এক টুকরো আলো পর্ব-২৭+২৮

0
450

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

দীর্ঘ দেড় মাস পর শশুর নিজ থেকেই ডাকলেন তাসিনকে। সাথে বাবাও আছেন। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দুই বেয়াই আলোচনায় বসলেন। জনাব আজাদ বললেন,“আমি আরো একবার আপনার ছেলেকে সুযোগ দিতে চাই। তাসিনের বাবা মৃদু হেসে বললেন,“আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কাছে আমি ঋণী থাকবো। আমার ছেলের পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড়ো অবদান আপনার। তারপর আপনার মেয়ের। আপনি মেয়ে বিয়ে না দিলে তো আর মেয়ে আমার ছেলেকে সঠিক পথে আনার চেষ্টায় নামতে পারতো না। আমি তার ধৈর্য দেখে অবাক হয়েছি। চোখের সামনে স্বামীর চলাফেরা, ভুল পথে হাঁটার চেষ্টা দেখেও বিন্দুমাত্র অভিযোগ করেনি কারো কাছে। আমি বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন আপনার কাছে জানতে পারলাম আপনাদেরও কিছু জানায়নি। কেবল চেষ্টাই করে গিয়েছে। আর যাই হোক আমি এমন রত্ন হারাতে চাই না।”

জনাব আজাদ প্রসন্নচিত্তে বললেন,“আমি খুশি হয়েছি। আমার মনে হয় জামাই খুব জলদি নিজেকে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সফল করুন। আমার অভিজ্ঞতায় অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের পরিবর্তন খুব জলদি হয়েছে আবার কারো বছরের পর বছর লেগে গিয়েছে। আসল হলো নিজের চিন্তাধারা। আপনি জেনে অবাক হবেন যে আমার মা একটি দ্বীনি পরিবার থেকে এলেও আমার বাবা তেমন ছিলেন না। মা ধৈর্য ধরে বাবাকে সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। নামাজ পড়তে বললে বাবা বিরক্ত হয়ে মায়ের গায়েও হাত তুলেছেন। কিন্তু আমার মা ধৈর্য ধরে পড়ে রইলেন। আমার বড়ো দুই ভাইয়ের জন্মের পর ধীরে ধীরে বাবার মাঝে পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন মানেই সবকিছু ছেড়ে দাড়ি-টুপি, আলখেল্লা পরে ঘুরে বেড়ানো নয়। ইসলামের বেইসিক কিছু দিক মেনে চললেই যথেষ্ট। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, হালাল উপার্জন, চরিত্রের হেফাজত।”

তাসিনের বাবা অবাক হয়ে বললেন,“কেবল আপনার মায়ের প্রচেষ্টায় আপনারা সব ভাই-বোন দ্বীনের পথের এগিয়েছেন?”

“আমার মায়ের চেষ্টার কমতি ছিলো না। মাকে দেখে আমাদেরও আগ্রহ জন্মাতো। আমাদের মানুষ করাও এতটা সহজ ছিলো না। হাফিজি পড়ার সময় বেশি জ্বালা দিয়েছি মাকে। কতবার পালিয়েছি মাদ্রাসা ছেড়ে।”
বলেই মুচকি হাসলেন জনাব আজাদ।

তাসিন পায়চারি করছে। দুই বেয়াইয়ের মাঝে কী কথা চলছে তাকে জানাচ্ছে না। বাবা বেরিয়ে তার সামনে আসতেই সে রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করল,“কী কথা হলো?”

বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন,“তোমায় আরো একটি সুযোগ দেওয়া হলো। মনে রেখো এটাই শেষ সুযোগ। দুদিন পর বউমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে।”

তাসিন চমক পেল। এটা ছিলো অপ্রত্যাশিত। চোখে খুশির ঝিলিক। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে একটু গম্ভীর থাকার চেষ্টা করে বলল,“বাড়ি যখন যাবেই, তখন দুদিন পরের কী দরকার? আজ কেন নয়?”

বাবা সরু চোখে তাকাতেই তাসিন অপ্রস্তুত হয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল,“দুদিন পর আমার কাজ থাকবে। তাই আজ চলে গেলেই ভালো হয়।”

“আমি কথা বলছি বেয়াই এর সাথে।”
বলেই বাবা চলে গেলেন। তাসিন বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দ্রুত পায়ে হুরাইনের ঘরে ঢুকলো। তাকে কিছু বুঝে উঠতে না দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,“আমি এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম।”

হুরাইন নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা না করেই বলল,“আপনার চেয়ে বেশি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। তবে এটাই শেষ সুযোগ বলে দিলাম।”

তাসিন বাঁধন শক্ত করে বলল,“আমি আর সুযোগ নিতে চাই না। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চাই।”

তাসিন আর তার বাবা হুরাইনকে নিয়েই বাড়ি ফিরলেন।
সাজেদাকে সালাম দিলো হুরাইন। তিনি জবাব দিয়ে বললেন,“যাও আগে বিশ্রাম নাও।”

হুরাইন জিজ্ঞেস করল,“আপনার শরীর এখন কেমন আছে আম্মা?”

“আমি আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি। তুমি নিজের চিন্তা করো।”

কঠিন হতে গিয়েও কেন যেন পারেন না। সাজেদা কবুতর রান্না করলেন হুরাইনের জন্য। সে ঘরে যাওয়ার পরই ফল কেটে পাঠালেন।

তাহাজ্জুদ পড়তে উঠলো হুরাইন। সে বিস্মিত। তাসিন জায়নামাজে। তার সাথে চোখাচোখি হতেই সামান্য হেসে বলল,“প্রতিদিন উঠতে পারি না। চেষ্টা করছি।”

হুরাইন আনন্দে ছুটে গেল ওজু করতে। বলে গেল আমি আসি তারপর একসাথে পড়বো।

তাসিন অপেক্ষা করলো। হুরাইন আসতেই দু’জনে একসাথে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করলো। এখনো ফজরের আজান পড়েনি। তাসিনের ঠিক সামনে গিয়ে বসলো হুরাইন। ওর কপালে চুমু দিয়ে চোখে চোখ রেখে কোমল স্বরে বলল,“এটা নিজের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়ার চেষ্টার জন্য।”

তাসিন মুখ নামিয়ে এনে হুরাইনের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,“বেশি বেশি উপহার দিলে আমার উৎসাহ আরো বাড়বে।”

হুরাইন মিটিমিটি হেসে তাসিনের সারা মুখে চুমু খেল। তার এই খুনসুটিময় পাগলামিতে হেসে ফেললো তাসিন। ফজর পড়ে মসজিদ থেকে ফিরে হুরাইনকে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেখে তাসিন পাশে বসে বলল,“এখন একটু বিশ্রাম করো। অসুস্থ তুমি। এখন এতো প্রেশার নিও না।”

হুরাইন আয়াত শেষ করে কপাল কুঁচকে বলল,“কে বলল আমি অসুস্থ? আলহামদুলিল্লাহ আমি সুস্থ আছি। এই সময়ে কত মেয়েরা এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ার শক্তি পায় না। আল্লাহ আমাকে শক্তি দিয়েছেন ইবাদত করার। এটা আমার জন্য কতবড়ো নিয়ামত। একজন সৎ, নেককার সন্তান জন্মদানে গর্ভাবস্থায় ইবাদতের বিকল্প নেই।”

তাসিন পাশে থেকে তেলাওয়াত শুনছে হুরাইনের। কিছুক্ষণ পর হুরাইন বলল,“আপনি নিজেও তো প্রতিদিন সকালে অন্তত এক লাইন হলেও তেলাওয়াত করতে পারেন।”

তাসিন কোনো প্রকার সংকোচ না রেখে বলল,“আমি সব ভুলে গিয়েছি। তুমি আবার নতুন করে শিখিয়ে দাও আমায়।”

হুরাইন উৎফুল্ল হেসে বলল,“আপনি শিখতে চান?”

“হুঁ।”

“তাহলে আজ থেকেই শুরু করি?”

তাসিন মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
হুরাইন বলল,“সর্বপ্রথম আপনাকে হরফ শিখতে হবে শুদ্ধভাবে।”

হুরাইন মনোযোগ দিয়ে আগ্রহ নিয়ে তাসিনকে আরবি হরফ শেখাচ্ছে। মাত্র চারটি হরফ শিখিয়ে বলল,“আজকের জন্য এতটুকুই।”

তাসিন বলল,“সবগুলো পড়িয়ে দাও।”

“না। এক সাথে সবগুলো পড়ালে এখন ঠিকঠাক পারলেও পরদিন দেখা যাবে উচ্চারণে ভুল করছেন। এমন পড়ে লাভ নেই। গোড়া মজবুত করা জরুরি। গোড়া যত নড়বড়ে হবে, গাছ তত দ্রুত ভেঙে পড়বে। আমাদের কোনো তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে শিখবেন।”

তাসিন বাধ্য ছাত্রের মত মেনে নিলো হুরাইনের কথা।

রান্নাঘরে গিয়ে সাজেদার হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দিল হুরাইন। ভারী কাজগুলো ধরতে দিলেন না সাজেদা। বললেন,“যতক্ষণ শরীরে শান্তি লাগে, তুমি হাঁটাচলার কাজগুলো করো।”

★★★

ফাবিহা দিনদিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। জীবন কেন তার সাথে এভাবে খেলছে? তার চিন্তায় বাবা-মা দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মাকে বলল,“আমি আবার ফুফুর কাছে চলে যাই মা।”

মা মুখে আঁচল চেপে কাঁদেন। মেয়ের ভবিষ্যৎ এমন হবে তিনি ধারণা করতে পারেননি। আতাউর রহমানও মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। বিভিন্ন মানুষ আজকাল প্রস্তাব নিয়ে আসেন মেয়ের জন্য। দেখা গেল ছেলের দুই-তিনটা বাচ্চা আছে। তিনি সবাইকে না করে দেন। মেয়ে এত দ্রুত বিয়ে দেবেন না জানিয়ে দিলেও তিনি জানেন এসব মানসিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া জরুরি। নয়তো এই পরিবেশ থেকে রক্ষা পাবে না সে।
মেয়েকে বললেন,“ফুফুর কাছে গিয়ে কী করবি? সেখানে গেলেও এখন ওর শশুর বাড়ির লোকজন ইঙ্গিতে আরো কথা শোনানোর সুযোগ পাবে।”

ফাবিহা কেঁদে ফেলে বলল,“আমি কী করবো? আমার জীবনটাই কেন এমন হতে হলো?”

আতাউর রহমান মলিন স্বরে বললেন,“সবসময় জেদের ভাত নেই মা। সব সময় জেদ দেখাতে নেই। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ের পরিচয় দিতে পারোনি। দুদিন হলো মাত্র। অন্তত একমাস থেকে ভেবেচিন্তে দেখা উচিত ছিলো তোমার। চলে আসলেও তোমাকে কী কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, কীভাবে সেসব মোকাবেলা করবে এসব ভাবা উচিত ছিল তোমার।”

ফাবিহা বলল,“তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে বাবা? আমার মাথায় একটাই চিন্তা ছিল। কীভাবে আমি বেরিয়ে আসবো। বিয়ের আগে থেকে শাবাব আমাকে যেভাবে টর্চার করেছে, বিয়ের পর আমি তাকে বিশ্বাস করে একমাস কেন, এক মুহূর্ত থাকার কথাও ভাবতে পারিনি। বিয়ের পরও ও আমার সাথে মিসবিহেভ করেছে। আমিও চুপ করে থাকিনি। আমিও ওর মতই ওর সাথে ব্যবহার করেছি। কিন্তু এভাবে কতদিন? আমি কিছুই ভুলতে পারছি না বাবা। ও আসার পর থেকেই আমার জীবন ওলটপালট হয়ে গেল।”

কান্নায় ভেঙে পড়লো ফাবিহা। আতাউর রহমান চুপ করে রইলেন। সমাজকে পাত্তা দিও না বললেও সবসময় সমাজকে এড়িয়ে চলা যায় না। ফাবিহা নিজেকে ঘরবন্দী করে নিলো। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে ম*রে যেতে।

শাবাব আজ মাকে ফোন করলো। রিসিভ করে সুরাইয়া হাউমাউ করে কাঁদছেন।
“কোথায় আছিস আব্বা। কীভাবে থাকছিস, কী খাচ্ছিস? তুই বাড়ি ফিরে আয় আব্বা। তোর আব্বা আর কিছু বলবে না। আমার আর কে আছে আব্বা। তোরা বাবা-ছেলে ছাড়া আমার আর কে আছে? এভাবে কেন আমাকে একা করে দিচ্ছিস?”

শাবাব কানে ফোন চেপে ধরে আছে। চোখজোড়া ভেজা। কোনো কথা বলতে পারছে না। গলা রোধ হয়ে আছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বলল,“আমি ভালো আছি মা। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমাকে আর ফিরতে বোলো না! আমি চাই না বাবা আমার জন্য আর কারো কাছে ছোটো হোক।”

সুরাইয়া ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন,“তুই যদি না আসিস, তবে আমি ম*রে গেলেও আর আসিস না। আমার খাটিয়া ধরার অধিকারও তোর নেই।”

বুক ছ্যাৎ করে উঠলো। আর্তনাদ করে কাতর স্বরে ডেকে উঠলো, “মা।”

সুরাইয়া কল কেটে ইচ্ছেমতো কাঁদলেন। শাবাব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কী করবে? মাকে কীভাবে বুঝাবে? সারারাত দুশ্চিন্তায় ঘুম হলো না। এপাশ-ওপাশ করেই ভোর হলো। শাবাব সিদ্ধান্ত নিলো একবার লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। দশটার পর বাবা বাড়ি থাকেন না। সে ওই সময়টাকেই কাজে লাগালো। দশটার পর বাড়িতে গিয়ে বেল দিলো। তুলি দরজা খুলে শাবাবকে দেখে চেঁচাতে চেঁচাতে ভেতরে গেল,“খালাম্মা ভাইজান বাড়ি আইছে।”

শাবাবের পা কাঁপছে। ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর পা বাড়ালো। সুরাইয়া অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে এলেন। শরীর নেতিয়ে পড়বে যেন। অথচ ছেলের বুকে মাথা দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,“আমার আব্বা আসছে। তুই আর আমাকে ছেড়ে যাবি না আব্বা।”

“তোমার ছেলে এই বাড়িতে কী করছে?”
বাবার বাজখাঁই গলা শুনে চমকে উঠলো শাবাব। বাবা তো এই সময় বাড়িতে থাকেন না। সে স্থির হয়ে গেল। সুরাইয়া গতকাল থেকে অসুস্থ। সেজন্যই আজ দেরি করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন ফিরোজ আলম। সুরাইয়া ছেলেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বললেন,“তোমার দোহাই লাগে। এবার এসব বন্ধ করো।”

শাবাব মাথানিচু করে বলল,“আমি যাচ্ছি মা।”

ফিরোজ আলম গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। সুরাইয়া ঝাপটে ধরে রাখলেন শাবাবকে।
“আমার কথা শোন। তোর বাবা রেগে আছে। তুই গিয়ে মাফ চা। তোর উপর রেগে থাকতে পারবেন না। তুই ভালো হয়ে যা বাবা। আমাদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও ভালো হয়ে যা। তুই এবার চলে গেলে আমি ম*রে যাবো। আমার জন্য হলেও তোর বাবার কাছে ক্ষমা চা।”

শাবাব কাঁপা গলায় বলল,“কোন মুখে ক্ষমা চাইবো মা?”

“তুই শুধু ক্ষমা চেয়ে দেখ। তোর বাবা ক্ষমা না করে পারবেন না। আমাদের একমাত্র ছেলে তুই। তোর বাবা বেশিদূর যায়নি। যা আব্বা।”

শাবাব দ্বিধান্বিত চোখে তাকালো। তুলি বলল,“ভাইজান আপনের জন্য খালাম্মা সারাদিন কান্দাকাটি করে। খাওনা খায় না। অসুস্থ হইয়া পড়েন। আপনে খালুর কাছে ক্ষমা চান।”

শাবাব দ্বিধা কাটানোর চেষ্টা করে বের হলো। বাবা এখনো যাননি। ড্রাইভারের সাথে কী কথা বলছেন। সে দ্রুত পা চালিয়ে বাবার কাছে গেল। পেছন থেকে ডাকলো,“বাবা।”

ফিরোজ আলম তাকালেন না। শাবাব বলল,“তোমার সাথে আমার কথা আছে বাবা।”

ফিরোজ আলম এবারও কথা না বলে গাড়িতে চড়ে বসলেন। শাবাব সাহস করে নিজেও গাড়িতে চড়ে বসলো বাবার পাশে। ফিরোজ আলম কঠিন স্বরে আদেশ দিলেন, “গাড়ি থেকে নামো।”

শাবাব না নেমে হাত জোড় করে বলল,“আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা। আমি এখন থেকে তোমার সব কথা মেনে চলবো।”

ড্রাইভার বাবা-ছেলের কথায় বিরক্ত না করে গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে গেলেন। ফিরোজ আলম বললেন,“আমার কথা শোনার দরকার নেই। তোমাকে আমি চিনি না।”

শাবাব বারবার আকুতি-মিনতি করছে। কিছুতেই মন গলছে না ফিরোজ আলমের। তিনি এতক্ষণ কথা বললেও এবার শক্ত হয়ে বসে রইলেন। আর কোনো কথা বলছেন না। হঠাৎ এক ঝড় এসে মুহূর্তের মাঝে তাণ্ডব ঘটিয়ে চলে গেল। জড়ো হলো মানুষ। রাস্তার মাঝে তিনটি শরীর। বড়ো বাসের ধাক্কায় ড্রাইভার জায়গায় মৃত্যুবরণ করেন। রাস্তার একপাশে ছিটকে পড়েছে শাবাবের শরীর। মাঝখানে পড়েছে ফিরোজ আলমের দেহ। লোকজন ঘিরে ধরেছে ফিরোজ আলমকে। মাথা দিয়ে গলগল করে র*ক্ত ঝরছে। পা ভেঙে একেবারে উল্টে আছে। ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট কিছু মানুষের মুখ ভেসে উঠছে। অনেক কষ্টে আওড়ালেন,“আমার ছেলে। আমার ছেলেকে আগে ধরুন।”

খানিক সময় পর চোখদুটো বন্ধ হয়ে এলো। ছেলের প্রতি বাবার ভালোবাসা সবসময় অপ্রকাশিত থেকে যায়। শাবাব শরীর টে*নে*হিঁ*চ*ড়ে বাবার দিকে আসার চেষ্টা করলো। কয়েকজন মিলে তাকে সিএনজিতে তুলে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পারলো না। বলল,“আমার কিছু হয়নি। আমার বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

#চলবে…..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

স্বামী-সন্তান দুজনই হাসপাতালে। সুরাইয়ার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। বলা হয়েছে ফিরোজ আলমের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কী হয় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এক্সি*ডেন্টের খবরটা ফেসবুক ফিডে আতাউর রহমানও পেলেন। সামান্য পরিচয়ে ভালো মানুষ মনে হয়েছে ফিরোজ আলমকে। আতাউর রহমান বের হতে নিলেন। ফাবিহার মা জিজ্ঞেস করলেন,“কোথায় যাচ্ছো?”

“ফাবিহার শশুর আর শাবাব এক্সি**ডেন্ট করেছে। যতটুকু বুঝলাম ওর শশুরের অবস্থা খুবই খা*রা*প।”

ফাবিহার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে সেদিনই তো লোকটি সুমনের হাত থেকে বাঁচিয়ে তাকে স্বসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে, সেদিনই তো তাকে এসে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। শাবাব যা করেছে, তাতে তার বাবা-মাকে দোষারোপ করে না ফাবিহা। কণ্ঠে বিস্ময়ের সাথে দুঃখ প্রকাশ পেল।
“কী বলছো বাবা! কখন হলো এসব?”

“এগারোটার পর নাকি এই ঘটনা ঘটে।”

“তুমি এখন কোথায় যাবে? কোন হাসপাতালে আছে সেটা তো জানো না।”

“আমি আগে ওনার বাড়িতে যাবো। সেখান থেকে হাসপাতাল যাবো।”

ফাবিহা গলা নামিয়ে বলল,“একটু অপেক্ষা কর। আমিও যাবো বাবা।”

ফাবিহার মা বললেন,“তোর বাবা যাচ্ছে যাক। তুই এখন গেলে কেমন দেখাবে?”

ফাবিহা অবাক হয়ে বলল,“আশ্চর্য মা! কেমন দেখাবে মানে? আমি তো আনন্দে উৎসব করতে যাচ্ছি না।”

ফাবিহার মা জড়তা নিয়ে বললেন,“দাঁড়া আমিও যাবো।”

তিনজন একসাথে বের হলো। শাবাবের বাড়িতে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের ভীড়। ফাবিহা আর তার মাকে বাড়িতে নামিয়ে একজনের কাছ থেকে জেনে নিয়ে আতাউর রহমান হাসপাতালে গেলেন।

সুরাইয়া আহাজারি করে কাঁদছেন। “ আমার ছেলে, আমার স্বামীর কী হয়ে গেল? আল্লাহ আমার স্বামী-ছেলেকেই পেলো? আমি কেন ছেলেকে তার বাবার পেছন পেছন পাঠালাম? তাহলে তো দুজনের একজনও এত তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বের হতো না।”

সুরাইয়ার পাশে ওনার বোন এবং জা রয়েছেন। তুলি একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
সুরাইয়ার আহাজারি থামছে না।

“আমার ছেলে বাড়ি ফিরলো কতদিন পর। আমি জোর করে ওর বাবার কাছে পাঠালাম মাফ চাইতে। কী হয়ে গেল আল্লাহ। আমি কেন পাঠালাম?”

বলতে বলতে স্বর কমে আসে। আবার আহাজারি করেন। ফাবিহা বুঝলো না শাবাব কোথা থেকে বাড়ি ফিরেছে। সুরাইয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত রেখে বলল,“কাঁদবেন না আম্মা। ইনশাআল্লাহ সবাই ঠিক হয়ে যাবে।”

ফাবিহাকে দেখে সুরাইয়া বললেন,“তুমি কেন এসেছো গো মা? আমার এখন আর কাউকে প্রয়োজন নেই। তুমি তো চলে গিয়েছিলে। এখন কি আমার ছেলে আর স্বামীর প্রাণ গিয়েছে কিনা সেটা দেখতে এসেছো?”

ফাবিহা অস্বস্তি নিয়ে বলল,“আম্মা আপনি শান্ত হোন।”

সুরাইয়ার কান্না দেখে ফাবিহার মায়েরও খা*রা*প লাগছে। একসাথে স্বামী-সন্তান দুজনের এত বড়ো বিপদ। তিনি পাশে বসলেন। ফাবিহা উঠে গিয়ে তুলিকে একপাশে ডেকে নিলো।
“বাড়িতে কী হয়েছিল তুলি? শাবাব এতদিন পর ফিরেছে মানে? কোথায় ছিল সে?”

তুলি নাক টানতে টানতে বলল,“আপনে চইলা যাওনের পর খালু ভাইজানরে বাইর কইরা দিছে। ক্যান আপনেরে ছাইড়া দিছে? ভাইজান কাউরে না জানাইয়া বাড়ি থেকে চইলা যান। এর ভিতর কারো লগে যোগাযোগ করেন নাই। হাতে টাকাপয়সাও ছিল না। কী খাইছে, কোথায় থাকছে? কাল খালাম্মারে ফোন দিছে। খালাম্মা কান্নাকাটি কইরা কইছে না আসলে খালাম্মা ম*ই*রা যাইবো, খাটিয়া ধরতে দিবো না। খালাম্মার লগে দেখা করতে আইসা খালুর সামনে পইড়া যায় ভাইজান। খালু রাগারাগি কইরা বাইর হওনের পর আম্মা আবার খালুর কাছে মাফ চাইতে পাঠাইছেন। এরপরই দুইজন গাড়িতে চইড়া চইলা যায়। তারপরেই এক্সি*ডেন্টের খবর আসে।”

শাবাব তো তাকে ছাড়েনি। বরং তার কথায় তাকে যেতে দিতে রাজি হয়েছে। ফাবিহা নরম হয়ে বলল,“চোখ মুছে ফেল। আম্মাকে দেখতে হবে তোর।”

তুলি কান্না না থামিয়ে অনবরত হেঁচকি তুলে বলল,“আপনের তো দয়ামায়া নাই ভাবি। ভাইজান আর খালুর লাইগা আমার কলিজা ফাইটা যায়।”

ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে দয়ামায়া দেখালেই বা কি? মানুষ দুটো কি সুস্থ হয়ে যাবে? সুরাইয়ার কান্না দেখে সে মনেপ্রাণে চাইছে শাবাব আর ফিরোজ আলম যেন সুস্থ হয়ে যায়।

ফাবিহার জেঠী শাশুড়ি ডাকলেন তাকে।
“তোমরা না ভালোবেসে লুকিয়ে বিয়ে করেছো? তাহলে সংসার দুদিনও টিকলো না? কেমন ভালোবাসা তোমাদের? ডিভোর্স কি হয়ে গিয়েছে?”

“না। এমনিতেই আলাদা হয়েছি। আমাদের অফিশিয়াল কোনো কাগজপত্র নেই।”

“যাই হোক, তোমাকে একটা কথা বলি। যা হয়েছে শেষ। আবার ভেবে দেখো। ডিভোর্স যেহেতু হয়নি তোমার উচিত এখন তোমার শাশুড়ির পাশে থাকা। সবাই তো আর সংসার ফেলে থাকতে পারবে না।”

ফাবিহা অস্বস্তি নিয়ে বলল,“আমরা তো আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আলাদা হয়েও গিয়েছি। এখন কীভাবে আমি এখানে থাকবো?”

“তা*লা*ক তো হয়নি। দেখো এমন আহামরি বয়স তোমাদের হয়নি। আরো বয়স্ক, জ্ঞানী মানুষও ভুল করে। মনে করো এটা ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ।
তোমরা একসাথে না থাকলে সেটা পরে দেখবে। আগে তোমার শাশুড়ির পাশে থাকো।”

ফাবিহার জেঠী শাশুড়ি চলে গেলেন। ভাবনায় পড়লো ফাবিহা। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মায়ের কাছে চলে গেল। কানাঘুঁষা চলছে ফিরোজ আলম বেঁচে নেই। কয়েকজন মহিলা সুরাইয়ার গয়নাগাটি খোলার তাড়া দিলেন। একটা ঘোরের মাঝে আছে সুরাইয়া। কী বলছে সবাই। গয়নাগাটি কেন খুলতে হবে? ফাবিহার হাঁসফাঁস লাগছে।
সুরাইয়া কিছুতেই কিছু খুলবেন না। আধাঘন্টা পর খবর এলো শাবাবের জ্ঞান আছে। একটা হাত ভেঙেছে তার। পায়েও ব্যথা পেয়েছে। তবে ভাঙেনি। রাস্তার একপাশে ছিটকে পড়ায় তেমন ক্ষয়-ক্ষতি তার হয়নি। ফিরোজ আলমের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। তিনি গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।

বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেল। সবার। যেই ভদ্রমহিলা গয়নাগাটি খোলার কথা বললেন, শাবাবের খালা ওই মহিলাকে কচলে ধরলেন।
“না জেনে আন্দাজে খবর ছড়ানো কোন অভ্যাস? আমরা জানলাম না আর আপনি জেনে গেলেন দুলাভাই নেই।”

মহিলা আমতা আমতা করতে লাগলেন। দোষ তাঁরও নেই। তিনিও অন্যজনের মুখে শুনেছেন।
ফাবিহার মা এবার চলে যাবেন। সুরাইয়ার কাছে ফাবিহাকে নিয়ে বিদায় জানাতে এলেন।
“আমরা আসছি আপা।”

দূরদূরান্তের কেউ জানেন না ফাবিহা আর শাবাবের বিচ্ছেদের কথা। তাঁরা অবাক হয়ে বললেন,“বউ কোথায় যাচ্ছে? স্বামী-শশুর মৃ*ত্যু*র পথে। বাড়িতে শোক। এই মুহূর্ত বউ যাচ্ছে কোথায়?”

সুরাইয়া নিস্তেজ হয়ে অসন্তোষ গলায় বললেন,“যাক। তারা আর একসাথে থাকবে না। দুজনেই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।”

চরম আশ্চর্যে অনেকের মুখে হাত।
“কী বলছেন? বিয়ে হতে না হতেই এই অবস্থা? তা*লা*ক কি হয়ে গিয়েছে?”

“তা*লা*কের কী দরকার? তারা একসাথে থাকবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটাই তো যথেষ্ট।”

এবার সবাই ফাবিহার দিকে ছুটলেন।
“কীগো মেয়ে নিজেরা নিজেরা বিয়ে করেছো, আবার নিজেরাই আলাদা থাকছো? স্বামী-স্ত্রীর রাগারাগি হয়েই থাকে, তাই বলে কি আলাদা থাকতে হবে? এত রাগ, জেদ ভালো না। কেমন পাষাণ মেয়ে তুমি? স্বামীর প্রতি কি একদিনের জন্যেও তোমার মায়া জন্মায়নি? মানুষের জন্যই তো মানুষ।”

সুরাইয়া ভেবেছিলেন ফাবিহা আগের সব ভুলে গিয়ে এসেছে যখন, তখন থাকবে। চলে যাওয়ার কথা বলতেই মনে কষ্ট পেলেন তিনি। নিজেকে বেহায়া বলে কয়েকবার গা*লি দিলেন। সবার চাপাচাপিতে ফাবিহার মা বললেন,“আপনারা যা জানেন না তা নিয়ে দয়া করে কথা বলবেন না।”

“যা কিছু হোক, আপনার মেয়ে তো এখনো এই বাড়ির বউ। তার তো উচিত এই সময়ে পাশে থাকা।”

ফাবিহার মা আতাউর রহমানকে কল দিয়ে জানালেন সবাই কী কী বলছে। এজন্যই তিনি মেয়ের আসা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন। আতাউর রহমান বললেন,“ও থাকুক এখন। এভাবে চলে যাওয়া বেমানান।”

তেতে গেলেন ফাবিহার মা। ফাবিহা চারদিক বিবেচনা করে বলল,“মা আমি থাকি দুদিন। এদিকটা স্বাভাবিক হলে আমি চলে যাবো।”

এবার মেয়ের উপর চটে গেলেন ফাবিহার মা।
“তুই কি শাবাবের সাথে সংসার করতে চাইছিস?”

ফাবিহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,“মা আমি শুধু আমার শাশুড়ির পাশে থাকতে চাইছি। শাবাব আর আমার মধ্যে যেহেতু আইনত আর ধর্মীয় ছাড়াছাড়ি হয়নি, সেটারও ব্যবস্থা করতে হবে। ও সুস্থ হলেই যাতে এদিকটা সামলে নেয়, তার জন্যও তো কথা বলতে হবে।”

“আমার ভয় হচ্ছে। একা পেয়ে ও না আবার তোকে মে*রে গুম করে দেয়।”

“মা এতদিন সুযোগ থাকার পর ও আমাকে গু*ম করলো না। আর এখন ভাঙা হাত-পা নিয়ে আমাকে গু*ম করবে? তুমি সবসময় বাচ্চাদের মত কথা বলো।”

“আমি কিছু জানি না তুই আমার সাথে চলে যাবি।”

“মা অবুঝ না হয়ে ভেবে দেখো। এটা খারাপ দেখায়।”

আতাউর রহমান এসে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফাবিহার মাকে নিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আত্মীয়স্বজনরা ও চলে গেলেন। ফিরোজ আলম মা*রা গিয়েছেন খবর শুনেই এত মানুষের ভীড় জমেছিল। ফাবিহার খালা শাশুড়ি থেকে গেলেন। ফাবিহার সাথে কথা না বলে নিজের কাজ নিজে করছেন। সুরাইয়াও কথা বলছেন না ফাবিহার সাথে। খুব অসহায় লাগছে তার। এমনিতেই সে আগের তুলনায় ভেঙে গিয়েছে। ওরাই তাকে থাকতে বলল, আর ওরাই কথা বলছে না।

শাবাবকে নিয়ে ওর কাজিন চলে এলো। ফিরোজ আলমের কাছে ওনার ভাই, ভায়রাভাই আছেন।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে মায়ের কাছে যেতেই সুরাইয়া ছেলেকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। শাবাবের চোখ দিয়েও নিরবে পানি ঝরছে। এমন অসহায় আর কোনোদিন লাগেনি। তার অন্তর কেঁপে উঠলো যখন লোকমুখে শুনলো “লোকটা নিজের মৃ*ত*প্রা*য় অবস্থাতেও আগে ছেলের খোঁজ নিলেন।”

শাবাব ভাবতো মা তাকে বেশি ভালোবাসে। বাবা বোধহয় কম ভালোবাসে। আজ বুঝলো বাবা মা কেউ তাকে কম ভালোবাসেন না। বাবার ভালোবাসা অপ্রকাশিত। তার এত অপ*রা*ধের পরও বাবা তার খোঁজ নিলেন।
মায়ের কাছ থেকে সরে এসে চমকে উঠলো ফাবিহাকে দেখে। চোখের পলক ঝাপটে নিজের ভ্রম কাটাতে চাইলো। ফাবিহার জন্য যে তার মনে কিছু আছে সেটা সে এর আগেই টের পেয়েছে। পলক ঝাপটে আবারও ফাবিহাকে দেখলো। কিছু না বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে গেল।

ঘরে বসে রইলো। শরীরে যন্ত্রণা। তারচেয়ে বেশি যন্ত্রণা মনে। বাবার এই অবস্থার জন্য বারবার নিজেকেই দায়ী করে।
রাতে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকালো সে। ফাবিহা খাবার হাতে ঘরে ঢুকলো। শাবাব মলিন মুখে বলল,“তুমি এখানে?”

ফাবিহাও একইভাবে জবাব দিলো,“এক্সি*ডেন্টের কথা শুনে এসেছিলাম। সবাই থাকার জন্য চাপাচাপি করলো।”

“সবাই বললেই তোমায় থাকতে হবে? জীবন তোমার, অন্যদের নয়।”

ফাবিহা কথা না বলে টেবিলের উপর খাবার রাখলো। ,“খেয়ে নাও। আমি দুদিন পরই চলে যাবো।”

বলে হাতের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো শাবাবের ডানহাতে ব্যান্ডেজ। আবারও বলল,“আমি খাইয়ে দেব?”

শাবাব জবাব দিলো,“না। একটা চামচ নিয়ে এসো। আমি খেয়ে নেব।”

ফাবিহা বেরিয়ে গেল চামচের জন্য।
শাবাব বাম হাতে চামচ নিয়ে মুখে খাবার তুললো। একটু বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। তবুও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করছে না। ফাবিহা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর হাতের দিকে। শাবাবের খাওয়া শেষ হলে বলল,“থ্যাংকস। এখন তো রাত, তুমি বরং কাল চলে যেও। কেউ কিছু বলবে না। আমি আছি বাসায়।”

ফাবিহা বলল,“তুমি রেস্ট নাও।”

শাবাব বলল,“তুমি বরং ঘরে ঘুমাও। আমি অন্যঘরে যাচ্ছি।”

“এসবের কি সত্যিই দরকার আছে শাবাব? আমরা এর আগেও এক ঘরে এক বিছানায় ছিলাম।”

“তখনের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এখন তুমি আর আমি সম্পর্কে নেই।”

শাবাবের অভিব্যক্তি স্পষ্ট হচ্ছে না। তার সব কথাই স্বাভাবিক। ফাবিহা বুঝতে পারছে না তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সে ফাবিহাকে দায়ী করছে কিনা?
ফাবিহা বলল,“তুমি কি সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করছো?”

“তুমি দায়ী হবে কেন? আমার কারণেই এসব হয়েছে। রাত হয়েছে। শুয়ে পড়ো।”
বলে শাবাব উঠে যেতে নিতেই ফাবিহা বলল,“তোমার এখন ঘর ছাড়ার প্রয়োজন নেই। এতে আরো বাজে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।”

শাবাব বিরক্ত হয়ে বলল,“তুমি কী প্রমাণ করতে চাইছো, আমি বুঝতে পারছি না। লোকে যাই বলুক, তুমি তো কখনো সেসব কান দাওনি। তাহলে আজ থেকে গেলে কেন? যেখানে আমরা দুজনই জানি আমাদের পথ আলাদা।”

ফাবিহা বলল,“তুমি ভালো কথা বলেছো। সুস্থ হয়ে সবার সামনে বলে দিও আমার সাথে তুমি থাকতে চাও না। মানে ডিভোর্সের যেই ব্যাপারটা। সেটার কারণেই আমার থেকে যাওয়া।”

শাবাবের চোখ স্থির হয়ে গেল। ফাবিহা নিজের ভালোটা ভেবেই এখানে থেকে গিয়েছে। সামান্য আবেগ থেকেও নয়।
“বলে দেব। এখন শুয়ে পড়ো।”

“হুম।”

ফাবিহা প্লেট নিয়ে চলে গেল। শাবাব কল দিল জেঠার কাছে বাবার অবস্থা জানার জন্য। তিনি জানালেন ফিরোজ আলমের জ্ঞান এসেছে। একজন মহিলা হলে ভালো হয়।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে বাবার কথা জানালো। কেউ ঘুমায়নি। সুরাইয়া বললেন,“কাল তাহলে আমি যাবো।”

শাবাব বলল,“তুমি অসুস্থ মানুষ। কীভাবে যাবে?”

সুরাইয়া বললেন,“আমার স্বামী, আমি যতটা বুঝবো ততটা অন্যকেউ বুঝবে না। আমার ঠেকা বেশি। বাড়িতে তোর খালা আছে, তুলি আছে।”

ফাবিহার কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। বললেন,“তুই ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়।”

“তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।”

শাবাব ঘরে এসে দেখলো ফাবিহা শুয়ে পড়েছে। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,“কোথায় গিয়েছো?”

“মায়ের ঘরে। বাবার জ্ঞান ফিরেছে।”

“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ঔষধ নিয়েছো?”

“এখন নেব।”

ফাবিহা উঠতে নিতেই দেখলো শাবাব ঔষধ বের করে পানি হাতে নিয়েছে। ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। দু’জন বিছানার দুপাশে। একজনেরও চোখে ঘুম নেই। দুজনই বুঝতে পারছে পাশের ব্যক্তি জেগে আছে।

ফাবিহা বলল,“আমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো!”

শাবাবের পাশ থেকে জবাব এলো,“কেমন?”

“বাকি মেয়েদের মতই। বিয়েটা না ভেঙে গেলে এখন সুন্দর একটা সংসার হতো।”

“তোমার বিয়ে তো আমার জন্যই ভাঙলো।”

“না, তারও আগে। তুমি যখন আমায় প্রেম প্রস্তাব দাও, তখন আমার বিয়ে ঠিক ছিল কাজিনের সাথে। তারপর সে আরেকজনকে বিয়ে করে নিলো।”

“তোমাদের মাঝে কি সম্পর্ক ছিল?”

“নাহ্, আমি তাকে পছন্দ করতাম।”

“এখনো?”

“না। আমি এখন আর কোনো কিছুর জন্য আক্ষেপ করি না। সে আমার ভাগ্যে ছিল না কখনো। তার ঘরে এখন নতুন সদস্য আসছে।”

শাবাব বলল,“ঘুমাও।”

এই বলেও দুজন কথা চালিয়ে গেল আরো কিছুক্ষণ। এটাই তাঁদের ঠাণ্ডা মাথায় দ্বিতীয় আলাপ।

হাতে ব্যথা পেয়ে ঘুম ছুটে গেল শাবাবের। ভোররাতে ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়েছে ফাবিহা। গোটানো হাঁটুর নিচে শাবাবের ডান হাত পড়েছে। চোখমুখ কুঁচকে হাত টে*নে নিলো। টিমটিমে আলোয় ফাবিহাকে অবলোকন করলো। সেও আক্ষেপ করল তাদের জীবন সুন্দর হতে পারতো।
নতুন সদস্য তাদের দুজনের ঘরেও আসতে পারতো। সব অসম্ভব হয়েছে তার নিজেরই কারণে। যদি নিজের অতীতের কর্ম, কথাগুলো ফিরিয়ে নেওয়া যেত, সেটা যতটা কঠিনই হোক সে ফিরিয়ে নিতো।

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে