#এক_টুকরো_আলো
#সূচনা_পর্ব
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
একটা চিকন শ্রুতিমধুর স্বর শুনে হৃদয় ছলকে ওঠে তাসিনের। এক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সেই কন্ঠস্বরের অধিকািনীর মুখখানা দেখার জন্য মন ছটফট করে ওঠে তার। তবে চোখ তুলে তাকানো অসম্ভব। এটা অপরাধ। একটা পর্দাশীল নারীকে এভাবে দেখা তাঁকে অসম্মান করার সমান। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রেখে মাথানিচু করে বসে রইলো তাসিন।
মেয়েটি কোনদিকে লক্ষ না করে ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। কাঁধে ব্যাগ। পুরো শরীর কালো বোরকায় আবৃত।
“আব্বু? আপনার কোথায় কষ্ট হচ্ছে আব্বু?”
মেয়েটির বাবা নরম স্বরে মেয়েকে আদেশ করলেন,“ভেতরে যান আম্মু।”
মেয়েটি বাবার বুক থেকে মাথা তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বাবা ইশারায় আবারো ভেতরে যেতে বললেন। মেয়েটি বাবার আদেশ মেনে পেছন ঘুরতেই মেহমান খানায় সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষকে বসে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠে। চোখ জোড়ায় ভীতি৷ নিকাব ফেলে ছুটে চলে যায় ভেতর ঘরে। এতক্ষণ মাথানিচু করে বসে ছিল তাসিন। এবার মাথা তুলে অস্বস্তি নিয়ে বলল,“উঠি তবে।”
তাসিনের ধারণা উনার মেয়েকে তাসিন দেখার চেষ্টা করেছে, এমনটাই ভাবছেন জনাব আজাদ। এটা ভেবেই তার অস্বস্তি বাড়লো।
কিন্তু তাসিনকে ভুল প্রমাণ করে জনাব আজাদ অনুরোধ করে বললেন,“আজ দাওয়াত গ্রহণ করুন। দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে তারপর যান।”
তাসিন অত্যন্ত নম্র গলায় বলল,“আমার কিছু কাজ আছে। পথে দুর্ঘটনা না ঘটলে আমি এখানে থাকতাম না। বেয়াদবি নেবেন না। আমাকে উঠতে হবে।”
জনাব আজাদ হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে বিদায় জানালেন তাকে। তাসিন মাথানিচু করে বেরিয়ে গেল। বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় উঠতেই তার প্রলম্বিত শ্বাস বেরিয়ে এলো। একটা মেয়ের কন্ঠস্বর এভাবে তার ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ রোজ সে কত মেয়ের স্বর শুনে অভ্যস্ত। রাস্তায় চলার পথেও কত নারী কন্ঠ কান ভেদ করে। কিন্তু এভাবে ভেতরটা নাড়িয়ে দিতে পারেনি। আমাদের নিষিদ্ধ জিনিসের উপর বরাবরই আগ্রহ বেশি। মেয়েটিকে দেখা সহজ কথা নয়। তাসিনের জন্য সে নারী নিষিদ্ধ। পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করে সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারলে তবেই দেখতে পাবে। তাসিন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো সব৷ কিন্তু কানে এখনো সেই শ্রুতিমধুর স্বর ভেসে আসছে।
রাস্তায় একটা গাড়ি এ*ক্সি*ডে*ন্টে দুজন লোক আ*হ*ত হন। সেই মুহূর্তে উনাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরি ছিল। আহতদের মধ্যে একজন ছিলেন জনাব আজাদ। ধার্মিক লোক তিনি। শরীরে লম্বা আলখেল্লা, মাথায় পাগড়ি, মুখভর্তি দাড়ি। একটা পা ভেঙেছে উনার। শরীরের আরো কিছু জায়গায় ব্যথা পেয়েছেন। হাসপাতাল থেকে জনাব আজাদকে নিয়ে উনারই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে তাসিন। বাড়ির উঠানে একটা কাকপক্ষীও নেই। একজন মহিলার স্বরও শোনা যাচ্ছে না। সবকিছু নিস্তব্ধ। তাসিন অবাক হলো না। ধার্মিক পরিবারের মানুষজনের জীবনযাপন নিয়ে কিঞ্চিৎ হলেও ধারণা আছে তার। জনাব আজাদ তাকে ছোটো একটা ঘর দেখিয়ে বললেন,“আমাকে এই ঘরে নিয়ে যাও।”
তাসিন সেটাই করলো। ছোটো একটা ছেলে তাদের দেখেই ছুটে বড়ো দালানটির ভেতর চলে গেল। তার মুখে বুলি উড়ছে,“দাদু এসেছে, দাদু এসেছে।”
তাসিন উঠতে নিলেই জনাব আজাদ বললেন,“বসুন বাবা। একটু পর যাবেন।”
তাসিন বসলো৷ কিছুক্ষণ পর সেই বাচ্চা ছেলের হাতে একটা নাস্তার ট্রে ধরিয়ে দেওয়া হলো। ছোটো ছোটো হাতে ধীর পায়ে ট্রে এনে রাখলো তাসিনের সামনে৷ জনাব আজাদ ইশারা করে বললেন,“নাস্তা করুন।”
তাসিন বিব্রত হয়ে বলল,“এসব..
জনাব আজাদ মৃদু হেসে বললেন,“সামান্য কিছু জিনিস। নিলে আমি খুশি হবো।”
তাসিন উপায়ন্তর না দেখে এক টুকরো ফল তুলে নিলো। জনাব আজাদের পরিবারকে তাসিন নিজ থেকেই কল দিয়ে জানিয়েছে দুর্ঘ*ট*নার খবর। জনাব আজাদ ছেলেকে ফোন করে জানাতে বলেছিলেন। ছেলে এই মুহূর্তে অনেক দূরে আছে। তবুও সে বাবার কথা শুনে ছুটছে কাজ ফেলে। সাথে বাড়িতে ফোন করে মা-বোন, স্ত্রীকে জানিয়ে দিল। তাসিনকে খুব অনুরোধ করে বলল,“আমার বাবাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিলে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। দয়া করে আমার অনুরোধটা রাখুন!”
তাসিন ফোন রেখে জনাব আজাদকে নিয়ে উনার বাড়ি চলে আসলো। এক টুকরো ফল খাওয়ার পরই কোথা থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এলো এক নারী। পুরো শরীর কালো বোরকায় মোড়ানো। পেছন দিক থেকেই এক পলক দেখেছে সে। মুখ দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। সাথে সাথেই দৃষ্টি নত করে ফেলেছিল। নারীটি এসেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
কথাগুলো ভেবে এখনো সেই নারীর জন্য ছটফট অনুভব করছে তাসিন।
বাড়ি ফিরে না খেয়েই একটা ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করলো। ঘুম হলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবনা অনুযায়ী বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল সে।
তাসিন চলে যেতেই মেহমান খানায় একে একে স্ত্রী, কন্যারা এসে ভীড় জমালো। সকলের চোখে পানি। প্রিয়জনের ব্যথায় ব্যথিত তাঁরা। জনাব আজাদ সান্ত্বনা দিলেন মেয়েদের।
“এর চেয়ে বড়ো কিছু ঘটতে পারতো। আমার মৃ*ত্যুও হতে পারতো। আল্লাহ যে আমাকে সহিসালামতে বাড়ি পৌঁছানোর তাওফিক দিয়েছেন, তাতে তোমাদের শুকরিয়া আদায় করা উচিত।”
সকলকে খানিকটা শান্ত দেখা গেল। জনাব আজাদের চোখ কাউকে খুঁজে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে না দেখতে পেয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,“আমার আম্মু কোথায়?”
স্ত্রী নরম স্বরে বললেন,“কান্নাকাটি করছে।”
“ডেকে দাও।”
হুরাইনকে ডেকে আনা হলো। ভয়ে ভয়ে পা ফেলছে সে। বাবাকে সে ভয় পায় না। অত্যাধিক ভালোবাসে। তার ভয়ের একমাত্র কারণ বাবার অসম্মান। কোন কিছু খেয়াল না করেই একজন পুরুষের সামনে বাবার কাছে ছুটে এসেছে। জনাব আজাদ মেয়ের ভীত সন্ত্রস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে কাছে ডাকলেন। কেঁদে ফেললো হুরাইন।
“আমাকে ক্ষমা করুন আব্বু। আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল।”
মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বাবা বললেন,“শান্ত হন আম্মু। এরপর থেকে সাবধানে চলবেন। এখন কান্না বন্ধ করুন।”
হুরাইন হেঁচকি তুলে কাঁদছে। জনাব আজাদ বড় মেয়ে জান্নাতকে ইশারা করলেন হুরাইনকে ভেতরে নিয়ে যেতে।
ছেলে হোসাইন গাড়ি থেকে নেমেই বাবার কাছে ছুটে এলো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বাবার হাত-পা চেক করছে৷ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বললেন,“আমি আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি। চিন্তা করবেন না।”
জনাব আজাদ ছেলে-মেয়েদের আপনি সম্বোধন করেন। অথচ এই আপনি সম্বোধনেও রয়েছে অপার স্নেহ, মমতা। হোসাইন কাতর চোখে তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে। আস্তে ধরে মেহমান খানা থেকে ভেতরের দালানে নিয়ে গেল বাবাকে। সেই দালানে বাইরের পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ। তাদের জন্য মেহমান খানায় বসা এবং শোয়ার ব্যবস্থা করা আছে।
খাবার খেয়ে উঠে গেল হুরাইন। আজ দেরিতে খাওয়া হয়েছে তার। আসরের সালাত আদায় করে জানালার ধারে বসলো। বাড়ির বাইরে থেকে লক্ষ করলে ভেতরের এই দালানটা দেখা যায় না। একটু ভেতরের দিকেই স্থাপন করা হয়েছে। তাই কোন পুরুষের দৃষ্টিতে পড়ার ভয় নেই। তবুও হুরাইনের অন্তরে ভীতি। কীভাবে সে এত বড়ো একটা ভুল করে বসলো। সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে আরো একবার ভয়ে শিউরে উঠলো সে। লোকটি তার স্বর শুনে ফেলেছে। চেহারাও হয়তো দেখে ফেলেছে!
ঘুম ভাঙলো তাসিনের। বেশ লম্বা ঘুম। সে নিত্যদিনের মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার মস্তিষ্কে আর সেই নারী এলো না।
পরদিন সকালে খাবার টেবিলে বাবা-মা আবারো তার বিয়ের কথা তুললেন। আশ্চর্য জনক ভাবে তাসিনের সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। কানে সুরেলা ঠেকলো সেই চিকন স্বর। মেয়েটি কি বিবাহিত? নিজের ভাবনা দেখে নিজেই বিস্মিত হয় তাসিন। সে তো সব ভুলেই বসেছিল। এমন তো সে ছিল না। একজন নারীর সামান্য স্বর যে তাকে এভাবে যন্ত্রণায় ফেলবে সে এটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। এসব কিছু মনের ভণ্ডামি ভেবে নিজেকে শক্ত করতে চাইলো। বাবা-মাকে অনুমতি দিয়ে দিল তার জন্য মেয়ে দেখতে। যদি একটুখানি স্বস্তি মিলে! বাবা-মা উভয়ই খুশি হলেন। প্রথমদিকে তাঁরা নিজেরাই চাননি ছেলে দ্রুত বিয়ে করুক। আগে ছেলের একটা শক্ত অবস্থান চেয়েছেন। এখন সেই অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে তাসিন। এবার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিতে পারলেই যেন দায়িত্ব কিছুটা কমে যাবে। তাসিনের মা বোনের মেয়েকে ছেলের জন্য পছন্দ করে রেখেছেন। আজই বোনের সাথে কথা বলবেন।
তাসিন বাবা-মাকে অনুমতি তো দিয়ে দিল। কিন্তু কিছুতেই মনে শান্তি পাচ্ছে না। তাই আধখাওয়া অবস্থায় উঠে পড়লো।
#চলবে……