#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২০
নিহিলা সব গোছাগাছ করে নিল। হোস্টেল রুমটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে। সে সবকিছু ঠিকঠাক করে বসা থেকে উঠে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। শেষবারের মতো জানালাটির বাইরে দৃষ্টি দিল। সে আলতো করে পর্দাগুলো ছুঁয়ে দিল। এরপরে মনকে শক্ত করে পর্দা টেনে দিয়ে ব্যাগ সব নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
এয়ারপোর্ট এ রিনা আহমেদরা আসবেন বিদায় দিতে। নিহিলা এয়ারপোর্ট এ নেমে আশেপাশে তাকাতেই অরিন এসে দাঁড়ালো। একে একে আহান আর রিনা আহমেদও এসে দাঁড়ালেন। নিহিলা একটু উঁকি দিল। তার ভাবনাতে এসেছে কোনো একটা ইমাজিন হোক যে রাহান ভাইও এসেছে কিন্তু অনেকক্ষন কথা বলে বুঝতে পারলো তিনি আসেনি। তিনি অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছেন। আজ ফিরবে। আচ্ছা? উনি যদি নিহিলা চলে গেছে জানে তাহলে কী খারাপ লাগবে? পরক্ষনেই নিহিলা নিজের বোকামির জন্য হাসলো। উনার কেন খারাপ লাগবে!
নিহিলা সবার সাথে বসে রইল। পাশেই অরিন আহান কথা বলছে। নিহিলা চারপাশে তাকালো। শেষবারের মতো জাপান দেখে নিচ্ছে। সে জানে হয়ত আর আসা হবে না। প্রথমবার এখানে পা রাখার স্মৃতিটা মনে পড়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর মুহূর্ত! নতুন জায়গা, তার স্বপ্নের জায়গা! আহান নিতে এসেছিলো, তারপর রাহান ভাইয়ের প্রথম দেখাতেই ধমক। নিহিলার চোখে একে একে সব ভেসে উঠছে। সময় কত দ্রুত ফুরোই! দেখতে দেখতে চারবছর সে কাটিয়ে দিয়েছে । আজ বাড়ি ফেরার পালা।
উপরের মনিটর থেকে শেষ বারের মতো আওয়াজ আসলো বোর্ডিং আওয়ার শেষ, যাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে স্পিকারে বলছে। নিহিলা অরিনকে জড়িয়ে নিল। আহানকে সহ বিদায় দিয়ে সে পা বাড়ালো রিনা আহমেদের কাছে।
“শুধু একটা বছর কাছে ছিলি, কিছুই তো করতে দিলি না। এই তিনবছর যখন ইচ্ছে দেখতে পারতাম, চলে আসতিস। কিন্তু এখন তো আর তাও পাবো না।”
“মায়ের মতো আগলে রেখেছ। যা করেছ অনেক বেশি করেছ ফুপি। কৃতজ্ঞতা রইল।”
রিনা আহমেদ এক গাদা আদেশ দিল। তার চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে। ভাবতেও অবাক লাগছে যে এই মেয়েটিকে সে হয়ত আর কাছে পাবে না।
নিহিলা চোখ মুছে পা বাড়ালো। রিনা আহমেদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “চিন্তা করো না ফুপি,তোমাকে আমি পরিবারের সাথে মিলাবোই।”
নিহিলা হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরে তাকালো। এই মানুষগুলো তার দ্বিতীয় পরিবার ছিল। অচেনা দেশের পরিবার। নিহিলা ঝাঁপসা দৃষ্টিতে তাদের হাত নাড়িয়ে বিদায় দিল।
নিহিলাকে যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় ততক্ষন তাকিয়ে রইল ওরা। অরিন আহানের মন খারাপ। রিনা আহমেদও চোখ মুছে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এইবার ফিরতে হবে। বাসায় শুধু শফিক আহমেদ আছেন। রাহান আজ বাইরে থেকে ফিরবে। ছেলেটাকে কিছু ভালোমন্দ খেতে দিতে হবে।
রিনা আহমেদ অরিন আহানকে ডাক দিতেই অরিন আহান না করলো।
“আরেকটু থাকি, নিহিলার ফ্লাইটের প্লেনটা অন্তত দেখি। শেষবারের মতো।”
রিনা আহমেদ দিরুক্তি করলো না। তিনিও দাঁড়িয়ে রইলেন।
নিহিলা সবকিছু শেষ করে প্লেনে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। ভাগ্য ভালো জানালার পাশেই সিট্ পড়েছে। অন্য সময় হলে খুশি লাগতো কিন্তু আজ লাগছে না। আজ যেন ভেতরে ভেতরে র’ক্ত’ক্ষরণ হচ্ছে। এতদিন একটা আশা ছিল কিন্তু আজ সেটাও আর নেই। একেবারের জন্য মিলিয়ে গেল। নিহিলার হুট্ করে কান্না চলে আসলো। কান্নার মাঝে হিচকি উঠতেই আশেপাশের মানুষগুলো তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো। নিহিলার লজ্জায় অস্বস্তি ঘিরে ধরতেই সে মাথা নিচু করে ফেলল। মানুষগুলো একবার দৃষ্টি দিয়েই তারপর ফিরিয়ে নিয়েছে। নিহিলা জানালার বাইরে দৃষ্টি দিল। ক্ষনে ক্ষনে হিচকি উঠছে। সে মুখ চেপে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। জীবন কী অদ্ভুত! চারবছর আগে যখন এই দেশে আসবে তখন কান্না এসেছিল সেই পরিবারের জন্য আর এখন কান্না এসেছে এই পরিবারের জন্য। অথচ চারবছর আগে এই মানুষগুলোর প্রতি কোনো মায়ায় ছিল না। না ছিল কারোর প্রতি টান। প্লেন ছেড়ে দিছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। যখনোই আকাশে উড়াল দিল তখনই কান্না আর আটকে রাখতে পারলো না। কান্নার সাথে সাথে বুক ছিঁড়ে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো। আজ থেকে সব আশা বেরিয়ে গেল। শেষ সব। দ্বিতীয়বারের মতো অনুভূতিটা এই দেশ ছাড়ার সাথে সাথেই বিসর্জন দিল।
কিন্তু নিহিলা যদি জানতো! মুদ্রার এই পিঠটা যদি দেখতো! তবে পরিস্থিতি অন্তত ভিন্ন হতো। মুখে হাসি রেখেই যেতে পারতো।
রাহান দ্রুত দৌড়ে এয়ারপোর্ট এ এগিয়ে এলো। রিনা আহমেদরা এগিয়ে সামনে আসতেই আহান ডাক দিল,
“মা, এটা রাহান ব্রো না?” আহানের কথা শুনে অরিন, আর রিনা আহমেদ দুজনেই তাকালো। হ্যাঁ, রাহান এগিয়ে আসছে।
রিনা আহমেদ একটু এগিয়ে যেতেই রাহান এসে দাঁড়ালো।
“কিরে বাবা!”
মায়ের কথা শুনে রাহান আশেপাশে তাকালো।
“শুনলাম, নিহিলা চলে যাবে আজ?”
“চলে গিয়েছে তো। এখনই বিদায় দিলাম।”
“ওহ।” রাহান পিছু ফিরে গেল।
“ব্রো দেখো। নিহিলার ফ্লাইটের প্লেন।” আহানের কথা শুনে রাহান উপরে তাকালো। মাথার উপর খোলা আকাশে প্লেনটি উঠে যাচ্ছে। রাহান আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ পর্যন্ত প্লেনটা চোখের আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে ততক্ষন তাকিয়ে রইল। আকাশে প্লেনটা ছোট আকার ধারণ করে মিলিয়ে যেতেই রাহানের চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়ত হাটু গেড়ে বসে পড়তো কিন্তু রাহান নিজেকে শক্ত করলো। তার বুঝতে বেশ দেরি হয়ে গেছে। সে কেন আগে এই অনুভূতিটার সাথে পরিচিত হয়নি! তাহলে হয়ত আজ পরিস্থিতি অন্যরকম হতো! এভাবেই হারিয়ে ফেলল!
অরিন,আহান দুজনেই ভাইয়ের দিকে তাকালো। তারা বেশ বুঝতে পারলো তাদের ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে কিন্তু দেখাচ্ছে না। তাদের খারাপ লাগলো। ওদের চোখ দেখে রিনা আহমেদ তাকালেন। তিনি এগিয়ে রাহানের কাঁধে হাত রাখতেই রাহানের ধ্যান ফিরে আসলো। সে পিছু ফিরলো।
“তো এভাবে দৌড়ে এলি? আর বাহির থেকে কখন ফিরলি?”
“এমনি নিতে এলাম।”
“আহান তো আছেই ড্রাইভিং করার জন্য। তুই এতো জার্নি করে আসতে গেলি কেন? সবেমাত্র বাইরে থেকে এলি। বাসায় বিশ্রাম নিতি।”
“নিতে এসেছি বলে দুঃখ পাচ্ছ যে?”
বলেই রাহান গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ড্রাইভিং সিটে বসতে নিতেই আহান ডাক দিল,
“ব্রো, তুমি অন্য সিটে বসো। ড্রাইভ আমি করবো।”
আহানের কথায় রাহান কিছু না বলে সরে গিয়ে ড্রাইভিং এর পাশের সিট্ টাতে বসলো।
রাহান জানালার বাইরে দৃষ্টি দিল। তার কিছুই হুট্ করে ভালো লাগছে না। বুঁকের ভেতর কোথাও যেন চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে। তার এমন কেন লাগছে! বাবার মুখ থেকে নিহিলা চলে যাচ্ছে শুনে সে কেন দৌড়ে এলো! কেন নিহিলাকে একটি ফলক দেখার জন্য এতো জার্নির পরেও আবার এখানে চলে আসলো! তার এমন বাজে অনুভূতি কেন হচ্ছে! তাহলে কী নিহিলা চলে গেছে তাই! কিন্তু তার সাথে নিহিলার কিসের সম্পর্ক! এমন তো না যে অনেক ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। তবে এই অনুভূতির নাম কী!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।