#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২৪
রিহির বিদায় হয়ে গেল। যাওয়ার আগে কী যে কান্নাকাটি মেয়েটা! নিহিলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আজ পূর্ণিমা। তালার মতো চাঁদের আলোটা তার মুখে এসে পড়ছে। দেখতে দেখতে বিয়ে শেষ। তার খারাপ লাগছে রিহির জন্য। বারেবারে মনে পড়ছে রিহিকে। এইতো এরকম নিহিলা একা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে রিহি চুপি চুপি এসে জড়িয়ে ধরবে নয়তো ভয় লাগাবে। যদি তাতে নিহিলা বিরক্ত হয় তবে হাসির হাসির কথা বলে হাসানোর চেষ্টা করতো। নিহিলার অনেক বেশি কান্না পাচ্ছে কিন্তু যেমনটা খারাপ লাগছে ততটা কেন জানি চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না। সে এগিয়ে দোলনাতে বসে মোবাইলটা হাতে নিল রিহিকে কল করার উদ্দেশ্যে কিন্তু কল দিতে গিয়েও মোবাইল রেখে দিল। এখন তো আর যখন তখন রিহিকে কল করা যাবে না। এখন সেও কোনো না কোনো পরিবারের বউ। নিহিলা মোবাইল থেকে রিহির ছবি দেখতে লাগলো। ছোটবেলা থেকে একসাথে থাকতে থাকতে তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছে মেয়েটা। সারাদিন রিহির জন্য নিজেকে শক্ত রাখলেও এখন আর পারছে না। মেয়েটাকে ছাড়া সে কীভাবে থাকবে!
নিহিলা বেশ কিছুক্ষন পরে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রিহির মতো আস্তে আস্তে ঘরটা আবারো খালি হয়ে যাবে। তখনের কথা ভাবতেই পারছে না নিহিলা। ঘর খালি হয়ে যাবে ভাবতেই খেয়াল হলো ফুপিরাও তো বিয়ের উদ্দেশেই এসেছিলেন। তারাও বোধহয় চলে যাবে। অরিন আহান এদের সাথে নিহিলা নিজেকে অনেক মিশিয়ে ফেলেছে। আর রাহান ভাই! সবাই আস্তে আস্তে চলে যাবে। নিহিলা ব্যালকনি থেকে রুমে চলে এলো। অন্তত অরিন আহানদের সাথে গল্প করলে মন খারাপের সময়টা কেটে যাবে। এতক্ষনে চোখ থেকে পানি পড়ার ফলে চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। সে বেসিন থেকে বেশ কিছুক্ষন পানির ঝাপ্টা দিয়ে মুখ মুছে নিল। এতে চোখগুলো আরো লাল আঁকার ধারণ করেছে।
নিহিলা উড়না ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। সিঁড়ির কাছে আসতেই সাফাতকে উঠতে দেখা গেল। এই প্রথমবারের মতো মুখোমুখি। নিহিলা নিজেকে শান্ত করে নেমে যেতে নিতেই সাফাত দাঁড়িয়ে পড়লো। সে সাফাতকে পেরিয়ে দুই ধাপ নেমে গেল,
“কেমন আছিস নিহু?”
“ভালোই আছি।”
“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবি না?”
নিহিলা ঘুরে দাঁড়ালো তবে সাফাতের দিকে তাকালো না। ঘুরে দাঁড়াতেই রুমের কর্নারে রাহানকে দেখা গেল। সে চোখ ঘুরিয়ে নিল।
“দেখছিই তো কষ্ট পাচ্ছেন। কেন পাচ্ছেন জানি না কিন্তু এভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী পাবেন! তাই বলবো, পরিবারের সাথে একসাথে থেকে নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিন।”
“আমাকে ক্ষমা করে দিস নিহু।”
নিহিলা হাসলো।
“ভেবেছেন? আমি আপনাকে অভিশাপ দিয়েছি? তা ভাবলে ভুল ভাববেন সাফাত ভাই। আমি তো অনেক আগেই এসব ভুলে নিজেকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছি। যদি নিজেকে গুছিয়ে তুলতে না পারতাম তবে হয়ত ক্ষমা করতাম না।”
সাফাত হুট্ করে এগিয়ে এসে নিহিলার হাত ধরে ফেলল। তাতেই নিহিলা ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করতেই সাফাত হাত ছেড়ে দিল।
“আপনার সাহস কীভাবে হয় আমার হাত ধরার? শান্তভাবে কথা বলছি তাই ভাবছেন সব ভুলে গেছি?”
“চল না আমরা আবারো নতুন করে সব শুরু করি। তোকে ছাড়া আমি ঠিক নেই।”
নিহিলা হেসে উঠলো। যেন এই মুহূর্তে অনেক হাসির কথা শুনেছে। সে সাফাতের হাত ঝাপটা মেরে দূরে সরিয়ে দিল।
“ভালোভাবে কথা বলছি তাই এমন কথা বলার সাহস পেয়েছেন। দ্বিতীয়বার এমন দুসাহস দেখবেন না। নইলে হিতে বিপরীত হবে। আমাকে চারবছর আগের নিহিলা ভাবলে ভুল ভাববেন। আপনাকে তো আমি মনেই করি না।” বলেই থেমে গেল নিহিলা।
মুহূর্তের মধ্যে কণ্ঠে বিষাদের চাপ রেখে মলিন স্বরে আবারো বলে উঠল,
“আমার চারটা বছর ফিরিয়ে দিতে পারবেন? পারবেন কী সেসময় আমার প্রতিটা বিষাদ রাতগুলো আমার স্মৃতি থেকে মুছে দিতে। এখন ভালো আছি সেটাই দেখতে পারছেন কিন্তু এই ভালো থাকার পেছনে আমার চারটা বছর তিলে তিলে কষ্ট পেতে হয়েছিল। তবুও নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি বিধায় ভালো আছি। তবে সেই তিক্ততা মিশ্রিত অতীতটা ভুলিনি। দ্বিতীয়বার এমন দুঃসাহস দেখালে ফল খারাপ হবে। আর দয়া করে এতো আদিক্ষেতা করে আমাকে ডাকবেন না। আমার নাম ধরে ডাকলেই খুশি হবো। ভালো আছি,ভালো থাকতে দিন।” বলেই নিহিলা নেমে গেল।
রাহান সাফাতের এমন হাত ধরা দেখে শান্তভাবেই আসতে নিতেই নিহিলার কথাগুলো শুনে পিছু ফিরে গেল। সে নিচে নিহিলার দিকে এক পলক তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল,’এই ভালো থাকাটাই যেন তোমার মধ্যে থাকে। ‘
————-
পরেরদিন নিহিলা সারাদিন রুমে ঘুমিয়েছিল। বিকালে রিহি আর ওর বর আসবে বিধায় সবাই মিলেমিশে কাজে লেগে পড়লো। অরিনও এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।
রাতে সবাই খেয়ে আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বসতেই আমান শেখও এগিয়ে এসে বসলেন। সাফাতও এগিয়ে এসে সামনের সোফাতে বসলো। মূলত তাকে সবাই রেখে দিয়েছে। সে আর যেতে পারেনি। ছেলের এমন অবস্থা পরিবারের কেই বা চাইবে তাই বাড়িতেই রেখে দিয়েছে। ছেলে একা একা থাকলে কষ্ট আরো বাড়বে বৈ কী কমবে না। নিহিলার এক মন বলছিলো সাফাতের থেকে দূরে থাকতে। আরেক মন বলছিলো সে কেন এসব থেকে বঞ্চিত করবে নিজেকে! আর এখন এসবে তার একটু মায়া হবে কিন্তু ঐ ব্যাপারটা আসবে না তা সে নিশ্চিত।
আমান শেখ বসতেই সবাই চুপ হয়ে গেল। তার পিছু পিছু রিনা আহমেদ এসেও দাঁড়ালেন। তিনি নিহিলার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। ফুপির সাথে চোখাচোখি হতেই নিহিলাও বিনিময়ে হাসলো। আমান শেখ নিহিলার দিকে তাকালেন,
“আমি যদি তোর সম্পর্ক সিদ্ধান্ত নিই তাহলে তুই কী কষ্ট পাবি?”
নিহিলা থমকালো। সে সবার দিকে তাকালো। হঠাৎ এই প্রশ্নটা করার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। তবুও নিজেকে শান্ত করে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল,
“ছোটবেলা থেকে আমার অভিবাবক তুমি। আমার সব সিদ্ধান্তই তোমার উপর। কষ্ট কেন পাবো বড়ো বাবা!
“যদি তোর বিয়ের কথাবার্তা বলি তবে তোর কী কোনো আপত্তি আছে?”
নিহিলা স্তব্ধ হলো। কিছুক্ষন থম মেরে থেকে আমান শেখের দিকে তাকালো। বড়ো বাবা হুট্ করে এমন কথা বলবে সেটা তার ভাবনাতে আসেনি।
“বল।”আমান শেখ নিহিলার দিকেই প্রশ্নের জবাবের আশায় তাকিয়ে আছেন।
নিহিলা শান্তদৃষ্টিতে আমান শেখের দিকে তাকালো,
“আমাকে বোঝা মনে করছো?”
নিহিলার কথায় আমান শেখ মলিন হাসলেন,
“দেখ মা,মেয়ে যখন হয়েছিস বিয়ে তো দিতেই হবে। যদি ভালো পাত্র পাই অবশ্যই এগোবো।”
নিহিলা সবার দিকে তাকালো। সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার মানে সবাই এটা জানতো! রাহান ভাই আশেপাশে নেই, বোধহয় রুমে। সে তাচ্ছিল্যা হাসলো। এখনো কেন মানুষটার কথা ভাবছে! পরিবারকে একবার কষ্ট দিয়ে ফেলেছে এইবার আর কোনো বিরুদ্ধে যাবে না। উপর তলায় নিহিলার চোখ যেতেই দেখলো রাহান দাঁড়িয়ে আছে। নিহিলা চোখ সরিয়ে নিয়ে বড়ো বাবার দিকে তাকালো।
“তোমরা আমার কাছের মানুষ। আমার ভালো চাইবে। তোমরা রাজি থাকলে আমিও রাজি।”
বলতেই নিহিলা আরেকবার তাকালো উপরে। রাহান ভাই রুমের ভেতরে চলে যাচ্ছে। নিহিলা মলিন শ্বাস ফেলল। সে দ্রুত বসা থেকে উঠে সিঁড়ি উঠতে নিতেই নিচের শরগোলের আওয়াজে থেমে গেল। বড়ো বাবা হাসছেন!
আমান শেখ রেহেনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি আনিয়ে বোনকে খাওয়াচ্ছেন।
“নেয়, আরেকটা নতুন সম্পর্কের জন্য মিষ্টিমুখ কর।”
নিহিলা থেমে গেল। মানে কী এসবের! অরিন দৌড়ে এগিয়ে এলো।
“রাহান ভাইয়ের সাথেই তো তোর বিয়ে।”অরিনের কথা শুনে নিহিলার দৃষ্টি এতক্ষন রাহান যেখানে ছিল সেখানে দিল। তার মানে এসবকিছুর মূল রাহান ভাই!
সাফাত খুশি হলো। যাক এইবার যদি নিহিলা একটু ভালো থাকে তবে তার নিজেরও অপরাধবোধ কম হবে।তবুও বুঁকের কোথাও জানি চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সাফাত নিজের উপরেই তাচ্ছিল্য হাসলো। সে তো এসবেরই প্রাপ্য। তার আরো শাস্তি দরকার।
নিহিলা নিজের রুমে যাওয়ার আগে রাহান ভাইয়ের রুমের সামনে গেল। দরজায় হাত দিয়ে ঠোকা দিতে নিতেই দরজা খুলে গেল। তার মানে দরজাটা এমনি আটকানো ছিল। নিহিলা লজ্জা পেলো, এভাবে অন্যের দরজা খুলে ফেলা। হোক না ভুলবশত কিন্তু এটাতো কেউ বিশ্বাস করবে না। নিহিলার ভয় হলো। এখন যদি মানুষটা নিচে গিয়ে বা আহান অরিনের যেকোনো একজনকে বলে যে,’নিহিলা বিয়ের কথা শুনে খুশিতে রাহানের রুমের দরজা খুলে ঢুকে পড়েছে!’ নিহিলা নিজেকে শান্ত করলো। পাগল না-কি সে! ভেতরের উৎফুল্লতার জন্য এসব উল্টোপাল্টা ভাবছে। মানুষটা জীবনেও এসব বলবে না। গম্ভীর স্বভাবের হয়ে এমন মজার কথা বলবে না। নিহিলা তাকালো। মানুষটা ব্যালকনির দরজার কাছে ঐদিকে মুখ করে আছে। তার মানে নিহিলাকে দেখেনি। নিহিলা আস্তে করে পিছু ফিরে নিতেই রাহানের কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেল,
“অন্যের রুমে অনুমতি ছাড়া দরজা খুলে ঢুকে যাওয়া এটা কোন ধরণের স্বভাব!”
নিহিলা তাকালো। মানুষটা দিব্যি পকেটে হাত দিয়ে ঐদিকে মুখ করে আছে কিন্তু ভেতরে কে ঢুকেছে সেটাও বা কীভাবে বুঝতে পেরেছে! নিহিলার লজ্জা লাগলো কিন্তু এখন লজ্জা পেলে চলবে না। ধরা যখন পড়েছে এখন আর লজ্জা করে লাভ নেই।
“আমি আসলে রুম লক কিনা দেখতে গিয়ে ভুলে দরজা খুলে গিয়েছে।”
“বিয়ে শুনে মনে পড়েছে?” রাহান ফিরে তাকাতেই নিহিলা চোখ বড়ো করে করে তাকালো। বলে কী এসব! আজকে চিনতে পারছে না সে এই মানুষটাকে। এতক্ষন একরকম এখন আরেকরকম।
“দেখুন, যেমন ভাবছেন তেমন না। আমি শুধু এসেছি..”
“ভালোবাসো আমাকে সেটা জানাতে? আই নো আমার স্বভাবটাকে প্রথমে সবাই অপছন্দ হলেও আস্তে আস্তে প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য।এটা আর বলা লাগবে না।”
নিহিলা তাকালো। নিজেকে কী মনে করে কী জানি! এই মানুষটাকে সে নিজের অজান্তে কীভাবে ভালোবেসে ফেলেছে!
“ভালো যখন বেসে ফেলেছো এখন আফসোস করে লাভ নেই।”
নিহিলা রেগে গেল। সে রাহানের দিকে আঙ্গুল তাক করে এগিয়ে যেতেই রাহান থামিয়ে দিল,
“উঁহু, একেবারে হালাল হলেই ছুঁয়ো। এখন হারামের পর্যায়ে। এতো উতলা হচ্ছ কেন মেয়ে?”
“মানে কী!”
রাহান নিহিলার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনা প্রশস্ত করলো।
“মানে এই যে! সব উল্টো কাজগুলো তুমি করছো। যেগুলো ছেলেদের করা উচিত সব তুমি করে ফেলছো। হবু বরের রুমে ঢুকে যাওয়া, ছুঁতে চেষ্টা করা। এগুলো তো ভালো না মেয়ে।”
নিহিলা আঙ্গুল তুলে আবারো কিছু বলতে নিতেই তার কান্না পেয়ে গেল। সে রেগে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিহিলা বেরিয়ে যেতেই রাহান হাসলো।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রিচেক দেওয়া হয়নি। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। রেসপন্স করার অনুরোধ রইল।)