এক টুকরো আলো পর্ব-০২

0
570

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

জনাব আজাদের এ*ক্সি*ডে*ন্ট এর সপ্তাহ পেরিয়েছে। তাসিনের মতামতের উপর ভিত্তি করে মা জিজ্ঞেস করলেন,“ফাবিহাকে তোর কেমন লাগে?”

“কেমন লাগবে আবার? ফাবিহাকে ফাবিহার মতোই লাগে। ওকে তো আর ফারজানার মতো লাগবে না।”

মা কিছুটা বিরক্ত হলেন। মুখ কুঁচকে ‘চ’ শব্দ করে বললেন,“আমি তোকে সেটা বলিনি। জানতে চাইছি ফাবিহা আমাদের ঘরের বউ হলে কেমন মানাবে?”

“বউ?” বলে হাত থেমে গেল তাসিনের। কাজ বাদ দিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকালো মায়ের মুখপানে। মা মৃদু হেসে বললেন,“ফাবিহাকে আমার বেশ পছন্দ। তোর খালার সাথেও আমি কথা বলেছি। এখন তুই বললেই তোর খালা তোর খালুর সাথেও আলাপ করবে।”

বউ বলে হাত থেমে গেলেও হৃদয় থামেনি। বরং এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তাসিন এক অজানা ঘোরে হারিয়ে গেল। সে সেরোয়ানি, মাথায় পাগড়ি পরে বসে আছে। তার পাশেই লাল টুকটুকে শাড়িতে একহাত ঘোমটা টেনে বসে আছে তার নববধূ। তাসিনের বড্ডো তাড়া। কবুল বলার পর থেকেই সে মুখিয়ে আছে তার হৃদয়ের রাণীকে এক পলক দেখার জন্য। বদ্ধ ঘরে স্ত্রীর ঘোমটা সরিয়ে দিল তাসিন। চোখের সামনে বোরকায় আবৃত সেই মানবী এসে ধরা দিল। মুখ দেখতে পেল না সে। দেখবে কীভাবে? সে তো বাস্তবে কখনো সেই কন্ঠস্বরের অধিকারিনীর মুখ দেখেনি। যতটুকু দেখেছে, কল্পনায়ও ততটুকুই ধরা দিচ্ছে। মায়ের ছোঁয়ায় ধ্যান ভঙ্গ হলো। এতক্ষণ মায়ের কোন কথাই শুনতে পায়নি তাসিন। মা বললেন,“কীরে কিছু বল।”

তাসিন লম্বা শ্বাস ফেললো। সে এসব কেন ভাবছে? বিয়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছে। অথচ বউ হিসেবে তার ফাবিহাকে কল্পনা করার কথা ছিল। সে খুব ভালোভাবেই জানে জনাব আজাদ কখনোই এমন পরিবারে এমন ছেলের কাছে মেয়ে দেবেন না। তাঁরা তাঁদের মতোই কোন এক পরিবারে মেয়েকে দেবেন। তাসিন মাকে বলে দিল,“তোমাদের যা ভালোলাগে কর। ”

মা তাসিনের কাছ থেকে এক প্রকার অনুমতি পেতেই খুশিমনে ছুটে গেলেন৷ দ্রুত আলোচনা চললো বিয়ের। যেহেতু মেয়ে, ছেলে সব নিজেদের মধ্যেই, সেহেতু দেখাদেখির পর্ব বাদ পড়লো। তবে রীতি অনুযায়ী বিয়ের কথাবার্তা মেয়ের বাড়িতে হবে।

নিশি ছুটে এলো ভাইয়ের ঘরে। কপালে হাত রেখে চোখ বুঁজে শুয়ে আছে তাসিন। নিশি এক বুক উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,“ভাইয়া, ভাইয়া কাল আমরা ফাবিহা আপুকে দেখতে যাবো। ওখানেই পাকা কথা হবে।”

তাসিনের কপালে ভাঁজ পড়লো৷
“ওকে আবার দেখতে যাওয়ার কী আছে?”

“এটা বললে তো হবে না। তোমাকেও কাল যেতে হবে। মাকে তো তাই বলতে শুনলাম।”

তাসিনের মন টানছে না কিছুতেই। তবুও কিছু একটা থেকে পালিয়ে বাঁচতেই সে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তাসিন নিজের মনকে বোঝাতে চাইছে এটা কেবল তার কৌতুহল। আর কিছু নয়। মেয়েটিকে বাকি মেয়েদের মতো বোরকা ছাড়া দেখলে এমনটা হতো না। বরং স্বাভাবিক মনে হতো। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি শুধু তার নয়, প্রতিটি মানুষেরই আগ্রহ থাকে। ছোটো বেলায় মা যেসব করতে নিষেধ করতো, তাসিন আগ্রহ নিয়ে সেসবই করতো। এখনো তার সাথে সেটাই ঘটছে।

ফাবিহার বাড়িতে সকলে উপস্থিত। তাসিনের মা ফাবিহাকে পাশে বসিয়ে রেখে থুতনিতে হাত রেখে নয়ন ভরে দেখছেন। ফাবিহাকে এক দেখায় যেকেউ নির্দ্বিধায় আগুন সুন্দরী বলে ফেলবে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। মেয়েটিও ভীষণ ভালো। চেহারা থেকে লজ্জা সরছেই না। তাসিনকে তার ভালোলাগতো। বিয়ের কথা আলোচনার পর থেকেই সেই ভালোলাগা ভালোবাসার বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। সকলে চলে এলেও তাসিন এখনো এলো না। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়ে এলো। মা কল দিলেন৷

“কোথায় তুই তাসিন? এখনো আসছিস না কেন?”

“আমি গিয়ে কী করবো মা? কাজে আছি।”

“এতকিছু বুঝি না৷ অসামাজিকের মতো কাজকর্ম করবি না। তাড়াতাড়ি আয়।”

মা ঝাড়ি দিয়ে কল কেটে দিলেন৷ হতাশ হয়ে তাসিনকে ফাবিহাদের বাড়ির পথ ধরতে হলো। তাসিনকে পেয়ে সকলেই খুশি হলো। নানার বাড়ির লোকজনও উপস্থিত আছে। ফাবিহা আর তাসিনকে কেন্দ্র করে সকলেই হাসি মজা করছে। তাসিন খেয়াল করলো ফাবিহা কেমন লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে। অথচ তার বিশেষ কোন অনুভূতি হচ্ছে না। যতবার ফাবিহাকে স্ত্রী রূপে কল্পনা করতে যায়, ততবারই ওই বোরকায় আবৃত কুচকুচে কালো অবয়বটা মানসপটে ভেসে ওঠে। নিজের উপরই রাগ উঠে যায় তার।

বিকেলের পূর্বেই বেরুতে নিচ্ছিল তাসিন। সামনে পড়লো ফাবিহা। তাসিনকে দেখে মুচকি হেসে সামনে পা বাড়িয়ে চলে যেতে নিতেই তাসিন ডেকে উঠলো।
“ফাবিহা।”

ফাবিহা দাঁড়িয়ে পড়লো। তার বুকে দ্রিমদ্রিম হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। এই বুঝি তাসিন তাকে বলবে ‘ছাদে যাবে?’
তাসিন এমন কিছুই বলল না। সে বলল,“তোর কাউকে পছন্দ আছে?”

তুই? তুই শুনেই মনটা বিষিয়ে উঠলো ফাবিহার। দুদিন পর যে বউ হবে, তাকে কেউ তুই ডাকে? আগে যতই কাজিন হিসেবে তুই ডাকুক, এখন তো তুমি বলতে পারে। সে মাথা নেড়ে বলল,“আমার কাউকে পছন্দ নেই।”
তারপরই ছুটে পালিয়ে গেল। তাসিন টের পেল মেয়েটা লজ্জা পেয়ে পালিয়েছে। অথচ সে লজ্জা পাওয়ার মতো কিছুই বলেনি।

★★

মাদ্রাসায় থেকে বাড়ি ফিরছে হুরাইন। ঝাঁকে ঝাঁকে কালো বোরকায় আবৃত ছোটো থেকে বড়ো মেয়েরা বের হচ্ছে গেট দিয়ে। সিএনজিতে বসা ছিল তাসিন। তিনজন মেয়ে এসে দাঁড়ালো পাশে। একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো,“বটতলা যাবেন?”

ড্রাইভার বললেন,“উইঠা বসেন।”
তাসিনকে কিছু বলতে হয়নি। সে পেছনের সিট ছেড়ে সামনে ড্রাইভারের সাথে গিয়ে বসে পড়েছে। সিএনজির ভেতরটা নিরব। হঠাৎ নিরবতা ভঙ্গ করে একটি কন্ঠ শোনা গেল,“তোর আব্বুর এখন কী অবস্থা হুরাইন?”

নিস্তব্ধতার মাঝে সেই স্বর স্পষ্ট হয়ে কর্ণকুহরে ঠেকলো।
“ভালো। ব্যান্ডেজ খুলবে আরো দশ-বারোদিন পর।”

তাসিনের ভেতর অস্থিরতা শুরু হলো। সে যদি ভুল না করে থাকে, তবে এটাই সেই কন্ঠস্বর। যা তাকে এমন উন্মাদ করে দিতে বাধ্য করেছে। কাজ-কর্ম, খাওয়াদাওয়া কোনটাই আজকাল ঠিকঠাক হয় না। তাসিন চোখ বুঁজে লম্বা শ্বাস টা*ন*লো। আবারো নিরবতা নামলো। হুট করেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেললো সে। বটতলার পরের স্ট্যান্ডে তার নামার কথা। সে ঠিক বটতলায় গিয়ে নেমে গেল। মেয়ে তিনটি ভাড়া মিটিয়ে রাস্তার পাশ ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তাসিন পুরোপুরি নিশ্চিত হতে সাবধানে পিছু নিলো মেয়েগুলোর। জনাব আজাদের বাড়ির সামনে এসেই একজন থেমে গেল। মাথা আর হাত নাড়িয়ে বাকি দুজনকে কী যেন বলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। তাসিন নিশ্চিত হলো। এটাই সেই, এটাই সেই রমনী। সেদিন একপলক পেছন থেকে দেখলেও আজ পুরোপুরিভাবে মনে গেঁথে নিয়েছে। দেখলেই চিনে ফেলবে। চোখদুটো পর্যন্ত নিকাবের উপরে পাতলা আরেকটি আবরণ দ্বারা ঢেকে রাখা। নিজেকে এভাবে রক্ষা করছে কার জন্য? কেবল একটি পুরুষের জন্য? তবে সে পুরুষ কতটা ভাগ্যবান?

তাসিন লক্ষ করল সে মেয়েটিকে অনুসরণ করে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে৷ নিজেই নিজের কাণ্ডে স্তব্ধ হয়ে গেল।
ফিরে এলো সে। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলো। তার শরীর এখানে হলেও মন পড়ে রয়েছে সেই মেয়েটির কাছে। পাশেরজন কী নাম বলে সম্বোধন করেছিল? মস্তিষ্কে দুবার চাপ দিয়ে মনে মনে আওড়ালো “হুরাইন।”
তাসিনকে উদাস হয়ে কিছু ভাবতে দেখে নিরব ওর পিঠে চাপড় মে*রে বলল,“কই হারাই গেলি? কয়েকদিন থেকেই দেখছি তুই কেমন আনমনা হয়ে কিছু নিয়ে ভাবিস। ঘরে কোন ঝামেলা?”

“কিছু না।”

“আরে বেটা বল। যেকোন সমস্যায় তোর সাথে আছি।”

নিরব আশ্বস্ত করলো তাসিনকে।
খানিকটা ভরসা পেয়ে তাসিন খানিকটা চাপা স্বরে বলল,“আমি একটা ঝামেলা ঘটিয়ে ফেলেছি।”

ভ্রু কুঁচকে গেল নিরবের। সবার মাঝখান থেকে তাসিনকে টে*নে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“ব্যাপার কী? খুলে বল।”

তাসিন কোনরূপ দ্বিধা না করেই বলে ফেললো,“আমি একটি মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছি।”

নিরব কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে থেকে খুশিতে আটখানা হয়ে গেল।
“আরে শা*লা। এটা তো খুশির খবর। তা ভাবিটা কে?”

“আমি কখনো দেখিনি তাকে?”

তাসিনের কথা শুনে নিরব রেগে গিয়ে বলল,“শা*লা ফাজলামো হচ্ছে?”

“আমি সিরিয়াস।”

তাসিনের চোখমুখ বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা বলছে না। নিরব নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,“দেখিসনি, তাহলে পছন্দ করেছিস কীভাবে?”

তাসিন ঘটনা খুলে বলতেই মাথায় হাত পড়লো নিরবের। বলে উঠলো,“এটা অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের আর ওই মেয়ের লাইফস্টাইলে প্রচুর পার্থক্য। এসব পছন্দ-টছন্দ বাদ দে।”

তারপরই কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,“তোর না ফাবিহার সাথে বিয়ে ঠিক? তাছাড়া তোর কথা শুনে মনে হলো ফাবিহা তোকে অনেক পছন্দ করে। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফাবিহাকে বিয়ে করে নে। দেখবি ওই মেয়ের ভূত মাথা থেকে নেমে যাবে।”

তাসিন করুন স্বরে বলল,“আমার ভাবনায় শুধু ওই মেয়েটিই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ অনুভূতি আরো তীব্র হলো। বারবার কানে সেই কন্ঠ ভেসে আসছে। আজ আর আমার ঘুম হবে না।”

নিরব অবাক চোখে তাকালো৷ তাসিনকে কখনো এমন আচরণ করতে দেখেনি সে। কেমন দিশেহারা লাগছে।
নিরব নরম সুরে বলল,“শান্ত হয়ে বোস।
আমার কথা শোন্। তুই মেয়েটিকে দেখিসনি। এমনও হতে পারে, দেখলে হয়তো তোর মন পাল্টে যাবে। তাছাড়া তুই শুধু পছন্দ করিস মেয়েটিকে।”

“বিয়ে করে নিলো ভালোবাসা হয়ে যাবে, তাই না?”
তাসিন প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে।

নিরব আজ পরপর স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার মুখে কোন কথা নেই। তাসিন স্বেচ্ছায় নিজের অ*শা*ন্তি ডেকে আনছে। না, মেয়েটিকে তো পাবেই না। উপরন্তু ফাবিহার মন ভেঙে যাবে, পরিবারের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে।

#চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে