এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১২

0
517

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১২)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে কিন্তু দুজন মানুষের মনে খুশি নেই। একজন আবরার আর একজন নাজিয়া, কথাতে আছে না যার বিয়ে তার হুঁশ নেই পাড়া-পড়শির ঘুম নাই এই দশা আবরারের। ওর বিয়ে অথচ ওর কোনো হেলদোল নেই, আর থাকবেই বা কিভাবে! ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে ভাবতেই সবকিছু কিরকম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ করেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।আগামীকাল বিয়ে তারজন্য আজকে শপিং করতে যেতে হবে আবির সবাইকে তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি করার জন্য।

– “এই তোরা আসবি? দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”

আবরার রেডি হয়ে সোফাতে বসে পড়ল, মন-মেজাজ ভালো নেই তার উপর আবার শপিং করতে যেতে হবে ভাবতেই নিজের মাথা ফাঁটিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে । শপিং এ যাবার পেছনে আবরারের একটা প্ল্যান তো অবশ্যই আছে, আর সেটা হলো নাজিয়ার সাথে একা কথা বলা। মেয়েটা তো ওকে দেখলেই পালাই পালাই করে, আর এখনো করে চলেছে। ওর যে অন্য কারোর সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেইদিকে নাজিয়ার কোনো খেয়ালই নেয়, সে নিজের মতো ব্যস্ত। আবরার শেষবারের মতো নাজিয়ার সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করেছে, নাজিয়া রাজি থাকলে ওহ আর কিছুই শুনবে না সোজা বিয়ে করে নেবে কিন্তু নাজিয়াই যে রাজি না।

সবাই মিলে শপিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সবাই বলতে আবির আবরার, নাজিয়া আর শ্রেয়া। নাজিয়া আস্তে চাইছিল না প্রানকে ছেড়ে আবির একপ্রকার জোর করেই নিয়ে যাচ্ছে। প্রান ওর দাদুর কাছে আছে।

আবির -আবরার সামনে বসেছে আর নাজিয়া শ্রেয়া পেছনে বসেছে, দুজনের মধ্যে টুকটাক কথা চলছে। বিয়ের জন্য কি দিলে ভালো হবে সেইসব আলোচনা চলছে। শ্রেয়ার আগ্রহ দেখে আবরার মনে মনে ওর গুষ্টির উদ্ধার করে ছাড়ছে..

– “মেয়ের ফূর্তি দেখ যেন ভালোবাসার মানুষটির সাথে বিয়ে হচ্ছে। এর নাকি বয়ফ্রেন্ড আছে, তারপরেও আমাকে বিয়ে করার জন্য এত লাফালাফি করছে কেন!!”

শপিং মলে প্রথমেই শাড়ি কিনতে এসেছে, প্রথমে বিয়ের শাড়ি নেওয়া হবে তারপর বাকি সবকিছু। শ্রেয়া একের পর এক শাড়ি ঘেঁটে চলেছে কিন্তু ওর পছন্দ হচ্ছে না, বিরক্ত হয়ে আবরার কে বলল,

– “এই আবরার একটা শাড়ি পছন্দ করে দাও না।”

আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগে আবিরের চোখ পাকানো দেখে কিছু না বলে চুপচাপ শাড়ি পছন্দ করে দিলো। মেরুন কালারের কাতান বেনারসি চয়েস করে শ্রেয়ার হাতে দিল।

– “ওয়াও কি সুন্দর শাড়ি, তোমার পছন্দ আছে বলতে হবে।”
– “হু।”

শ্রেয়া শাড়িটা প্যাক করে দিয়ে নাজিয়াকে বলল একটা শাড়ি চয়েস করে দিতে। আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,

– “আবার শাড়ি কি হবে?”
– “কেন বৌভাত আছে তো।”

এই মূহুর্তে আবরারের মুখ দিয়ে ভালো কিছু কথা বের হয়ে আসতে চাইছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ সহ্য করে যেতে লাগল। নাজিয়া রয়েল ব্লু কালারের একটা শাড়ি চয়েস করে দিল, এই শাড়িটাও বেশ সুন্দর।

– “হয়েছে!” (আবরার)
– “আরে কি হয়েছে হয়েছে করছ! এই তো শুরু এখনো অনেকগুলো শাড়ি কিনতে হবে, ততক্ষনে তোমরা অন্য কিছু কেনাকাটা করো যাও।”

শ্রেয়ার কথাতে আবরার বিরবির করে বলল,
– “মেয়ে মানুষ মানেই প্যাচাল। কেন যে আসতে গেলাম!”

আবরার কথাটা আসতে বললেও আবিরের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ওহ হেসে দিয়ে আবরারের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
– “ভাই এই তো সবে শুরু, বিয়েটা হতে দে বুঝবি তারপর মেয়ে মানুষ কতটা প্যাচালে।”

আবরার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
– “দাদা আমি বিয়ে করব না, প্লিজ!”

আবির আর কিছু না বলে হলে গিয়ে দাঁড়াল, এই ছেলেকে পাত্তা দিলে চলবে না। শ্রেয়া শাড়ি পছন্দ করেই চলেছে, মেয়েটা শপিং করতে খুব ভালবাসে আর আবির বলেছে ওর যত ইচ্ছা তত শপিং করতে এতে তো ওর সোনায় সোহাগা ইচ্ছামতো কেনাকাটা করেই চলেছে। যদিও একার জন্য নয় নাজিয়া ও আবিরের মায়ের জন্যও করেছে।

নাজিয়াও শাড়ি নাড়াচাড়া করছে একটা সাদা শাড়ি ভালো লেগেছে, কিন্তু নেবে কিনা বুঝতে পারছেনা। বিষয়টা আবিরের খেয়ালে আসে, নাজিয়ার মাথাতে টোকা দিয়ে বলল..
– “কি রে পেত্মী!! তোকে কি আলাদা করে বলতে হবে নিজের পছন্দমতো কেনাকাটা করার জন্য? শাড়িটা যদি পছন্দ হয়ে যায় নিয়ে নে।”

নাজিয়া মৃদু হাসল। আবিরের সাথে সম্পর্কটা সেই আগের মতোই আছে। ছোট থেকে নাজিয়ার আফসোস ছিল একটা বড়ো দাদার, আবিরের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে নাজিয়া সেই আফসোসটা করার সুযোগ পাইনি। ওর ছোট বড়ো সকল আবদার বড়ো দাদার মতো মিটিয়েছে আবির, ঠিক যেমন এখন করল।

আবরার বেচারা বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছে মেয়েদের শপিং চলতেছে তো চলতেছে। ওহ নাজিয়ার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজে চলেছে, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। কি করবে সেটাই ভাবছিল তখনি নাজিয়া বলল,

– “আবির’দা আমি প্রানের জন্য কয়েকটা জামা নিতাম।”
– “যা নে কে বারন করেছে?”
– “তাহলে আমি ওইদিকে আছি।”

নাজিয়া কিছুটা হেঁটে যেতেই একটা হাত ওকে টেনে নিয়ে আড়ালে চলে যায়। নাজিয়া প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে বুঝল মানুষটা অন্য কেউ নয় আবরার।

– “এইসবের মানে কি? আপনি আমাকে এইভাবে নিয়ে আসলেন কেন?”
– “নাজু প্লিজ আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো। প্লিজ একবার স্বীকার করো আমাকে ভালোবাসো, আমি সবকিছু ঠিক করে নেব।”

নাজিয়া তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,

– “কি ঠিক করবেন? আগামীকাল আপনার অন্য একজনের সাথে বিয়ে আর আপনি এখন আমাকে বলেছেন সব ঠিক করে নেবেন!”

আবরার আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– “প্লিজ ট্রাস্ট মি আমি সবকিছু ঠিক করে নেব, এখনো সময় আছে। প্লিজ তুমি একবার বলো আমাকে ভালোবাসো।”

নাজিয়ার চোখ ছলছল করছে, এতদিন নিজের মনের কথাগুলো চাপা দিয়ে রাখলেও আবরারের বিয়ের কথা শুনে সেইগুলো ছাই চাঁপা আগুনের মতো জ্বলে উঠছে। এতদিন দূরত্ব থাকলেও, অনুভূতির প্রকাশ না করলেও দুজন দুজনের জন্য ছিল কিন্তু কালকের পর থেকে আবরার অন্য কারোর স্বামী হয়ে যাবে। তখন নাজিয়ার কি হবে!

আবরার নাজিয়ার হাতটা স্পর্শ করতেই ওহ হাতটাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমার হাত ধরার অধিকার আপনার নেই মিষ্টার আবরার আহমেদ। আগামীকাল থেকে আপনি অন্য কারোর হয়ে যাবেন তাই তাকে নিয়ে ভাবাটাই আপনার জন্য ভালো‌ হবে।”
– “কিন্তু আমি যে তোমাকে নিয়ে ভাবতে চাই! তোমাকে ভালোবেসে আগলে রাখতে চাই, প্লিজ একটিবার সেই অধিকারটা আমাকে দাও।”

নাজিয়ার বুক ফেঁটে কান্না আসছে, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

– “সেইটা সম্ভব নয়।”

আবরারের প্রচন্ড রাগ হলো, মেয়েটাকে মানিয়ে নেবার তো কম চেষ্টা করল না কিন্তু মেয়েটা এতটা জেদি কেন! আবরার নাজিয়ার দুই কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
– “এই তোমার এত জেদ কেন? কেন বারবার আমার ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দাও! কেন আমাকে এতটা অবহেলা করো, উত্তর দাও।”

নাজিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
– “কারন আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

আবরারের তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
– “আচ্ছা ভালোবাসো না! এই কথাটা একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তো, বলো!”

নাজিয়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উশখুশ করতে লাগল, কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।

– “আমাকে ছাড়ুন আমার‌ লাগছে।”
– “আমারও প্রচন্ড লাগছে, (নাজিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল.. কিন্তু আফসোস তুমি সেইটা বুঝেও না বোঝার ভান করলে। আমাকে ভালোবাসো না তাই না! তাহলে তোমার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে কেন?”

নাজিয়া নিজের চোখের পানিটা মুছে নিয়ে বলল,
– “আপনার ধরাতে ব্যথা পেয়েছি তাই।”
– “মিথ্যা ভালোই বলতে পারো! তুমি যখন আমাকে চাও না তাহলে তাই হোক, আমি কাল শ্রেয়াকেই বিয়ে করব। কিন্তু তুমি সেটা নিজের চোখের সামনে সহ্য করতে পারবে তো?”

নাজিয়া উত্তর না দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, আবরার ব্যথিত হয়ে মৃদু হেসে চলে যায়। নাজিয়া আবরারের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বলল,
– “তোমার আমার মাঝের ‘এক আকাশ দূরত্ব’টা আজ সত্যি সত্যি আকাশ ছুঁলো। আর কখনো এই দূরত্ব মিটবে না, ভালো থেকো আবরার।”

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে