#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩০
বাইরে দাঁড়িয়ে ইমাদ কড়িকে কয়েকবার কল করল। কড়ি প্রতিবারই কল কেটে দিয়েছে। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে কড়ির ঘরের পেছনের জানালায় ইমাদ ধাক্কা দিলো। জানালা ভেতর থেকে বন্ধ না থাকায় চট করে খুলে গেল। কড়ি উপুড় হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়েছিল। ভড়কে উঠল সে, “আপনি? এখানে?”
ইমাদ বলল, “স্যরি আমি বুঝিনি জানালা খোলাই ছিল। কড়া নাড়তে ধাক্কা দিতেই খুলে গেছে।”
“আপনি এখানে কি করছেন?” কড়ি কঠিন করে বলল।
“কথা বলতে এসেছি। অনেকবার কল করেছিলাম। কেটে দিয়েছেন।”
“যেহেতু কল কেটে দিয়েছি আপনার বোঝা উচিত যে আমি কথা বলতে চাইছি না।”
“আচ্ছা।”
কড়ি এগিয়ে এসে জানালা বন্ধ করে দিলো। পরে রাতে খাওয়ার সময় ইমাদকে কেউ খুঁজে পেল না। সবাই হয়রান হয়ে গেল। নিলয় অনেকবার কল করার পরও ইমাদ কল ধরল না। দীপা কল করতেই রিসিভ করল সে। দীপার কল কেটে দিলে ও কেঁদেকেটে মরে যাবে। তাই বলল, “তোরা খেয়ে নে।”
দীপাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো। কড়ি খাওয়া দাওয়া শেষে ঘরের দরজা আটকে জানালা খুলে দেখল ইমাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি হতাশ হয়ে বলল, “কি যে করি আপনাকে নিয়ে! শুনেননি আমার বিয়ের তারিখ ঠিক করছেন, বাবা?”
ইমাদ বলল, “শুনেছি।”
“তাহলে?”
“এজন্যই এখানে।”
“আপনি শার্টের বোতাম লাগান। এভাবে কথা বলতে অড লাগছে।”
ইমাদ শার্টের বোতাম লাগিয়ে বলল, “স্যরি।”
কড়ি তাড়া দিয়ে বলল, “তারপর?”
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
“কথাটা আমার বাবাকে গিয়ে বলুন।”
“আপনার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে উনি কি করেন?”
“পুলিশ অফিসার।”
“ভয় দেখাচ্ছেন?”
কড়ি মাথায় হাত রেখে বলল, “আরে না সত্যি।”
ইমাদ বিড়বিড় করে বলল, “একবার চোর, আরেকবার সোজা পুলিশ! আমার মতন সাধারণ মানুষদের কি চোখে পড়ে না?”
কড়ি সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কি বললেন?”
“কিছু না।”
“আমি শুনেছি।”
“আচ্ছা।”
কড়ি কিছু বলল না আর। ইমাদ প্রশ্ন করল, “আপনার বাবার কাছে আপনার রেফারেন্স দিতে পারি?”
“রেফারেন্স বলতে?”
“রেফারেন্স বলতে এরকমটা যে আপনিও আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক এই ধরনের কিছু আঙ্কেলকে বলা গেলে তিনি আমাকে সুযোগ দিলেও দিতে পারেন।”
কড়ি সাফ সাফ মানা করে বলল, “কখনো না।”
“আমার এখন যে অবস্থা যেকোনো গার্ডিয়ান লাভ ম্যারেজ হলে মেনে নিবে কিন্তু অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে মানবে না। পড়াশুনায় ভালো, কর্মঠ বেকারকে মেয়ে পছন্দ করে ফেললে এক কথা। অন্যথায় আঙ্কেল কেন কেউ’ই মানবেন না। আমার পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি। চাকুরী নেই। কেন মানবেন তিনি?”
“বুঝতে যেহেতু পারছেন তাহলে আর এখানে আমার কাছে কি?”
“আপনার রেফারেন্স চাই। আমার হয়ে একটু সুপারিশ করুন।”
“মজা পেলাম। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি চাকুরী চাইতে যাচ্ছেন।”
“আপনার কাছে হয়তো বিষয়টা মজার হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা কোনো মজার বিষয় না।”
ইমাদের এমন বেহাল দশা দেখে কড়ির মায়া হলো। ছেলেটা নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে খুব অসহায়বোধ করছে। কিন্তু ওর ত আসলে কিছু করার নেই।
ইমাদ’ই আবার বলল, “নাহয় ক’টা বছর অপেক্ষা করুন আমার জন্যে। আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আঙ্কেলের কাছে আমি আর আমার পরিবার যাব। আঙ্কেল ফিরিয়ে দিলে আপনাকে আর কখনো বিরক্তও করব না। কিন্তু এইটুকু সুযোগ অন্তত আমাকে দিন।”
কড়ি বলল, “আপনি আমার পছন্দেরও না আবার অপছন্দেরও না। তাই আমার রেফারেন্সটুকু আপনি পাবেন না। এমনকি আমি যদি আপনাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুকও হতাম তবুও বাবাকে বলতাম না, আর না আপনাকে বলতে দিতাম। আমি এমন একটা মেয়ে যে এই অধিকারটুকু নিজের অপরাধে হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমার পরিবারই আমার প্রথম এবং একমাত্র প্রায়োরিটি। তবুও অবস্থা কেমন আমি দেখছি কথা বলে। এখনো আমি জানি না বাবা পাকা কথা দিয়ে তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন কিনা। যদি করে থাকেন তাহলে আমার হাতে করার মত আর কিছুই থাকবে না।”
“আচ্ছা।”
ইমাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কড়ি বাবার ঘরে গিয়ে বাবাকে পেল না। দেখল সবাই ড্রয়িংরুমে আলোচনায় বসেছে। কড়ি ইতঃস্তত করে বলল, “আসব?”
কাইয়ূম হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকল। কাইয়ূমের পাশে বসতেই কাইয়ূম এক হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কিছু বলবি?”
“না।”
“কিছু বলার থাকলে বল।”
“কি কথা হচ্ছিল?”
“ঐ তোর বিয়ের তারিখ নিয়ে। রিমার কাছে শুনেছি তোর কোনো আপত্তি নেই। ওরাও আকদ করিয়ে ফেলতে চাইছে। ওটা নিয়েই আলোচনা করছিলাম।”
“আমার একটু ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। তারিখ মিলে গেলে বোধহয় যেতে পারব না, তাইনা?” কড়ি ঘুরিয়ে প্রশ্নটা করল।
কাদের সাহেব কাশতে কাশতে বললেন, “কয় তারিখ যেতে চাইছিস?”
তার মানে তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। কড়ি বাবার দিকে তাকিয়ে কি বলা যায় দ্রুত ভাবতে লাগল।
কাইয়ূম বলে উঠল, “হ্যাঁ, তারিখ তো এখনও ফিক্সড হয় নি। কয় তারিখ ঢাকা যাবি ওটা বল। ঐ তারিখ আর আশেপাশের দুই তিনদিন বাদ দেওয়ার কথা মাথায় রেখে তারিখ বসাব।
কাদিন অসহিষ্ণু গলায় বলল, “আমি যাই।”
কাদের সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “কি হয়েছে তোর?”
“আমার কথা তো কেউ কানেই তুলছে না। আমার মনে হয়না আমার কোনো প্রয়োজন এখানে আছে।”
রিমা ধমক দিয়ে বলল, “কোথাও যেতে হবে না। বস এখানে।”
কাদিন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসল। বলল, “বাড়িতে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান সবে হলো। এখনি আবার আকদ কিসের? কি দরকার অত তাড়াহুড়ো করার?”
কাইয়ূম বলল, “শুভ কাজে দেরি করতে নেই। উভয়পক্ষই যেহেতু রাজি এখানে দেরি করবার কি আছে?”
“হুট করে কিছু করতে নেই। আমাদের উচিত আরো খোঁজ খবর নেয়া।”
“খোঁজ খবর নিয়েছি। নিয়েই তো এগুচ্ছি।”
“আমার কেন যেন মন টানছে না।”
“কেন কি সমস্যা?” কাদের সাহেব প্রশ্ন করলেন।
“ছেলে পুলিশ। এইসব পেশার মানুষদের রিস্ক বেশি। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখন কি হয়!”
কায়েস বলল, “রিস্ক ভাই সবকিছুতেই। এই যে তুমি বাইকে করে অফিস করতে যাও। আল্লাহ না করুক তোমারও বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। তো এটা ভেবে কি মেজো ভাবির পরিবার তোমাকে তাদের মেয়ে দেয়নি?”
“এই ছেলের মাঝে আরো সমস্যা আছে। ছেলেকে ভালো করে দেখেছিস তুই? শু পরতে হয় বেল্টের সাথে ম্যাচ করে। এটাও জানে না। এই ছেলে শু পড়েছে প্যান্টের সাথে ম্যাচ করে। পারফিউমের ঘ্রাণটাও কড়া ছিল। কেমন যেন সস্তা পারফিউম! ড্রেসিং সেন্স ভালো না। এমন ছেলের সাথে কড়ির বিয়ে আমি দিব না।”
দীপা ফ্যালফ্যাল করে কাদিনের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটার মাথায় সমস্যা আছে নাকি? দীপা পাশে বসা রিমার কানে ফিসফিস করে বলল, “আপু, আপনার ভাই ছোটবেলায় কোথাও পড়েটরে গিয়ে মাথায় কোনো আঘাত পেয়েছিল?”
রিমা বলল, “এইটুকু দেখেই এ কথা বলছ তাহলে ওর বেলায় ও মেয়ে দেখে এসে কি কি বলত শুনলে কি বলবে? আমাদের ভাগ্য ভালো শেষ পর্যন্ত তোমাকে পেয়েছি। ভাগ্যিস তোমার উপর ওর কুনজর পড়েনি! কি জাদু করেছিলে ওকে বলো তো!” রিমা দুষ্টু হাসি হেসে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো দীপাকে। দীপার আচমকা এত লজ্জা লাগল! কায়েস দু’হাত একসাথে জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “নিজের বেলায় যে অত্যাচার করেছ! তবুও তোমার হয়নি না? আবার শুরু হয়েছে তোমার এই অত্যাচার! ক্ষ্যামা দাও না, আমাদের। আর কত জ্বালাবে?”
কাদিন দমল না। উল্টো বলল, “তোর বোধহয় বিয়ে করতে বেশি মন চাইছে। এজন্যই কড়ির বিয়ের এত তাড়া তোর! এত মন চাইলে তোর বিয়ে তুই সেড়ে ফেল। আমাদের কোনো সমস্যা নেই।”
কায়েস থতমত খেয়ে একদম চুপ হয়ে গেল। বেচারা লজ্জায় শেষ!
কাদিন কাদের সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, এত তাড়া কিসের আমাদের? একটাই তো বোন, তাইনা? আমরা আরো ভাবি, আরো দেখি। একটা কেন দশটা বিয়ে দেখে এরপর বেস্টটা দিব।”
কাইয়ূম বাগড়া দিয়ে বলল, “তোর পছন্দ হওয়ার আশায় বসে থাকলে দশটা কেন দশ হাজারটা দেখার পরও কড়ির আর বিয়ে হবে না। তুই তোর উস্তাদি কলম চালাতেই থাকবি আর একেকটা বিয়ে ভাঙতেই থাকবি। তুই যেসব কারণ দর্শালি একটাও ধরার মতন না।”
কাদিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কাদের সাহেব ডাকলেন, “কাদিন?”
কাদিন বিনম্র গলায় বলল, “জি, বাবা।”
“রিস্ক এর কথাটা বলে তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ। এখনি বুক ধড়ফড় করছে। আমি এখানে আর মেয়ে দিতে পারব না। আর দিলেও দুশ্চিন্তায় আমি টিকতে পারব না। কাজটা ঠিক করোনি।” উঠে গেলেন তিনি। কড়িও উঠল। সে বুঝে গেছে এই বিয়ে ভাগ্যক্রমে বাতিল হয়ে গেছে। অবাক লাগছে তার!
কাইয়ূম দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আহারে! কত ভালো সম্বন্ধটা ছুটে গেল !”
রিমারও মন খারাপ। কড়ির বিয়েতে কোন শাড়িটা পরবে এটাও সে ঠিক করে ফেলেছিল! কায়েস বেচারা যে লজ্জা পেয়েছে এরপর চুপচাপ ঘর ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ওর নেই। দীপা আর কাদিনও নিজেদের ঘরে চলে এল। বিয়েটা শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় কাদিনের ভালো লাগছে। এই সম্বন্ধটা ওর মনমত হয়নি। দীপা আচমকা বলল, “আমাকে কেন বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন?”
কাদিন দীপার দিকে ঘুরে তাকাল, “জেনে কি করবে?”
দীপা বলল, “আমার ত দোষের শেষ নেই তাই আরকি।”
কাদিন বিছানা ঝাঁট দিতে দিতে ঠেশ দিয়ে বলল, “লুচ্চা উপাধী পেতে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।”
দীপা এতক্ষণে কাদিনের রেগে থাকার কারণটা ধরতে পারল। এতক্ষণ আসলে বুঝতে পারছিল না ঠিক কোন কারণটায় কাদিন ওর উপর এত ক্ষেপে আছে। দীপা মিনমিন করে নীচু গলায় বলল, “স্যরি।”
কাদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি চুমু খেতে বলেছিলে। এরপরই আমি এগিয়েছিলাম। কোন হিসেবে আমাকে লুচ্চা বললে তুমি?”
দীপা কি বলবে? কাদিন তো ঠিকই বলেছে। দীপা তাই চুপ করে রইল। কাদিন বলল, “কেন বলেছ?”
দীপা কঠিন জেরার মুখে পড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “স্যরি বললাম তো! এরপরেও এমন শক্ত শক্ত কথা কেন বলছেন?”
কাদিন বলল, “যাও বললাম না আর।”
শুয়ে পড়ল ও। দীপাও ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। কাদিনের ধমকাধমকিতে মন খারাপ নিয়েই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল ও। ঘুমের ঘোরে সবসময়ের মতই পাশ উল্টে কাদিনের উপর হাত পা তুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কাদিনকে। কাদিন বিরক্ত হয়ে সরিয়ে দিলো দীপাকে।
চলবে…
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩১
শিল্পী বলল, “তোর বান্ধবীদের আসতে বলেছিস তো?”
মিলা চুলের কাটা খুলে, চুলে দুই ঝুঁটি করতে করতে বলল, “হু।”
শিল্পী বলল, “নীল স্কার্টটা পর না। এটা কেন?”
মিলা মায়ের দিকে তাকিয়ে জোর করে হেসে বলল, “ঠিক আছে।”
শিল্পী যেতেই দরজা আটকে মিলা পোশাক বদলে নীল স্কার্ট পরল। সুহাকে কল করল সে, “আসছিস তো?”
সুহা বলল, “না।”
“কেন?”
“তোর জন্মদিন যদি কেউ কোনোদিন পালন করে তবে সেদিন যাব।”
“আহ এমন করিস না তো।”
“আমি গেলে কিছু একটা উল্টাপাল্টা বলে ফেলব, দেখিস।”
“আয় না।”
“না।” সুহা খট করে মোবাইল রেখে দিলো।
.
মুবিন আজ এত খুশি যে ওর অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও মায়ের পছন্দের ডেনিম শার্ট এবং নীল জিন্স পরল। শিল্পী খুশি হয়ে মুবিনকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখল। মুবিন খানিক লজ্জা পেল। শেষটায় ধৈর্য্যহারা হয়ে বলল, “আর কতক্ষণ মা? ছাড়ো না।”
“না, ছাড়ব না। তোর বুকে অনেক শান্তি বাপ! কি লম্বা হয়ে গেছিস! মাশাআল্লাহ্।”
মঈন ঘরে ঢুকে মা ছেলেকে একসাথে দেখে নিজেও এগিয়ে গেল, “দেখি আমার চেয়ে লম্বা কিনা তোমার ছেলে?”
মুবিন উৎসাহে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাবার কাঁধের সাথে কাঁধ মেলাল, “এই তো আর একটু।”
“একটু না অনেকটুকু। এখন কানের দুল খোল।” মঈন হাত বাড়িয়ে দিলো।
মুবিন বিনাবাক্যে কান থেকে দুল খুলে বাবার হাতে দিলো। আজ বাবাকে খুব ভালো লাগছে। বাবা- মা সবসময় এমন থাকতে পারেন না? একঅপরের সাথে যুদ্ধ কেন করেন? এই সুখী বাবা, মায়ের সাথে একটা ছবি তুলে ফেললে কেমন হয়? ছবিটায় ওরা হাসতে থাকবে। বাবা মুখ মেঘকালো করে রাখবেন না, মায়ের চোখ দীঘির মত কান্না টলমলে হবে না। আর মিলা? মিলা কোথায়? মুবিন বলল, “একটু দাঁড়াও, একটা ছবি তুলব আমরা। মিলাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
মুবিন দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মেহমানরা ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে। মিলা ড্রয়িংরুমে হাসি মুখে সবাইকে অভ্যর্থনা জান্নাচ্ছে। সে হাসি উদারতার হাসি। হাসিতে কষ্ট মিশে আছে, তবে হিংসে নেই। বেদনা আছে, জ্বলন নেই। মুবিন পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “একটা ছবি তুলব। আয় তো।”
মিলা বলল, “পরে।”
“না, এখনি।”
মুবিন ঘরে গিয়ে ছবি তুলবার উদ্দেশ্যে মা – বাবার মাঝে দাঁড়িয়ে মিলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মিলা বেশ সময় নিয়েই এল। ঘরের ভেতরে আসার পরিবর্তে ও ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মোবাইল হাতে ওদের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, “বাবা, তোমার টাইটা বাঁকা হয়ে আছে।”
মঈন মুবিনের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে টাই ঠিক করে দাঁড়াল। মিলা একটা ক্লিক নিয়ে নিলো। মুবিন অবাক হয়ে বলল, “তুই সহ, স্টুপিড।”
“না আমার ছবি তুলতে ইচ্ছে করে না।”
“শুধু পড়াশুনা করে বড় বড় মার্কস নিয়ে এলেই স্মার্ট হওয়া যায় না।” মুবিন রাগে শুধু এটুকুই বলতে পারল!
মিলা হাসল, “আমি অত স্মার্ট নারে।”
মুবিন বলল, “মিথ্যে কেন বলছিস? নিজের ফ্রেন্ডের সাথে ত সারাদিন’ই সেলফি তুলিস। আমার সাথে ছবি তুলবি না এটা বল।”
মিলা দেখল মুবিন রাগ করে ফেলছে। আসলে স্টুপিড ও নয়, স্টুপিড মুবিন। ওকে সাথে নিয়ে ছবি তুলবার প্রয়োজনটা কি? মা-বাবাকে তাদের ছেলের সাথেই মানায়। ওকে ক্যামেরাম্যানের চরিত্রে দেখতে তাঁদের খুব একটা খারাপ নিশ্চয়ই লাগবে না। বরং মুবিনকে মাঝে দাঁড় করিয়ে শুধু তিনজনের আকাঙ্ক্ষিত একটি ছবি খুব সহজেই তাঁরা পেয়ে যাবে। মিলা নিজের মুখকে সংবরণ করল। নাহয় সে খুব সহজেই বলতে পারত যে, “আমি সহ তুলতে গেলে যে সমস্যা হয়ে যাবে, আমার অতি প্রিয় বোকা ভাই। তোকে ছবিতে কে পাশে পাবে তা নিয়ে যে তর্কাতর্কি, রক্তারক্তি কোনো কান্ড ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কি তুই দিতে পারবি? আমি চাই না তোর জন্মদিন ভেস্তে যাক।”
মুবিন অপেক্ষা করতে করতে স্বভাবসুলভ ধৈর্য্যহারা হয়ে উঠল এবং রেগে গিয়ে বলল, “যাহ তুই, তোর ছবি তুলতে হবে না।”
মিলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “উফ, মুবিন আমার মেকআপ এখনও বাকি, তাই তুলতে চাইছিলাম না।”
মুবিন সরে এসে মিলাকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে ঠেলে দিয়ে বলল, “চুপচাপ দাঁড়া এখানে। গর্দভ একটা!”
মিলা একটুও রাগ করল না। বরং প্রশস্ত হাসি হেসে মা – বাবার মাঝে দাঁড়িয়ে তাঁদের চারজনের জীবনের একসাথের শেষ এবং চিরস্মরণীয় ছবিটি তুলল। ছবিটি তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় ছবির দলে যোগ দিলো, কিংবা যুক্ত হলো অন্যতম কুৎসিত এক ফ্রেমেবন্দি স্মৃতি হয়ে। কারণ এর কিছুক্ষণ পর’ই এক ফরাসী নারী বিনা আমন্ত্রণে মুবিনের অভূতপূর্ব সেই জন্মদিনে অতিথি হয়ে এল। তাঁর পরিচয় সে মুবিন এবং মিলার বাবা মঈনের প্রেয়সী। সে মঈনের অসুস্থতার খবর পেয়ে সুদূর ফ্রান্স থেকে ছুটে এসেছে তাকে শুধু এক নজর দেখবার জন্য। তাঁর নাম মিশেল, মিশেল উড।
.
মিশেলকে স্বচক্ষে দেখে শিল্পী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। মেহমানের ভয়ে মঈনকে ছেড়েও কথা বলেনি, “এই সেই রূপসী, মঈন? আমার ধারণা তাহলে ভুল ছিল না।”
মঈন শিল্পীর হাত ধরে তাকে হলঘর থেকে নিজেদের শোবার ঘরে টেনে নিয়ে যেতে চাইল। শিল্পী হাত ছাড়িয়ে বলল, “খবরদার ছুঁবে না আমায়। এখন এত লজ্জা কিসের? জানুক লোকে!”
মঈন বলল, “আই ক্যান এক্সপ্লেন!”
“না, তুমি পারো না।”
“ঠিক আছে ঘরে চলো।”
শিল্পী যেতে চাইল না। মঈন জোর করে টেনে নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল ওদের ঘরের, কিন্তু দাম্পত্যকলহের কোলাহল ছড়িয়ে পড়ল হলঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায়, প্রতিটি নিমন্ত্রিত লোকের কোল্ডড্রিঙ্কসের গ্লাসে গ্লাসে, কেকের টুকরো বহনকারী নকশাকৃত পিরিচে পিরিচে। শিল্পী আর মঈনের চেঁচামেচি, ফুলদানির ভাঙন, মিশেলের উপস্থিতি ইত্যাদি চারিদিকে গুঞ্জন আর রঙতামাশা দেখা এমন কিছু চাহনির সৃষ্টি করল, যেসব চাহনি দেখে মুবিন দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে। সে একা থাকতে চায়। মিলা মেহমানদের কাছে দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমা চাইল। মুবিনের জন্য নিয়ে আসা উপহারসামগ্রী রেখে মেহমানরা চলে যেতেই মিশেল মিলাকে একা পেয়ে ইংরোজীতে বলল, “তোমার নাম মিলা?”
মিলা দাঁতে দাঁত ঘঁষে শুদ্ধ বাংলায় বলল, “আর তুমি নিশ্চয়ই কোনো ডাইনী।”
জানালা দিয়ে সব মেহমানদের চলে যেতে দেখে মুবিন নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এল। সে বলল, “এই মহিলাকে বলে কি হবে? বলতে হলে তোর মা – বাবাকে বল।
মিশেল আবারো ইংরজীতে প্রশ্ন করল, “কি বলছ তুমি?”
মিলা এইবার ইংরেজীতে বলল, “নাথিং এন্ড প্লিজ লিভ আস এলোউন।”
মিলা নিজের ঘরে চলে গেল। মুবিন মিলার পেছন পেছন গিয়ে বলল, “দেখলি তোর মা – বাবার কাণ্ডটা? পরে কথা বলা যেত না? সবার সামনেই বলতে হবে? মার এভাবে সবার সামনে রিএক্ট করা ঠিক হয়নি। সবাই কি বলছিল? আমি কাল থেকে আর স্কুলেই যাব না। ক্লাসে গোসিপ করার নতুন খোরাক পেয়য়ে গেল ওরা।”
মিলা বলল, “যাস না। তুই স্কুলে গিয়ে করিসটাই’বা কি? পড়াশুনা ত আর করিস না।”
“তুই আমার সাথে এমন করে কেন কথা বলছিস?”
মিলা বলল, “তুই এখন এখান থেকে যা।”
মুবিনও চটে গেল, “না গেলে কি করবি? আমি যাব কেন?”
“মেহমানদের মাঝে থেকে যেভাবে পালিয়ে গিয়েছিলি এখন এমন গলাবাজি করতে লজ্জা করে না!”
মুবিন বড্ড অপমানিত বোধ করল। সে উপর নীচ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ওহ এখন বুঝেছি। তোর তো আনন্দ হচ্ছে। মা – বাবা আমার জন্মদিন পালন করেছে সে হিংসেই তুই জ্বলে যাচ্ছিলি। এখন সব ভেস্তে গেছে তাই খুব খুশি তাইনা?”
মিলা অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল, “আমি জীবনেও তোর মত আর একটা স্বার্থপর ছেলে দেখিনি। মা – বাবার সংসার ভেঙে যাচ্ছে, বাড়িতে এক অপরিচিতা মহিলা আর তুই পড়েছিস কে কি বলল তা নিয়ে!”
“আমি স্বার্থপর? আমি?” মুবিন চেঁচিয়ে উঠল।
মিলা স্বাভাবিক গলাতেই বলল, “হ্যাঁ তুই স্বার্থপর। সবসময় নিজের কথাই ভাবিস। না ভাবিস মা – বাবার কথা আর না ভাবিস আমার কথা! প্রতিবার মা – বাবা যখন শুধু তোর জন্মদিন পালন করেন আর আমার বেলায় ওদের তারিখটা পর্যন্ত স্মরণ থাকে না তখন তুই তা দেখেও না দেখার ভাণ করে থাকিস। মা যখন আমার ঘরের পাখা নষ্ট হয়ে গেলে নতুন পাখাটা কিনে তোর ঘরে লাগায় আর তোর পুরোনো পাখাটা আমার ঘরে নিয়ে আসে তখনও তুই চুপ। আর আমায় এসে বলিস আমি হিংসুটে! আমি যদি হিংসুটে হয়ে থাকি তবে তুইও স্বার্থপর।”
চকিতে মিলাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলো মুবিন। মিলা উঠে বসল, দাঁড়াল না, মেঝেতেই বসে রইল। রাগান্বিত মুবিনের চোখ লাল, জল টলমলে। পকেটে হাত রেখে ও মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমাকে এত হিংসা করিস, রোদমিলা? এত?”
মিলা চুপ করে রইল। মুবিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে…