বান্ধবীকে না পেয়ে ভালোলাগছে না। রিপার সাথে সম্পর্কটা গভীর নয়। একজন থেকে অপরজন পরিচয় যেভাবে, ঠিক সেভাবেই।
সানির সাথে দেখা করে একপাশে বসে রইল সে। সানির কাজিন এসে নম্র, কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,“আপনি কি অসুস্থবোধ করছেন মিস?”

ফাবিহা সৌজন্য হেসে বলল,“না আমি ঠিক আছি।”

“মনে হচ্ছে আপনি পরিবেশটা এনজয় করতে পারছেন না।”

“না সেরকম ব্যাপার নয়।”

“ওকে, আপনি বসুন। প্রবলেম হলে আমাকে ডাক দিতে পারেন।”

ফাবিহা জোরপূর্বক হেসে বলল,“জি।”

ভার্সিটিতে কয়েকবার সানির সাথে দেখা গিয়েছে তার এই কাজিনকে। ছেলেটা যে ফাবিহাকে পছন্দ করে, সে খানিকটা আন্দাজ করেছিল। আজ রিপার কথা শুনে শিওর হলো।
সানিসহ বাকি ফ্রেন্ডরা এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল।
“তুই এমন রোহিঙ্গাদের মতো ওখানে বসে আছিস কেন? আমরা সবাই এখানে।”

রিপা হাসতে হাসতে সানিকে বলল,“বলেছিলাম তোর কাজিনকে একটা চান্স দিতে। ছেলে ভালো। বললে বিয়েও করে নেবে।”

ফাবিহা বলল,“আসলে রিপা আমার উপর দিয়ে বলছে। তার নিজেরই চান্স পেতে ইচ্ছে করছে।”

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। সানি বলল,“না ভাই, আমার ভাই যাকে পছন্দ করেছে তাকেই লাগবে। সমস্যা কী ফাবিহা? লাইফটা গুছিয়ে নে না। আমাদের মাঝে তোর লাইফটাই এখন এলোমেলো।”

ফাবিহা বলল,“সানি আমি বাসায় যাবো। মাথাব্যথা করছে।”

“সবাই আজ এখানে থাকবে। তুইও কোথাও যাবি না। এখন একটু রেস্ট কর।”

“না, বাসায় যাবো।”

“আচ্ছা আমি তোকে পৌঁছে দেব একটুপর।”

“তোদের যেতে হবে না। আমি একাই যেতে…
বলতে বলতে শাবাবকে দেখে থেমে গেল। ও এখানে কেন? শাবাবের দিকে আঙ্গুল তাক করে সানিকে জিজ্ঞেস করল,“ও এখানে কেন?”

“আমার মেজো ভাইয়ার ফ্রেন্ড মনে হচ্ছে।”

“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”

সানির কাজিন এসে বলল,“বাসায় চলে যাচ্ছেন? আমি পৌঁছে দেব?”

“ধন্যবাদ। আমি যেতে পারবো।”

শাবাবও দূর থেকে দেখলো ফাবিহাকে। স্থির হয়ে গেল সে। ফাবিহা তার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছে। একা বের হচ্ছে দেখে সেও পিছু পিছু এলো। ফাবিহা একবার পিছু ঘুরে শাবাবকে আসতে দেখেই মনে মনে তিরস্কার করল তাকে। দ্রুত সে বেরিয়ে যাচ্ছে। শাবাবের লম্বা কদমের সাথে পাল্লা দিয়ে বেশিদূর যেতে পারলো না। সে থেমে গিয়ে শাবাবকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবে বলে মনস্থির করলো। তাকে আশ্চর্যের চরমে পৌঁছে দিয়ে পাশ কাটিয়ে শাবাব এগিয়ে গেল। রাগ আরো বেড়ে গেল তার। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে গাড়ি ডেকে উঠে পড়লো। যেতে যেতে গাড়ির পেছনে তাকিয়ে দেখলো শাবাবের গাড়ি তাদের পেছনেই আসছে। এভাবে কয়েকবার তাকিয়ে একইভাবে শাবাবকে আসতে দেখে সে ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ করল,“আমাকে ফলো করছো কেন?”

কোনো জবাব এলো না। এবার কল দিলো ফাবিহা। শাবাব ফোন তুললো না প্রথমবারে। দ্বিতীয়বারে কানে তুলে প্রশ্ন করল,“কে?”

ফাবিহার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে এলো। দাঁত চেপে বলল,“আমাকে ফলো করছো কেন?”

“আশ্চর্য! আমি কেন আপনাকে ফলো করতে যাবো? আমি কি আপনাকে চিনি?”

“না চেনার ভান করছো? নম্বর সেইভ থাকার পরও কীভাবে এত নাটক করছো?”

“একমিনিট, ফাবিহা?”

“কাকে আশা করেছিলে? নিউ গার্লফ্রেন্ড? শোনো, তোমার যা ইচ্ছে করো। আমাকে আর বিরক্ত করবে না।”

শাবাব বলল,“তোমার নম্বরতো এখন আর সেইভ নেই। ফলো করে বিরক্ত করার প্রশ্নই আসে না?”

ফাবিহা চোখ বুজে রাগ দমনের চেষ্টা করে বলল,“আমি জানি শাবাব, তুমি আমার পিছু পিছু আসছো। নাটক করবে না। তোমাকে চেনা আছে আমার।”

“তোমাকে তো আমি দেখিইনি। তাহলে ফলো করবো কীভাবে?”

“তুমি একটা অ*স*ভ্য। আর সারাজীবন অ*স*ভ্য*ই থেকে যাবে। ভালো হবে না।”

“আমি রাখছি ফাবিহা। আর কিছু বলবে? ইমপোর্টেন্ট কাজ আছে।”

ফাবিহা নিজেই খট করে কল কেটে দিলো।
শাবাব ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ইচ্ছে করেই ফাবিহার নম্বর ডিলিট করে দিয়েছে। নম্বর দেখে চিনে ফেললেও সত্য প্রকাশ করলো না।
ফাবিহাকে বাসার সামনে নামতে দেখে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। তার আগেই দেখে নিলো ফাবিহা।
বিড়বিড় করে বলল,“এবার তোমায় আমি খু*ন করে তবেই শান্ত হবো শাবাব।”

বাড়ির ভেতর ঢুকতেই বাবা-মায়ের চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেল ফাবিহা। বাবা বলছেন,“তুমি রাতের বেলা মেয়েকে একা ছাড়লে কোন সাহসে? কী কী ঘটে গিয়েছে কিছুই মনে নেই, না?”

“মেয়ে কি ঘরে বসে থেকে ম*রে যাক, সেটা চাও তুমি? গেল তো বন্ধুর বাসায়।”

ফাবিহা বলল,“আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করো না। আমি চলে এসেছি।”
কাউকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। শাবাবের প্রতি ক্ষো*ভ নিয়ে ঘুমালো সে। রাতে এক চমকপ্রদ স্বপ্ন দেখলো। ইচ্ছে মত শাবাবকে পে*টা*চ্ছে সে।
স্বপ্ন হলেও শান্তি পেল ফাবিহা। রাগ একেবারে পানি হয়ে গিয়েছে। সকাল সকাল শরীর, মন দুটোই ভালোলাগছে। এলার্ম দিয়ে রেখেছিল ফজরের জন্য। এখন ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে। কতদিন ভার্সিটি না গিয়ে থাকবে? সে মাঝারি মানের স্টুডেন্ট থাকলেও এখন আর তা নেই। পড়াশোনায় একেবারে পিছিয়ে পড়েছে। ভাবলো একটা বোরকা কিনবে। হুরাইনের কথামতো নিজেকে সুমনের কাছ থেকে আড়াল করা যাবে। কিন্তু জীবনে বোরকা না পরায় এখন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। পরক্ষণে ভাবলো বোরকা কিনবে না। সুমনের নামে মা*ম*লা করা হয়েছে। সেও শাবাবের মত সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।
ভেবে দেখলো সানির কাজিন যদি প্রপোজ করে, তবে সে বিয়ের কথা তুলে ফেলবে। রাজি হলে বিয়েটাও করে নেবে।
পরক্ষণেই ভাবলো শাবাবের উপর জেদ করে সে কেন বিয়ে করে নেবে?

★★★

শাবাবের ফেসবুক একাউন্টে গতদিনের একটা ছবি পোস্ট দেখলো। যেখানে তার জেঠাতো বোন মিফতা আর সে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাপশন “সুইট সিস্টার”।
ফাবিহা ছবিটি নিয়ে রিপাকে পাঠালো।
“দেখতো, এই মেয়েটাকেই দেখেছিস?”

রিপ্লাই এলো,“না। অন্যজন ছিল।”

ফাবিহা আবারও নিজেকে ধিক্কার জানালো। সে কেন রিপাকে এই ছবি পাঠাতে গেল? শাবাবকে সাধুসন্ন্যাসী বানানোর এত ইচ্ছে কেন জেগেছে তার। রিপা আবার রিপ্লাই করল,“তোকে পার্টিতে আনার জন্য দুষ্টুমি করেছি। আমি শাবাব ভাইকে কারো সাথে কেন, একাও দেখিনি।”

ফাবিহার রাগ এবার রিপার উপর গিয়ে বর্তাল। বুঝে উঠতে পারলো না তার এখন কী করা উচিত।

#চলবে…..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_৩৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“শাবাব তোর বাবা ডাকছে তোকে।”

শাবাব অফিসের কিছু কাজ গুছিয়ে রাখছিল। বাবা যেভাবে সবটা সামলাতেন, বাড়িতে সময় দিতেন, সে ঠিক সেভাবে সব পেরে ওঠে না। এখনো ততটা দক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। মাঝেমাঝে হাঁপিয়ে ওঠে, বিরক্তি ধরে যায়। পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় আগে বাবার উপর নির্ভরশীল ছিল। বাবা না দিলেও মাকে বললেই টাকা পেয়ে যেত। ইচ্ছেমত খরচ করেছে। এখন বুঝতে পারছে উপার্জনে কত কষ্ট।
ল্যাপটপ বন্ধ করে ধীর পায়ে বাবার ঘরে গেল সে। ফিরোজ আলম চলাফেরা করতে পারেন না। কেবল মুখটাই এখন শক্ত আছে। বললেন,
“এই ঠাণ্ডার মধ্যে এটা কী পরে আছিস? পাতলা গেঞ্জিতে শীত যায়? বস এখানে।”

শাবাব বসতে বসতে বলল,“ঘরে গিয়ে পরবো গরম কাপড়। এখন শরীর কেমন আছে?”

“ভালো আছে। অফিসের কী খবর? সব সামলাতে পারছিস তো?”

“একটু কষ্ট হচ্ছে; তুমি চিন্তা কোরো না। ইনশাআল্লাহ সব সামলাতে পারবো।”

ফিরোজ আলম গম্ভীর স্বরে বললেন,“হুম। যদি মনে হয় নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পারবি, তহলে বলিস। বিয়ে করিয়ে দেব। বয়স তো বাড়ছে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছিস।”

শাবাব গলা খাঁকারি দিয়ে ইতস্তত করে বলল,“মাত্র ২৭ শেষ হলো। বুড়ো হলাম কোথায়?”

“২৮ বছরেও কি নিজেকে কচি খোকা মনে করছিস? যেটা বলেছি মাথায় রাখিস। নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারলে মুখ খুলবি। নয়তো জবান বন্ধ রাখবি।”

“এখন এসব নিয়ে ভাবছি না আমি। কাজে মন দিচ্ছি। ওটাই মন দিয়ে করার চেষ্টা করছি।”

“শুধু টাকা কামালেই চলবে না। সবদিকে নজর রাখতে হবে। এখন যা।”

শাবাব উঠে নিজের ঘরে চলে এলো। সুরাইয়া ঘরে ঢুকে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন,“কী বলল?”

“বলল এখন এসব নিয়ে ভাবছে না।”

“ও কী আর মুখে বলবে যে আমাকে বিয়ে করিয়ে দাও? ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারি না আমি। আমার কী ছেলে কী হয়ে গেল।”

ফিরোজ আলম বিদ্রুপ করে বললেন,“তোমার ছেলের লজ্জা-শরম আছে নাকি? বিয়ে করতে চাইলে নিজেই বলবে। আর কী বললে? ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারছো না? তাহলে নির্ঘাত তোমার চোখে ছানি পড়েছে। নয়তো ছেলের পরিবর্তন কেন দেখতে পাচ্ছো না? আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তাছাড়া তোমার ছেলে স্বেচ্ছায় যখন তা*লা*ক দিয়েছে, তখন দুঃখ পেতে যাবে কীসের ভিত্তিতে? গর্দভ মহিলা।”

সুরাইয়া কটমট করে বললেন,“তুমি অসুস্থ বলে কিছু বললাম না। এখন তোমার মুখ চলে বেশি।”

“সারাজীবন কি চুপ করেই থাকবো?”

“না চুপ করবে কেন? আমিই তোমার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে চুপ করিয়ে দেব।”

★★★

মাকে নিয়ে বের হয়ে বোরকা কিনলো ফাবিহা। মেয়েকে তীক্ষ্ণ চোখে পরোখ করে বলেও ফেললেন,“হঠাৎ বোরকা কেনার শখ হল কেন?”

“সুমন যাতে না চিনতে পারে।”

“যারা চেনে, তারা চোখ আর হাঁটার ধরণ দেখেই চিনে ফেলে।”

ফাবিহা ভেবে দেখলো তাইতো? মনঃক্ষুণ্ন হলো। বোরকা কিনবে না বলে ফিরে যেতে নিয়েও কিনে ফেললো। রাতে বোরকা পরে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখলো। একেবারে অন্যরকম লাগছে। কেমন লজ্জাও লাগছে। তখনই সাজেদার ফোন।

“কেমন আছো খালা?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। শোন খালা ব্যস্ত আছি। তোকে কল দিয়েছি কাল আমাদের বাড়ি আসার জন্য। নিশির শশুর বাড়ি থেকে মেহমান আসবে। তুই কাল চলে আসিস। তোর মাকে ফোন করেছি। আমার ফোন তুলছে না।”

ফাবিহা বলল,“তুমি একবার আসলেই তো পারো খালা। তখন রাগ না ভেঙে কোথায় যাবে?”

সাজেদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,“কিন্তু কাল আসার সময় কোথায়? মেহমানের আপ্যায়নের কাজ। হুরাইন এসব একা পারবে না। তাছাড়া ও অসুস্থ মানুষ।”

“আচ্ছা আমি কাল চেষ্টা করবো যাওয়ার।”

“আচ্ছা রাখছি।”

ঘন্টাখানেক পর বসার ঘরে শোরগোল শুনে ফাবিহা ঘর থেকে বের হলো। সাজেদা আর তাসিনকে দেখে সে আশ্চর্য হলো। বোনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন সাজেদা। ফাবিহার মা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এখন আসার বুদ্ধি হুরাইনে। সে-ই ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে। তাসিনকেও সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারও উচিত খালার সাথে মনমালিন্য দূর করা। দোষটা তো তারই বেশি।
সাজেদা আর তাসিন মিলে চেপে ধরলেন তো ধরলেনই। অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। তাসিন বারবার মাফ চাইলো। সাজেদা বললেন,
“আল্লাহ চাইলে আমার নাতি-নাতনি আসবে দুনিয়াতে। তুই তার কথা ভেবে মাফ করে দে আমার ছেলেকে। আমি নিজেও ওর উপর অসন্তুষ্ট ছিলাম। বউয়ের উপরও আমার রাগ ছিল। কিন্তু এখন মনে হয় আমার সংসারের জন্য হুরাইনকেই দরকার ছিল। আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।”

ফাবিহার মা বললেন,“এখন নিজের ভালো খুঁজলি। তোর নাহয় ভালো হলো; কিন্তু আমার মেয়ের জীবন তো ধ্বং*স হয়ে গিয়েছে।”

“জীবনে কত খা*রা*প সময় আসে। আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন। এই সময়টাতে ধৈর্য ধারণ করতে হয়।”

ফাবিহা বলল,“মা এসব মনে পুষে রেখে কী লাভ হচ্ছে তোমার? আমাকে নিয়ে তোমাদের চিন্তা, অথচ আমি এসব মনেও রাখিনি।”

ঘন্টাখানেক বসে থেকে নাছোড়বান্দার মত বোঝানোর পর ফাবিহার মায়ের মন খানিকটা গললো গেল। তাসিন আর সাজেদা উঠবে। ফাবিহার মা বললেন,“রাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবি।”

“না না। বউ বাড়িতে একা আছে। এমনিতেই অনেকক্ষণ হলো। আজ উঠি। কাল যাবি কিন্তু।”

আতাউর রহমানও বাড়িতে ঢুকলেন। ওনার সাথেও কথা হয়ে গেল। তাসিন আর সাজেদার মন হালকা হলো। এতদিন মনে যে একটা ভার ছিল। সেটা আর নেই। এর জন্য হুরাইনের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
মাঝপথে সাজেদা বললেন,“হুরাইন কী খাবে? কিছু কিনে নে।”

তাসিন মনে মনে হাসলো।
বাড়ি ফিরে হুরাইনকে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেখা গেল। তাসিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। চোখমুখে প্রফুল্লভাব। হুরাইন পড়া শেষ করে উঠে গেল। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,“খালা মেনেছেন?”

“না মেনে উপায় আছে? তুমি অনেক বড়ো উপকার করলে। এর জন্য কী চাও বলো।”

হুরাইন হেসে ফেলে বলল,“সব তো আমারই আছে।”

তাসিন হুরাইনের হাসিতে ডুবে গিয়ে তাকে কাছে টেনে নিলো। মন্থর গলায় বলল,“যা তোমার, তা তোমারই থাকবে। এর বাইরে কিছু চাও।”

“আপাতত কিছু মনে পড়ছে না। যখন কিছু লাগবে, তখন চেয়ে নেব?”

“তাহলে কি পাওনা তোলা রাখলে?”

“হুম।”

“তুমি আগে যখন বলেছিলে, তখনই আমাদের যাওয়া উচিত ছিল। তাহলে অনেক আগেই সবটা মিটমাট হয়ে যেত।”

“থাক, আর আফসোস না করে খুশি হোন।”

★★★

ফাবিহা বোরকা পরে বের হতে গিয়ে কেমন জড়তা কাজ করছে। সবাই কেমন চোখে তাকাবে? এই ভেবে শীতের মাঝেই তার গরম লাগছে। আতাউর রহমান মেয়েকে দেখে বললেন,“মাশাআল্লাহ! আজ তো আমার মেয়েকে অনেক ভালো দেখাচ্ছে।”

ফাবিহা আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো,“সত্যিই ভালোলাগছে?”

“তাহলে আর বলছি কী?”

নাস্তা করে বাবার সাথেই বের হলো সে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে বলাবলি করছে “দেখ্, দেখ্, এখন পর্দায় ঢুকেছে। পর্দার ভেতরেই সব শ*য়*তা*ন থাকে।”

আতাউর রহমান মেয়ের মাথা চেপে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,“নিজের কাজে মন দাও।”

ফাবিহা আর মাথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো না। চলে গেল বাবার সাথে। ক্লাসে অনেকেই জিজ্ঞেস করছে।
“নতুন মেয়েটা কে?”
কেউ এসে বলছে “বাবাহ বোরকাও পরছো রীতিমতো।”

ক্লাসে সবাইকে টপকিয়ে সুমনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ই তার হার্টবিট বেড়ে গেল। এই বুঝি তাকে চিনে ফেললো। দুরুদুরু বুক নিয়ে সমুনকে পেরিয়ে গেল। দ্রুত গাড়িতে উঠে চলেও এলো।
মা আর বাবা তাসিনদের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। সেও ওখানে এসেই নেমেছে। বোরকা পরে ভেতরে ঢুকে হুরাইনকে না দেখে তার ঘরে এগিয়ে গেল। দএজনের কুশল বিনিময়ের পর হুরাইন ভীষণ খুশি হয়ে বলল,“মাশাআল্লাহ!”

“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। সুমনের সামনে দিয়ে চলে এসেছি, সে আমাকে চিনতেই পারেনি। তবে আন্দাজ করতে পেরেছি কয়েকবার অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছিল।”

“আপনার চিন্তা কী? মানে নিজেকে নিয়ে কিছু ভেবেছেন?”

ফাবিহা চুপ করে আছে।

“তুমি খেয়েছো?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকে পড়লো তাসিন। হুরাইন, ফাবিহা দুজনই তাকালো। তাসিন ফাবিহাকে সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
হুরাইন বলল,“না, খাব পরে।”

“অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমি এখানে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।”

বলেই বেরিয়ে গেল সে। ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। কিছুক্ষণের মাঝে দুজনের খাবারই চলে এলো। হুরাইন বলল,“বোরকা খুলে হাত-মুখ ধুয়ে এসো।”

ফাবিহা হাত-মুখ ধুয়ে নিলে দুজনই খেয়ে নিলো। সে জিজ্ঞেস করল,“তাসিন ভাই তোমার খুব যত্ন নেয়, তাইনা?”

হুরাইন হাসছে। যেন নূর ভাসছে তার চোখেমুখে। এতটুকুতেই নিজের প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট দেখতে পেল ফাবিহা। হুরাইন বলল,“আপনিও নিজেকে নিয়ে ভাবুন, আপনাকেও যত্ন করার মানুষ এসে যাবে। আল্লাহ চাইলে সেই যত্ন আপনার প্রত্যাশার চেয়ে বেশিও হতে পারে।”

“আমি জানি না কতদিন সুমনের চোখ ফাঁকি দিয়ে থাকতে পারবো। পড়াশোনার জন্য ওর সামনে যেতেই হচ্ছে।”

“আপনার স্বামী কি আপনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে?”

ফাবিহা উদাসী গলায় বলল,“নাহ্। আমার নম্বরও ওর ফোনে সেইভ নেই। কিন্তু কয়েকদিন আগে ও আমাকে ফলো করছিল।”

“কেন? আর নম্বর সেইভ নেই, সেটা আপনি কীভাবে জানলেন?”

“কেন ফলো করছিল আমি জানি না। আর নম্বরের ব্যাপার জেনেছি আমি ফোন করার পর।”

“আপনি ফোন করেছিলেন? কিন্তু কেন?”

“ওকে রাতেরবেলা আমার পিছু পিছু আসতে দেখেই আমি ফোন করেছিলাম। ও আমাকে মিথ্যা বলল। ও নাকি আমায় ফলো করছে না। অথচ আমি যখন বাড়ির সামনে নামলাম, তখন স্পষ্ট ওকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে দেখলাম।”

হুরাইন ভাবুক হয়ে বলল,“এমনও তো হতে পারে তিনি আপনাকে এখনো মন থেকে সরাতে পারছেন না।”

ফাবিহা হাসলো।
“আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিল না। নাম মাত্র বিয়ে।”

“তা*লা*কে*র জন্য কিন্তু আপনিই জোর করেছিলেন। কখনো কি জিজ্ঞেস করেছিলেন ওনার মনে আপনার জন্য কিছু আছে কিনা?”

ফাবিহা চুপ হয়ে গেল। তা*লা*কে*র জন্য সে-ই চাপ প্রয়োগ করেছে। শাবাব মুখে কিছু না বললেও নিরবে অস্বীকার করেছিল। সে তা*লা*ক দিতে চাইছিল না। প্রথমবারেও সে বলল যেখানে বিয়ে মন থেকে হয়নি, সেখানে তা*লা*কে*র কী দরকার? পরেরবারও সে তা*লা*ক দিতে গড়িমসি করার চেষ্টা করছিল। কিছুকিছু কাজ ভাবায় তাকে। দ্বিধায় আছে শাবাবের কাজকর্ম নিয়ে।
হুরাইন বলল,“কী ভাবছেন আপু?”

“হুঁ? না কিছু না।”

“আপনি তাহলে বসুন। আমি প্লেট রেখে আসছি রান্নাঘরে। মেহমান আছে বলে কাজ শেষ করে ঘরে এসে বসে আছি। মহিলাদের আপ্যায়নে আম্মা আর খালা আছেন। আব্বা আর উনি পুরুষদের খাবার তদারকি করছেন। আমাকে আম্মা ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।”

ফাবিহা বলল,“এগুলো আমি নিতে পারবো। তুমি অসুস্থ।”

হুরাইন মৃদু হেসে বলল,“সবাই আমাকে অসুস্থ বলছে। কোথায়? আমি তো আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ। এগুলো করলে বরং আমার শরীর আরো ভালো থাকবে।”

ফাবিহাকে উঠতে না দিয়ে হুরাইনই উঠে চলে গেল। ফাবিহা ভাবনায় ডুবে গেল। শাবাব কেন সেদিন তার পিছুপিছু এসেছিল? সে বিয়ে করে বর নিয়ে ঘুরছে কিনা সেটা দেখতে? সে সংসার করছে বলে শাবাব কি জেলাস? হুরাইন এসে ডাকলো কয়েকবার। ফাবিহার সাড়া পেল না। সে ভাবনায় মগ্ন। হুরাইন কিছু একটা আন্দাজ করে আর ডাকলো না। খালা শাশুড়িকে বলে ফাবিহাকে দুদিনের জন্য রেখে দিল।
সে ফাবিহার গতিবিধি লক্ষ করছে। পুরোপুরি কোনো ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে পারছে না। সকাল হলেই নিজের সাথে ডেকে তুলে নিচ্ছে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ ডেকে ডেকে নামাজ পড়ায়। সাজেদার সাথে বিকেলে বসিয়ে তাকেও হাদিস পড়ে শোনায়।

নিশির মতিগতি বুঝলো না হুরাইন। দিন কয়েকের ব্যবধানে তার মাঝে পরিবর্তন চলে আসবে, এমনটা আশা করা বোকামি। তবে চাপে পড়ে সব মেনে চলার চেষ্টা করে। এ বাড়িতে থাকতেই আজান দিলেই নামাজ পড়ে ফেলতো। হুরাইনের সাথে টুকটাক কথাও বলেছে।

দুদিন সুমনের চোখ ফাঁকি দিলেও আজ সে চিনে ফেললো হুরাইনকে। অ*ক*থ্য ভাষা শুরু করলো।
“আমার চোখ ফাঁকি দিতে শিখে গিয়েছো? মা*ম*লা করা, না? আমি কিন্তু শাবাব না, যে মা*ম*লা করার পরও তোকে মাথায় তুলে চুমু খাবো। একেবারে গু*ম করে ফেলবো ****।”

ফাবিহা গর্জে উঠে বলল,“সমস্যা কী তোমার? আমার পেছনে এভাবে কেন লেগেছো?”

“তোর ***** বেশি। তাই তা একেবারে না কমিয়ে তো থামতে ইচ্ছে করছে না।”

“অ*স*ভ্য আমাকে যেতে দাও।”

“যাবি? যা।”

ফাবিহা পথ খোলা পেয়েই বেরিয়ে গেল। সুমনের নজর ফাবিহার পায়ের গতির উপর। ঠোঁটে কুটিল হাসি।

প্রতিদিনের খবরাখবর শাবাব রাখে। সুমন কোনো ঝামেলা করে কিনা তার খোঁজ ফরহাদ তাকে দিয়ে থাকে। সে ফাবিহা আর সুমনের উপর নজর রাখে। ফাবিহাকে গত দুদিন সে দেখেনি। মূলত বোরকা পরার কারণে চিনতে পারেনি। আজ সুমন যখন ধরে ফেললো, তখন সেও অবাক হলো। ফাবিহা বোরকা পরেছে সুমনের চোখ ফাঁকি দিতে?
সে শাবাবকে ফোন করে জানিয়ে দিল।
মাথার চুল টেনে ধরলো শাবাব। ক্রোধান্বিত স্বরে
ফারহাদকে বলল,“পোলাপান রেডি রাখ। আজ ছিঁ*ড়ে ফেলবো *****কে।”

সুমনকে ফোন করে বলল,“তোর সাথে কথা আছে। ব্রিজের উপর চলে আসিস দশটার পর। তখন আমি ফ্রি থাকবো।”

সুমন হাসতে হাসতে বলল,“তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই। তাই আসার প্রশ্নই ওঠে না।”

শাবাব হুঙ্কার ছাড়লো। হিসহিসিয়ে বলল,
“এ্যাই ফাবিহার পেছনে কেন এখনো পড়ে আছিস? তুই যা বলেছিস, আমি করেছি। তোর কাছে মাফ চাইতে বলেছিস, আমি চেয়েছি।”

“তোর এত জ্বলছে কেন? তুই তো ইউজ করেই ফেলেছিস। এবার আমিও একটি ইউজ করি। যদিও তোর ইউজ করা, সেকেন্ড হ্যান্ড, তবুও ব্যাপার না।”

রক্ত উঠে যাচ্ছে মাথায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না শাবাব। চিৎকার করে বলল,“বে*জ*ন্মা, তুই আর একবার এই কথা মুখে আনলে তোর জিহ্ব টেনে ছিঁ*ড়ে ফেলবো।”

“তুই বে*জ*ন্মা, লু*জা*র। সামান্য একটা মেয়ের গো*লা*ম হয়ে আছিস। কী আছে এই মেয়ের মধ্যে? আমারও তো দেখা লাগবে।”

শাবাব উত্তেজিত স্বরে বলল,“তুই কোথায় আছিস বল?”

“মোকাবেলা করতে চাস? ঠিক আছে। চলে আয় আমার আড্ডাখানায়।”

শাবাব হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে একাই চলে গেল সুমনের ডাকে।

★★★

ফাবিহা চারদিন পর আবার ক্লাস করতে এলো। ফরহাদ যেন অপেক্ষাতেই ছিল তার। সে নিশ্চিত শাবাব ফাবিহাকে ভালোবাসে। ফাবিহাকে দেখেই দৌড়ে গেল। ফাবিহা পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই বলল,“দাঁড়ান।”

ফাবিহা দাঁড়ালো, কিন্তু পিছু ফিরলো না। ফরহাদ পেছন থেকেই বলল,“আপনি কি ভাইকে একটা সুযোগ দিতে পারতেন না?”

ফাবিহা বলল,“আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই ক্লাস আর দ্বিতীয়বার পাবো না।”

ফরহাদ বলল,“শাবাব ভাইও একবার চিরতরে হারিয়ে গেলে আর দ্বিতীয়বার ফিরে পাবেন না। আপনার জন্য সুমন ভাইকে মে*রে একেবারে আধ*ম*রা করে দিয়েছে।”

চমকে উঠলো ফাবিহা। পেছন ঘুরে বিস্ময় নিয়ে বলল,“মানে?”

“সেদিন আপনাকে সুমন বিরক্ত করেছিল শুনে, আমাকে বলল পোলাপান রেডি রাখতে সুমনকে শায়েস্তা করবে। কিন্তু তার আগেই সুমন ভাইকে উল্টাপাল্টা বলে রাগ উঠিয়ে দেওয়ায় ভাই একা একাই চলে গেলেন। আর একা পেয়ে ভাইকে ইচ্ছামতো মে*রে*ছে সুমন আর তার ছেলেরা। এক্সি*ডেন্টে যে হাত ভেঙেছে, সেই হাতই আবার ভেঙে গিয়েছে।”

ফাবিহা উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল,“ওকে কে বলেছিল সুমনের সাথে ঝামেলায় যেতে? আমার সাথে তো আর ওর লেনাদেনা নেই। আমারটা আমি বুঝবো। ও কেন আমার জন্য সুমনের সাথে আবার ঝামেলা করলো?”

“ভাই আপনাকে ভালোবাসে। আপনিই বুঝতে পারলেন না।”

বারবার চমকাচ্ছে ফাবিহা। সে অবিশ্বাস্য চোখে বলল,“মিথ্যা বলবে না।”

ফরহাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,“আপনি না বুঝলে তো আর করার কিছু নেই। নয়তো ভাইয়ের কী দরকার প্রতিদিন আমাকে দিয়ে আপানার খোঁজ নেওয়ার? সুমন আপনাকে বিরক্ত করে কি না তার খোঁজ নেওয়ার কী দরকার? আপনি বললেন আর আপনার মতকে গুরুত্ব দিয়ে ডি*ভো*র্স দেওয়ার কী দরকার? আচ্ছা বাদ দিন। আপনার ক্লাস আছে।”

ফরহাদ চলে গেল। পেছন থেকে ফাবিহা ডাকলো,“দাঁড়াও।”

ফরহাদ পিছু ফিরতেই বলল,“কোন হাসপাতালে?”

“গেলে আমার সাথে আসুন।”

ফাবিহা দ্বিতীয়বার না ভেবে ফরহাদের সাথে চলে গেল। শাবাব ঘুমাচ্ছে। সারা শরীরের দৃশ্যমান অংশ, মুখের আ*ঘা*তে*র চিহ্ন। প্রথমবার শাবাবের কথা ভেবে তার বুক কেঁপে উঠল। চোখের কোনে একটুখানি পানিও জমা হয়েছে। সুরাইয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফাবিহাকে দেখেই তেতে উঠলেন।
“এখানে কেন এসেছে এই মেয়ে? যাও এখান থেকে।”

ফাবিহা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। তার মস্তিষ্কে কোন কথাই ঢুকছে না। এক নাগাড়ে সুরাইয়া কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন।

বাড়ি ফিরলো অশান্ত মন নিয়ে। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছুই ভালোলাগছে না। শাবাবের কথা মাথা থেকে সরছেই না।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে