#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৬
দীপা তড়িঘড়ি করে এড্রেসটা মেসেজ করল। এরপর আবার কলও করল, “পেয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“শুনো রিকশা ভাড়া ৩০ টাকার বেশি একদম দিবে না।”
“আচ্ছা।”
“কত দিয়ে ঠিক করলে?”
কড়ি হেসে দিলো, “পঁয়ত্রিশ”
“ইশশিরে হায় হায় করলেটা কী! আমি বাসার গেইটে এসে দাঁড়াচ্ছি। রিকশাওয়ালাকে আজকে ধুলাই দিয়ে সারব। লোক ঠকানো! ওরা না এমনি করে। সবসময়। একবার আমার সাথেও এমন হয়েছে। সেবার আমি…..”
দীপা কথা বলতে বলতে বাসার গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কড়ি এসে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত মোবাইলে অনর্গল কথা বলেই গেল। কড়ি চুপ করে শুনছিল শুধু। আর ভাবছিল যে ছেলেটা তাকে ডিচ করেছে তার সঙ্গেও নিশ্চয়ই সে এভাবেই বকবক করতো। এই এতদিনে ছেলেটার কানের কাছে তার শব্দদূষণ নেই। এত কথা বলা একটা মানুষকে হুট করে জীবন থেকে বাদ দিয়ে ফেলল। শূণ্যতা কিংবা কোনো হাহাকার কী ছেলেটার মাঝে একবারের জন্যও কাজ করে না? করে না বোধহয়। বরং মাছির ভনভন থেকে মুক্তি পাবার আনন্দে সুখময় দিন পার করবার সম্ভাবনাই বেশি। যাঁরা ছেড়ে যেতে ভালোবাসে তাঁদের শুধু বাহানা প্রয়োজন। আর কিছু নয়।
গলির মুখে রিকশাটা প্রবেশ করতেই দীপা হাত উঁচু করে ডাকল, “হেই!!!! এদিকে।”
কড়ির চমক ভাঙল। কল ডিসকানেক্ট করে রিকশাচালককে বলল, “ভাই ঐ দিকে। লাল গেটটার সামনে।”
ভাড়া মেটানোর সময় দীপা আচ্ছা মতন রিকশাচালককে বেশি ভাড়া নেওয়ায় ধরল। কড়ি হাসতে হাসতে টেনে নিয়ে এল তাকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দীপা বলল, “উফ, নিয়ে এলে কেন?”
কড়ি শুধু হাসল। দীপা কড়িকে সোজা নিজের ঘরে নিয়ে গেল। কড়ি ও ঘরে গিয়ে প্রথমেই যেটা বলল, “কেমন আছ?”
“হুম ভালোই। আমার কথা তোমার এখনও মনে আছে!”
“এক গোয়ালের গরু বলে কথা!”
কড়ি আর দীপা আবার হেসে ফেলল। কড়ি বলল, “তাহমিদের কথা মনে পড়ে তোমার?”
“পড়ে। তোমার বফ কী যেন নামটা? ভুলে গেলাম।”
“রামিম।”
“হ্যাঁ, রামিমের কথা কী একটুও মনে পড়ে না তোমার?”
“কে বলল পড়ে না?”
“যখন মনে পড়ে তখন কী করো?”
“তুমি কী করো?”
“যখন মনে পড়ে তখনই নিজেকে অসহ্য লাগে।” দীপার গলার স্বর ভারি হয়ে এল।
“ওর দেওয়া জিনিসপত্র সব পুড়িয়ে ফেলো, দীপা। আমিও পুড়ে ফেলেছি। ওসব দেখলেই বেশি বেশি মনে পড়ে।”
“আমি পারব না। সেগুলো আমাদের শেষ স্মৃতি।”
কড়ি ভ্রু কুঁচকে অবাক চোখে দীপার দিকে তাকাল। হতভম্ব গলায় বলল, “যে হারিয়ে যায় তার স্মৃতি রাখতে হয়। আর যে ছেড়ে যায় তাকে নিজের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে হয়, মিস দীপা।”
দীপার চোখে জল চলে এলো। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আমার কথা বাদ দাও। রামিমকে পেলে? কেন চলে গেল জানতে পারলে?”
“হুম। ওর বাসায় গিয়েছিলাম।”
“ওকে পেয়েছ?”
“না। ওর মায়ের সাথে দেখা হয়েছে।”
দীপা হকচকিয়ে গেল, “তিনি তোমাকে চিনতেন?”
কড়ি বড় করে নিশ্বাস ওরফে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো। বিকেলের নরম হাওয়া চোখে মুখে মিশে গেল। হাওয়ার তালে উড়ল তার টকটকে লাল ওড়না। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “তিনি আমায় চিনবেন কী করে? রামিম ত কখনো তাঁর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়নি। সবসময় আমাকে ওর পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তাছাড়া, ওর বাড়ি দিনাজপুর।”
“তাহলে তুমি কী করে খুঁজে পেলে ওদের? ঠিকানা জানতে?”
কড়ি চুপ হয়ে গেল। রামিমকে খুঁজে বের করতে সে আবার ঢাকা গিয়েছিল। রামিমের মেসে গিয়ে রামিমকে পেল না সে। রামিম কোথায় আছে, রামিমের বাড়ি কোথায় মেসের কেউ বলতে পারল না। তাই সে ক্যাম্পাসে ছুটে গেল। ক্যাম্পাসে গিয়ে সবার আগে আশরাফ ভাইকে খুঁজল। আশরাফের মাধ্যমেই রামিমের সাথে তার পরিচয়। আশরাফ ভাই তার কোর্সমেট ছিল। তখনি ওদের পরিচয়টা হয়। আশরাফ ভাইকে সে ডিপার্টমেন্টে খুঁজে না পেলেও তার এক বন্ধুকে পেল। সেই মারফতে খবর পেল আশরাফ আজ ভার্সিটিতে আসেনি। আশরাফের ঠিকানা নিয়ে কড়ি সেখানে গেল। আশরাফ তার বন্ধুদের সাথে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। দরজা খুলে কড়িকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। ভরকে যাওয়া গলায় বলল, “তুমি? তুমি এখানে?”
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
“এই তো ভালো।”
“আপনি এভাবে ঘামছেন কেন?”
“না, আমার শরীরটা তেমন ভালো না আজ। তাই ক্লাসেও যেতে পারিনি।”
“শরীর কী বেশি খারাপ? একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম।”
আশরাফ হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছে বলল, “না বলো।”
“ভেতরে এসে কথা বলি।”
আশরাফ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। কড়ি চট করে ভেতরে ঢুকে এ ঘর ও ঘর যেতে লাগল। তার ধারণা রামিম এখানেই আছে। আশরাফ অধীর হয়ে পড়ল। বলল, “করছ কী? করছ কী?”
কড়ি জবাব দিলো না। সে অনেকটা ছুটে ছুটেই পাঁচ রুমের এই ফ্ল্যাটটা ঘুরে রামিমকে খুঁজল। বাথরুম আর বারান্দাও বাদ রাখল না। রান্নাঘরেও দেখে ফেলল, কিন্তু রামিম নেই। কড়ি হতাশ হয়ে বিছানায় বসল। বলল, “রামিম কোথায়?”
আশরাফ রূঢ় কণ্ঠে বলল, “ও কোথায় আমি কী করে জানব?”
“ওর বাড়ি দিনাজপুর না?”
“হ্যাঁ।”
“বাসার ঠিকানাটা আমার একটু লাগবে।”
“আমি ওর বাসার ঠিকানা কী করে জানব?”
“আপনি তো ওকে দিনাজপুর থেকেই চিনেন। আপনিও সেখানকার। বেস্টফ্রেন্ড এর বাসার ঠিকানাও জানেন না?”
“না, জানি না। সে নিজের পরিবার থেকে সবাইকেই দূরে রাখে। তুমি তা খুব ভালো করেই জানো।”
কড়ি দু’হাতে মুখ ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আশরাফ কড়িকে বিদায় করতে বলল, “আমি এখন বেরুবো।”
কড়ি মুখ থেকে হাত সরিয়ে আশরাফের দিকে তাকাল। তার চোখের দৃষ্টি শীতল আর স্থির। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আশরাফ তাড়া দিয়ে উঠল, “কিছু মনে না করলে এখন তুমি আসতে পারো।”
কড়ি উঠতে যাবে তখনি কলিংবেল বেজে উঠল। আশরাফ দরজা খুলতে চলে গেল। দরজা খুলে দেখলো মুনিরা এসেছে। মুনিরার হাতে স্টিলের বড় টিফিন ক্যারিয়ার। আশরাফ অবাক, “আজ হঠাৎ এখানে?”
মুনিরা আশরাফের কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপতে মাপতে বলল, “তোমার জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছি। জ্বর হলে এমনি মানুষ কিছু খেতে পারে না। তার উপর তোমাদের বুয়ার রান্নার যে প্রশংসা শুনেছি তোমার মুখ থেকে!”
মুনিরা আশরাফকে হাত দিয়ে ঠেলে দরজা থেকে সরাল। ভেতরে ঢুকল সে। এই বাসায় ড্রয়িংরুম, ডাইনিংরুম বলতে কিছু নেই। সবকটা ঘরকেই ছেলেরা শোবার ঘর বানিয়ে রেখেছে। কড়ি আশরাফের ঘরে বসেছিল। সে মুনিরার কথা আগে শুনেছে তবে পরিচয় নেই। ফেসবুকে আশরাফ আর মুনিরার ছবিও দেখেছে। কড়ি চট করে গায়ের ওড়নাটা খুলে ফেলল। ওড়না পাশে রেখে চুলের খোঁপা খুলল। চুল সামনে এনে নিজেকে আবৃত করে ঝিম মেরে বসে রইল। মুনিরা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে এ ঘরে এসে হতভম্ব হয়ে গেল। আশরাফ দরজা বন্ধ করে মুনিরার পেছনে এসে দাঁড়াতেই খেয়াল করল টিফিন ক্যারিয়ার মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কড়ি আর মুনিরা দুজন দুজনার মুখোমুখি। দুজনেই নির্বাক, স্তব্ধ। মুনিরার চোখ বিস্ফারিত, চাহনী জুড়ে রাজ্যের অবিশ্বাস। আশরাফ একবার মুনিরার দিকে তাকাল, একবার কড়ির দিকে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখনি মুনিরার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করল। আশরাফ তড়িঘড়ি করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করল, “আরে আরে তুমি ভুল বুঝছ, মুনিরা। ও কড়ি। আমার বন্ধু রামিমের….”
বাকিটুকু আর বলে শেষ করতে পারল না সে। তার আগেই মুনিরা সপাটে চড় বসাল তার গালে। কড়ি বিছানায় রাখা ওড়নাটা নিয়ে গায়ে চরাল। এই দৃশ্য দেখে আশরাফের চোখ কপালে উঠে গেল। সে গালে হাত চেপে রেখে কড়িকে প্রশ্ন করল, “তুমি কী পাগল, কড়ি?”
কড়ি বলল, “মেয়েদের কত সুন্দর করে তোমরা ধোঁকা দাও, আশরাফ।”
“আশ্চর্য! এভাবে কথা বলছ কেন? আমি তোমার সিনিয়র।”
“ওহ্ ক্লাস বাঙ্ক করে জুনিয়রদের বাসায় নিয়ে এসে ফস্টিনস্টি করার অপর নাম জ্বর, অসুস্থতা তাই না? এত অসুস্থ তুমি আর তোমার মানসিকতা!” মুনীরার সারা শরীর কাঁপছে। চোখে – মুখে আগুনের লেলিহান।
চলবে…
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৭
আশরাফ মুনিরাকে শান্ত করতে ওর কাঁধে হাত রাখল, “দয়া করে, আমার কথা শুনো।”
মুনিরা ত্বরিত আশরাফের হাত সরিয়ে দিল, “ছুঁবে না আমায়।”
আশরাফ ছটফট করে উঠল, “ভুল বুঝছ আমায়। ও মিথ্যে বলছে।”
“ও ত কিছু বলেনি। যা দেখার আমার চোখ দেখেছে। যা বুঝার আমি বুঝেছি।”
আশরাফ মুনিরার দিকে এগিয়ে গেল। মুনিরা আশরাফের বুকে দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গেল। আশরাফ কড়ির দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো, “আমি তোমাকে ছাড়ব না, কড়ি। আই ওন্ট স্পেয়ার ইউ।” “আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” কড়ির ঠোঁটের কোণায় স্মিত হাসি।
আশরাফ দাঁতে দাঁত পিষল। আঙুল তুলে বলল, “তোমাকে আমি পড়ে দেখ নিব।”
তারপর মুনিরার পিছন পিছন ছুটে বেরিয়ে গেল। মুনিরাকে যে কোনো মূল্যে বুঝাতে হবে এসব মিথ্যা, বানোয়াট। কিছুই সত্য নয়। প্রাণটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামল সে। মুনিরা একদম শেষ সিঁড়িটায় বসেছিল। ওর পা চলছে না। পাগুলো সর্বশক্তি হারিয়ে এখানেই পড়ে রয়েছে। শরীরটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থাতেও সে আর নেই। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। চোখের কোলে জলের অভাব না থাকলেও বুকের ভেতর ফেটে চৌচির। আশরাফ গিয়ে মুনিরার সামনে হাঁটু ভেঙে বসল। দু’হাতে মুনিরার মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখল, “বিশ্বাস করো মুনিরা, দয়া করে বিশ্বাস করো। প্লিজ বিশ্বাস করো। দোহাই লাগে বিশ্বাস করো।”
আশরাফের জ্বরমাখা উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় মুনিরা যেন আরো পুড়ে গেল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ওর হাত সরিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। কাঁচি গেইটটার দিকে এগিয়ে গিয়েই পড়ে গেল। আশরাফ উঠাতে সাহায্য করতে চাওয়ায় বলল, “প্লিজ দূরে থাকো।”
আশরাফ সর্বশক্তি দিয়ে গেইটটায় একটা লাথি বসাল। এরপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল আবার। বাসায় গিয়ে কড়িকে বলল, “এই মেয়ে শুনো রামিম কোথায় আমি জানি না। তবে ওর বাড়ির ঠিকানা আমি তোমায় দিতে পারি।”
“আমাকে রামিমের কাছে নিয়ে চলো, আশরাফ।”
আশরাফ গলা ফাঁটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “ডোন্ট কল মি আশরাফ। সে আশরাফ ভাইয়া।”
“পৃথিবীতে আপনিই বোধহয় একমাত্র ছেলে যে কিনা কেঁদেকেটে ভাইয়া শুনতে চাইছেন।” কড়ি হেসে ফেলল।
“এক থাপ্পরে সব হাসি বের করে দিব বেয়াদব মেয়ে।”
“ভদ্রভাবে কথা বলুন।” কড়ি সতর্ক করে দিলো।
আশরাফ হাত মুঠো করে আত্মসংবরণ করল। তারপর অনুনয়ের গলায় বলল, “কড়ি, লিসেন টু মি। তুমি আমায় মেরে ফেললেও আমি ওর খবর দিতে পারব না। কারণ আমি সত্যি বলছি সে কোথায় জানি না।”
কড়ি আশরাফের দিকে কেমন করে যেন তাকাল। বিশ্বাস হলো কথাটা। তাই বলল, “এড্রেস লিখে দিন।”
“তুমি আগে মুনিরাকে সব সত্য বলো।”
“আগে ঠিকানা তারপর বাকিসব।”
“পরে যদি তুমি ওকে সত্য না বলো?”
“কথা দিলাম বলব।”
আশরাফ মোবাইল বের করে ঠিকানাটা মেসেজ করল কড়িকে। কড়ি মেসেজটা চেক করে বলল, “যদি ঠিকানা ভুল হয় তবে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না, আশরাফ ভাইয়া।”
“ভুল না।”
“মুনিরা আপু কোথায়?”
“নীচে।”
কড়ি দ্রুত নীচে নামল। কড়ির পেছন পেছন আশরাফও নামল। মুনিরা নীচে নেই। আশরাফ গেইট থেকে বেরুলো। মুনিরা রিকশায় উঠে গেছে। আশরাফ লাফ দিয়ে রিকশায় মুনিরার পাশে উঠে বসে মুনিরা হাত চেপে ধরল। মুনিরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই কড়ি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “স্যরি আপু। আমি আসলে আশরাফ ভাইয়ার বন্ধু রামিমের এক্স। রামিমের সাথে বাসা থেকে পালিয়েছিলাম। রামিম আমার গয়নাগাটি নিয়ে আমাকে ফেলে চলে গিয়েছে। ওকে খুঁজছি আমি। আশরাফ ভাইয়ের কাছ থেকে ওর ঠিকানা আদায় করতে বাধ্য হয়ে এসব করেছি। আপনি আশরাফ ভাইয়াকে ভুল বুঝবেন না। উনি সত্যি বলছেন। আপনার জন্যে উনি সমগ্র ছেলে জাতির বিপক্ষে গিয়ে ভাইয়া ডাক শুনবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আপনাদের একসাথে ভালো দেখায়। সবসময় একসাথে থাকুন। তবে চোখে চোখে রাখবেন। সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। রামিমের মতন অসভ্যদের সাথে মিশতে দিবেন না।”
একটানা কথাগুলো বলে কড়ি ঘুরে হাঁটা শুরু করল। রোদ বাড়ছে। চোখে, মুখে রোদ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বলে কড়ি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সানগ্লাসটা বের করে চোখে দিলো। মুনিরা হা করে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সে থ বনে গেছে।
দীপা তাড়া দিলো, “এরপর? এরপর?”
“এরপর আর কী?”
কড়ি জানালার ধার থেকে সরে এলো। দীপা উদগ্রীব হয়ে বলল, “আরে এরপর রামিমের বাড়ি যাওয়ার পর কী হলো?”
“সে এক বিশাল কাহিনী। পড়ে একদিন বলবনে তোমায়। এখন ইচ্ছে করছে না।”
“উফ আমার এখনি শুনতে ইচ্ছে করছে।”
“পরে শুনো, সুন্দরী।”
“না, না এখনি।” দীপা ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল। তবুও শেষ পর্যন্ত সে কড়িকে কড়ির ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলাতে পারল না। কড়ি একসময় বলল, “আচ্ছা বলব তবে একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?” দীপা অস্থিরতার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। কোনো কথা অর্ধেক শুনে বাকিটা আর জানতে না পারলে ওর জীবনে অক্সিজেনের ঘাটতি ঘটে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
“তাহমিদ এর সাথে জড়িয়ে থাকা সবকিছু এখন এই মুহূর্তে আমার সামনে তোমার পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ওর ছবি থেকে শুরু করে সব।”
দীপা ধপ করে নিভে গেল। গাল ফুলিয়ে ফেলল চট করে। তবে জানবার ইচ্ছা আর দমিয়ে রাখতে পারল না। বলল, “আচ্ছা এসো পুড়িয়ে ফেলি।”
কড়ি দেখলো দীপা ড্রেসিংটেবিল এর লক খুলে একটা বড় কাঠের বাক্স বের করল। কড়ি বাক্সের মুখ খুলে দেখল বিভিন্ন ডিজাইনের কানের দুল, মালা, চুড়ি, ব্রেসলাইট দিয়ে বাক্স বোঝাই করা। দীপাকে প্রশ্ন করল, “এগুলো সব গিফ্টস?”
“হ্যাঁ, ও দিয়েছিল। আরো আছে।” বলেই আলমারির নীচের তাকে রাখা কম্বলের নীচ থেকে একটা আইস্ক্রিমের বক্স বের করল। কড়ি বলল, “এটায় কী?”
“ওর আর আমার ছবি। আমি ছবি তুলতে প্রচন্ড ভালোবাসি আর ওয়াশ করাতেও। আইস্ক্রিমের বক্সে রেখেছি যেন কেউ দেখতে না পায়।”
সে বক্স খুলে ছবিগুলো উল্টে মেঝেতে ফেলল। এরপর ম্যাচের বক্সে দেশলাইকাঠি ঘষে আগুন জ্বালল। কাঠিটা ছবিগুলোর উপর ফেললেও আগুন জ্বলছে তার বুকে। দীপা কাঁদছিল খুব। কড়ি স্বান্তনা দেবার ভঙ্গিতে দীপার পাশে দাঁড়িয়ে দীপার কাঁধ চেপে ধরল। আর তখনি তার চোখ আটকে গেল আগুন ধরে যাওয়া একটা ছবিতে। দীপাকে ছেড়ে দিলো সাথে সাথে। ঝুঁকে পড়ে ছবিটা হাতে তুলে নিলো। চোখ বড় বড় হয়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার দশা হলো প্রায়। ভ্রু কুঁচকে অবিশ্বাসের গলায় বলল, “এ কে?”
দীপা বলল, “যার জন্য মরতে বসেছিলাম সে।”
আগুনের আঁচে কড়ির হাত জ্বলছিল তবুও ছবিটা কিছুতেই ছাড়তে পারল না। শেষে যখন একদম আগুন আঙুলে পৌঁছে যাচ্ছিল তখন হাত ফসকে পড়ে গেল ছবিটা। কড়ি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
চলবে…